#প্রেমনোঙর_ফেলে,২৪,২৫
লেখনীতেঃ মিথিলা মাশরেকা
২৪.
বাহুডোরে ইচ্ছেকে টলতে দেখে খানিকটা আটকে রইলো প্রাপ্ত। মিষ্টিঘরের স্কুলটা দ্বিতল করতে নতুনকে পুনর্নির্মাণের জন্য ইনিশা বিল্ডার্সে আসতে হয়েছিলো ওকে। দুজন ইন্জিনিয়ারের সাথে কথা শেষ করে বেরিয়ে আসছিলো ও ইনিশা থেকে। লিফটে করে গ্রাউন্ড ফ্লোরের জন্য নামার সময় ইচ্ছেকে লক্ষ্য করেছিলো ও। গাঢ় নীল টপস্, জিনস্, পিঠে ছোট স্কুলব্যাগের মতো ডিজাইনার ব্যাগ, খোলা চুলে স্বাভাবিক সাজই ছিলো ওর। কিন্তু চেহারায় বিদ্ধস্ততা ঠিকই ছিলো। হয়তো সে অস্থিরতার জন্যই মাস্ক নামিয়ে থুতনিতে রেখেছে ইচ্ছে। আচমকাই লিফট আটকে যাওয়াতে জ্ঞানও হারানোর উপক্রম হয়েছিলো ওর। কোনোমতে আগলে নিয়েছে প্রাপ্ত ওকে।
খুব বেশি সময় না নিয়েই ইলেক্ট্রিসিটি চলে আসে। লিফট নামতে শুরু করেছে। আবছা চোখে প্রাপ্তকে দেখে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলো ইচ্ছে। নিজেকে ছাড়িয়ে লিফটের দেয়াল ধরে সোজা হয়ে দাড়ালো ও। মাথা ঝারা মেরে প্রাপ্তর দিকে তাকিয়ে বললো,
-তুমি? এখানে?
প্রাপ্ত কিছু বলতে যাবে, লিফট গ্রাউন্ড ফ্লোরে পৌছেছে। ইচ্ছের চারপাশ ঘুরছে। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসলো ও লিফট থেকে। পেছনপেছন প্রাপ্তও বেরিয়ে এসে বললো,
-শুনবে না কেনো এসেছিলাম?
ইচ্ছে দাড়ালো। তবে বুঝলো দাড়ানোর মতো অবস্থায় বেশিক্ষন হয়তো থাকবে না ও। শরীর ছেড়ে দিচ্ছে ক্রমশ। প্রাপ্তও বুঝলো ওর অবস্থা। বিচলিতভাবে বললো,
-ঠিক আছো তুমি?
জবাবের পরিবর্তে ইচ্ছে একটা শুকনো ঢোক গিললো। তারপর ব্যাগ থেকে পানির বোতলটা বের করে কয়েকঢোকে শেষ করলো ওটা। হাতের পিঠে গলার ঘাম মুছলো ইচ্ছে। প্রাপ্ত আবারো বললো,
-আর ইউ ওকে মিস রকস্টার?
