নিজের পরিচয়ে বাঁচতে চাই।( পর্ব–১৩)
কলমে— পারমিতা মন্ডল।
আজ আমার সম্পর্কটা সত্যিকারের ভেঙে গেল। প্রকৃত ডিভোর্স হলো আজ । আমি কিন্তু এটা চাইনি কখনোই। তবে ওর কাছে ফিরে যেতেও চাইনি। তাও ভাবতাম ছাড়াছাড়ি হলেও পৃথিবীর কোন না কোন প্রান্তে রাতুল থাকবে। নাই বা ভালো বাসলো আমায় ? কিন্তু বেঁচে তো থাকবে। আর আমার জীবনে তো রাতুলই হলো প্রথম ভালোবাসা। সে স্বামী হোক বা প্রেমিক। ব্রেকআপ হয়ে গেলে কি সব সম্পর্ক ,সব স্মৃতি মুছে যায় ? আমার তো সব মনে আছে। তবে খারাপ ব্যবহার গুলো বেশী করে মনে আছে। তাইতো ওকে ছেড়ে চলে এসেছিলাম। কিন্তু কখনোই ভাবতে পারিনি তার পরিনতি এটা হবে।
তবে একদিকে মনে হয় ঈশ্বর মুখ তুলে চেয়েছে। রাতুলের সাথে থাকা কালিন যদি এই দুর্ঘটনা ঘটতো তবে শাশুড়ি, পাড়া ,প্রতিবেশী তাকে অপয়া, অলক্ষ্মী তকমা এটে দিতো।জীবন হয়ে উঠতো আরো দুর্বিসহ। আর আমার শাশুড়ি মা কি যে করতেন ভেবেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে। আমি কি ভুল করলাম ? আর একবার কি সুযোগ দেওয়া যেত রাতুলকে?তাহলে কি ওকে বাঁচানো যেত ? নাকি ফিরে গেলে আবার শুরু হতো এক কাহিনী ? আর ভাবতে পারে না অমৃতা।
কার দোষে এমন সুন্দর সাজানো একটি সংসার ভেঙে চুরমার হয়ে গেল ? এর কি খুব দরকার ছিল ? কেন শাশুড়ি মায়েরা ছেলের বৌদের নিজের মেয়ে ভাবতে পারেনা ? তারা যদি ভালোবাসা দিয়ে এগিয়ে আসে, তাহলে অন্য বাড়ি থেকে আসা মেয়ে গুলোও শাশুড়ি মাকে মা ভাবতে পারে। বৌদের যে দোষ নেই তা নয়। তবে শাশুড়ি মাকে মনে হয় আগে এগিয়ে আসতে হয়। কারন তিনি বয়সে বড় , মায়ের মত। আর তিনি তার নিজের বাড়িতেই থাকেন। অন্য বাড়ি থেকে আসা মেয়েদের মানিয়ে নেওয়ার সময় দেওয়া ও সহযোগিতা করা দরকার। এটুকু হলেই হয়তো একদিন বৃদ্ধাশ্রম আর থাকবে না। সম্পর্কগুলোও কাঁচের বাসনের মত ভেঙে যাবে না।
আজ নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে। রাতুলের এই পরিনতির জন্য আমি দায়ী নয় তো ? মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে ওর শরীর এমন ভেঙ্গে গেল যে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো ? আমি কাছে থাকলে হয়তো এমনটা হতো না । আমি তো ওকে মুক্তি দিতে চেয়েছিলাম । ওর যাকে ভালো লাগে, ওর মনের মানুষের সাথে যাতে সারাজীবন থাকতে পারে ,তাই ওকে ছেড়ে চলে এসেছিলাম । তাছাড়া ওখানে থেকে নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে যাচ্ছিল । একটু সহানুভূতি একটু ভালোবাসা চাইতো