#সুখের_নেশায়
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব_৪
সাফারাত দাঁড়িয়ে আছে সামনে, অতি নিকটস্থ। মুখভঙ্গি তার নির্লিপ্ত, নির্বিকার। চৈত্রিকা আকস্মিক সাফারাতের এতোটা সান্নিধ্য মেনে নিতে পারছে না। দু’পা পিছিয়ে গিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠল,
‘ আপনি এখানে কি করছেন?’
সাফারাত নিরুত্তর থেকে গায়ের জ্যাকেট টা খুলতে শুরু করল। খোলামেলা রাস্তায়,মানুষের সামনে সাফারাতের এমন কাজে হতভম্ব চৈত্রিকা। কন্ঠে তেজ ধরে রেখে পুনরায় প্রশ্ন করল,
‘ কথা বলছেন না কেন?আপনি আমার এতো কাছে কি করছিলেন?’
‘ দেখছিলাম। ‘
তীক্ষ্ণ প্রশ্নের সাদামাটা উত্তরে ভড়কে গেল চৈত্রিকা। কপাল কুঁচকে বলে উঠল,
‘ মানে?’
সাফারাতের চোখে মুখে বিরক্তি ফুটে উঠল। গায়ের জ্যাকেট টা চৈত্রিকার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে নিরলস ভঙ্গিতে জবাব দিল,
‘ আপনি দেখাচ্ছিলেন,আমরা দেখছিলাম। আপনি কি এতোটাই গর্দভ?কথায় আছে,আক্কেল কে ইশারা এবং বেক্কল কে ধাক্কা। আপনি কোন কাতারে পড়েন?আক্কেল নাকি বেক্কল?’
সাফারাতের কথায় মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল চৈত্রিকার। নজর সরিয়ে সামনে তাকাতেই দেখল ছেলে তিনটে পাশ হতে পিছনে এসেছে দাড়িয়েছে। কখন এলো? মিহিতার সাথে কথার তালে খেয়ালই ছিল না। নিজের দিকে চেয়ে আবারও লজ্জায় চুপসে গেল। গায়ে জামা লেপ্টে গিয়ে খুবই বাজে দেখাচ্ছে। ছেলেগুলো একা নয়,সাফারাত নিজেই তো তাকে দেখল!
চৈত্রিকা সাফারাত কে কতগুলো তিক্ত কথা শুনিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে পোষণ করল। পরমুহূর্তেই অপমান, আঘাত সাময়িক সময়ের জন্য ভুলে নিজের সম্মান রক্ষার্থে তড়িঘড়ি করে জ্যাকেট টা হাতে নিয়ে গায়ে জড়িয়ে ফেলল। মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করল- এই শুভ্র রঙের ড্রেস পড়ে আর কখনও বেরোবে না সে। কখনও না। লজ্জাজনক এই ঘটনা তার সাদা রঙের পছন্দটা কে কালো রঙে ঢেকে দিল হুট করে।
মিহিতা এত সময় অব্দি ছিল নিরব দর্শক। তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছিল সবকিছু। চৈত্রিকার সাফারাতের হাত থেকে জ্যাকেট ছিনিয়ে নিয়ে গায়ে দেওয়ার বিষয়টা তার মাথায় ঢুকতেই মৃদু হাসল সে। পরক্ষণেই অবাক স্বরে জিজ্ঞেস করে উঠল,
‘ স্যার আপনি এখানে?’
