#আমার_ভুলপর্বঃ১৬
অরিত্রিকা আহানা
প্রিন্স বেরিয়ে যাবার পর আমি গেটের কাছে সায়মাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দৌঁড়ে গেলাম। ভেবেছিলাম ক্ষমা চেয়ে নিবো। মেয়েটার সঙ্গে বিনা কারণে খারাপ ব্যবহার করেছি।
কিন্তু প্রান্ত আমাকে সেই সুযোগটা পর্যন্ত দিলো না। সায়মার হাত ধরে টেনে ওকে গাড়ির কাছে নিয়ে গেলো। আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে গম্ভীর থমথমে গলায় সায়মাকে উদ্দেশ্য করে বললো,’আমি তোমাকে ভালোবাসি সায়মা। তাই এখান থেকে নিয়ে যেতে চাইছি। আমি চাইনা তুমি এই স্বার্থপর প্রকৃতির মেয়েমানুষটির সঙ্গে মেলামেশা করো। এসব মহিলাদের বিশ্বাস নেই। বলা যায় না কখন নিজের অন্তরের বিষ তোমার অন্তরেও ঢুকিয়ে দিলো।’
‘প্রান্ত!’ আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম!
কিন্তু আমার দুঃখ, কষ্ট বেদনা এসব কিছুই ওদের স্পর্শ করলো না। ওরা সবাই নিজেদের মত করে আমাকে দোষী ভেবে নিয়েছে। কাউকে আমি নিজের দুঃখ বোঝাতে পারি নি। আমি ব্যর্থ!
“আঘাত করবার একটা সীমা আছে। যেটাকে অতিক্রম করলে আঘাত অসুন্দর হয়ে উঠে। আর তখনই তার নাম হয় অবমাননা।” আমি জানি না নজরুল ঠিক কতটা আঘাত পেয়ে এইকথা গুলো বলেছিলেন। তবে আমি আঘাত পেয়েছি। আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে গেছি। সবাই মিলে আমার ভাঙাচোরা হৃদয়টাকে আঘাত দিয়ে দিয়ে একেবারে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে। এখন আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে না। বড্ড যন্ত্রণা হয়!
প্রিন্স হয়ত আমার চেয়ে অনেক বেশি আঘাত পেয়েছেন। আমি অন্যায় করেছিলাম উনার সঙ্গে। কিন্তু উনাকে বোঝার মতন মানুষ আছে। উনার না বলা কথাগুলো সবাই বোঝে।
কিন্তু আমার কেউ নেই! আমাকে সবাই সহানুভূতি দেখায়, মায়া দেখায় কিন্তু আমার সত্যিকারের অন্তরের খোঁজ কেউ নিতে পারে না! আফসোস শুধু এইটুকুই!
★
আমি জানতাম বিয়ের বাড়ির ঘটনা এত সহজে মিটবে না। ঐ ঘটনার এক সপ্তাহের মাথায় আমার শ্বশুর প্রান্ত আর প্রাপ্তিকে নিয়ে আমাদের বাসায় এলেন। প্রিন্স আসেন নি।
সেদিন বাড়ি ফেরার পর থেকেই আমার শরীর খারাপ। বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছি না। ইউনিভার্সিটি থেকে ছুটি নিয়েছি। আমি জানি আমার সংসারটা আর টিকবে না। এতবড় কান্ড ঘটানোর পর আর কোন মুখেই বা ক্ষমা চাইবো! তাছাড়া আমার ক্ষমা কেই বা চায়!
নিজেকে আমি সামলে নেওয়ার চেষ্টা করছি। মাথার ভেতর নানারকম চিন্তাভাবনা ঘুরপাক খায়। জীবনে যত ভুল করেছি সেগুলোর জন্য অনুতাপ হয়। মাঝে মাঝে আবার মনে হয় এর চেয়ে কত গুরুতর অপরাধ করেও তো মানুষ সুখে আছে। তবে আমার বেলায় কেন এমন হলো?
আমাকে তো কেউ ক্ষমা করলো না! আমার বেলাতেই পৃথিবীর সকল নিয়ম বদলে গেলো। সবাই কঠোর হয়ে গেলো! এসব ভাবতে ভাবতে আমার অন্তরে জ্বালা ধরে! সমস্ত পৃথিবীকে নিজের শত্রু মনে হয়।
আমি ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছি। ড্রয়িংরুমে যাই নি। তবে আলাপ আলোচনা সব আমার কানে এসেছে। আমার আর প্রিন্সের মাঝে যেই মানসিক দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে সেই বিষয় নিয়ে আলাপ করছেন আমার শ্বশুর। হয়ত এর পরে কাগজে কলমে দূরত্বের বিষয়টাও তুলবেন। আমি দাঁত কামড়ে পড়ে রইলাম। সিদ্ধান্ত নিয়েছি যত যাই হয়ে যাক আর কাঁদবো না।
মা এসে একবার জ্বর চেক করলেন। আর্দ্র কন্ঠে বললেন,’আমার এত বুঝের মেয়ে কি করে এমন অবুঝ হয়ে গেলো! তুই কি করে জামাইয়ের গায়ে হাত তুললি মা?’
মা দুঃখ পাচ্ছেন আমার সংসারটা ভেঙ্গে যাবে বলে। কিন্তু কেন সেদিন আমি এমন দিশেহারা উন্মাদের ন্যায় আচরণ করেছিলাম, কতটা ভয়, ভালোবাসা, আমার মধ্যে বিরাজ করছিলো একথা কেউ বুঝবে না। সবাই কেবল আমার বাইরের দিকটাই দেখে!
