#প্রেমনোঙর_ফেলে,০২,০৩
#লেখনীতে-মিথিলা মাশরেকা
#পর্ব-২
বসন্ত উৎসব পালন উপলক্ষে ভার্সিটিতে আজ কনসার্ট আছে। ক্যাম্পাসের সুবিশাল মাঠে সুই ধারনের জায়গাটাও নেই। পুরো মাঠে লোকে লোকারন্য। বন্ধুমহল নিয়ে প্রত্যেকে মেতে আছে মনের মতো করে উল্লাস করবে বলে। স্টেজের সামনে দর্শকসমাজ বাধভাঙা স্বরে চেচিয়ে চলেছে,ইচ্ছে! ইচ্ছে! হওয়ারই কথা! ভীনদেশের লাখো দর্শক নিয়ে যার গানের সাম্রাজ্য,সে আজ এসেছে এই ভার্সিটিতে! সরাসরি শুনবে সবাই তার গান,সে মুহুর্তের জন্য অধীর হয়ে আছে প্রত্যেকে। আর সে মেয়েটা? গ্রিনরুমের এককোনে গুটিয়ে বসে আছে ইচ্ছে। গলার গিটার শেইপের লকেটটা চেপে ধরে শক্ত হয়ে রয়েছে ও। চোখ দিয়ে পানি পরছে না। তবে কেপেকেপে উঠছে একটু পরপরই। রাকা হন্তদন্ত হয়ে লক খুলে ভেতরে ঢুকে আবারো দরজা লক করে দিলো। ওর সামনে এসে হাটুগেরে বসে বললো,
-ইচ্ছে? এই ইচ্ছে? আর কতোক্ষন এভাবে বসে থাকবি? তোর পার্ফরমেন্সের সময় হয়ে গেছে! অডিয়েন্সে এক্সাইটমেন্ট ওভারলোডেড ইয়ার!
খেয়ালি চোখ তুলে তাকালো ইচ্ছে। গলা দিয়ে গান বের করবে বলে এতোক্ষন হলো নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করেছে ও। পারছেই না! প্রতিবার গিটারটার সাথে হওয়া ঘটনার কথা মনে পরতেই বিষিয়ে উঠছে ওর চারপাশ। নিজের শরীরে প্রাপ্তর আকস্মাৎ স্পর্শের জন্য যেটুকো অপমানিত হয়েছিলো,সেটাও ভুলে গেছে ও গিটারের কথা ভেবে। রাকা ওকে মৃদ্যু ধাক্কা মেরে বললো,
-কিরে? যাবি তো?
ইচ্ছে কিছু বলার আগেই দরজায় নক পরলো। রাকা গলা উচিয়ে বললো,
-কে?
-প্রাপ্ত।
নাম আর স্বর শুনেই তরিঘড়ি করে দাড়িয়ে গেলো রাকা। ইচ্ছের দিকে তাকালো অসহায়ভাবে। ইচ্ছে চোয়াল শক্ত করে মেঝেতেই বসে রইলো। আরো শক্ত করে চেপে ধরলো গলার লকেটটা। রাকা একটা শুকনো ঢোক গিলে কম্পিতহাতে দরজা খুলে দিলো। তৎক্ষনাৎ পকেটে দুহাত গুজে,হেলেদুলে ভেতরে ঢুকলো প্রাপ্ত। ওর পেছনে মিষ্টি,অরিত্রা,সাফোয়ান আর মাহীনও ঢুকেছে। অরিত্রার হাতে একটা ফুলের তোড়া,সাফোয়ান একটা মোড়কের গিফটবক্স আর মাহীন হাতে কিছু খাবার আর পানীয় এনেছে বলে মনে হলো। ইচ্ছে উঠে দাড়ালো এবার। প্রাপ্তর সাথে শীতল চাওনি বিনিময় হলো ওর। ওদের পেছনপেছন ইভেন্ট ম্যানেজার এসে বললেন,
-ইনায়াত? ইনি মিস্টার…
-সাদমান ইনাব প্রাপ্ত।
ইচ্ছের জবাব শুনে প্রাপ্ত মুচকি হেসে মাথা নাড়ালো। অরিত্রার হাত থেকে ফুলের তোড়াটা নিয়ে ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
-মিস রকস্টারের ব্রেইন অনেক শার্প দেখছি। গুড ফর ইউ। এনিওয়েজ! প্রাপ্তর এলাকায় স্বাগতম তোমাকে। প্রথম দেখার সময় বলা স্বাগতবানী আর অভ্যর্থনার কর্মযজ্ঞ হয়তো পছন্দ হয়নি তোমার। তাই আবার এলাম,তোমাকে ওয়েলকাম করতে।
হাত বাড়িয়ে তোড়াটা নিলো ইচ্ছে। বললো,
-আমার স্বাগত স্পর্শ তোমারও ভালো লাগেনি জানি মিস্টার। তবুও তোমার এই একাগ্রতাসম্পন্ন স্বাগতম আমি গ্রহন করলাম। ওয়েলকামের জন্য থ্যাংক ইউ।
ইচ্ছের স্পষ্ট জবাবে ওকে কষ্ট দেওয়ার জেদটা আরো নাড়াচাড়া দিয়ে উঠলো প্রাপ্তর। ইভেন্ট ম্যানেজার হাতের ঘড়িটা দেখে বললেন,
-মিস্টার প্রাপ্ত? আপনারা তবে কথা বলুন? ইনায়াতের পার্ফরমেন্সে এখনো পনেরো মিনিট লেইট। আমি বাকি দিকটা একটু…
-আসুন।
একদমই গুরুত্বহীনভাবে বললো সাফোয়ান। যেনো ও বিরক্ত এই লোকটার মাত্রাতিরিক্ত আপ্যায়ন দেখে। ইভেন্ট ম্যানেজার চলে যেতেই রাকা বললো,
-ই্ ইয়ে মানে,প্রাপ্ত ভাইয়া,ব্ বসুন না? মিষ্টি আপু আপনিও? সাফোয়ান ভাইয়া আপনারা…
-এত্তো সম্মান দেখাতে হবে না তোমাকে ম্যাডাম। অতিভক্তি চোরের লক্ষ্মন।
