নিজের পরিচয়ে বাঁচতে চাই।( পর্ব–২০)
কলমে– পারমিতা মন্ডল।
জীবনটা যেন পায়ে পায়ে জড়িয়ে ধরছে। কিছুতেই উপরে উঠতে দিচ্ছে না। একটি মানুষের জীবনে এতো ঝড় ঝাপটা থাকে ? কি অপরাধ ছিল আমার ? শুধু অন্যায়ের প্রতিবাদ করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেয়েছি। একটু ভালো থাকতে চেয়েছি। শ্বশুরবাড়ি ,বাড়ি বাবার বাড়ি কেউ আশ্রয় দিলো না।অথচ তাদের কিন্তু ছেড়ে দিতে পারলাম না। বিপদে পাশে গিয়ে দাঁড়াতে হলো। মেয়েরা তো মায়ের জাত । তাই ইচ্ছা করলেও অনেক কিছু করতে পারেনা। যেমন আমি পারলাম না ;ওরকম দর্জাল শাশুড়িকে শাস্তি দিতে। যে বাবা তাড়িয়ে দিলো ,যার জন্য পথে পথে ঘুরছি আজও ।তবুও তার অসুস্থতায় মন অস্থির হয়ে উঠেছে। এখনই ছুটে যেতে ইচ্ছা করছে বাবার কাছে। গলা জড়িয়ে ধরে বলতে ইচ্ছা করছে তোমার কিছু হবে না বাবা। আমি তো আছি। কিন্তু সেই মনের জোর কেন পাচ্ছি না।
একটি অদৃশ্য দাগ আজ দুজনের মাঝে চলে এসেছে। যা শত চেষ্টা করেও আর মোছা যাবে না। তবুও বাবা তো ? তিনি আমাকে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছেন ।এতো বড় করেছেন, সব দায়িত্ব সামলে বিয়েও দিয়ে ছিলেন। আমি সংসার করতে পারিনি। সেটা আমার কপালের দোষ । বাবা তো চেয়েছিল আমি সুখী হই। তাইতো ভালো ছেলে দেখে বিয়েও দিয়েছিল। বাবার উপর আমার শুধু একটাই রাগ , আমার এই লড়াইতে যদি আমার পাশে থাকতো ? আমার একটু সুবিধা হতো ঘুরে দাঁড়াতে।
আসলে পুরনো দিনের মানুষ তো।ধ্যান ধারনা এখনো পুরনো। তারপর মা মারা যাওয়ার পর অসুস্থ দিদিকে নিয়ে বাবা অনেক লড়াই করেছেন। তখনো লোকে অনেক কথা বলেছে। ক্যানসার আক্রান্ত মেয়ের তো বিয়ে হবে না । আর একথা জানতে পারলে ছোটটার ও বিয়ে হবে না । যদিও মানুষ এখন বোঝে যে ক্যানসার ছোঁয়াচে বা বংশগত নয়। কিন্তু অনেকে বুঝেও না বোঝার ভান করে। ভয় দেখায় । তাই দিদি মারা যাওয়ার পর বাবা মানষিক দিক থেকে ভেঙে পড়েছিল। তারপর আমার এই খবরটা । তাই হয়তো মেনে নিতে পারেনি। হয়তো ভেবেছিল রাগারাগি করলে, জায়গা না দিলে ফিরে যাবো শ্বশুর বাড়িতে।কিন্তু আমি যে বেরিয়ে এসে, এভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করবো সেটা হয়তো ভাবেনি বাবা।
এরকম ভুল অনেক বাবা মা করে থাকেন।” আর একটু সহ্য কর, আর একটু মানিয়ে নে ” –বলে মেয়েদের চরম ক্ষতি করে দেয়। যদি একবার জানতে চায় “কেন থাকতে পারছে না ,অসুবিধা কোথায় ?”তাহলে অনেক প্রান হয়তো অকালে ঝরে যায় না । আমার মত মনের জোর সব মেয়ের থাকে না।এভাবেও নিঃস্ব হাতে ঘুরে দাঁড়ানো যায়, অনেক ভাবতেই পারে না।
যাইহোক বাবার কাছে তো যেতেই পারি। আর পারি কেন বলছি?মনটা তো ছুটে গেছে বাবার কাছে। এই পৃথিবীতে আজ একমাত্র বাবাই আছে আমার আপনজন। মানে রক্তের সম্পর্কের আপনজন। তবে রক্তের সম্পর্ক থাকলে সব সময় আপনজন হয়না। সুজাতা, মেসোমোশাই, প্রনীলদা এমনকি সৌহার্দ্যবাবু না থাকলে আমার লড়াই করা,ঘুরে দাঁড়ানো খুব কঠিন হয়ে পড়তো। তাই ওরাও আমার একান্ত আপনজন। নাই বা রইল তাদের সাথে রক্তের সম্পর্ক ?