-আম্ আমি ঠিকাছি।
ইচ্ছের অগোছালো উত্তর। হাটা লাগাচ্ছিলো ও। প্রাপ্ত কি বুঝলো, হাতের কাগজগুলো মুড়িয়ে ঠিকঠাকমতো ধরলো ও। এসে সামনে দাড়ালো ইচ্ছের। এগোলো ওর অনেকটা কাছে। মুখে বললো,
-বুঝেছি কতোটা ঠিক আছো।
ইচ্ছে মাথা তুলে ওর চোখের দিকে তাকালো। প্রাপ্ত নিজের চোখের ভাষাটুকো পড়ার সময় দেয়নি ওকে। ওটুকো বলেই হুট করে কোলে তুলে নিলো ইচ্ছেকে। বিস্ফোরিত চোখে ইচ্ছে তাকালো ওর দিকে। সব অসুস্থ্যতা যেনো বিস্ময়ের সাথে প্রতিযোগীতায় হার মানলো। গলা জরিয়ে রাখা মানুষটার কোনো হেলদোল নেই ওর সে চাওনির জন্য। ইচ্ছে শশব্যস্তের মতো আশেপাশে তাকালো। এখনো অবদি করিডোরে কেউ নেই। ঝটপট বললো,
-ক্ কি করছো তুমি মিস্টার গ্…
ওকে বলতে না দিয়ে প্রাপ্ত একদম ঝুকলো ওর মুখের দিকে। ইচ্ছের গলায় কথা আটকে গেলো। চোখ কোঠর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। প্রাপ্ত ওর ঠোটের নিচ অবদি থাকা মাস্ক নিজের মুখ দিয়ে টেনে উপরে তুলে দিলো। ইচ্ছে যেনো জমে গেলো। প্রাপ্ত এভাবে ওর এতোটা কাছে চলে আসবে, ভাবেনি ও। দু দন্ড ওর প্রসারিত চাওনির দিকে নেশালো দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো প্রাপ্ত। তারপর সরে এসে শীতলস্বরে বললো,
-কিপ কোয়ায়েট মিস রকস্টার। অসুস্থ্য তুমি।
ইচ্ছের দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম এবার। মাস্ক কিংবা অসুস্থ্যতার জন্য না। প্রাপ্তের এতোটা কাছে আসার জন্য। পরিস্থিতি সামলাতে প্রাপ্তর গলা ছেড়ে নামার চেষ্টা করে বললো,
-আমি ঠিকাছি। নামাও আমাকে। ছাড়ো।আমি…
প্রাপ্ত আরো শক্তিতে জরিয়ে নিলো ইচ্ছেকে। ওর শক্ত চোয়াল, শান্ত চাওনি যেনো বলছে, “ছাড়ো বললে আরো কাছে টেনে নেবো” তব্দা মেরে নিস্পলকভাবে তাকিয়ে রইলো ইচ্ছে প্রাপ্তর দিকে। এই ছেলেটার সবকাজের ধরনটাই অদ্ভুত। আর আশ্চর্যজনকভাবে, সে অদ্ভুত কাজগুলোতে মানা করতে পারে না ও। ডোন্টকেয়ার ভাবে ইচ্ছেকে কোলে নিয়েই হাটা লাগালো প্রাপ্ত। ওকে নিয়ে বেরিয়ে এলো ইনিশা থেকে। বাইকের সামনে এসে আরেকবার তাকালো ইচ্ছের দিকে। ওর তখনো সেই বিমুঢ় চাওনি। প্রাপ্ত বললো,
-বাইকে কম্ফোর্টেবল?
-হু?
ইচ্ছের অস্ফুট আওয়াজে বিস্ময় স্পষ্ট। কিন্তু তা যেনো শুনেও না শোনার ভান করলো প্রাপ্ত। যেনো হু বলে অনুমতি দিয়েছে ওকে। দেরি না করে ইচ্ছেকে সামনে নিয়েই বসে গেলো বাইকে। ইচ্ছে তখনো ওর গলা জরিয়ে। সবটা যেনো ওর মাথার উপর দিকে যাচ্ছে। বাইক স্টার্ট দিলো প্রাপ্ত। ইচ্ছে আঁতকে উঠলো। চলন্ত বাইক দেখে আরো শক্তভাবে ও আঁকড়ে ধরলো প্রাপ্তর গলা। প্রাপ্ত বাইক চালাতে মনোযোগ রেখে বললো,
-নাইস সিটবেল্ট হা?