সাফারাত হাতের ঘড়ির দিকে একপলক চেয়ে মিহিতার দিকে দৃষ্টি রাখল। পানিতে ভিজে গেছে ঘড়িটা। স্বাভাবিকভাবে জবাবে বললো,
‘ মাঝ রাস্তায় গাড়ি নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ড্রাইভার ঠিক করে নিয়ে আসবে। তত সময় অব্দি অপেক্ষা করা পসিবল না। তাই ভাবলাম বাস ধরে বাসায় চলে যাবো। বাই দ্যা ওয়ে,আপনাকে আমার বাসার জন্য নিউ কুক নিয়ে আসার কথা ছিল।’
‘ জ্বি স্যার। একটু পরেই যাব।’
আর কিছু বলল না সাফারাত। চৈত্রিকার কাছ থেকে দূরে সরে দাঁড়িয়ে রইল বাসের অপেক্ষায়। চৈত্রিকা আঁড়চোখে অবলোকন করে যাচ্ছে দূরে সাদা গেঞ্জি পড়ে দাঁড়িয়ে থাকা সুদর্শন যুবককে। ভুল করেও একবার তাকাচ্ছে না সাফারাত। দৃষ্টি তার বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটায় ফোঁটায়। চৈত্রিকার মনে হচ্ছে আরো একটা বার বেহায়া হয়ে উঠুক মন,আরও একটা বার সাফারাতের কাছে গিয়ে অনুরোধ করুক চেনার। সময় একটা মানুষকে কি করে এতো পাল্টে দিতে পারে!
বাস এসে থামতেই সাফারাত পা বাড়িয়ে উঠতে নিয়েও ঘাড় কাত করে চৈত্রিকার দিকে তাকালো প্রখর দৃষ্টিতে। দৃষ্টির প্রখরতায় কেমন মাদকতা মিশে ছিল,যা বাধ্য করল চৈত্রিকার হৃদস্পন্দন বাড়াতে। চৈত্রিকা নিজের দিকে একবার চাইল। অতঃপর গা থেকে জ্যাকেট খুলতে নিলে সাফারাত বাঁধা দিয়ে বলে উঠল,
‘ জ্যাকেট টা বাসায় পৌঁছে দিবেন। একবার তাড়িয়ে দিয়েছি বলে দ্বিতীয় বার আমার বাড়িতে পা রাখতে পারবেন না এমন নিয়ম নেই। অপমান আঁকড়ে ধরে রাখলে সুখ পালিয়ে যাবে। মাঝে মাঝে বুঝে নিতে হয়, সময়ও বড় নিষ্ঠুর হয়।’
কথাটা বলে ছেলে তিনটের উদ্দেশ্যে গলা উঁচিয়ে বললো,
‘ আপনারা বোধ হয় বাসের অপেক্ষা করছিলেন। বাস তো চলে যাবে,যাবেন না?’
ছেলে তিনটে একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। সাফারাতের দৃষ্টি দেখে বিলম্ব না করে উঠে পড়ল বাসে।
বাস চোখের আড়াল হয়েছে সেই কখন কিন্তু চৈত্রিকা এখনও তব্দা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে স্থির। সাফারাতের কথায় কেমন রহস্য ছিল। চৈত্রিকা বুঝতে পারছে না একদম। রহস্যজনক কথাবার্তা তার কাছে বিরক্ত লাগে। এইসব ভাবতেই মন মস্তিষ্ক অসাড় হয়ে পড়ে। সাফারাতের বলা ‘ অপমান আঁকড়ে ধরে রাখলে সুখ পালিয়ে যাবে’ বাক্যটাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে হাওয়ায় উড়িয়ে দেয় চৈত্রিকা। তার জীবনে আবার সুখ?মনে মনে বললো,
” আমার সুখের অসুখ হয়েছে,
সে এক বিরাট অসুখ! ”
.
.