আজ বহুদিন পর অমৃতা পা দিল তার বাবার বাড়িতে। হ্যাঁ, বাবারই বাড়ি। নিজের বাড়ি ভাবতে পারেনা। মেয়েদের তো এভাবেই তৈরি করা হয় ।বাবার বাড়ি আর শ্বশুরবাড়ি বলে। কোন মেয়ে যদি নিজের রোজগারে বাড়ি করে তবেই সেটা হয় তার নিজের বাড়ি। কিন্তু অমৃতা এখনো সেটা পারেনি।তবে খুব তাড়াতাড়ি করবে সে।
ওকে দেখে পিসি দৌড়ে আসে। “তুই এসেছিস ? এতো অভিমান করতে হয় মা ? তোর বাবা আমি কত করে তোকে ডাকলাম। তবুও এলি না ?।না হয় একটা ভুল তোর বাবা করেই ফেলেছিল ? তাই বলে এতো অভিমান করবি ?বলে পিসি।
“পিসি ওসব কথা থাক। বলো কেমন আছো তুমি ? আর বাবার কি হয়েছে ? কোন ডাক্তার দেখিয়েছে ?”বলে অমৃতা।
মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠেন পিসি। বল “তোর বাবাকে মনে হয় আর বাঁচানো যাবে না রে ? আমি একা মানুষ। দৌড়াদৌড়ি করতে পারি না। ঐ পাড়ার ছেলেরা ডাক্তার ডাকে, ঔষধ এনে দেয়। ওরা অনেক করে। তাই তো এখনো বেঁচে আছে। এবার তুই চলে এসেছিস । সব ঠিক হয়ে যাবে। বাবাকে তুই সুস্থ করে তোল মা।”
পিসি এতো কান্নাকাটি করো না । আমি এসেছি তো? ভয় পেয়োনা। দেখি কি করা যায় ? চলো বাবার ঘরে যাই। “বলে অমৃতা।
বহুদিন পর আবার সেই ঘর। কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই বাড়ি, ঘরের সাথে। এই বিছানা নিয়ে কাড়াকাড়ি। দিদির সাথে মারামারি। কে মায়ের পাশে শোবে ? তারপর বাবা এসে ঝামেলা মেটাতো। মাকে মাঝখানে রেখে দুই বোন দু”পাশে শুতাম। বাবাই ঠিক করে দিতো। মনে মনে হেসে ওঠে অমৃতা সেদিনের ছেলেমানুষির কথা ভেবে।
তারপর একদিন মা চলে যায়। হঠাৎই বিনা নোটিশে। আমাদের জন্য সারাদিন পরিশ্রম করতে করতে মা নিজের প্রতি যত্ন নিতো না। সব মায়েরা যেমন কর। কখন যে রোগে ধরে গেল বুঝতেও পারলো না। দুটো কিডনি নষ্ট হয়ে গেল। মাকে আর বাঁচানো যায়নি। তখন আমি খুব ছোট। বাবার তখন দিশেহারা অবস্থা। তবুও দুই বোনকে আঁকড়ে বাবা বেঁচে ছিল। মায়ের শূন্য জায়গায় এসে বাবা বসেছিল। পূরন করতে চেয়েছিল শূন্যস্থান। বাবাকে মাঝখানে রেখে দুইবোন দুদিকে শুতাম। ঠিক মায়ের মত। এভাবেই মায়ের জায়গা নিয়েছিল বাবা। সব মারামারি, ঝগড়া যেন এক নিমেষে শেষ হয়ে গিয়েছিল।
বাবা কিন্তু আবার নতুন করে সংসার পাতেনি। শুধু আমাদের জন্য। বড় ভীতু ছিল যে। আত্মীয় স্বজন অনেকেই বলেছিল আবার বিয়ে করতে। ছোট দুটো বাচ্চা নিয়ে কিভাবে অফিস করবে ? তারপর সংসারের কাজকর্ম। কিন্তু বাবা রাজি হয়নি। সৎ মা এসে যদি আমাদের না দেখে? তারপর বাবা পিসিকে নিয়ে এলো আমাদের বাড়িতে। পিসেমহাশয় মারা যাওয়ার পর পিসি বড় একা হয়ে পড়েছিল।
অথচ আমার সেই বাবা আমাকে আশ্রয় দিলো না। আসলে বাবা সংসার ভাঙার ভয় পেয়েছিল। নিজে যে ভুক্তভোগী ছিল।
ভাবতে ভাবতে বাবার ঘরে চলে আসে অমৃতা। আস্তে করে ডেকে বলে “বাবা কেমন আছো এখন ? ” কাছে গিয়ে হাত ধরে অমৃতা।
“কে এসেছে ? কে বাবা বলে ডাকলো আমায় ? “পাশ ফিরে তাকান উনি।
“অমৃতা ! মা এসেছিস ? এতো অভিমান করলি এই বুড়ো বাবাটার উপর ? একবার না হয় ভুল করেই ফেলেছি। আর কি সংশোধন করা যায় না ? তুই কি পারিস না আমাকে ক্ষমা করে দিয়ে আমার কাছে থাকতে ? বলে ঝরঝর করে কেঁদে দেন অমৃতার বাবা।
