নিজের পরিচয়ে বাঁচতে চাই পর্ব-১৪

0
482

নিজের পরিচয়ে বাঁচতে চাই।( পর্ব–১৪)
কলমে– পারমিতা মন্ডল।

আমি তো এভাবে কষ্ট পাবো বলে ঘর ছাড়িনি । আমি ভালো থাকবো, নিজের পায়ে দাঁড়াবো বলে ঘর ছেড়ে ছিলাম। তাহলে আজ কেন কষ্ট পাচ্ছি ? কেন হাল ছেড়ে দিচ্ছি ? এ ঘটনা তো যে কোন দিন ঘটতে পারতো। আমাকে আরো শক্ত হতে হবে। যে বাঁধন ছেড়ে চলে এসেছি ,তার দিকে পিছু ফিরে তাকানোর কোন মানে হয় না আজ আর। তাছাড়া এরা তো বদলায়নি। আর কখনোই বদলাবে না। এই তো বুনি এতোগুলো লোকের মাঝে আজও আমাকে আপমান করতে ছাড়লো না। তবে কেন এসেছি আমি এখানে ? সব সম্পর্ক তো চুকে বুকে গেছে। আমাকে অনেক দূরে চলে যেতে হবে। যেখানে এদের কোন খবর আর আমার কানে পৌঁছাবে না।

তাছাড়া সৌহার্দ্যবাবুকে নিয়েও ওরা নানা কথা ভাবছে। যার একটাও ঠিক নয়। লজ্জায় আমার মাথা নীচু হয়ে যাচ্ছে ওনার কাছে। এটা ওদের স্বভাব। তবে আজ আমি যদি নিজের জীবন নিজের মত গুছিয়ে নেই এদের কিছু বলার নেই। আমি আইনত এদের কেউ নয়।

“তুমি এখনো দাঁড়িয়ে আছো যে ? কি দেখবে বলে দাঁড়িয়ে আছো? চিতার আগুন ? এখনো সখ মেটেনি ? “বলে বুনি।

“তুমি ভদ্রভাবে কথা বলো বুনি। তোমার মত তথাকথিত শিক্ষিত মানুষের কাছ থেকে অবশ্য এমন ব‍্যবহারই আশা করা যায় । তোমাদের ভাষায় আমার মত এই অশিক্ষিত মানুষেরও তোমার ব‍্যবহারে মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছা করছে। আমি কিন্তু এখন আর আগের মত নেই। সব অপমান হজম করবো না মুখ বুজে মনে রেখো। আমার কোন দায়ও কিন্তু নেই আজ।–বলে অমৃতা।

“তাহলে এখানে এসেছো কেন ? মজা দেখতে নাকি সম্পত্তি নিতে ?–বলে বুনি।

” হ‍্যাঁ, আমি বুঝতে পেরেছি তোমার রাগের কারন। আমাকে দেখে ভয় পেয়েছো। যদি কিছু দাবী করি? নাহলে মাকে তো সেই বৃদ্ধাশ্রমে ফেলে রেখে দিয়েছো। কখনো খোঁজ নাও না। হঠাৎ আজ ছুটে এসেছো শুধু কি দাদার মৃত্যু খবরে ?নাকি সম্পত্তি হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার ভয়ে ?– চোয়াল শক্ত করে বলে অমৃতা।

“তুমি কি করে জানলে যে আমি আমার মায়ের খোঁজ নেই কিনা? গায়ে পড়ে ঝগড়া করতে এসেছো ? মা তো ভালো জায়গাতেই আছে। তুমি ভাবতেও পারবে না ,মা ওখানে কত ভালো আছে ?সমস্ত ব‍্যবস্থা করা আছে। মাসে মাসে অনেক টাকা পাঠাই সেটা জানো ? যাক, স কথা তোমাকে বলে কি হবে ?-গর্বের সাথে বলে বুনি।

