নিজের পরিচয়ে বাঁচতে চাই পর্ব-১৭

0
321

নিজের পরিচয়ে বাঁচতে চাই।( পর্ব– ১৭)
কলমে– পারমিতা মন্ডল।

আস্তে আস্তে কাপড় সরিয়ে দেয় রামু। খ‍্যাঁক খ‍্যা়ঁক করে বলে ওঠে রামু “তাড়াতাড়ি দেখুন দিদিমনি। আমার অন‍্যত্র বিস্তার কাজ পড়ে আছে। এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে না। এতো লোক আছে তবুও শুধু রামুকে ডাকবে সব কাজে। অথচ দেখো পয়সা দেওয়ার বেলায় নেই। দশটা টাকা বেশী চাইতে যাও অমনি হাজারটা কথা শুনিয়ে দেবে। ” –বলে গজ গজ করতে থাকে রামু।

সত্যিই মানুষের জীবন বড় বিচিত্র । প্রিয়জনের মৃত্যুতে আমরা ভেঙে পড়ি । তাকে শেষ বিদায় দিতে মন চায় না, কান্নায় ভেঙে পড়ি, অথচ কারো কারো রুজি রোজগার হয় এই মৃত মানুষদের নিয়ে। যেমন এই রামুকে সামলাতে হচ্ছে মর্গ ,তেমন চন্ডালকে সামলাতে হয় শশ্মান ঘাট। তাই এদের কাছে মৃত্যুটা আর পাঁচটা ঘটনার মত। মনে কোন রেখাপাত করে না।

“ভালো করে দেখো দেখিনি তোমরা যাকে খুঁজছো এ সে কিনা ? যদি সে হয় , তাহলে আমাকে কিন্তু বকশিশ দিতে হবে, বলে দিলাম। শত হলেও আমি তো তোমাদের এই ঘরে নিয়ে এলাম। তবে হ‍্যাঁ বাপু এই কথাটা যেন বড় বাবুকে আবার বলে দিওনা তোমরা । তাহলে রাগ করবে।”–বলে রামু।

“না, না ঠিক আছে , তুমি বকশিশ পাবে । চিন্তা করো না। এবার ঢাকাটা খোল দেখি।” বলে সৌহার্দ্য।

রামু কাপড়টা সরিয়ে দেয়। সামনে শুয়ে আছে বড় করুন ফ‍্যাকাসে একটি মুখ। যে অনেকটা লড়াই করেও হয়তো হেরে গেছে শেষে। কিন্তু মুখের মধ্যে দৃঢ়তা প্রকাশ পাচ্ছে। এ মুখ প্রতিটি ঘরে ঘরে আছে। লড়তে লড়তে শেষ হয়ে যাওয়া একটি মুখের প্রতিচ্ছবি । যারা নিজের সবটুকু নিঙড়ে দিয়েও কখনো নিজে সুখী হতে না পেরে হেরে যাওয়া একটি মুখ। তবে এ মেয়েটি অমৃতা নয়। অমৃতার মতোই হয়তো অন‍্য কোন অভাগী।

সুজাতা দেখ চেয়ে একবার , এ আমাদের অমৃতা নয় রে । ভালো করে দেখ । চিৎকার করে বলে ওঠে সৌহার্দ্য।

সৌহার্দ্যের চিৎকারে সম্বিত ফিরে পায় সুজাতা। এক ঝটকায় ঘুরে যায় সামনে। নিথর মেয়েটির শরীরের উপর ঝুঁকে পড়ে ভালো করে দেখে সুজাতা। সত্যি তো, এ তো অমৃতা নয়। মনে মনে খুব আনন্দ পায় সুজাতা। খুশী হয়। তাহলে কোথায় গেল অমৃতা ? অন‍্য কোন মর্গে শেষ নিদ্রায় শুয়ে নেই তো ? কিভাবে খুঁজে পাবো তাকে ?

কেউ হারিয়ে গেলে হয়তো এক সময় তাকে খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু কেউ যদি নিজের থেকে লুকিয়ে থাকে ,তবে তাকে খুঁজে পাওয়া সত্যিই কঠিন। তাই সুজাতাও আর খুঁজে পেলো না অমৃতাকে । এভাবে কেটে গেছে বেশ কিছুদিন। মানুষ চোখের আড়াল হলে মনের ও আড়াল হয়। তাই আস্তে আস্তে অমৃতাও যেন কোথায় হারিয়ে যেতে থাকে সবার মন থেকে। যে যার কাজ নিয়ে ব‍্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু অমৃতার হারিয়ে যাওয়াটা খুবই রহস্যময় হয়ে থেকে যায় । একটা মানুষ এভাবে কর্পুরের মত উবে গেল কোথায় ?