“বাবা এসব কথা এখন থাক। বলো তুমি এখন কেমন আছো ? শরীরের যা হাল করেছো ? ঔষধ খাচ্ছো না ঠিক করে ? কি বলছেন ডাক্তার কাকা ?” বলে অমৃতা।
“আমার আর বাঁচার ইচ্ছা নেই রে । লোকের কথা শুনে আমি আমার মেয়েকে তাড়িয়ে দিয়েছি। এটা তার শাস্তি। আমি সত্যিই বড় ভুল করেছি। আমার এতো বড় বাড়ি থাকতে তুই কেন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবি ? তোর পরিচয় তো আমি ? আমি তোর বাবা।” বলেন অমৃতার বাবা।
“তুমি আগে সুস্থ হও । তারপর এসব নিয়ে আলোচনা করা যাবে। তবে একটা কথা ঠিক যে, আমি তোমার মেয়ে। এটা একটা পরিচয় বটে। তবে খুব ঠুনকো । রাগ করোনা বাবা। তোমাকে অস্বীকার করছি না। ভুলে যাচ্ছি না তোমার অবদান। কিন্তু একটা বয়সের পর এই পরিচয় আর কোন কাজে লাগে না হয়তো। যদি সে মেয়ে হয় । আবার সে ডিভোর্সী বা বিধবা হয়। আর যদি তার বাবার ঘরে কোন পুত্র সন্তান থাকে তখন সে মেয়ে বোঝা হয়। তাই বাবা, ভাই বা স্বামীর পরিচয় নয় নিজের পরিচয় নিজেকে তৈরী করতে হবে। আর আমি সেই চেষ্টা করছি। আমার লড়াই সমাজের আর পাঁচটা মেয়েকে উৎসাহিত করবে বাবা। তাই তুমি আমাকে এখানে থাকতে বলো না। আমি সেই লড়াইতে অনেকটা এগিয়ে গেছি। মাঝপথে ছেড়ে দিয়ে চলে আসা মানে পরাজয় স্বীকার করা। তুমি কি চাও তোমার মেয়ে হেরে যাক ? ”
“তার মানে তোর এখনো রাগ কমেনি। আমাকে ক্ষমা করতে পারিসনি। কিন্তু আমি আর কতদিন বাঁচবো বল ? এই তো শেষের ডাক চলেই এলো ? আজ আছি কাল নেই। এখনো রাগ করে থাকবি ?”
বাবা এসব কথা এখন থাক। তুমি এখন কেমন আছো বলো ?শরীর তো একেবারে ভেঙে গেছে। পিসির পক্ষে তো তোমাকে দেখাশোনা করা সম্ভব নয়। তাই একজন আয়ার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। আমিও আসবো মাঝে মাঝে । তোমাকে দেখে যাবো। ফোন নাম্বার থাকবে। কথা বলবো তোমার সাথে। কিন্তু আমি যে কাজ করছি সেটা ছেড়ে এখনই চলে আসতে বলো না আমাকে। এটা আমাকে শেষ পর্যন্ত লড়তেই হবে। এবং একা। দেখি পারি কিনা ?” বলে অমৃতা।
অনেক কষ্টে ঐ আশ্রমে ঠাঁই পেয়েছে অমৃতা। তার বিপদে ওকে আশ্রয় দিয়েছে। সেই নিরপদ আশ্রয় ছেড়ে সে বাবার কাছে চলে আসতেই পারে । তহলে তো সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। কিন্তু সে তা করবে না। পরিস্থিতি তাকে বদলে দিয়েছে। শোক- তাপ- দুঃখ সব কিছুকে জয় করেছে অমৃতা। তাই এখন তার একটাই লক্ষ্য ,নিজের পায়ে দাঁড়ানো।
তাই বাবাকে সব ব্যবস্থা করে দিয়ে আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসে অমৃতা। সে এখন তার বাবার একমাত্র সন্তান। তাই বাবাকে দেখাশোনা করাটাও তার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। তবে বাবাকে ছেড়ে আসতে কষ্ট হচ্ছিলো । কিন্তু আশ্রমে যে ফিরতেই হবে। ওটাই তো তার এখন একমাত্র নিরাপদ ঠিকানা।
আশ্রমে ঢুকতে যাবে , এমন সময় দেখে গেটে ছোট্ট একটি জটলা। কেউ একজন উচ্চস্বরে কথা বলছেন। মনে হয় প্রচণ্ড রেগে গেছেন। কার সাথে ঝামেলা লাগলো রে বাবা ? ছুটকি দুলকি ওরা কিছু করেনি তো ? একটু উঁকি দিতেই দেখে রাগি ম্যাডাম। কিন্তু কার উপর রেগে গেলেন উনি ?
আগামী পর্বে সমাপ্ত।
All rights are reaerved by paramita mandal.