মাহীনের কথায় চুপসে কাচুমাচু হয়ে দাড়ালো রাকা। ততোক্ষনে ইচ্ছে-প্রাপ্তর কোনো সমর দৃষ্টি বিনিময় চলছে। মিষ্টি না এসব সমর্থন করতে পারছে,না চলে যেতে পারছে। ভুলটা ঠিক কার,কোথায়,কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না ও। রাস্তার লোকটা এক ফুলকুড়োনি বাচ্চা মেয়েকে বাজেস্পর্শ করেছিলো বলে তাকে মারছিলো প্রাপ্ত। আর ওকে আটকাতে এসেই বাজে স্পর্শের মুখোমুখি হতে হয় ইচ্ছেকে। যদিও এটা ইচ্ছের জন্য অনেক অপমানের,তবে তা ছিলো অনিচ্ছাকৃত। ইচ্ছে ছাড় দেয়নি প্রাপ্তকে। ওদিকে চড়,থাপ্পড়,কলার ধরা,এগুলো নিয়ে প্রাপ্তও ওর গিটার ভেঙেছে। কাকে কি বলবে,মাথায়ই ঢুকছে না মিষ্টির। এককোনে জানালার দিকে চলে গেলো ও। সাফোয়ান এগিয়ে গিফটবক্সটা ইচ্ছের সামনে ধরে বললো,
-এইযে বিদেশী ম্যাম? আপনার জন্য ইম্পর্টেড গিফট এনেছি। নিয়ে আমাদের ধন্য করুন!
ইচ্ছে তোড়াটা পাশের টেবিলে রেখে নিরবে গিটারটা নিলো। প্রাপ্তর কপাল কুচকে এলো এবার। ওর কলার ধরে,দু দুটো চড় লাগিয়ে দেওয়া সেই তেজী মেয়েটা এভাবে চুপচাপ উপহার মেনে নিচ্ছে? কেনো? গিফটবক্স নিয়ে খুলতে শুরু করে দিলো ইচ্ছে। পুরোটা খুলে ওতে চোখ বুলিয়েই চোখ বন্ধ করে নিলো ও। বড় বক্সটায় ওর গিটারের প্রতিটা টুকরো সযত্মে তুলে রাখা। ওর খিচে বন্ধ করে থাকা চোখজোড়াকে বিস্ময়ে আরো গভীরভাবে পর্যবেক্ষন করলো প্রাপ্ত। সেকেন্ড পাঁচেকের ব্যবধানে চোখ মেললো ইচ্ছে। শান্তভাবে বললো,
-মানুষ নামে কলঙ্ক।
চরম রাগে তাকালো সবাই ওর দিকে। ইচ্ছের ভাব পরিবর্তন হলো না একটুও ওতে। এবার রাগ হলো প্রাপ্তর। ও তো এসেছে মেয়েটাকে কষ্ট দিতে। এই মেয়ে গায়ে মাখছে না কেনো তবে বিষয়টা? উল্টো ওকেই শোনাচ্ছে! প্রাপ্ত কড়াগলায় ডাক লাগালো,
-মাহীন? ড্রিংকগুলো দে!
টপাটপ দুটো কাচের বোতল এনে ইচ্ছের পাশের টেবিলে রাখলো মাহীন। ইচ্ছে তাকালো সেদিকে। টকটকে লালবর্নের পানীয়টা যে অবশ্যই পানযোগ্য না,তা বেশ বুঝতে পারছে ও। প্রাপ্ত বললো,
-হ্যাভ ইট!
-পার্ফরমেন্স আছে আমার।
-ফাইন।
কথাটা বলে প্রাপ্ত একটা বোতল নিয়ে রাকার সামনে তুলে ধরলো। বললো,
-তোমার বান্ধবীর পারফর্মেন্স আছে। তাই ওর পরিবর্তে,এটা তুমি খাবে।
রাকা শুকনো ঢোক গিললো। এই বোতল শেষ করতে গিয়ে ওউ শেষ হয়ে যাবে,তা বেশ বুঝতে পারছে ও। প্রাপ্ত ঠান্ডা আওয়াজে বললো,
-খাবে তো? নাকি বলবে মিস রকস্টারের মতো তোমারও পার্ফরমেন্স আছে?
রাকা একটাকিছুও বলার মতো পেলো না। দোয়াদরুদ পড়তে পড়তে কাপাকাপা হাতটা বোতলের দিকে বাড়ালো ও। কিন্তু ও নেওয়ার আগেই সেটা নিয়ে নিলো ইচ্ছে। ছিপি খুলে মুখে পুরতেই যেনো আগুন ধরে গেলো ওর কন্ঠনালী জুড়ে। এতোটা ঝাল ওই পানীতে,যা অকল্পনীয় যে কারো। চোখের কোনা দিয়ে জল গরাতে লাগলো ইচ্ছের। রক্তিম হয়ে উঠেছে পুরো মুখচোখ ওর। তবুও ঢোকের পর ঢোকে পুরো বোতল শেষ করে দিলো ও। একটাকথাও কেউ বলছে না আর। বিস্ময়ে ইচ্ছেকে দেখছে প্রত্যেকে। জ্বলন্ত,টলোমলো শরীরটা নিয়ে,ইচ্ছে কোনোমতে বললো,
-গিটারটা না ভাঙলেও পারতে মিস্টার গ্যাংস্টার।
কথা শেষ করেই ঢলে পরলো ইচ্ছে। জ্ঞান হারিয়েছে। ঝাল খেতে পারে না ও কোনোকালেই। এতো ঝাল সইবে কিভাবে? তবে জ্ঞান হারিয়ে পরে যায়নি একেবারে। কাছেই দাড়িয়ে ছিলো বলে দুবাহুতে প্রাপ্তই ওকে আগলে নিলো। বাকিসবাই থমকে আছে যেনো। প্রাপ্ত কিয়দক্ষন তাকিয়ে রইলো ঝালে মরিয়া হয়ে থাকা ওই চেহারার দিকে। ইচ্ছের গাঢ় খয়েরি লিপস্টিক দেওয়া ঠোট শুকিয়ে উঠেছে একদম। ধানি লঙ্কার মতো ঝাঝালো রকস্টারের ঝাল লেগেছে নাকি?- একবার মনে এই প্রশ্নটা উকিও দিয়েছে হয়তো প্রাপ্তর। কিন্তু পরপরই কি ভেবে ইচ্ছেকে ছেড়ে দিলো ও। সাধেসাথে ধপ করে মেঝেতে পরলো ইচ্ছে। বাইরে এনাউন্সমেন্ট হলো,
-এবারে সময় আমাদের সেই হার্টথ্রোবের! গান গাইতে আসছে,ইনায়াত নিক্কন ইচ্ছে!