সেদিন সকাল এগারোটার । নোয়াপাড়া থানা প্রচণ্ড ব‍্যস্ত। কাজকর্ম শুরু হয়েছে। সবাই চারিদিক ছোটাছুটি শুরু করে দিয়েছে। থানায় কত লোক আসছে, যাচ্ছে । কাজের প্রথম দিন । তাই চারিদিকে খুব ব‍্যস্ততা। ঠিক এই সময় তিরিশ- বত্রিশ বছর বয়সী একটি মেয়ে থানায় ঢোকে । ধীর পায়ে এগিয়ে যায় বড়বাবুর ঘরের দিকে। কিন্তু সিকিউরিটি এসে আটকে দেয় ।
বলে-” এভাবে তো ঢোকা যাবে না ম‍্যাডাম। আগে আমি পারমিশন নিয়ে আসি তারপর আপনি যাবেন বড়বাবুর ঘরে।”

“দেখুন আমার ওনার সাথে খুব দরকার। অনেক দূর থেকে এসেছি। একবার দেখা করতে দিন। সত্যিই আমার ভীষণ দরকার। “–বলেন আগন্তুক মেয়েটি।

“দেখুন ম‍্যাডাম এভাবে তো ঢুকতে দেওয়ার নিয়ম নেই। আপনি একটু দাঁড়ান। আমি স‍্যারকে বলে পারমিশন নিয়ে আসি। তারপর ভিতরে যাবেন।”– বলে সিকিউরিটি।

“আচ্ছা ঠিক আছে । আমি অপেক্ষা করছি। “–ম্লান হেসে বলে আগন্তুক মেয়েটি।

” কিন্তু ম‍্যাডাম আপনার নাম কি বলবো ? ” জানতে চায় সিকিউরিটি।

“আমার নাম বললে চিনতে পারবেন না । বলবেন একজন মহিলা খুব জরুরি দরকারে দেখা করতে এসেছেন । আমার যা দরকার ওনাকে বলবো। তিনি যেন একবার দয়া করে আমাকে দেখা করার অনুমতি দেন ।” বলে আগন্তুক মেয়েটি।

“ঠিক আছে ম‍্যাডাম আমি বলছি। কিন্তু উনি তো ব‍্যস্ত মানুষ। জানি না দেখা করবেন কিনা ? আপনি 2nd অফিসার মানে মুখার্জি স‍্যারকেও বলতে পারেন। আসলে স‍্যার তো খুব ব‍্যস্ত। সবার সাথে দেখা করেন না। তাও আমি গিয়ে বলছি আপনার কথা। “- বলে সিকিউরিটি।

কিছুক্ষন পরেই সিকিউরিটি ফিরে আসে। জানায় বড়বাবু অফিসে নেই। জরুরি কাজে বাইরে বেরিয়ে গেছেন। কোথায় যেন একটি মার্ডার কেস এসেছে। ফিরতে দেরী হবে।

শুনে তো আগন্তুক মহিলার মাথায় হাত। এতোদূর এসে শেষে কি সব পন্ড হয়ে যাবে ? জানাতে পারবে না বড়বাবুকে ? অন‍্য অফিসারদের তো অনেক বার জানানো হয়েছে। কেউ গুরুত্ব দিয়ে দেখেনি। আর একবার জানালেও দেখবে না। তাই সমস্ত ডকুমেন্ট যোগাড় করে নিয়ে এসেছে বড়বাবু হাতে তুলে দেবে বলে। উনি নাকি খুব ভালো মানুষ। কিন্তু উনি তো বেরিয়ে গেছেন। কখন আসবেন কেউ বলতে পারছে না। ঠিক আছে আমি অপেক্ষা করবো। কারন আর একদিন আসা সম্ভব নয় এতো দূর থেকে। সময়ও হবে না। মনে মনে ভাবে আগন্তুক মেয়েটি।

প্রায় দু’ঘন্টা অপেক্ষা করার পর বড়বাবু ফিরলেন। তার কিছুক্ষন পর সিকিউরিটি এসে ডেকে নিয়ে যান আগন্তুক মেয়েটিকে। দুর থেকে ঘর দেখিয়ে দিয়ে চলে যায় সিকিউরিটি।

উনি ভিতরে প্রবেশ করলে বড়বাবু বসতে বলেন। না তাকিয়েই বলেন -“কি সমস্যা ? স্বামীর সাথে ঝগড়া ? শ্বশুর বাড়িতে অত‍্যাচার ? ডিভোর্স কেস ? উকিল ধরুন না ? আমার কাছে কেন ? নাকি স্বামী পালিয়েছে অন্য মেয়ে নিয়ে ?”

