শিরোনাম—নিজের পরিচয়ে বাঁচতে চাই–(পর্ব-১)
কলমে– পারমিতা মন্ডল।
আমি রায় বাড়ির বড় বৌ ।আজ পাঁচ বছর হলো আমার বিয়ে হয়েছে ।দেখাশোনা করেই বিয়ে হয়েছে । তাই স্বামীকেও ঠিক সেভাবে চিনতাম না । তবে বিয়ের পর পর শাশুড়ি বলেছিলেন , “তুমি হলে রায় বাড়ির বড় বৌ ,তাই সবাইকে খুশি রাখার দায়িত্ব আজ থেকে তোমার । আর নিজেকেও খুশি রাখার অভ্যাস করতে হবে । অকারণে মন খারাপ করবে না । ছোট খাট ব্যাপার গুলো মানিয়ে নিতে হবে ।এই পরিবার তো আজ থেকে তোমার পরিবার । তাই পরিবারের সবাইকে খুশি রাখার দায়িত্বও আজ থেকে তোমার । সবাইকে আপন করে নাও ।, দেখো তুমিও খুশি থাকতে পারবে ।”
আমি ভেবেছিলাম উনি তো ঠিকই বলেছেন । আজ থেকে তো এই বাড়ি আমারও বাড়ি । তাই আমারও উচিৎ সবাইকে খুশি রাখা তাহলেই নিজে ও ভালো থাকতে পারবো। সেই মতো সব ঠিক ঠাক চলছিল। আমিও চেষ্টা করছিলাম সবার মন রেখে চলতে।
দিন বেশ ভালোই চলছিল । সকালে ঘুম থেকে উঠে সকলের জন্য চা বানিয়ে ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া, তারপর টিফিন করা , আবার আটটার মধ্যে ভাত করা । আমার বর ও দেওর অফিসে যাবে । তাদের জন্য টিফিন গুছিয়ে দেওয়া । ওরা চলে গেলে শাশুড়ির ফাই ফরমাস খাটা । এভাবে সারাদিন কোথা দিয়ে যেন চলে যেত। নিজের জন্য একটুও সময় ছিল না । কতদিন যে ভালো করে আয়নায় মুখ দেখিনি। সাজিনি ভালো করে। জীবন যেন চার দেওয়ালে মধ্যে আটকে গেল।
আমার শাশুড়ি বলেন — “সংসারের নানা কাজের মধ্যেই নিজেকে আটকে রেখে খুশী থাকতে হয় ।এখনকার মেয়েরা যেন কেমন ? সারাদিন শুধু বাইরে বাইরে মন । নাহলে ফোন নিয়ে বসে থাকে । কি যে করে এতো ফোন নিয়ে বাপু বুঝি না । সংসারের প্রতি তাদের কোন মনই নেই । তুমি যেন ঐসব নেশা আবার ধরে ফেলো না। আমার বাবু কিন্তু পছন্দ করেনা। ফোন হলো কথা বলার জন্য। দু’চার কথা বলবে ছেড়ে দেবে।তা না । মেয়েগুলোর বাবার বাড়ির ফোন এলে আর যেন ছাড়তেই চায়না।”
অথচ শাশুড়ি মা নিজে কিন্তু সংসারের একটি কাজও করেন না । তবে ফোনে কথা ভালোই বলেন।মেয়ে তো বাইরে থাকে। তার সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা চলে।এদিকে আমার সারাদিন সংসারে সকলের ফাই ফরমাস খাটতে খাটতে কখন যে দিনটা চলে যায় বুঝতেই পারি না । আমার সব অভ্যাস আস্তে আস্তে চলে যায়। বই পড়তে খুব ভালো বাসতাম । এখন আর সময় পাইনা ,বই নিয়ে বসার । গান শোনা, ছবি আঁকারও খুব নেশা ছিল। এখন সে সব কথা মনেও আনতে পারি না। আমার সময় কোথায় ? আমি যে রায় বাড়ির বড় বৌ। নিজের সখ বলে যে আমার কিছু থাকতে নেই।
আমার স্বামী অফিস থেকে ফিরে বলেন “সারাদিন তো কোনো কাজই নেই । কি করো ? একটু তো ভালো মন্দ রান্না করতে পারো । সেজে গুঁজে শুধু পটের বিবি হয়ে বসে থাকো ।সংসারে সবাইকে খুশি রাখতে পারলে তবেই নিজে খুশি থাকা যায় । সেটা জানো তো ? কেন বিকেলের দিকে একটু ভালো মন্দ জলখাবার তো বানিয়ে রাখতে পারো।