ইচ্ছের মুখ তালাবন্ধ। এমনই পাগলামি শুরু করে দিয়েছে প্রাপ্ত। পুরো রাস্তায় একটা টু শব্দ অবদি করেনি ইচ্ছে। বাইকের সামনে বসে, প্রাপ্তর গলা জরিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থেকেছে। রাস্তার লোকজন হাজারটা কথা বলেছে হয়তো ওদের উদ্দেশ্য করেই। কানে যায়নি দুজনের একজনেরও। একটাএকটা মুহুর্তে প্রাপ্তর শ্বাস অনুভব করেছে ইচ্ছে। একটাএকটা মুহুর্তে ইচ্ছের বাহুবন্ধনীকে গলায় স্বয়ংবরের বরমালার মতো অনুভব হয়েছে প্রাপ্তর। সে অনুভূতিতে ইচ্ছে-প্রাপ্ত নিজেরাও গা ভাসিয়েছিলো হয়তো। অন্যকিছুতে মন ছিলো না কারোরই। কাছেরই এক হসপিটালে পৌছে বাইক থামালো প্রাপ্ত। ইচ্ছেকে কোলে করেই হসপিটালে ঢুকলো। রিসেপশনের দিকে এগিয়ে বললো,
-ইমারজেন্সি কোনদিকে?
দৃষ্টি আবারো প্রসারিত হলো ইচ্ছের। ইমার্জেন্সি? লিফটের ওখানেই ও বলেছে, ঠিক আছে ও, কিছুই হয়নি। এই ছেলে তারপরও ওকে হসপিটালে নিয়ে আসলো। এখন আবার বলছে ইমার্জেন্সি। পাগলটাগল হয়ে গেলো নাকি? খানিকটা জোর গলায় বললো,
-ইমার্জেন্সি মানে? আমি ঠিকাছি বললাম তো।
প্রাপ্তর শীতল চাওনি। ইচ্ছে দমলো না। বললো,
-দেখো মিস্টার গ্যাংস্টার, নামাও আমাকে।
প্রাপ্ত ওকে নিয়ে হাটা লাগালো নির্বিকারচিত্ত্বে। ইচ্ছে নির্বাক আগের মতোই। দুর্বলতার জন্য না হলেও প্রাপ্তর কাজকর্মে এবার সত্যিই ও জ্ঞান হারাবে। করিডরে এক নার্সকে দেখে প্রাপ্ত বললো,
-ইমার্জেন্সির পেশেন্টের কেবিন কোনদিকে সিস্টার?
সিস্টার ড্যাবড্যাব করে ওর কোলে মাস্ক পরিহিত ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে রইলো। বললো,
-পেশেন্ট কে?
-আপনি ডক্টর?
-সরি?
-চেকআপ কি আপনি করবেন? ডক্টরকে ডাকুন এন্ড স্টে আওয়ে ফ্রম মাই ওয়ে!
প্রাপ্তর জোরালো কথায় খানিকটা চমকেই উঠেছে নার্স। আর একটা কথাও বললো না সে। হাত বারিয়ে পাশের কেবিনটা দেখিয়ে বললো,
-দ্ দিস ওয়ে স্যার।
ইচ্ছেকে নিয়ে প্রাপ্ত কেবিনে ঢুকলো। ওকে বেডে শুইয়ে দিয়ে হাত ঝাকি মারলো নিজের। অনেকটা পথ বইতে হয়েছে ইচ্ছেকে। হাত লেগে গেছে। শার্টের হাতা ঠিকঠাকমতো গুটাচ্ছিলো প্রাপ্ত। ইচ্ছে শোয়া থেকে উঠে বসলো। গলা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বললো,
-এটা কি হলো?
প্রাপ্ত হাতা ফোল্ড করা বাদ দিয়ে, নার্সের দিকে তাকালো একপলক। বললো,
-তুমি অসুস্থ্য।
-তোমাকে বলেছিলাম আমি ঠিকাছি।
-তারপরও জ্ঞান হারাতে যাচ্ছিলে!