ইচ্ছের নামে মুখোরিত পুরো জায়গাটা। মিষ্টিরা সবাই এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করছিলো। প্রাপ্ত দেয়ালে ঠেকিয়ে রাখা একমাত্র গিটারটা নিয়ে দ্রুতপায়ে বেরিয়ে গেলো গ্রিনরুম থেকে। একটা ক্ষুদ্রশ্বাস ওকে সহসা অভয় দিলো,ও যদি তোর কাজ বিগরাতে পারে,তুইও ওর কাজ বিগরাতে পারিস প্রাপ্ত! ভুল করিসনি কোনো। গিটার নিয়েই সোজা ভার্সিটির বাইরে বেরিয়ে যেতে চেয়েছিলো ও। পারলো না! চোখের সামনে ইচ্ছের মুখটা ভাসছে সেই কতোক্ষন হলো। কারন ওরই নাম উচ্চারন হচ্ছে চারপাশে! ওজানে,যতোক্ষন না ইচ্ছে স্টেজে আসবে,এটাই চলবে। রাগ নিয়ে এবার নিজেই স্টেজের দিকে এগোলো প্রাপ্ত। মিষ্টি এসে ওর পথ আগলে দিয়ে বললো,
-আর ঝামেলা করিস না প্রাপ্ত! প্লিজ! কনট্রোল ইউরসেল্ফ!
-পারবো না।
-মেয়েটার সেন্স না ফেরা অবদি এদেরকে সামলাতে হবে। পিয়ালী কল করেছিলো। আঙ্কেলের কিছু স্টুডেন্ট জানিয়েছে তাকে,তুই এসেছিস ভার্সিটিতে। পিয়ালী বারবার করে বলেছে,ইভেন্টটা সামলে নিতে।
পিয়ালী,আঙ্কেল শব্দদুটো শুনে আর কিছুই বলতে পারলো না প্রাপ্ত। মাথার চুলগুলো উল্টে কিছু একটা ভেবে সোজা স্টেজে উঠে গেলো ও। স্পিকারে বললো,
-গান আমি গাইবো!
চারপাশ স্তব্ধ। প্রাপ্তকে স্টেজে দেখে,ভয় বিস্ময়ে থেমে গেছে সব। তবে প্রাপ্ত নিজেই বুঝে উঠতে পারছে না কি করবে। উত্তেজনা সামলাবে জন্য বলে তো দিলো গাইবে,কিন্তু কি গাইবে? মিষ্টি বুঝলো ওর অবস্থা। এটুকো চেনে ও প্রাপ্তকে। স্টেজের খানিকটা সামনে থেকে মৃদ্যু হেসে বললো,
-তোর কাল্পনিক শ্যামাকন্যাকে নিয়ে গা প্রাপ্ত?
প্রাপ্ত নিজেই মুচকি হাসলো এবার। এইতো কতোনা রোদ ছিলো আকাশে। কিন্তু সে অদৃশ্যময়ীর নামেই দমকা বাতাস শুরু হয়েছে আচমকা। সামনের দর্শকের ভাব উপেক্ষা করে প্রাপ্তর মনপ্রান জুড়ে ভালোলাগা হঠাৎই। তাকে নিয়ে ভাবতেও ভালোলাগে এমন এক উপলব্ধি ওর শরীরমন জুড়ে। পুরো স্বস্তিতে,গিটারে সুর তুলে প্রাপ্ত গাইতে লাগলো,
মন ভাবে তারে,এই মেঘলা দিনে
শীতল কুয়াশাতে,তার স্পর্শে
তার রিমঝিম নুপুরের সাজে
বাতাসে যেনো মৃদ্যু সুবাসে
নিটোল পায়ে রিনিকঝিনিক,পায়েলখানি বাজে
মাদল বাজে সেই সঙ্গেতে,শ্যামা মেয়ে নাচে(ii)
চাদের অধরে যেনো,তোমার হাসির মাঝে
সোনালী আবেশে তবে সাগর ধারে
হৃদয়ের মাঝে কবে বেধেছিলে বাধন
ভালোবাসা তবে কেন,মনের অগোচরে…
ভয় বিস্ময় সব ভুলে গানটা দর্শকশ্রোতারাও উপভোগ করছিলো। মেতে উঠেছিলো প্রাপ্তর গানে। কিন্তু এটুকো গেয়ে চোখ বন্ধ করার সাথেসাথেই চোখজোড়া খুলে ফেলতে বাধ্য হলো প্রাপ্ত। চোখ বন্ধ করার পর ইচ্ছের চেহারা আবারো সামনে এসেছে ওর। গান থামিয়ে, একটু দিশেহারার মতো প্রাপ্ত সামনের দর্শকস্রোতের পুরোটায় চোখ বুলালো একপলক। সত্যিই অগোচরে সে ভালোবাসা। সে অনন্যা নেই এই আধুনিক বেশধারীদের ভীড়ে। থাকার সম্ভবনা নেই। তবে কোথাও নেই,এটা মানতে নারাজ প্রাপ্ত। কোথাও না কোথাও তো আছে সে। নিয়তির কোন অন্তরীক্ষে আছে সে, এই একটা প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষায় কাতর চোখজোড়া অন্যদিকে সরিয়ে নিলো ও। ইচ্ছেকে নিয়ে না,গানটা যে ওর শ্যামাকন্যাকে উদ্দেশ্য করে গাওয়া। ইচ্ছে কেনো ওর বন্ধ চোখের পাতায়? মনে যে সেই অদৃশ্যময়ীর জন্য সেই চেনা সুর,
নিটল পায়ে রিনিকঝিনিক,পায়েলখানি বাজে
মাদল বাজে সেই সঙ্গেতে,শ্যামা মেয়ে নাচে…
•
-তর সব নাচোন আজকা আমি বাইর কইরা দিমু খই! এই আইলাম কইতাছি মাছদাডা নিয়া! আইলাম!
