তোমাকেপর্ব 14.1
-অনিমা, তোমার ভাইয়ের ঠিকানা আর ফোন নাম্বারটা আমার লাগবে
অনিমা চমকে উঠলো I ও ভেবেছিল একবার দেশে গেলে আর মুনিরের সঙ্গে কোন যোগাযোগ রাখবে না I ধানমন্ডির যে বাড়িতে আগে ওরা থাকত সেখানে এখন আর কেউ থাকেনা I হাসান সাহেব মারা যাবার পর আবরার ওর বউ সহ মহাখালী ডিওএইচএস এর ফ্ল্যাটে গিয়ে উঠেছে I অনিমা ভেবেছিল দেশে কয়েকটা দিন কাটিয়ে আবার ফিরে আসবে I মুনির নিশ্চয়ই ওদের খুঁজে পাবেনা I কিন্তু এখন ঠিকানা ফোন নাম্বার চাইলে তো সমস্যা I
– তুমি কি শুনেছো আমি কি বলছি ?
– হ্যাঁ শুনেছি I ঠিকানা ফোন নাম্বার কেন লাগবে ?
– আমি অফিশিয়ালি ওকে জানাতে চাই I উনি তো এখন তোমার গার্জিয়ান তাই না ?
– তোমার কিছু জানাতে হবে না I আমি জানিয়ে দেবো
– সে তোমারটা তুমি জানাবে I কিন্তু আমাদের পক্ষ থেকে জানাতে হবে I আমার মা ওর সঙ্গে কথা বলবে
অনিমা একটু দ্বিধায় পড়ে গেল I মুনির এতদূর ভেবে ফেলেছে I যা মনে হচ্ছে ওরা অফিশিয়ালি প্রস্তাব পাঠাতে যাচ্ছে I এরকম করলে তো সমস্যা I এমনটা হলে তো ও কিছুতেই পালাতে পারবে না I
– এবার তুমি আমার কাছ থেকে পালাতে পারবে না অনিমা
অনিমা রীতিমতো কেঁপে উঠলো I এই লোকটা কি এখন মনের কথা ও টের পাচ্ছে নাকি ? অনিমা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল I তারপর মনে মনে বলল ভয় নেই আমি পালাবো না I নিজের কাছ থেকে পালাতে পালাতে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি I মুখে বলল
– ঠিক আছে টেক্সট করে দিচ্ছি
অনিমা ঠিকানা ফোন নাম্বার টেক্সট করে দিল I মুনির চেক করে দেখলো এসেছে কিনা I মুনির চলে যাচ্ছে না I দাড়িয়েই আছে I বেলা প্রায় সাড়ে বারোটা বাজে I অনিমা রান্না মাত্র শেষ করেছে I আজ ওর ছুটি I একটু বাইরে যেতে হবে বলে রাতের রান্না আগেই করে ফেলেছে I অনিমার হঠাৎ মনে হল মনিরকে খুব ক্লান্ত বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে I মনে হচ্ছে সারারাত ঘুমাই নি I হয়তো খায়ওনি কিছু I অনিমার একটু মায়া হল I বলল
– বস
মুনির চেয়ার টেনে বসে পরলো I অনিমা চিঁড়ের পোলাও করেছিল I একটা বাটিতে একটু বেড়ে চামচ দিয়ে এগিয়ে দিল I মুনির একটু অবাক হয়ে তাকালো তবে কিছু বলল না I বাটিটা টেনে নিয়ে খাওয়া শুরু করলো I মুনির খুব আগ্রহ নিয়ে খাচ্ছে দেখে বোঝা যাচ্ছে ওর প্রচন্ড ক্ষুধা পেয়েছিল I অনিমার চোখে পানি এসে গেল I নিজের উপর খুব রাগ হচ্ছে I কি হয়েছে ওর I কারণে অকারণে শুধু চোখে পানি এসে যায় I মুনির খাওয়া শেষ করে বলল
– কি জিনিস এটা খেতে এতো ভালো
– চিঁড়ের পোলাও তুমি খাওনি আগে কখনো ?
– না , খুব ভালো খেতে
-আরেকটু দেই ?
– দাও
অনিমা বাটিতে আরো অনেকটা ঢেলে এগিয়ে দিল I গ্লাসে পানি ঢেলে দিল I মুনির খেতে খেতে বলল
– আমার একটু শপিং করতে হবে তুমি কি আমার সঙ্গে যাবে?