মনে ভাবি আমার স্বামী তো ঠিকই বলেছে। ওদের খুশী তো আমারও খুশী। তাই আমি আরো ভালো ভালো রান্না করতে শুরু করবো ভাবি। সবাইকে খুশি করতে হবে। এখন তো এটাই আমার বাড়ি । কিন্তু ভালো কিছু বানাতে গেলে যে শাশুড়ি মার পারমিশন দরকার হতো। জিনিস পত্রের দরকার। সেগুলো কোথায় পাবো ? আবার বেশী খরচ করা যাবে না। শাশুড়ি মায়ের কড়া নির্দেশ। ওনার বাবু কষ্ট করে রোজগার করে তো ? আথচ ভালো খাবার চাই। কিন্তু একথা তো আমি কখনো আমার স্বামীকে বলতে পারিনি। তাই ওর ধারনা ছিল আমি হয়তো বানাতে চাই না বা পারি না। এভাবে কেটে গেল আরো ছয় মাস ।
এরমধ্যে আমার শাশুড়ি একদিন বললেন , “আমার মেয়ে বিদেশে থাকে। জানোই তো । তোমাদের বিয়ের সময় আসতে পারেনি । আগামীকাল আসবে । ও কিন্তু শাড়ি টাড়ি পরে না । বিদেশে তো শাড়ি পরার চল নেই। ওকে দেখে তুমি যেন আবার ঐসব পোষাক পরতে চেওনা । তুমি হলে রায় বাড়ির বড় বৌ । তোমাকে কি আর ঐসব মানায় ?”
মনে মনে ভাবলাম আমি যেমন রায়বাড়ির বড় বৌ তেমনি সেও তো রায়বাড়ির মেয়ে । তাই সন্মান রক্ষার দায়িত্ব তো দুজনেরই । কেন যে এই বিভেদ বুঝি না। আমিও তো কোন না কোন বাড়ির আদরের দুলালী । কিন্তু চুপ করে গেলাম । মানিয়ে নিলাম । অশান্তির ভয়ে। তাছাড়া আমার দিদি খুব অসুস্থ। বাবা তাকে নিয়ে দিশেহারা। আবার আমার শ্বশুর বাড়ির অশান্তির কথা যদি শোনে মনে কষ্ট পাবে। তার চেয়ে আমি মানিয়ে নেই।
আমার মা ছিল না। দিদি আর আমি । দিদির অসুস্থ ছিল । তাই সে বিয়ে করেনি । আমাদের মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবার ছিল। কিন্তু মা না থাকায় আর দিদি অসুস্থ হওয়ায় ,আমার তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেয় । আর বিয়ের পর প্রত্যেকটা মেয়েই চায় সংসারের ছোটখাট বিষয়গুলো মানিয়ে নিতে । আমিও তাই করে ছিলাম । কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না ।
আমার বিয়ের কিছু দিনের মধ্যে আমার দিদি মারা যায় । ক্যানসারে ভুগছিল। আমার থেকে অনেক বড় ছিল। আমার মায়ের মতো। আমার শশুর বাড়ী থেকে অনেক দূরে থাকতো ওরা । তাই আমি খবর শুনেও তখনই যেতে পারিনি । এদিকে মনের এই অবস্থাতেও আমাকে রান্না ঘরে ঢুকতে হলো । সবার জন্য ভালো মন্দ রান্না করতে হলো প্রতি দিনের মতো । ছুটি মিললো না। একহাতে চোখের জল মুছে আর একহাতে সবার জন্য রান্না করে দিলাম।
শাশুড়ি বললেন—” উনি তোমার মা নয় দিদি ,। তাই তোমার কোন কিছু করতে হবে না। কোন নিয়মও মানতে হবে না । স্বাভাবিক খাওয়া দাওয়া করো । পরে একবার গিয়ে ঘুরে এসো । এখনই যাওয়ার কোন দরকার নেই। বাবু ছুটি দেখে তোমাকে একদিন নিয়ে যাবে।