মায়ের কর্কশ আওয়াজ শুনে খই সর্বোচ্চস্বরে বললো ‘আইতাছি মা!’ হন্তদন্ত হয়ে কোমড়ে গোজা ওড়না ছেড়ে দিলো। এখন যদি মা বাড়ি থেকে বেরোয়,সত্যিই মাছ কাটার বটিতে গর্দান যাবে ওর। পায়ের ঘুঙুরটা খুলে একটা চুমো দিলো ও দুটোতে। তারপর খোপা করা চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে পাশে তাকালো। মেঘলা আকাশের নিচে,বটতলার বসে,মাদল বাজাতে থাকা আশির্ধো লোক। সে একেবারে মগ্ন হয়ে তাল তুলেছে যেনো। খই ঘুঙুরজোড়া মাদলে রেখে লোকটাকে ধাক্কা লাগিয়ে বললো,
-হইছে থামো! মেলা হইছে!
বদু ফকির থামলো। খই টগবগানো স্বরে বললো,
-হুনো ফকির কাকা! কাইল আবার আইবা শুকমরার এপারে! আজকার ধুয়ার দাম দিবার পারলাম না। কাইল আইলে তোমারে এই শুকমরার সবচাইতে বড় সরপুটি ভাজা দিয়া পান্তাভাত দিমু যাও! আর হুনো! কাইল সবচাইতে ভালো ধুয়া মুখস্ত কইরা আইবা! আর এই মাদলে যদি কাইলকা এক তিল্লি ফুটা পাই,ঘুঙ্গুর ফেরত দিমু না কইলাম! হুনছো?
বদু ফকির কিছুক্ষন ভাষাহীনভাবে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। বিশের এদিকওদিক বয়স নিয়ে এই মেয়েকে পুর্নযুবতী বলা চলে। রঙের দিক থেকে বেশ চাপা। শ্যামবর্ন যাকে বলে। মাথা ভর্তি এলোকেশ,কপালের ছোটচুলগুলো এতো বেশি যে,কানের পাশ দিয়ে সবসময় পরে থাকবে। প্রতিবার কথা বলার সময় ওর নাকবালি নামের গয়নাটা দুইনাকের মাঝে সুন্দরমতো নড়তে থাকে। কানে দুল নেই কোনো। তবে কানের ছিদ্র ধরে রাখতে কুটো গুজে দেওয়া। কালো কুটোটা দেখতেও অমায়িক লাগে। খইয়ের সবচেয়ে প্রিয় গয়না ওর গলায় আটকে থাকা কালোসুতার ধানতাবিজ। এই ধানতাবিজে কালো রঙেরই একটা শঙ্খ ঝুলানো। শ্যামাঙ্গে এই অল্পবিস্তর সাজগুলো বরাবর মানানসই লাগে বদু ফকিরের। সেই ছোট্ট থেকে হাতেপায়ে এতো বড় হতে দেখলো সে এই মেয়েটাকে। শুধু গায়ের গরন বাড়া ছাড়া কোনো পরিবর্তন নেই। এখনো সেই ফড়িংয়ের মতোই লাফায়। খইয়ের মতোই বুলি ফোটে ওর। বদু ফকির একটা ছোট শ্বাস ফেলে বললো,
-ঘুঙ্গুর কি তোর? এইডা আমার মায়ের ঘুঙ্গুর! তুই না দেওয়ার কেডা?
-এইডা তোমার বাপজানে তোমার মায়রে দিছিলো। তো এইডা কিনছে তোমার বাপজানে! না তুমি! না তোমার মা! মরা মানুষের কবর ছাড়া আর কিছুই হয়না। আর এই ঘুঙ্গুর এই আক্কা ভাদুলগাঁয়ে খালি আমার পায়েই বাজে। তাই এই ঘুঙ্গুর আমার! খই ছাড়া এই ঘুঙ্গুর আর কেউ পরবো না হুনছো?
খইয়ের যুক্তি আর শাষনের ভঙিমা দেখে বদু ফকির শব্দ করে হেসে দিলো। এই গ্রামে একমাত্র ওর কাছেই বদু ফকিরের মাদলের তাল আর গানের ধুয়া পাগলামি না। নইলে সবাই ফকির কম,বদুপাগল বলেই বেশি ডাকে তাকে। বদুফকির তাই সব পাড়াগায়েই বলে বেরায়,ভাগ্য করে ভাদুলগাঁয়ে একটা মেয়ে পেয়েছে বটে!