অনিমা নিজের ভেতরকার দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলে কর্কশ কন্ঠে বলল
-না
মুনির আর কিছু বলল না I মোবাইল স্ক্রল করতে লাগলো I ওর খাওয়া শেষ হয়ে গেছে তবু চলে যাচ্ছে না বসেই আছে I অনিমা জিজ্ঞেস করল
-আর কিছু খাবে ?
– চা খেতে পারি
অনিমার নিজের ও চা খাওয়া হয়নি সকালে I ও চা বানিয়ে এনে মুনির কে দিল I নিজেও এক কাপ নিল I তারপর একটু ইতস্তত করে বলল
– আমি গ্রোসারি করতে যাচ্ছি I তোমাকে কি কোথাও নামিয়ে দেবো ?
– নামিয়ে দিয়ে লাভ হবে না I এসব জিনিস কোথায় পাওয়া যায় আমার কোনো ধারনাই নেই I
– কি জিনিস ?
– দেশ থেকে লিস্ট পাঠিয়েছে
– কোথায় দেখি
মুনির মোবাইল এগিয়ে দিল I অনিমা দেখল কিছু ব্র্যান্ডের কসমেটিক্স পারফিউম আর ব্যাগের নাম লেখা I
– আমি যেখানে যাচ্ছি সেই মল এই পাওয়া যায় এসব I আমি নিয়ে যাচ্ছি I এখনই বেরোবে তো ?
– তোমার যদি কোন সমস্যা না হয়
– ঠিক আছে বস তাহলে আমি রেডি হয়ে আসছি I
কেনাকাটা শেষ করে ওরা একবারে সেজুতিকে পিক করে নিল I মুনির বলল
– চলো একবারে ডিনার করে বাসায় যাই
অনিমা কিছু বলার আগেই সেঁজুতি বলল
– THAT WILL BE GREAT
-কি খাবে বলো ?
– LETS TRY আফগানি টুডে
– PERFECT
মুনির তাড়াতাড়ি মোবাইল সার্চ করে অর্ডার দিয়ে দিল I তারপর ঠিকানা দেখে অনিমা কে বলল ওখানে যেতে I অনিমা হতভম্ব হয়ে গেল I মনে হচ্ছে ও একজন ড্রাইভার I ওর মতামতের কোনই গুরুত্বই নেই I রেস্টুরেন্টে যাবার পরও ওকে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করল না I দুজন দিব্যি গল্প করতে করতে খেতে লাগলো I অনিমা আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে রইল I গল্প করা শেষ I এখন একটা মুভি দেখছে সেঁজুতির মোবাইলে I অনিমা কিছু শুনতে পাচ্ছে না I মনে হচ্ছে কোন হাসির মুভি I সাবটাইটেল দেখে দুজন হাসতে হাসতে গড়িয়ে পরছে I অনেকদিন পর সেজুতিকে এত খুশি হতে দেখল অনিমা I একবারের জন্য ওর মনে হলো সেঁজুতির জন্য হলেও ওর বোধহয় বিয়েটা করা উচিত I
পর্ব 14.2
মুনির রোকেয়া হলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় আধা ঘন্টার উপরে I কল পাঠিয়েছে এখনো নাজমার কোন খবর নেই I মনিরের অসম্ভব বিরক্ত লাগছে I ও ঠিক করে ফেলেছে নাজমা নেমে এলে ওকে টেনে দুটো চড় বসিয়ে দেবে I কোনো টাইম সেন্স নেই I যত্তসব I শুধু যদি এমন সেনসিটিভ ইসু না হত তাহলে ও কখনই নাজমার হেল্প নিত না I
নাজমা মুনিরের ছোট বোন I এ বছরই ইউনিভার্সিটিতে চান্স পেয়েছে I মুনির যতটা চুপচাপ আর গম্ভীর নাজমা ঠিক ততটাই চঞ্চল আর ছটফটে I ক মাসের মধ্যেই অসংখ্য বন্ধু বানিয়ে ফেলেছে I তবে নাজমা অসম্ভব বুদ্ধিমতী , চটপটে আর দায়িত্বশীল মেয়ে I ওর উপর কোন কাজের দায়িত্ব দিলে নির্ভর করা যায় I
আরো প্রায় মিনিট 15 পর নাজমা নেমে এলো I দাঁত কেলিয়ে হাসতে হাসতে বলল
– সরি ভাইয়া গোসল করছিলাম
– 2 ঘন্টা ধরে গোসল করলে পড়াশোনা কখন করিস ?
– সরি ভাইয়া ভুল হয়ে গেছেI তোমার কোন কাজ ছিল?