জ্যাকেট থেকে খুব সুন্দর একটা ঘ্রাণ নাকে এসে ধাক্কা দিচ্ছে। দু’চোখ বুঁজে ফেলল চৈত্রিকা। গভীর ভাবে ঘ্রাণ টা টেনে নিতেই স্মৃতির পাতায় ডুবে গেল মন। এই তো প্রথম যেদিন পাশাপাশি বসেছিল চৈত্রিকা ও সাফারাত, সেদিন এই মন মাতানো ঘ্রাণ টা পেয়েছিল। বিমুগ্ধ নয়নে চেয়ে কৌতূহল বশত বলেই বসে,
‘ তোমার পারফিউমের ঘ্রাণ টা তো খুব মিষ্টি সাফারাত।’
সাফারাত স্মিত হেসে বলেছে,
‘ আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ আমার মা, এই পারফিউম টা দিয়েছে। ঘ্রাণ টার চেয়েও খুব মিষ্টি আমার মা। একদিন নিয়ে যাবো তোমাকে আমাদের বাড়িতে,আমার মায়ের সাথে দেখা করাতে।’
চৈত্রিকা দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল। একই মানুষ, একই পারফিউম পার্থক্য শুধু আচরণে। বর্তমান সাফারাতের পুরো মুখ জুড়ে থাকে কেবল গম্ভীরতার ছাপ। আচরণ কেমন ধারালো,তীক্ষ্ণ, রাগান্বিত!
___________
বৃষ্টি বিদায় নিয়েছে ধরিত্রী হতে কিছু সময় পূর্বে। গায়ে জ্যাকেট টা ভালোভাবে জড়িয়ে উল্টো পথে হেঁটে চলেছে চৈত্রিকা। ঠান্ডায় ফর্সা চেহারা ফ্যাকাসে, রক্তশূণ্য। মিহিতা দৌড়ে কাছাকাছি এলো। হাঁপিয়ে গেছে মেয়েটা চৈত্রিকার পিছু পিছু হাঁটতে হাঁটতে। যখনই পাশাপাশি হচ্ছে তখনই চৈত্রিকা পায়ের গতি বাড়িয়ে পিছু ফেলে দিচ্ছে তাকে। আচমকা চৈত্রিকার এমন আচরণ তার মাথায় ঢুকছে না। বড় বড় শ্বাস ফেলে চৈত্রিকার হাত টা চেপে ধরে আঁটকে দিল। ক্লান্ত কন্ঠে বলে উঠল,
‘ এমন করছিস কেন চৈত্রি?আর বাড়ির দিকে যাচ্ছিস কেন?হঠাৎ কি হয়েছে তোর?’
‘ আমি চাকরিটা করব না মিহি। তাই তোর স্যারের বাড়িতে যেতেও ইচ্ছুক নই।’
চৈত্রিকা আগ্রহহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রতুত্তর করে। মিহি আঁতকে উঠে বললো,
‘ পাগল হয়েছিস চৈত্রি?একটা বছর ধরে হন্য হয়ে চাকরি খুঁজে বেড়াচ্ছিস। অনার্স দ্বিতীয় বর্ষ পর্যন্ত পড়ে আর পড়লি না। ইন্টার পাসে আজকাল জব হয় না তুই নিজেও জানিস। পরিবারের অবস্থা দেখে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছিলি। তোর বাবার অবস্থার কথা মাথায় আছে তো?’
মুহুর্তেই করুন চাহনি নিক্ষেপ করল চৈত্রিকা মিহির দিক। আহমেদ সাহেব প্রায় বছর খানেক আগে বাম হাত হারিয়েছেন এক এক্সিডেন্টে। তখন থেকেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। দু’দুবার হার্ট অ্যাটাক করেছেন উনি। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে হওয়ায় বাবার দেওয়া সম্পত্তি খুব বেশি নয়। এবং যা ছিল তা বেঁচে নিজের চিকিৎসা চালাচ্ছেন,সংসার চালাচ্ছেন। কাজ করার মতো সামর্থ্য আর নেই উনার। চৈত্রিকার দায়িত্ব তিনি নেন নি তবে ফাহমিদা টুকটাক মেয়েকে টাকা দিতেন পড়ালেখার খরচ চালাতে।
একটা সময় চৈত্রিকা নিজে এক দু’টো টিউশন করানো শুরু করে। টিউশনের চার হাজার টাকা দিয়ে তো আর সংসার চলে না। সংসারের খরচ,বোনের পড়ালেখার খরচ, বাবার চিকিৎসা সব মিলিয়ে বাধ্য হয়ে নিজের পড়াশোনা ছেড়ে দিল চৈত্রিকা। লুকিয়ে লুকিয়ে মাঝে মাঝে বাবার ওষুধ কিনে দেয় ফাহমিদার কাছে। বাসা ভাড়া ও আঁটকে আছে দুই মাসের। আজ সকালে বাড়িওয়ালা বলে গেছেন ভাড়া ক্লিয়ার না করলে বাসা ছেড়ে দিতে হবে শীগ্রই। তারপর?কোথায় থাকবে পুরো পরিবার?বস্তিতে নয়ত ফুটপাতে!তাছাড়া যে উপায় নেই। সিলেটে দাদার দেওয়া যেই ভিটে ছিল তা-ই ছিল চৈত্রিকার দাদার দেওয়া একটুখানি সম্পত্তি। বাবা চৈত্রিকার সাহায্য নিবে না তবুও নিজের পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালন করতে চায় সে। কিন্তু!