ভাদুলগাঁও! শহরের কোলাহল পেরিয়ে এক ছোট্ট গ্রাম। আধুনিকতা বলতে এ গ্রামের শুধু স্কুলবিল্ডিং আর গেরোস্ত মুন্সিবাড়ির দালান অবদিই চোখে পরবে। বাকিসব টিনের ঘরগুলো কাছারিবাড়ির একনামে জানাশোনা। কুমোরপাড়ায় মাটির ঘরও আছে। ঠিক মাঝখান দিয়ে,একরকম বুক চিরে একেবেকে চলা গ্রামের নামে মিল রেখে শাখানদীর নাম ভাদুয়া। লোকমুখে ওটা শুকমরা নামেই পরিচিত। স্রোতস্বীনী কোনো নদীর একাংশকে ভাদুয়াকে,মরা বলে ডাকার যথেষ্ট কারন আছে। কথিত আছে,এই ভাদুয়ার আগে অনেক তেজ ছিলো। প্রায়ই নৌকাডুবী হতো এখানে। সেটাও আবার শুক্লপক্ষের তিথিতে। শুক্লপক্ষের তিথিতে নৌকাযাত্রীদের সুখ মরতো বলে ওই শাখানদীকে সব শুকমরা বলেই ডাকে। বদু ফকির বললো,
-শুকমরার সরপুটি তোর সুহাগের লাগি রাইখা দে খই! বড় তো আর কম হইলি না! আর কতোদিন নাচবি আমার মাদল আর ধুয়ায়? একখান সোন্দর দেইকখা সুহাগ দেইকখা বিয়াশাদী করন লাগবো না?
খইয়ের সব কথায় ইদানিং বিয়ের কথা বলে বদুফকিরের অভ্যাসে দাড়িয়েছে। আর সাথে খইয়ের গালগুলো লাল হওয়ার অভ্যাসও বানিয়ে নিয়েছে। প্রতিবারের মতো এবারও বিয়ে আর সুহাগ শব্দদুটো শুনে ছুট লাগালো খই। বদুফকির চেচিয়ে বললো,
-এতো লজ্জায় পরিস না খই! মেয়েলোকের লজ্জাই কিন্তু প্রেমযমুনার প্রেমনোঙ্গর! একবার আটকাইলে,আর নিস্তার নাই! আর নিস্তার নাই!
একছুটে নদীপারে এসেছে খই। হাপাচ্ছে রীতিমতো। তীরে ভিড়ানো নৌকোয় বসে,ভাদুয়ারজলে পা ভিজিয়ে উষ্ণ গালজোড়া শীতল করার বৃথা চেষ্টা করলো ও। বদু ফকিরের কথা মনে করে দুহাতে মুখ লুকোতে যাচ্ছিলো। কিন্তু পাশের ডাঙায় তুলে রাখা নোঙরটা দেখে থেমে গেলো ও। সেদিকে মুগ্ধচোখে তাকিয়ে থেকে আস্তেধীরে বলতে লাগলো,
-ফকির কাকা কি সত্যই কইলো? মাইয়াগো লজ্জা সত্যই কি প্রেমযমুনার প্রেমনোঙ্গর? এই প্রেমনোঙ্গরে আটকাইলে সত্যই কি আর নিস্তার নাই? আমার মতো এই মুখপুড়ির প্রেমযমুনায় সত্যই কি আটকাইবো কেউ? এই এত্তোবড় দুনিয়ায়,সত্যই আছে কেউ এমন? কেউ কি সত্যই আইবো,প্রেমনোঙ্গর নিয়া? আমার প্রেমযমুনায় আটকাইতে?
#চলবে…
#প্রেমনোঙর_ফেলে
#লেখনীতে-মিথিলা মাশরেকা
#পর্ব-৩
জ্ঞান ফেরার পর প্রাপ্তর গানই আগে ইচ্ছের কানে ভেসে আসলো। চোখ মেলে অরিত্রা,রাকা,সাফোয়ান,মাহীনসহ কনসার্টের স্বেচ্ছাসেবী দলকে চোখে পরলো ওর। আস্তেধীরে উঠে বসলো। রাকা ওকে জুসের গ্লাস দিয়ে বললো,
-ইচ্ছে? এখন কেমন আছিস? এ্ এটা খা। বেটার ফিল করবি।
মুখের ভেতরের জ্বালাপোড়া আর গায়ে র’্যাশগুলো দেখে ইচ্ছের মনে পরলো কি ঘটেছিলো। মুখ দিয়ে শ্বাস ছেড়ে জুসটা কয়েকঢোকে শেষ করলো ও। ঝাল কমেছে কিছুটা। অরিত্রা বললো,
-ঝালে কেউ অজ্ঞান হয়,আজ প্রথমবার,চাক্ষুস দেখলাম। বাবা!
ইচ্ছে কিছুই বললো না। ও বোঝার চেষ্টা করছে,স্টেজে গান গাইছে কে। অরিত্রার কথা শুনে রাকা মনেমনে কয়েকটা গালি দিয়ে বলতে লাগলো,তুমিই খেয়ে দেখতে না হয় অরি! কেমন লাগে ওইটা খেতে। একনম্বরের শাঁকচুন্নি মেয়ে একটা! যেমন নাম,তেমন কাম! অরি! শত্রু! ওকে চোখ ছোটছোট করে তাকিয়ে থাকতে দেখে সাফোয়ান বললো,
-এক বোতলেই এই দশা? আরেক বোতলের কি হবে তাহলে? উমমম্… ওটা কে খাবে?
-কেনো? ইচ্ছে ম্যাডামের বান্ধবী আছে তো! রাকা ম্যাডাম!
মাহীনের কথা শুনে আতকে উঠলো রাকা। এবার মাহীনের দিকে তীক্ষ্মচোখে তাকালো ইচ্ছে। ওর চাওনি দেখে না চাইতেও খানিকটা ভয় পেয়ে গেছে মাহীন। এই মেয়ে প্রাপ্তর কলার ধরে ওকে চড় মেরেছে। ওর হকিস্টিকও ড্রেনে ফেলে দিয়েছে। একটু থতমতো হয়ে বললো,
-ক্ কি ব্যাপার? আপনি আমার দিকে এভাবে তাকাতে পারেন না!