-তো…
প্রাপ্ত এগিয়ে বেডে হাত রেখে বেশ অনেকটাই ঝুকে দাড়ালো। ইচ্ছে কথা থামালো নিজের। গুটিয়ে গিয়ে হাত দিয়ে মাস্কটা ঠিকঠাক করে তুলে নিলো। আবারো কিছু বলতে যাবে, প্রাপ্ত বলে উঠলো,
-সেদিন কি বলেছিলে? প্রান বাচিয়েছিলে তুমি আমার? তার বিনিময়ে থ্যাংকস্ দিয়েছিলাম তোমাকে রাইট? অনেক ভেবে দেখলাম, সাদমান ইনাব প্রাপ্ত তো কোনোদিন কারো ঋন রাখে নি। সেখানে তো তুমি প্রানঋনে ঋনী করে দিয়েছো আমাকে। এতোবড় ঋন কিভাবে রাখি বলো? তাই আজকে তোমাকে হসপিটালাইজড্ করে দিয়ে বাচিয়ে দিলাম। হিসাব বরাবর। থ্যাংকস দিতে হবে না। ওয়েলকাম।
প্রাপ্ত বেরিয়ে গেলো কেবিন থেকে। দু দন্ড পাথর হয়ে বসে রইলো ইচ্ছে। কপালে হাত রেখে দুম করে শুয়ে পরলো ও। সবটা ভেবে হাসতে লাগলো পরপরই। তেমন অসুস্থ্য না হওয়া সত্ত্বেও, ওকে জোর করেই হসপিটালাইজড্ করে, তার সো কল্ড প্রানঋন নাকি শোধ করে গেলো এই ছেলে। ওর প্রতি সেন্সিটিভিটি না বুঝিয়ে, লজিক ছুড়ে গেলো। একেই হয়তো বলে, ভাঙবে তবু মচকাবে না। পাশে দাড়িয়ে থাকা নার্সটা অবুঝের মতো শুধু সবটা দেখলো। কপাল কুচকে তাকিয়ে রইলো ইচ্ছের দিকে। কি বলে গেলো ছেলেটা? হিসাব বরাবর? ওয়েলকাম? এভাবে কোলে করে হসপিটালে ভর্তি করিয়ে কে ওয়েলকাম জানায়? এটা কোন হিসাববিজ্ঞানের কোন হিসাবের কোন কমার্স? শুধু কি ছেলেটাই পাগল? নাকি সাথে মেয়েটাও? ইমার্জেন্সির পেশেন্ট তো নয়ই এ। আদৌও কি কোনো রোগী? নাকি কোনো পাগলের পাগলামীর ভুক্তভোগী?
#চলবে…
#প্রেমনোঙর_ফেলে
লেখনীতেঃ মিথিলা মাশরেকা
২৫.
প্রাপ্ত চলে গেছে বেশ অনেকক্ষন। ওর পাগলামোগুলো ভেবে এতোটা সময় শুধু নিশব্দে মিটিমিটিয়ে হেসেছে ইচ্ছে। অনেকটা সময় পর খেয়াল হলো, আবারো শরীর দুর্বল লাগছে ওর। পাশে তখনো সে নার্স থমকে দাড়িয়ে। চুপচাপ উঠে বসলো ইচ্ছে। গলা ঝেড়ে বললো,
-একচুয়ালি…
-উনি আপনাকে নিয়ে অনেক সেন্সিটিভ।
ইচ্ছে কিছু বলার আগেই নার্সটা বলে উঠলো। ইচ্ছে থামলো। সত্যি তো এটাই, জীবনে ওকে নিয়ে চিন্তা করার মানুষ আছে। ওর বাবা, রাকীন, রাকীনের বাবা-মা সবাই ভাবে ওকে নিয়ে। তবে চিন্তা করলেও ওকে সময় দেওয়ার সময় হয়ে ওঠে না কারোরই। তাই প্রাপ্তর মতো এমন করে কারো সেন্সিটিভিটি দেখা হয়ে ওঠেনি ইচ্ছের। ইচ্ছে নখ দেখতে দেখতে মৃদ্যু হেসে বললো,
-মেবি।
নার্স চুপ রইলো। দু দন্ড পরই ইচ্ছে ধ্যান ভাঙলো নিজের। বললো,
-সরি সিস্টার। ও এভাবে আমাকে এখানে নিয়ে আসলো, আ’ম রিয়েলি সরি।
-ইটস্ ওকে। কিছু মানুষের ভালোবাসা দেখতেও ভালো লাগে। অল দ্যা বেস্ট টু বোথ অফ ইউ।