“এসব যা তা কি বলছেন আপনি ? শুনেছিলাম আপনি খুব ভালো মানুষ ? কিন্তু এ কেমন ব‍্যবহার আপনার ? আমার কথা না শুনেই উল্টোপাল্টা বলতে শুরু করেছেন ?অসহিষ্ণু হয়ে বলে ওঠে আগন্তুক মেয়েটি।

এবার বড়বাবু চোখ তুলে তাকান । এই বয়সী মহিলার কি দরকার থাকতে পারে ওনার কাছে ? দেখতে বেশ সুন্দরী। কিন্তু মুখের মধ্যে বেশ একটা দৃঢ়তা আছে । কিন্তু ওনাকে কোথায় যেন দেখেছি । কোথায় দেখেছি ঠিক মনে করতে পারছি না। কিন্তু খুব চেনা লাগছে। মনে মনে ভাবেন বড়বাবু।

মুখে বলেন–“বলছি আপনাকে না , খুব চেনা চেনা লাগছে । কোথায় যেন দেখেছি। আপনি কি আগে কখনো এসেছিলেন থানায় ? ”

“না, না এই প্রথম বার এলাম। এর আগে আমার উকিল এসেছে। আসলে আমি একটা —

কথা কেটে দেন বড়বাবু । দাঁড়ান আমি একটু আসছি । আমার জরুরি একটা ফোন করার আছে। এসে শুনছি। বলে উঠে যান বড়বাবু।

আর ধৈর্য ধরতে পারেনা আগন্তুক মেয়েটি। একে তো এতো দেরী করে এলেন তারপর আবার উঠে গেলেন। এই জন্য লোকে আজকাল আর পুলিশের উপর ভরসা করে না । বড্ড ঘোরায় । কি জানি আমার কাজ হবে কিনা ? তবে আমিও ছাড়বো না । পিছনে লেগে থাকবো। মনে মনে ভাবেন আগন্তুক মেয়েটি।

সেই যে চলে গেলেন বড়বাবু। বহুক্ষণ অপেক্ষা করেও আর ফিরে আসছেন না দেখে বাইরে বেরতে যান আগন্তুক মেয়েটি। কিন্তু সিকিউরিটি এসে আটকে দেয়। বলে-” স‍্যার আপনাকে অপেক্ষা করতে বলেছেন। আর বাইরে যেতে বারন করেছেন।”

মাথা গরম হয়ে যায় আগন্তুক মেয়েটির । বলে “এসবের মানে কি ? এতোক্ষন বসিয়ে রেখে উনি এলেন পাঁচ মিনিটের জন্য। আমার সমস্যাটা বলতেও পারলাম না উঠে চলে গেলেন । এখন আবার বলছেন আপেক্ষা করতে ? আমাদের সময়ের কি কোন দাম নেই ? “বলে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দেয় আগন্তুক মেয়েটি।

একে তো সারাদিন খাওয়া হয়নি । তারপর একটা অভিযোগ করত এসে যদি এভাবে হেনস্থা হতে হয় ,তাহলে এদের উপর মানুষের আর কোন আস্থাই থাকবে না। এই জন্য সাধারণ মানুষ পুলিশকে আর বিশ্বাস করতে চায় না।

“ম‍্যাডাম এতো উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন কেন ? এই তো আমি এসে গেছি। হ‍্যাঁ, বলুন আপনার সমস্যা ?

আপনি কেন সিকিউরিটিকে বলে গেছেন -” আমাকে বাইরে যেতে না দিতে ? আমি কি চোর না ডাকাত ? কেন বলে গেছেন এমন কথা ?