আধশোয়া থেকে ইচ্ছে উঠে দাড়ালো। জিভ দিয়ে ঠোট ভিজিয়ে রাকাকে বললো,
-গিটার কোথায়?
-এখানে।
প্রাপ্ত গিটার হাতে দরজায় দাড়িয়ে। পাশে মিষ্টিও আছে। ওর হাতে গিটার দেখে জ্বলে উঠলো ইচ্ছের শরীর। হনহনিয়ে গিয়ে কেড়ে নিলো ও গিটারটা। চেচিয়ে বললো,
-তুমি আবারো কেনো আমার গিটার ধরেছো?
-প্রাপ্ত কারো অনুমতিও নেয়না,কারো কাছে জবাবদিহিও করে না।
-তা বলে কারো আবেগকে আঘাত করার কোনো অধিকারও তোমার নেই!
ইচ্ছের কথায় এবার একটু কপাল কুচকালো প্রাপ্ত। আবেগ বলতে কি গিটারকে বুঝালো ইচ্ছে? এই আবেগ শব্দটা শুনেই মাথা ফাকা হয়ে গেছে ওর। কি হলো,সহসা ইচ্ছের দুহাতের কনুইয়ের উপরে চেপে ধরলো প্রাপ্ত। নিজেও চড়া গলায় বললো,
-আমাকে আঘাত করার অধিকার তোমাকে কে দিয়েছে?
ইচ্ছে নিজের হাতের দিকে তাকালো। অনেকবেশি জোরে চেপে ধরেছে প্রাপ্ত ওর হাত। ঝারা মেরে ছাড়িয়ে নিলো নিজেকে। দাতে দাত চেপে বললো,
-অন্যায়ের শাস্তি দিয়েছিলাম জাস্ট। কিন্তু পরেরবার আর শাস্তি নয়,প্রতিত্তর দেবো। তৈরী থেকো সাদমান ইনাব প্রাপ্ত। ইচ্ছে ওর প্রিয় জিনিস হারানো যন্ত্রনায় যেভাবে পুড়ছে,তার চেয়ে কয়েকহাজার গুন বেশি যন্ত্রনায় পোড়াবো তোমাকে। প্রিয় হারানোর যন্ত্রনা! বি রেডি!
একপলক সবার দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে গেলো ইচ্ছে। হাত মুঠো করে শক্ত হয়ে দাড়িয়ে রইলো প্রাপ্ত। প্রচন্ড রাগে কাপছে ও একপ্রকার। এই মেয়েটার সাহসে প্রতিবার অপমানিত হতে হয়েছে ওকে। শেষ কথাগুলোতে সতর্ক করে দিতে গিয়ে আরেকদফায় নিজেকে সাহসী প্রমান আর প্রাপ্তকে অপমান করে গেলো ও। মিষ্টি অবস্থা বুঝে উঠেও বরারের মতো নিজের করনীয়টাও বুঝলো না। প্রাপ্তকে নিয়ে সবসময়ই ভয়ে থাকে ও। কিন্তু এখন ইচ্ছে যা বলে গেলো,যেভাবে বলে গেলো,তাতে ওই বা কি করবে,সেটা ভেবেও ভালোরকমের চিন্তা হচ্ছে মিষ্টির।
•
‘ইনিশা! উই ইনিশিয়েট ইউর ড্রিম’
স্থাপত্য,নকশায় একধাপ এগিয়ে থাকা দেশের প্রকৌশল কর্মক্ষেত্রগুলোর মাঝে,এক অন্যতম নাম। এ অফিসের প্রাত্যহিক কর্মদিবস,সকাল আটটা থেকে রাত আটটা। রাত সর্বোচ্চ দশটাও হয় কোনোকোনো দিন,কারোকারো জন্য। তার উর্ধ্বে নয়। এখন রাত আড়াটা। অন্ধকারচ্ছন্ন বহুতল অফিস ভবনটির এগারো নম্বর ফ্লোরে এখনো আলো জ্বলছে। রুমের ঠিক মাঝখানে আগুনও জ্বলছে। লিখন মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে তার বসের সামনে। হাতদুটো মুষ্ঠিবদ্ধ করে সামলাচ্ছে নিজেকে। তার অক্লান্ত মেধা,শ্রমের ফল শেষ হয়ে যাচ্ছে ওরই চোখের সামনে। ক্ষোভে ফেটে যাচ্ছে লিখনের শরীর। ইচ্ছে করছে সামনে বসে মদ গিলতে থাকা শিক্ষিত জানোয়ারটিকে ওই আগুনেই জ্বালিয়ে দিতে। তবুও কিছু বলতে পারছে না,করতে পারছে না ও। শুধু দুহাত মুঠো করে দাড়িয়ে রইলো।
নেশায় বুদ হয়ে থাকা নিজাম টলোমলো চোখে লিখনের দিকে তাকালো। পৈশাচিক আনন্দ পাওয়ার কথা ওর লিখনের এতোদিনে করা এই সব প্রেজেন্টেশন পোড়াতে। তবে তা হচ্ছে না। লিখনের আফসোসের পরিবর্তে রাগী চেহারাটায় একদমই মজা পাচ্ছে না ও। লিখনকে নিজাম অফিসে ডেকে পাঠিয়েছিলো প্রমোশনের জন্য। রাতারাতি প্রমোশন দেবে বলে। তবে শর্ত ছিলো, এই পদমর্যাদা বৃদ্ধির জন্য লিখনকে স্বস্ত্রীক আসতে হবে। সেদিনের ইভেন্টে এসেছিলো লিখনের বউ। হলুদ শাড়ীতে আসা মেয়েটির দু দন্ডের বেখেয়ালিপনায় জন্য তলপেট কিছুটা দৃশ্যমান হয়। আর তা চোখে পরার পর থেকেই তাকে রাত্রীযাপনে চাই বলে প্রতিজ্ঞা করে বসেছে নিজাম। কিন্তু আজ যখন দেখলো,লিখন একাকী অফিসে এসেছে,রাগে ওর সব প্রেজেন্টেশন আর নকশা নিজেহাতে জ্বালিয়ে দিয়েছে ও। তারপরও কোনো আফসোস নেই লিখনের। উল্টো রাগ ওর চেহারায়। নিজাম উঠে দাড়িয়ে বললো,
-এগুলো রশিদের প্রেজেন্টেশন ছিলো। চুরি করে এগুলো তুই নিজের নামে চালিয়ে দিচ্ছিলি। ইনিশা থেকে তোকে বরখাস্ত করা হলো!