ইচ্ছে নির্বাকচোখে তাকিয়ে রইলো। আর পাঁচটা সাধারন মেয়েকে বুঝি ওদের ভালোবাসার মানুষটা এভাবেই যত্ম নেয়? তাই বুঝি ওকে আর প্রাপ্তকে তুলনা করলো নার্স? তাহলে ওর জীবনটা কেনো এতো সুন্দর না? কি দোষ করেছে ও? সেলেব্রিটি হওয়া তো না। তবে কি নিজেকে খোলকে মুড়িয়ে রাখার জন্য? ও তো চেয়েছিলো কেউ নিজে থেকে এসে বুঝুক ওকে। ভালোবাসুক ওকে। সেই ছোট থেকে রাকীনের সাথে বড় হলো। কই? কখনো তো রাকীনকে নিয়ে এতোকিছু ভাবার সুযোগ হয়নি ওর। তবে কেউই কি নেই ওকে বোঝার জন্য? ওকে চুপ থাকতে দেখে নার্স আবারো বললো,
-জলদি জলদি স্যারের অভিমান ভাঙাবেন কিন্তু ম্যাম! স্যার বেশ অনেকটা অভিযোগ করে বেরিয়ে গেলো বলে মনে হলো।
ইচ্ছে আবারো মাস্কের আড়ালে মুচকি হাসলো। বাবু হয়ে বসে আগ্রহ নিয়ে বললো,
-তাই? তো কিভাবে স্যারের অভিমান ভাঙাতে হবে সিস্টার? এনি টিপস্?
নার্স একটু চিন্তার ভঙিমা করে বললো,
-উম্…শুনেছি ছেলেরা নাকি মেয়েদের শাড়িতে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে। আপনি শাড়ি পরে স্যারকে ভালোবাসি বলে দেবেন, দেখবেন সব অভিমান গায়েব!
ইচ্ছে শব্দ করে হেসে দিলো এবার। এইসব ফিল্মি বিষয়গুলো কেনো শুনতে চেয়েছিলো ও, কেনো শুনলো, নিজেও জানে না। তবে এগুলো কোনোদিনও ঘটার নয়। নার্সকে আরো দুবার সরি বলে সৌজন্য হেসে হসপিটাল থেকে বেরোলো ও। ইতিমধ্যইে রাকার কল। রিসিভ করতেই রাকা বললো,
-কোথায় তুই ইচ্ছে?
-লিভ ইট। তুই কোথায়?
-তুই যে হসপিটালে, তার রিসেপশনে দাড়িয়ে আছি। প্রাপ্ত ভাইয়া কল করে বললো তুই নাকি হসপিটালে? নিশ্চয়ই আজও বাসা থেকে না খেয়ে বেরিয়েছিস? তাই সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলি। তাইনা? কতো নম্বর কেবিনে তুই এখন? প্রাপ্ত ভাইয়া বললো…
-প্রাপ্ত?
বিস্ময়ে বললো ইচ্ছে। রাকা বললো,
-হ্যাঁ! ভাইয়া তো…ন্ না মানে, আগে বল তুই কোথায়?
-বেরিয়েছি।
-ও! বেরিয়েও গেছিস? আচ্ছা ঠিকাছে। তুই পাশের রেস্ট্রুরেন্টে বস। আমি আসছি।
নতুন নতুন রোমান্টিক গল্প পেতে ভিজিট করুন আমাদের ফেসবুক পেজ ” নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ” এবং ফলো করে সাথেই থাকুন।
নিরবে কল কেটে তাই করলো ইচ্ছে। কেমন অদ্ভুত লাগছে ওর। প্রাপ্ত রাকাকেও জানিয়েছে ওর বিষয়ে। তারমানে শুধু ঋনপরিশোধ ছিলো না সবটা। চুপচাপ বসে রইলো ও রেস্ট্রুরেন্টের এক কোনে। মিনিটপাঁচেকের মধ্যে রাকা হাজির। ও এসেই আগে জরিয়ে ধরলো ইচ্ছেকে। স্বস্তির শ্বাস ফেলে বললো,
-শুকরিয়া খোদার। ঠিক আছিস তুই!