যে বাড়িতে সে অপমানিত হয়েছে সেই বাড়িতে কখনও যাবে না। যাবে না সাফারাত নামক ভালোবাসার মানুষটার কাছে,সন্নিকটে। কে চায় নিজ থেকে আগুনে জ্বলতে?চৈত্রিকার কাছে সাফারাতের কাছাকাছি থেকে তার ভালোবাসা না পাওয়া জ্বলন্ত আগুনে পুড়ে ছাড়খাড় হয়ে যাওয়ার চেয়ে কম নয়। আচ্ছা সাফারাত কি কখনও জানবে তাকে ভালোবাসে চৈত্রিকা?চৈত্রিকা নিজেও তো জানে না সাফারাত তাকে ভালোবাসে কিনা!
চক্ষুদ্বয় বুঁজে লম্বা একটা শ্বাস টেনে আবার তা মুক্ত করে দেয় চৈত্রিকা। ধাতস্থ করে নিল নিজেকে। মিহিতার দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় বলে উঠল,
‘ মাথায় আছে আমার। কিন্তু তোর অফিসের বসের বাড়িতে আমার পক্ষে জব করা সম্ভব না। ‘
কথাটা বলে এক মুহুর্তও দাঁড়াল না চৈত্রিকা। মিহিতা কে ফেলে চলে এল বাসার কাছাকাছি। গেইট দিয়ে ঢুকতে গেলেই দারোয়ান মুখ কালো করে বিচলিত কন্ঠে বলে উঠল,
‘ তোমার বাবারে হাসপাতাল লইয়া গেছে। অবস্থা ভালা না। গাড়ি চাপা দিছে। জলদি হাসপাতাল যাও।’
চৈত্রিকার চোখের সামনে কালো আঁধার ছেয়ে গেল নিমেষে। কথাটা কর্ণে প্রবেশ মাত্র শরীর কেঁপে উঠল ঝাঁকুনি দিয়ে। কোনো কিছু না ভেবে উদভ্রান্তের মতোন ছুটতে শুরু করে।
________
প্রিয়ন্তীর মা চিৎকার করে কাঁদছে। প্রিয়ন্তী ভয়ে দাদির বুকে মুখ লুকিয়ে রেখেছে। সাফারাতের চাচা ও দিহান মিলে চেষ্টা করেও থামাতে পারছে না সাফারাত কে। বেধড়ক মারছে সাফারাত তার চাচাতো ভাই পৃথক কে মেঝেতে ফেলে। আরেকটু মারলেই নিঃশ্বাস সঙ্গ ছেড়ে দিবে বোধ হয়। সাফারাত যেন হিংস্র হয়ে উঠেছে অতিশয় রাগের বশীভূত। সাফারাতের এই রগচটা রূপ সবাই খুব ভয় পায়। দিহানও আঁতকে উঠে মাঝে মাঝে। উপায়ন্তর না পেয়ে পুলিশকে ফোন দিল তৎক্ষনাৎ।
#চলবে,,,!
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)
পিক ক্রেডিট ঃ তাঈব