লিখনের ভাবান্তর হলো না। যাতে আরো রাগ হলো নিজামের। ড্রয়ার থেকে চেইকবই টা নিয়ে কিছু একটা লিখে বললো,
-আমার কাছ থেকে পঞ্চাশ লাখ টাকা নিয়েছিলি তা ফেরত দিসনি। সে দায়ে জেলে যেতে হবে তোকে!
লিখন তখনও চুপ। নিজাম একটু থেমে বাকা হেসে বললো,
-তুই জেলে গেলে বাসায় রুবা একা। তাইনা রে লিখন?
এতোক্ষনে চোখ তুলে তাকালো লিখন। রাগে চোখ ভরে উঠেছে ওর। সামনে থাকা জঘন্য মানুষটাকে খুন করবার ইচ্ছা জাগছে ওর। হাতের মুঠো আরো শক্তিতে মুঠো করার আগেই কেউ ঘুষি লাগিয়েই দিলো নিজামকে। লোকটা এমনিতেও মাতাল ছিলো। আর সেই ঘুষিতে টেবিলে গিয়ে পরেছে একদম। লিখন বিস্ময়ে নিজামের থেকে চোখ সরিয়ে পাশে তাকালো।
হালকা নীল রঙের শার্ট,কালো প্যান্ট,ইন করা,হাতে মোটা চেইনের ঘড়ি,একেবারে ফর্মাল লুকে দাড়ানো সুদর্শন এক যুবক। বয়স সাতাশ আটাশ হবে হয়তো। গায়ের রঙ বেশ উজ্জ্বল। চোখে চশমা পরিহিত ছেলেটার চেহারায় যেনো নিস্পাপ শব্দটা স্বর্নাক্ষরে লেখা। অফিসের কেবিনের আলোর চেয়ে,ফ্লোরের কাগজের আগুনের অল্পবিস্তর আলোতে ছেলেটাকে বেশ লাগছে দেখতে। লিখনের দিকে তাকিয়ে ছেলেটা বললো,
-এইধরনের পশুবেশী মানুষদের মারার জন্য এতো সময় নিতে নেই। নইলে তুমি মারার আগেই অন্যজন এই সওয়াবের কাজ করে দেবে। বুঝেছো?
লিখন নিরবে তাকিয়ে রইলো ছেলেটার দিকে। নিজাম টেবিল থেকে মুখ তুলে ঠোটে আঙুল ছোয়ালো। কেটে রক্ত ঝরছে। ওকে কেউ ঘুষি ছুড়েছে ভেবে চরম রাগ হলো ওর। টেবিলে বারি মেরে ঘুরে উঠে বলতে যাচ্ছিলো,
-আজ তোকে…
লিখন খেয়াল করলো,ছেলেটাকে দেখেই নিজাম থেমে গেছে তৎক্ষনাৎ। যতোটা তেজ নিয়ে ও বলতে শুরু করেছিলো,ততোটাই নুইয়ে বিস্মিত চেহারায় তাকিয়ে আছে ও ছেলেটার দিকে। যেনো এ কাকে দেখছে ও! ছেলেটা শান্তদৃষ্টিতে তাকিয়ে নিজামের দিকে। ডানহাতে বা হাতের হাতাটা ভাজ দিতে দিতে এগুলো সে। এগিয়ে একদম নিজামের সামনে দাড়িয়ে গিয়ে বললো,
-কিছু বলছিলি নিজাম?
-র্ রা রাকীন? ত্ তুই এখানে?
বিস্ফোরিত চোখে মানুষটাকে আরেকবার পরখ করে নিলো লিখন। এই তবে রাকীন শাফায়াত? ইনিশা’র ফাউন্ডার রাজীব মাহমুদের একমাত্র ছেলে রাকীন শাফায়াত? এই ছেলেই বাবার এতোবড় সাম্রাজ্যে এক সাধারন কর্মচারীর মতো কাজ করে চলেছে তবে? নিজামের কথায় তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটলো রাকীনের ঠোটে। টেবিলে রাখা গ্লাসের পানিটা একদম মুখে ছুড়ে মারলো ও নিজামের। চোখ খিচে বন্ধ করে নিয়ে ভেজা চেহারায় হাত বুলালো নিজাম। মাথা ঝারা মারলো বারকয়েক। রাকীন বললো,
-নেশা কেটেছে?
…
-অফিসে রাত আড়াইটায় এসে তুই রাষলীলা বসাতে চাইবি,বাবার তিলতিল করে গড়া এই ইনিশায় অপবাদ লাগানোর ধান্দা খুজবি,আমি থাকতে তা কি করে হতে দেই বল? চলে এলাম তাই!
-দ্ দেখ ভাই…
-বড়কাকা,কাকী মারা যাওয়ার পর বাবা কোনোদিনও কোনোকিছুর কমতি দেয়নি তোকে নিজাম। ইনিশা’র এতোবড় একটা জায়গায় জায়গা করে নিয়েছিস নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতায়। আজ এতোনিচু চিন্তাটা মাথায় আনতেও লজ্জা করলো না তোর?