আমি জবাব দিলাম না। বিছানায় শুয়ে নিরবে দেয়াল ঘড়িটার দিকে চেয়ে ছিলাম। প্রাপ্তি পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢুকলো। আমার পাশে বসলো। নরম গলায় জানতে চাইলো কেমন আছি।
আমার অসুস্থতার কথা শুনেছে হয়ত।
হঠাৎ করে ক্ষোভ জন্ম নিলো। আর কোনকিছুর পরোয়া করতে মন চাইলো না। প্রিন্সকে যখন হারিয়েছি তখন আর কিসের ভয়! এরা সবাই মিলেই তো আমার সংসারটা ভেঙ্গে দিচ্ছে। বিদেশে থাকাকালীন একবারও আমাকে উনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেয় নি।
বিদ্রুপের হাসি হেসে বললাম,’তোরা যেমন দেখতে চেয়েছিলি। তেমনই আছি।’
-‘তোর কিসের এত রাগ সবার ওপর? বিয়েটা ভাংতে বসেছে তাও তুই এত আগ্রাসী। কেন? সেদিন ভাইয়াকেও অপমান করলি।’
-‘ডিভোর্স না হওয়া পর্যন্ত উনি আমার স্বামী। আমার স্বামীকে আমি কি কারণে আপমান করেছি সেই কৈফিয়ত আমি কাউকে দেবো না।’
প্রাপ্তি অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে রইলো। আমি তাচ্ছিল্যভরে হাসলাম। আর ওদের কাছে নরম হবো না। ওরা আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। কষ্ট দিয়ে দিয়ে আমাকে পাথর বানিয়ে দিয়েছে।
-‘তুই এখানে কেন এসেছিস? যা চেয়েছিলি সেটা তো পেয়ে গেছিস। এখন এসব নাটক করার কি মানে? চাকরী করতাম বলে তোদের সহ্য হতো না। নিজে তো পড়ালেখা করিস নি তাই আরেকজনের টাও তোদের সহ্য হয় নি। সবাই মিলে আমাকে উনার লাইফ থেকে ভাগানোর জন্য উঠেপড়ে লেগে গেলি।’
প্রাপ্তি অবাক হয়ে বললো,
-‘এসব তুই কি বলছিস? আমাদের তেমন মন মানসিকতা থাকলে প্রান্তর বউকে আমরা চাকরি করতে দিতাম? তুই ভাইয়ার সাথে কি করেছিস তোর মনে নেই? এখন আবার উলটো আমাদের দোষ দিচ্ছিস?’
-‘বেশ করেছি। করলে আমার স্বামীর সঙ্গে করেছি। তোদের কি! নিজের স্বামীকে তো ঠিকই হাত করে রেখেছিস। আমার বেলায় যত দোষ!’
এভাবেই নিজের ভুলভাল কথার মাধ্যমে উনি যে আমার একান্ত আপন, আমার স্বামী সেটা প্রমাণের চেষ্টা আমি অদ্ভুত রকমভাবে চালিয়ে গেলাম।
প্রাপ্তি গম্ভীর মুখ করে বললো,
-‘তোর স্বামী আমাদের ভাই। আমাদের আপনজন। তাকে অসম্মান করলে আমার গায়ে লাগবে। এটাই স্বাভাবিক।’
-‘হ্যাঁ। ভাইয়ের জন্য কতটুকু টান আর ভাইয়ের টাকার জন্য কতটুকু সেটা কেবল তোরাই ভালো জানিস। যা উঠে যা আমার সামনে থেকে। তোকে আমার ভালো লাগছে না।’
প্রাপ্তির চেহারা অস্বাভাবিক গম্ভীর হয়ে গেলো। আমি এত খোলামেলা ভাবে ওকে আক্রমণ করবো ও ভাবতেই পারে নি। ক্ষুদ্ধ কন্ঠে বললো,
-‘যাচ্ছি। কিন্তু যাবার আগে একটা কথা বলে যাই। তোর মতো মেয়েরা কোনো দিন স্বামী সংসার নিয়ে সুখি হতে পারে না। তোদের কপালে স্বামীসুখ নেই।’
আমি এমনিতেই মরেছি! তবে আর কিসের ভয়! আমিও সমান তেজে জবাব দিলাম,’হ্যাঁ। যা,যা তোর ভাইকে গিয়ে আবার বিয়ে করা। সেই বউকে মাথায় তুলে নাচ। আমার সঙ্গে কেন মুখ লাগাতে এসেছিস। আমি যেন কাঁদছি তোর ভাইয়ের জন্য!’
প্রাপ্তি বেরিয়ে গেলো। আমি ফাঁকা, শূন্য দৃষ্টিতে ওর যাওয়ার দিকে চেয়ে রইলাম। চোখের পানি গাল গড়িয়ে নিচে পড়ছে! মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে! মনে হচ্ছে মরে যাবো! আর পারলাম না! অসহ্য বেদনায় বালিশে মুখ ঢেকে হুহু করে কেঁদে ফেললাম। এত যন্ত্রণা! এত যন্ত্রণা! চারদিকে এত হতাশা! আমার স্বামীকে ওরা সবাই মিলে কেড়ে নিচ্ছে। আমার সংসার শেষ করে দিচ্ছে। ঐ মানুষটাকে আমি আর কোনোদিন কাছে পাবো না।