মন। কিন্তু দিনশেষে জুটতো কটুক্তি, লাঞ্ছনা, আপমান । রাতুল তো কখনো আমার দিকে ভালো করে তাকাতো না পর্যন্ত । শুধু যখন শরীরের চাহিদা হতো তখন ছাড়া। এভাবে নিজেকে দিনের পর দিন মানিয়ে নিতে কষ্ট হতো। তাই তো বেরিয়ে এলাম। আগের দিন হলে হয়তো মুখবন্ধ করে সব অন্যায় মেনে নিতো মেয়েরা। কিন্তু আমি যে পারলাম না। তবে তার পরিনতি এমন হবে সেটাও ভাবিনি। কেন আমার এতো কষ্ট হচ্ছে ? আমি কি এখনো ওকে ভালোবাসি ? আমার কি যাওয়া উচিত ? আইনত তো আমি এখন ওদের কেউ নয় ।কোন রকম নিয়ম-কানুন তো আমার মানতে হবে না । কিন্তু–
“কি হলো অমৃতা ? কার ফোন এসেছে ? এতো কি কথা বলছো ? এদিকে সৌহার্দ্য বসে আছে । ওর দেরী হয়ে যাচ্ছে। চলে যাবে তো।”–ডাক দেন মেসোমহাশয়।
সম্বিত ফিরে পায় অমৃতা । কাঁপা কাঁপা পায়ে আস্তে আস্তে চেয়ারে এসে বসে। এক নিমেষে মুখের থেকে যেন সমস্ত রক্ত কেউ শুষে নিয়েছে। কেমন যেন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে চোখ মুখ। দেখে ভয় লাগছে । কি হলো হঠাৎ মেয়েটার ? কে ছিল ফোনের ওপারে ? সে কি বলেছে অমৃতাকে ?
“তোমাকে এমন লাগছে কেন অমৃতা ? কি হয়েছে ?কে ছিল ফোনে ? কোন কি খারাপ খবর ?” বলেন মেসোমহাশয়।
আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না অমৃতা । হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে ।মেসোমহাশয় আমি এটা চাইনি । রাতুল আর নেই। আমাদের ছেড়ে চলে গেছে না ফেরার দেশে।”
“মানে ? নেই মানে কি ? কি হয়েছে তার ?’
“রাতুল আর বেঁচে নেই । কিডনির অসুখে ভুগছিল । আজ সকালে মারা গেছে। এখনো বডি হাসপাতালে রয়েছে । বোন তো বিদেশে থাকে। মা এখানে। বডি মনে হয় অফিসের ওরা নিয়ে আসবে বাড়িতে। রমাদি বললো বোনকে খবর দেওয়া হয়েছে। এদিকে ওনার মাকে রাখা খুব মুসকিল হয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে জ্ঞান হারাচ্ছেন। আমাকে একবার যেতে বলছেন আশ্রমে । আমি যতই ওদের ছেড়ে দূরে থাকতে চাইছি ততই কেন জড়িয়ে যাচ্ছি ওদের সাথে ? এখন আমার কি করা উচিৎ মেসোমহাশয় ? আমি কি যাবো ?”বলে আবার ও কাঁদতে থাকে অমৃতা।
“দেখো মা আমি তোমাকে আমার মেয়ের মত স্নেহ করি। তাই তোমার বিপদে পাশে দাঁড়িয়েছি বাবার মত। আমার কথা যদি শোন তাহলে বলবো তোমার যাওয়া উচিত। সব সম্পর্কের উপরেও মনুষ্যত্ব বলে একটা সম্পর্ক থাকে। সেখানে শত্রু- মিত্র ভেদ না করে পাশে দাঁড়াতে হয় মানুষের বিপদে। এই যেমন তোমার অসময় তোমার বন্ধুরা পাশে দাঁড়িয়েছে । তাই আমি বলি কি সব সম্পর্ক ভুলে গিয়ে আজ তুমি ওদের পাশে দাঁড়াও । একজন অসহায় বৃদ্ধা আজ তোমাকে চাইছে। তারপর যখন ওদের আর প্রয়োজন হবে না; তখন ফিরে আসবে। আজ অন্তত একবার সামনে গিয়ে দাঁড়াও।”