-হ্যাঁ
মুনির ওর ব্যাগ থেকে একটা কাঠের বাক্স বের করে নাজমার হাতে দিয়ে বলল
– এটা তোর জন্য এনেছিলাম কক্সবাজার থেকে
নাজমার হাসি আরো বিস্তৃত হল I তারপর সন্ধিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
– শুধু এটাই দিতে এসেছিলে?
– না , আমার একটা কাজ করে দিতে হবে
– কি বলো
মুনির একটু ইতস্তত করে বলল
– একটা শাড়ি কিনে দিতে পারবি ? নীল রঙের তাঁতের শাড়ি I
নাজমার চোয়াল ঝুলে পড়ল I আকাশ থেকে পরী নেমে এলে, জঙ্গল থেকে দৈত্য বের হয়ে এলে কিংবা মহাকাশযানে করে এলিয়েন নেমে এলেও হয়তো ও এত অবাক হতো না I ভাইয়া ওকে শাড়ি কিনে দিতে বলছে I এই শাড়ি নিশ্চয়ই ওর বা মায়ের জন্য নয় I তারমানে ভাইয়ার বিশেষ কেউ আছে I
– মুখ বন্ধ কর I রাস্তার মধ্যে হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন ? পারবি কিনে দিতে ?
– অবশ্যই পারব I কিন্তু একটা শর্ত আছে I আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে
– আচ্ছা সেটা পরে দেখা যাবে
– নামটা অন্তত বলো
– এখন না I সামনে ওর একটা প্রোগ্রাম আছে I আগে ওখানে শাড়িটা পড়ুক তারপর
– কিসের প্রোগ্রাম?
– গানের
– গানের? তারমানে অনিমা আপু ? নাজমা আনন্দে চিৎকার করে উঠলো I ওদের রুমের সবাই অনিমার ফ্যান I
মুনির ঠোটে আঙ্গুল তুলে বলল
– চুপ I যতটুকু বলেছি ততটুকু কর I আমার আজকে রাতেই লাগবে I পারবি ?
– ডেফিনেটলি পারব
মুনির নাজমা কে 2000 টাকা দিল I সামনেই inter-university সিঙ্গিং কম্পেটিশন I গত বছর এই কম্পিটিশনে অনিমা চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল I সেমিনারের সামনে ওর একটা ছবি আছে ট্রফি হাতে I মুনির যতবার সেমিনারে যায় ওই ছবিটা দেখে I অসম্ভব ভালো লাগে ওর I মুনির ঠিক করেছে অনিমাকে একটা নীল শাড়ি দেবে আরেকটি চিঠি লিখবে I যদি অনিমা ওকে ভালোবাসে তবে যেন প্রোগ্রামের দিন এই শাড়িটা পড়ে আর না হলে ওদের বন্ধুত্ব যেমন আছে তেমনি থাকবে I মুনির কোন অবস্থাতেই অনিমা কে অস্বস্তিতে ফেলতে চায় না I তবে কেন জানিনা মুনিরের মনে হয় অনিমা ও ওকে ভালবাসে I ঠিক ততটাই যত টুকু মুনির ওকে ভালোবাসে কিংবা হয়তো তার চাইতেও বেশি I
নাজমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মুনির নীলক্ষেতের দিকে হাটতে লাগল I মোড়ের কাছে এসে দেখল অনেকটা ভিড় জমে আছে I মনে হচ্ছে কোনো অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে I মুনির স্টুডেন্টের বাসায় যাচ্ছিল I আজকে যাওয়াটা খুব জরুরী I হাতে একদম টাকা নেই I মুনির পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল হঠাৎ মনে হল ভিড়ের মধ্যে অনিমা কে দেখলো I ওতো চলে গেছে অনেকক্ষণ I তাহলে ? মুনির দীর্ঘশ্বাস ফেলল I সবখানেই এখনও অনিমা কে দেখা শুরু করছে ? মুনির ভিড়ের মধ্যে এগিয়ে গেল I একটা বাইক অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে I একটা লোক মুখ থুবড়ে পড়ে আছে রাস্তার মধ্যে I চারপাশেটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে I পাশেই একটা ছোট বাচ্চা বয়স 5 বা 6 হবে পড়ে আছে I সবাই দাঁড়িয়ে দেখছে I কেউ এগিয়ে আসছে না I মুনির অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো অনিমা দৌড়ে এসে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিল তারপর ভিড় থেকে বের হয়ে রিকশা খুঁজতে লাগলো I মুনির হতভম্ব হয়ে গেল I অনিমা এখানে কি করছে ?
চলবে……
লেখনীতে
অনিমা হাসান