নিজাম মাথা নিচু করে চুপ রইলো। ইনিশা তে আজ অবদি রাকীনের অগোচরে হয়নি কিছুই। ছেলেটা এই নতুননতুন জয়েন করা লিখনকেও নখদর্পনে রাখবে,ভেবে দেখেনি ও সেটা। ঘুষিটা বেশ জোরেই দিয়েছে। রাকীন লিখনের দিকে এগিয়ে বললো,
-তুমি কি চাও? ওকে কি শাস্তি দেবো? পুলিশকে বলবো? নাকি রাজীব মাহমুদকে?
-রাজীব কাকাকে কিছু বলিস না রাকীন! আর হবে না কোনোদিন এমন! প্লিজ কিছু বলিস না রাজীব কাকাকে!
তৎক্ষনাৎ রাকীনের পায়ে পরে গিয়ে নিজাম আহাজারির মতো করে বললো। সবে জয়েন করলেও,লিখন জানে রাজীব মাহমুদের শাস্তির ধরন। পুলিশকে বললে যদি মানহানির মামলায় জেল হয়,রাজীব মাহমুদ জানলে ওর ফাসির ব্যবস্থা করে দেবে নির্ঘাত। কোনোকাজে কোনোরুপ অন্যায় সহ্য করতে পারেন না ভদ্রলোক। রাকীন বললো,
-লিখনের পা ধর নিজাম। ওকে বল ও কি চায়।
হুড়মুড়িয়ে লিখনের পা জড়িয়ে ধরলো নিজাম। বললো,
-আমাকে ক্ষমা করে দাও লিখন! মাফ করে দাও প্লিজ! দয়া করো! আর কোনোদিন হবে না এমন! কোনোদিনও না!
লিখন খানিকটা বিমুর্ত। রাকীন বললো,
-নির্ভয়ে বলো লিখন। তুমি কি চাও? আমি বলছি,সেটাই হবে। তোমাকে,তোমার স্ত্রীকে অপমানের জবাব তোমার মনমতোই হবে।
লিখন একটা ছোট শ্বাস ফেলে বললো,
-পা ছাড়ুন স্যার।
-না! আগে বলো তুমি আমাকে…
-ক্ষমা করলাম। সরুন আপনি।
নিজাম সরে গেলো। রাকীন বললো,
-এতো সহজে ছাড় দেওয়াটা কি উচিত হলো তোমার লিখন?
লিখন মৃদ্যু হেসে বললো,
-জ্বী স্যার! কারন আমি চাইনা ওনার কৃতকাজের জন্য রাজীব স্যার এতোটুকো কষ্ট পান,বা অপমানিত হোন। আর বিনিময়ে শুধু আপনি আমাকে কথা দিন,ভবিষ্যতে ইনিশার কোনো সদস্যকে যেনো আমার মতো বাজে পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে না হয়। আপনি কথা দিলেই এটা সম্ভব,জানি আমি। তাই এটাই চাইলাম। দ্যাটস্ ইট!
লিখনের জবাব শুনে তৃপ্তিতে মাথা উপর নিচ করলো রাকীন। কৃতজ্ঞতাস্বরুপ সুন্দরমতো একটা হাসি দিয়ে,আসছি স্যার বলে বেরিয়ে গেলো লিখন। তারপর নিজামের দিকে তাকালো রাকীন। বললো,
-কি কি ডকুমেন্টস্ পুড়িয়েছিস?
গরগর করে পুরোটা বলে দিলো নিজাম। সবটা শুনে রাকীন বললো,
-রাফের সফটকপি অবশ্যই তোর কাছে। দ্বিতীয়বার তৈরী করে যাতে লিখন না জমা দিতে পারে। এখানে রাখলে আমার চোখে পরবে। তাই ওগুলো বাসায়ই রেখেছিস। রাইট?
রাকীনের যুক্তি দেখে কিছু সময় থেমে রইলো নিজাম। রাকীন আবারো উত্তর চাইতেই মাথা উপরনিচ করলো ও। রাকীন বললো,
-এই মুহুর্তে বাসায় যাবি তুই। আর বাসায় গিয়ে পুরোটা সেন্ড করবি আমাকে। ওর প্রেজেন্টেশন আমি কভার করবো। আর এই ড্রাংক সিচুয়েশনে তোকে বাবা যেনো না দেখে। গট ইট?
মাথা আরো জোরে নাড়ালো নিজাম। ইশারায় ওকে বেরিয়ে যেতে বললো রাকীন। নিজাম চলে গেলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে থাইগ্লাসের জানালার ধারে গিয়ে দাড়ালো রাকীন। পকেটে দুহাত গুজে তাকিয়ে রইলো রাতের শহরের দিকে। ভাবতে লাগলো ওর অবদানটুকো নিয়ে। এভাবেই নিজের কাজ,অন্যের পরিবর্তে কাজ,অন্যের ভুল শুধরানো নিয়েই চলছে ওর ইনিশার ক্যারিয়ার। কিন্তু বিদেশের সনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইন্জিনিয়ারিং পাশ তো ও শুধু ইনিশার জন্য করে নি! পেশার মাঝে প্যাশনকে কবে খুজে পাবে,আদৌও পাবে কিনা,কে জানে? আলতো করে গ্লাস ঠেলে সরিয়ে দিয়ে তাতে মাথা ঠেকালো রাকীন। শীতল হাওয়া চেহারায় লাগতেই চোখ বন্ধ করে নিলো ও। ম্যাসেজের শব্দ কানে আসলেও চোখ মেললো না। অনুভব করত লাগলো মাঝরাতের এই স্নিগ্ধ বাতাসকে। আচমকাই মনে হলো,তাতে যেনো কারো গাঢ় প্রশ্বাসসহিত সংবাদ পাঠানো,”অজানা কোনো প্রেমজোয়ারে গা ভাসিয়ে,তোমার প্রেমনোঙরের অপেক্ষায় আছি প্রিয়। বেশি অপেক্ষায় রেখো না! রেখো না খুব বেশি অপেক্ষায়…”
#চলবে..