“না, না । আমি ঝগড়া করতেও আসিনি । কিছু নিতেও আসিনি। একজন অসহায় বৃদ্ধা যার ছেলে ,মেয়ে তাঁকে নিজের কাছে না রেখে দায়িত্ব এড়িয়ে বৃদ্ধাশ্রমে ফেলে রেখে দিয়েছে, তার করুন আর্তীতে আমি ছুটে এসেছিলাম। কোন সম্পর্কের বাঁধনে নয়। এই যে তুমি চলে এসেছো। এবার আমি চলে যাবো। তোমার ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি থাকতে আসিনি।
আর হ‍্যাঁ, তোমার জানার জন্য বলে রাখি , তোমার মা কিন্তু আমাদের আশ্রমেই থাকেন। আমার হাত ধরে তিনবেলা কাঁদেন বাড়িতে ফিরে আসার জন্য। আজ উনি অনুতপ্ত। তুমিও একদিন হবে। এই ঔদ্ধত্য বেশীদিন থাকবে না। তাই কত ভালো রেখেছো তোমার মাকে সেটা আমি ভালো করেই জানি।

আজ তোমার মন মাথা ভালো নেই বুনি । আমি বেশী কথা বলবো না। চলে যাবো কিছুক্ষন পরে। শুধু ডেড বডিটা একটু আসতে দাও। ভয় পেয়োনা। আমি কিছু দাবী করবো না।” –বলে অমৃতা

এমন সময় প্রতিমা দেবী উঠে আসেন আস্তে আস্তে। অমৃতার হাত ধরে বলে বৌমা তুমি যেওনা। আমি বলছি এবাড়ি আমি তোমার নামে লিখে দেবো। তুমি যেওনা বৌমা। আমার ছেলে চলে গেছে আমার ভুলে। আমি তোমাকে আর হারাতে চাই না। বুনির কথায় তুমি কিছু মনে করো না।”

“আমি কখনোই আপনার কাছে টাকা, পয়সা, সম্পত্তি চাইনি। শুধু একটু ভালোবাসা চেয়ে ছিলাম ।সেটা যদি দিতে পরতেন তাহলে আজ হয়তো আপনাকে বা আমাকে এই দিনটা দেখত হতো না। তাছাড়া যার জন্য এবাড়িতে আসা সেই যখন নেই, তখন তার টাকা দিয়ে আমি কি করবো ? বলে অমৃতা।

আজ সব বুঝতে পারছেন প্রতিমাদেবী। যদি একটু আগে, আর একটু সহানুভূতি , ভালোবাসা দিতো অমৃতাকে , তাহলে সে হয়তো বাড়ি ছাড়তো না। একফোঁটা চোখের জল পড়ে নীরবে সবার আড়ালে।

ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে অমৃতা–বুনি, মানুষকে আঘাত করা খুব সহজ জানোতো। কিন্তু ভালোবাসা এতোটা সহজ নয়। আর মানুষ কি পরিস্থিতিতে কি কাজ করে সে শুধু যে পরিস্থিতির শিকার হয় সে বোঝে। দেখ তোমার মা কিন্তু বুঝেছেন আজ তার পাশে কেউ নেই। তুমি কিন্তু ওনাকে তোমার কাছে নিয়ে যাবে না। ছেলেও নেই। আজ যদি আমি থাকি তাহলে উনি হয়তো বাড়িতে থাকতে পারবেন। নাহলে তুমি তো বাড়ি বিক্রি করে চলে যাবে। বিদেশ ছেড়ে এখানে তো থাকতে আসবে না নিশ্চয়ই ।

এতো বছর পর তোমার মা বুঝতে পেরেছেন যে আমি ওতোটা খারাপ ছিলাম না। অথচ দেখো তুমি ভয় পাচ্ছো । ভাবছো সব সম্পতি মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে আমি না নিয়ে নিই। আমি ওতোটাও খারাপ নয়। নেওয়ার হলে তো অনেক কিছু দাবী করতে পারতাম বুনি। কিছু তো চাইনি আমি তোমার দাদার কাছে। মিউচ্যুয়াল ডিভোর্স দিয়ে দিয়েছি। আজ কেন চাইবো ? আমি সত্যিই তোমাদের সাথে কোন সম্পর্ক রাখতে চাইনা। ওনার সাথে হঠাৎ করেই আমার আশ্রমে দেখা হয়ে যায়।বারবার আশ্রমে আমার নাম করছিলেন । তাই ছুটে এসেছিলাম মানবিকতার খাতিরে। তাছাড়া তোমার দাদার সাথে এতোদিন সংসার করেছি। তাই এলাম শেষ বিদায় জানাতে। কোনকিছুর দাবী নিয়ে আসিনি।
তবে এমন অভ‍্যর্থনা পাবো সেটা ভেবেই এসেছিলাম। তুমি কিছু মনে করো না।