ওরা আমার মনের অবস্থাটা বুঝলো না । কিভাবে আমি স্বাভাবিক থাকবো ? সে আমার মা নয় মানলাম । কিন্তু আমার রক্তের সম্পর্ক আছে তার সাথে । জন্মের পর আমরা একসাথে মানুষ হয়েছি । একই থালায় খাবার ভাগ করে খেয়েছি । একটা জামা দু’জনে ভাগ করে গায়ে দিয়েছি। যখন আমি অসুস্থ হয়েছি মায়ের মত বুকে আগলে রেখেছে দিদি আমাকে। কোন কষ্ট পেতে দেয়নি। আজ সে নেই । তার অন্তিম যাত্রায় আমি সঙ্গী হতে পারবো না। পারবো না একফোঁটা চোখের জল ফেলতে। চিৎকার করে কাঁদতে পারবো না। কারণ সে আমার মা নয়। আমি অন্য গোত্র হয়ে গেছি। এ কেমন নিয়ম ? হাসি মুখে আজও আমাক সবাইকে খাবার পরিবেশন করতে হবে ? শুধু সংসারকে সুখে রাখার জন্য ? এরা তো আমার মনের কথা, সুখের কথা ভাবলো না ?
শাশুড়ি বললেন–” তুমি যেন এখন আবার শোক পালন করতে বসে পড়ো না “। অসুস্থ ছিল মারা গেছে । একদিকে ভালোই হয়েছে । ” স্বামীও তাতে সায় দিলেন ।
হয়তো ঠিক বলেছেন। মারা যাওয়াতে সব জ্বালা, যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়েছে দিদি। তাই বলে এতোটা অবহেলা ? তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ?এরা তো আমাকেও কোনদিন ভালো বাসবে না। মনকে বোঝাবো কি করে ? সে আমার আপন সহদরা।আমার মায়ের চেয়েও বেশী ছিল।
জানেন তো আর পারলাম না সহ্য করতে । এদের কি মন বলে কিছু নেই? সবাইকে ভালো রাখতে গিয়ে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে আমিও একজন মানুষ। যথেষ্ট লেখাপড়া জানি ।এভাবে নিজের সব সত্তা বিকিয়ে দিয়ে ভালো থাকতে পারবো না ।আমার শ্বশুর বাড়ির প্রতি যেমন দায়িত্ব আছে তেমনি বাপের বাড়ির প্রতিও কিছু দায়িত্ব আছে ।সেগুলো অস্বীকার করতে পারিনা । তারাও আমাকে তাদের সবটুকু দিয়েই মানুষ করেছ । তাই বিয়ে হয়ে গেছে বলে আমি তাদের দায়িত্ব এড়াতে পারি না ।তাছাড়া আমার প্রতি তো এদের কোনো দায়িত্ব আমি দেখতে পেলাম না । আমার ভদ্রতাকে এরা দূর্বলতা ভেবেছে।
আমি সবাইকে খুশি করতে গিয়ে নিজেই বড় একা হয়ে যাচ্ছিলাম । আমার সুখ দুঃখ, ভালো লাগা, মন্দ লাগা সবই কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছিল। তাই রায় বাড়ির বড় বৌ হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে একজন স্বাধীন মানুষ হয়ে বেঁচে থাকা আমার কাছে অনেক সন্মানের । এভাবে নিজেকে শেষ করার আগে একবার দেখি না কিভাবে ঘুরে দাঁড়ানো যায়। কিভাবে সন্মানের সাথে ভালো থাকা যায় ? তাই ভালো থাকার পথ খুঁজতে আমি আজ সব কিছু ছেড়ে চলে এসেছি ।নতুন পরিচয় গড়তে চাই ।বাঁচতে চাই নিজের পরিচয়ে। নিজের মতো করে ভালো থাকতে চাই ।
চলবে—-
All rights are reserved dy paramita mandal.