” দুঃখিত ম‍্যাডাম আপনাকে এতক্ষন বসিয়ে রাখার জন্য । আসলে আপনাকে দেখে আমার খুব চেনা মনে হয়েছিল। কোথায় যেন দেখেছি মনে করতে পারছিলাম না । তাই পুরনো কেস হিস্ট্রি দেখতে যাই। আর সেখানেই আপনাকে আবিস্কার করি।” বলেন বড়বাবু।

“মানে ? কি বলতে চাইছেন আপনি ? আমার নাম পুলিশের খাতায় ? আপনি কি পাগল হয়ে গেলেন ? আমার নাম কেন পুলিশের খাতায় থাকবে ? দেখুন কথা ঘোরাবেন না ? আমি একটি জরুরি কাজে এসেছি। সেটা আমাকে বলার সুযোগ দিন।” বলে আগন্তুক মেয়েটি।

উনি ঠিক বলছেন । পুলিশের খাতাতেই আপনার নাম আছে।তাই তো আপনাকে এতোক্ষন বসিয়ে রেখেছেন। আর সেই না লিখিয়েছি আমরা।

পিছন ঘুরে তাকান আগন্তুক মেয়েটি। এ কাদের দেখছে সে ? এরা কোথা থেকে এলো এখানে ?

“দেখ তো ভালো করে চিনতে পারিস কিনা অমৃতা ? তুই এভাবে কাউকে কিছু না বলে কোথায় চলে গেলি ? জানিস তোকে কত খুঁজেছি ? থানায় মিসিং ডাইরি করেছিলাম। এই বড়বাবুর কাছে। কিন্তু কেউ তোকে খুঁজে পায়নি । এতো অভিমান হলো তোর আমাদের উপর ? একবার বলে গেলি না ? “বলে জড়িয়ে ধরে সুজাতা।

আসলে থানায় মিসিং ডাইরিতে যে ছবি দেওয়া ছিল তার সাথে আপনার মুখ মিলে যায়। তাই আপনাকে দেখে আমার খুব চেনা লাগছিল। ঐ সময় অনেক খোঁজাখুঁজি হয়েছে আপনাকে। এমনকি মর্গ পর্যন্ত ও খুঁজেছি আমরা। কিন্তু পাইনি। এটা আমাদের ব‍্যর্থতা। বলতে বাধা নেই। তাই আপনাকে দেখে আমার সেই মুখটা মনে পড়ে যায়। আমি ভিতরে গিয়ে ছবির সাথে মিলিয়ে দেখি। দেখি সম্পূর্ণ মিলে যায়। তাই ওখানে যে ফোন নাম্বার দেওয়া ছিল তার সাথে যোগাযোগ করে এনাদের ডেকে আনি। –বলেন বড়বাবু।

“হ‍্যাঁ ,রে অমৃতা । আমরা বলি তোকে বসিয়ে রাখতে । তারপর সৌহার্দ্যকে নিয়ে তড়িঘড়ি আমি চলে আসি। তুই আমাদের এতোটা পর ভাবলি অমৃতা ? জানিস তোকে পাগলের মত কোথায় কোথায় খুঁজেছি।”–বলে সুজাতা।

“ওনাকে বলে কোন লাভ নেই। উনি আপনাকে বন্ধুই ভাবেন না । আর আমাকে তো নয়ই। “বলে সৌহার্দ্য।

“এতো রাগ করিস না সুজাতা । আসলে খুব দরকার ছিল আমার এইটুকু লুকোচুরির । তোকে সব কথা বলবো। তোকে বলে এলে তুই আটকে দিতিস। আমার উদ্দেশ্য সফল হতো না। তবে তোরা আমাকে এতো দুর্বল ভাবলি কি করে ? আমি সুইসাইড করবো ? কখনোই না । আমি হেরে যাবো না। হারবো বলে তো ঘর ছাড়িনি। আর রাগ করিস না । ” বলে অমৃতা।

“ঠিক আছে চল আমার সাথে। আমার কাছে থাকবি। আর তোকে ছাড়বো না ।”

“না রে সুজাতা । আমি এখন ভালো আছি। সব কথা বলবো তোকে। তবে আজ নয়। তোরা চলে যা। আমি একদিন যাবো তোদের কাছে। আর একটু কাজ বাকি আছে। শেষ করি তারপর । রাগ করিসনা বন্ধু আমার। বলে অমৃতা আস্তে আস্তে বেরিয়ে যায় ঠিকানা না রেখে ।

কোথায় আছে অমৃতা ? কি কাজ বাকি আছে ? কেন সে থানায় এসেছিল ? জানতে চোখ রাখুন পরের পর্বে।

চলবে—–

All rights are reserved by paramita mandal.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here