আর সৌহার্দ্যবাবুকে দেখিয়ে যে ইঙ্গিত তোমারা করছো সেটা ঠিক নয়। সব সম্পর্ক কুৎসিত হয় না। মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভর করে। উনি আমার বিপদে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন বন্ধুর মত। আর দুর্ভাগ্যক্রমে সেই বন্ধু হলো ছেলেবন্ধু। তাই এতো কথা হচ্ছে। তবে সে যাইহোক এতো কৈফিয়ত তো আমি তোমাকে দেবো না। তুমি এসে গেছো । এবার আমি চললাম। আর হ‍্যাঁ, পারলে তোমার মাকে তুমি সাথে করে নিতে যেও। এতো ভালো জায়গায় না রেখে নিজের কাছে নিয়ে রেখো। তাহলে উনি বেশী ভালো থাকবেন। বলে গটগট করে বেরিয়ে এলো অমৃতা।

এসব কি হচ্ছে তার জীবনে ? এগুলো তো সিনেমাতে হয়। না, না এখানে আর থাকা চলে না। আর কোনভাবেই আমি পিছন ফিরে তাকাবো না। আমার উদ্দেশ্য ছিল নিজের পায়ে দাঁড়ানো। রাতুলকে উপযুক্ত জবাব দেওয়া। কিন্তু সে তো আমাকে দোষের ভাগী করে পালিয়ে গেল। আর এদের সাথে কোন সম্পর্ক রাখবো না। দরকার হলে সব ছেড়ে আরো দূরে চলে যাবো। যেখানে এদের কোন কথা আমার কানে আসবে না।

রাতুলকে নিয়ে এসেছে। দূর থেকে শেষ বিদায় জানিয়ে চলে যেতে হবে। আর কোনদিন এদিকে আসবো না। আমাকে ঘুরে দাঁড়াতেই হবে। সুস্থভাবে বাঁচতে হবে। তবুও স্মৃতি কেন বারবার পিছু ডাকছে ?

সেদিন বাড়িতে ফিরে এসে খুব কেঁদেছিল অমৃতা ।সবাই আজ তাকে লোভী স্বার্থপর ভাবছে। রাতুলের মৃত্যুর জন্য তাকেই দোষারোপ করছে। এসব তাকে শুনতে হতো না, যদি না সে রাতুলের বাড়িতে যেত। কেন গেল সে ? যে তার ভালোবাসার দাম দিলো না, মনের খোঁজ নিলো না , তার জন্য কিসের কষ্ট তার ? যদি কঠিন অসুখ না হতো তাহলে তার জীবন হয়তো দুর্বিসহ করে তুলতো রাতুল। যেমন শুরু করেছিল। তবে সে কেন একটু একটু করে আবার ওদের সাথেই জড়িয়ে পড়ছে ? আর না । অনেক হয়েছে। আর ওদের কথা ভাবা যাবে না।তবে এখানে থাকলে তাকে আবার এমন পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হবে। বুনি নিশ্চয়ই ওর মাকে নিয়ে যাবেনা । পাঠিয়ে দেবে এই আশ্রমে। আবার আমার সমস্যা হবে। তাই আর এখানে নয়। কিন্তু কোথায় যাবো ? এভাবে পালিয়ে পালিয়ে কতদিন বাঁচতে পারবো ?