“হ্যাঁ, আপনি ঠিক বলেছেন কাকু। বিপদে মানুষই তো মানুষের পাশে দাঁড়ায় । চলুন আমিও যাবো আপনার সাথে।-“- বলে সৌহার্দ্য।
“আমার ও যাওয়ার ইচ্ছা ছিল তোমাদের সাথে। কিন্তু তোমার মাসিমার শরীরটা ভালো নেই। এদিকে ছেলেও বাড়িতে থাকে না । কিছু হলে বৌমা একা সামলাতে পারবে না। তাই যেতে পারলাম না। “–বলেন মেসোমহাশয়।
“আমি থাকবো ওনার সাথে। আপনি চিন্তা করবেন না। সুজাতার বন্ধু তো আমার ও বন্ধু। তাছাড়া ওরা এখন এখানে নেই। আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে। আর আগামীকাল তো রবিবার। আমার তেমন কোন কাজ নেই। আমি যাচ্ছি ওনার সাথে। আপনি চিন্তা করবেন না । “– বলে সৌহার্দ্য।
সৌহার্দ্যের সাথে অমৃতা প্রথমে আশ্রমে যায় । প্রতিমা দেবীর অবস্থা খুব খারাপ। এই বয়সে সন্তান শোক পাওয়া সত্যিই খুব কষ্টের। কোথা থেকে কি হয়ে গেল। ভালোর জন্য সব ছেড়ে চলে এসেছিল অমৃতা । কিন্তু ভালো তো কিছুই হলোনা । আবার একটু একটু করে সেই সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে নিজে।
আশ্রমে গিয়ে শোনে ওনাকে বাড়িতে নিয়ে গিয়েছে আশ্রমের লোকজন। কিছু আত্মীয় স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশী এসেছে বাড়িতে। বডি ওখানে নিয়ে আসবে। বিদেশে থাকা মেয়েকেও খবর দেওয়া হয়েছে। চলে আসবে হয়তো রাতের দিকে। অমৃতা আর দেরী না করে রওনা দেয় প্রক্তন শ্বশুর বাড়ির উদ্দেশ্যে। সৌহার্দ্য যায় সাথে।
আজ এতো বছরপর আবার এবাড়িতে পা দিলো অমৃতা। একদিন শাঁখা , সিঁদুর আলতা পরে, বেনারসি শাড়িতে, চন্দন চর্চিত হয়ে নববধূ রূপে এবাড়িতে এসেছিল অমৃতা। কিন্তু আজ? এবাড়িতে আসার তার কোন অধিকার নেই। সে আজ এবাড়ির কেউ নয় । তবুও কেন এসেছে ? সবাই যেন তার দিকে কেমন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। প্রথম যেদিন এসেছিল বৌ হয়ে সেদিন ও এমনি ভীড় করে এসেছিল সবাই। কত ভালো ভালো কথা বলছিল। আর আজও সবাই এসেছে ভীড় করে। সবাই হাঁ করে তাকেই দেখছে। যেন অদ্ভুত জীব। এই তো রাঙা কাকিমা কি যেন বলছে পুতুলদিকে । সব কানে আসছে।—
“এটা রাতুলের সেই বৌটা না রে পুতুল ? তা ঐ অপয়া মেয়ে এখানে এসেছে কেন ?তেজ দেখিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েও হয়নি ? শেষে ছেলেটাকে খেয়েই ছাড়লো ? তা এখন আবার সোহাগ দেখাতে এসেছে কেন ?”
“আস্তে বল কাকিমা শুনতে পাবে “।–বলে পুতুল।
আরে রাখ তো ! আমি কি ভয় পাই নাকি ওকে ? তা এখানে কি করতে এসেছে এখন ? সম্পত্তি, টাকা পয়সার ভাগ চাই বুঝি ? শুনেছি তো ডিভোর্স হয়ে গেছে । তাও দেখ, বেহায়ার মত এসেছে। সাথে আবার বয়ফ্রেন্ড নিয়ে এসেছে। লাজ লজ্জার মাথা একেবারে খেয়ে ফেলেছে । এখানে থাকলে তো আর ওসব করা যেত না ? তাই বেরিয়ে গেছিল। আরে দিদি একেবারে ঠিকই বলতো । এখানে যখন থাকতো কত ভালো ? একেবারে ভিজে বেড়াল কিছুই যেন জানতো না । আর এখন দেখো ? ছেলে নিয়ে বেল্লেলেপনা করে বেড়াচ্ছে। সংসারটাকে শ্মশান করে ছেড়ে দিলো। অপয়া মেয়ে মানুষ একটা। ওকে কে খবর দিলো কে জানে ?” বলে রাঙা কাকিমা।
এদিকে আসছে । চুপ করো কাকিমা। – বলে হাত চেপে ধরে পুতুল রাঙা কাকিমার। কথা ঘুরিয়ে দেয় পুতুল ।বলে—
“জেঠিমাকে তো নিয়ে এসেছে শুনলাম। এই বয়সে সন্তান শোক সত্যি সহ্য করা খুব কষ্টের। আর বুনি দিদি কখন আসবে গো কাকিমা ? কিছু কি শুনেছো ?”
সব কথা কানে যায় অমৃতার। ইচ্ছা করে দু’কান চেপে ধরে ছুটে পালাতে। কিন্তু ঐ অসহায় মানুষটার মুখের দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে ঘরে ঢোকে অমৃতা। সৌহার্দ্য তাকে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে বলে । বুনি মানে রাতুলের বোন আর কিছুক্ষনের মধ্যে চলে আসবে। তারপর অমৃতা বেরিয়ে আসবে। কিছুক্ষন একটু কান বন্ধ করে থাকতেই হবে।
আস্তে আস্তে শাশুড়ির মাথার কাছে গিয়ে বসে অমৃতা। সন্তান হারা মাকে সান্ত্বনা দেওয়ার কোন ভাষা নেই তার। এদিকে নিজের বুক যে ফেটে যাচ্ছে সেকথা বলার বা বোঝার আজ কেউ নেই। সে তো এখনো রাতুলকে স্বামী ভাবে। যতই তাদের আইনী ছাড়াছাড়ি হোক না কেন ? তার জীবনে তো অন্য কেউ আসেনি। অথচ সবার সামনে কাঁদতেও পারছে না। ভাগ্যের কি পরিহাস !
“বৌমা তুমি এসেছো ? দেখো আমার অপরাধে আজ আমার কতবড় ক্ষতি হয়ে গেল মা ? আমার ছেলেটা শেষ হয়ে গেল। আমি সত্যিই তোমার উপর বড় অবিচার করেছি । তুমি আর কোথাও যাবে না তো আমাকে ফেলে ? আমি আর ঐ আশ্রমে ফিরে যেতে চাই না। “বলে অমৃতার হাত ধরে কাঁদতে থাকে প্রতিমা দেবী।
“মা তুমি ওকে কেন এখানে ঢুকতে দিয়েছো ? ও তো আজ আমাদের কেউ নয় ? কেন এসেছে এখানে ? মজা দেখতে? আজ ওর জন্য আমার দাদার মৃত্যু হয়েছে।-“-ঘরে ঢুকে বলে বুনি।
“তুমি কোথায় ছিলে এতোদিন বুনি। তোমার মাকে তো আমি আগলে রেখেছিলাম। আমার বিয়ের পর থেকেই দেখেছি তুমি বিদেশে। মাঝে মাঝে কয়েকবার তোমাকে দেখেছি। তাও এমন কথা বলছো ? কেন মাকে বৃদ্ধাশ্রমে না দিয়ে নিজের কাছে তো নিয়ে যেতে পারতে। তা তো করোনি। আজ এতো বড় বড় কথা বলছো।-“- মনে মনে ভাবে অমৃতা । তার যে আজ কিছু বলার কোন অধিকার নেই।
ধীরে ধীরে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে অমৃতা। এখানে না এলেই ভালো হতো। আজ তো ফিরে যাওয়া যাবে না। তাছাড়া রাতুলকে একবার শেষ দেখা দেখতে চাইছে মন। কি করবে সে এখন ? বাইরে বেরিয়ে সৌহার্দ্যের কাছে এসে কান্নায় ভেঙে পড়ে অমৃতা।
চলবে—–
All rights are reserved by paramita mandal.