সেদিন রাতেই কাউকে কিছু না বলে , একটি চিঠি লিখে বাড়ি ছেড়ে চলে আসে অমৃতা। ভাগ্য তাকে কোথায় নিয়ে যাবে তা সে নিজেও জানে না। ইচ্ছা ছিল সবকিছু ছেড়ে , কিছুদিনের জন্য একা থাকা। নিজের সাথে নিজের লড়াই করা। অনেক কষ্টে ঘুরে দাঁড়াতে গিয়েও আবার সে হোঁচট খেয়েছে। আর না। এবার শক্ত হাতে হাল ধরতে হবে। তার আগে কিছুদিন একা থাকা খুব দরকার।

অমৃতা উঠেছে না দেখে বাড়িওয়ালী মাসিমা ডাকাডাকি শুরু করেন। হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। যা চলছে মেয়েটার উপর দিয়ে ! কিন্তু ঘরে এসে দেখেন সে ঘরে নেই। কোথায় গেল এতো সকালে মেয়েটা ? আশ্রমে যায়নি তো ? এদিক ওদিক খুঁজতে খুঁজতে একটি চিঠি পান টেবিলের উপর। ওনাদের উদ্দেশ্য করেই লেখা। চিঠিটা এনে দেন স্বামীর হাতে । আস্তে আস্তে খোলেন চিঠিটা মলয়বাবু। তাঁকে উদ্দেশ্য করেই লেখা–

শ্রদ্ধেয় মেশোমোশাই,

আজ আপনাকে না বলেই আমাকে চলে যেতে হচ্ছে। বললে হয়তো আটকে দিতেন ।আপনারা আমাকে ভালোবাসেন যে । কিন্তু আমি সেই ভালোবাসার দাম দিতে পারলাম না। এই বয়সে নিশ্চিন্ত জীবন কাটাবেন এটাই স্বাভাবিক। আপনার পরিবারে কোন সমস্যাও নেই। কিন্তু বারবার আপনারা আমার সমস্যায় জড়িয়ে পড়ছেন। মেয়ের মত ভালোবাসেন বলে এগিয়েও আসছেন সমাধান করতে। কিন্তু আমি তো এভাবে আপনাদের কষ্ট দিতে পারিনা।

একটু একটু করে যখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছিলাম, তখনই এতোগুলো টাকা মার হয়ে গেল । মেরুদন্ড ভেঙে দিয়ে গেল আমার। তারপর আবার রাতুলের বাড়ির ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ি। আমি চাইনা যে সম্পর্ক ভেঙে গেছে,তা আবার নতুন করে গড়তে। আর কার সাথেই বা গড়বো ? সে তো আর নেই। কিন্তু এখনে থাকলে রাতুলের মায়ের সাথে আমি আবার জড়িয়ে পড়বো। আমি কিছুতেই ঘুরে দাঁড়াতে পারবো না। তাই এই সিন্ধান্ত নিলাম।
আপনাদের ঋন আমি কোনদিন ভুলবো না। বাড়ি ভাড়ার টাকা আপনার একাউন্টে পাঠিয়ে দিয়েছি। আশ্রমের সব কাজ রমাদিকে বুঝিয়ে দিয়েছি। কোন অসুবিধা হবে না ।

এবার আমি আসি। রাগ করবেন না দয়া করে। এখনই আমি আমার ঠিকানা দিতে পারছি না। পরে অবশ্যই যোগাযোগ করবো কখনো। আমি যে সব ভুলে আবার নতুন করে শুরু করতে চাই নতুন পরিবেশে। জানিনা এভাবে আর কতদিন ঠিকানা খুঁজে বেড়াতে হবে ? আর কতদিন লাগবে নিজের পরিচয় তৈরি করতে ?

আমার প্রনাম নেবেন আপনি ও মাসিমা। ভালো থাকবেন।

ইতি
অমৃতা।

চিঠি পড়ে অবাক হয়ে যান মলয়বাবু । এভাবে কাউকে কিছু না বলে কোথায় গেল মেয়েটা ? আপনারা কিছু অনুমান করতে পারেন ?

চলবে—–
All rights are reserved by paramita mandal.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here