-রাকা…
-কোনো কথা না! আগে তুই কিছু খেয়ে নে!
-কিন্তু রাকা…
-ওয়েটার?
রাকা ওয়েটারকে ডাক লাগালো। বলার সুযোগ দেয়নি ইচ্ছেকে। ইচ্ছেও আর তেমন কিছু বললো না। রাকার সাথে বসে খেয়ে নিলো চুপচাপ। খাওয়া শেষে বললো,
-তোকে এখানে প্রাপ্ত আসতে বলেছে?
রাকা মোবাইলে ব্যস্ত ছিলো। ইচ্ছের কথা শুনে তৎক্ষনাৎ বন্ধ করলো মোবাইল। বললো,
-ম্ মানে, ও্ ওই…আসলে…
ওকে তোতলাতে দেখেই ইচ্ছে বুঝলো, প্রাপ্তই বলেছে ওকে আসতে। ইচ্ছে চুপ রইলো। রাকা ধীর গলায় বললো,
-তুই রাগ করেছিস প্রাপ্ত ভাইয়া আমাকে বলেছে বলে?
-তেমন কিছু না রাকা। তবে আমি ঠিক আছি। এভাবে তোকে বলে…
-ভাইয়া তোকে নিয়ে অনেক ভাবে ইচ্ছে।
-ইয়াহ্! সরি, থ্যাংকস্, ওয়েলকাম করার নিত্যনতুন উপয়াগুলো আমার ওপর এক্সপেরিমেন্ট করতে হবে যে!
-হ্যাঁ! শুধু তোরই ক্ষেত্রে সরি বলেছে সে। থ্যাংকস্ বলেছে। আরো হয়তো অনেককিছু, যা না আমি জানি, নাইবা তুই!
ইচ্ছে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। তারপর খানিকটা গুরুগম্ভীরভাবে বললো,
-কি বলতে চাইছিস তুই বলতো রাকা? তুই জানিস, আমার কথা প্যাচানো পছন্দ না। যা বলার স্ট্রেইটলি বল।
রাকা একশ্বাসে বলে দিলো,
-আমার তো মনে হয়, প্রাপ্ত ভাইয়া তোকে ভালোবাসে।
ইচ্ছে থমকে গেলো রাকার কথায়। খানিকক্ষন তাকিয়ে থেকে জোরপুর্বক হাসার চেষ্টা করে বললো,
-রিল্যাক্স)। আই নো, মিস্টার গ্যাংস্টার ওসব প্রেম ভালোবাসা টাইপের ছেলে না।
-বাবা! ইনায়াত নিক্কন, দ্যা রকস্টার! একটা গ্যাংস্টার কেমন ছেলে, কেমন না, তার সম্পর্কে ভালোই জেনে গেছে দেখছি।
রাকার কথায় ইচ্ছে চুপ করে গেলো আবারো। তবে এটাও বুঝলো, ওকে মৌনতায় মানায় না। মৌনতা মানেই দুর্বলতা। কিন্তু ইচ্ছে তো দুর্বল নয়! রাকার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে, একটা শ্বাস ছেড়ে ইচ্ছে শক্তভাবে বললো,
-হাজারো ফ্যানফলোয়ার ভালোবাসে ইচ্ছেকে। এদের সবাইকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত না রাকা। তবে হ্যাঁ, ঠিকই বলেছিস তুই। না চাইতেও, ঘটনাক্রমে প্রাপ্তকে অনেকটাই চিনে গেছি। তুই যা ভাবছিস, ওর দ্বারা এমন কিছু হতে পারে না।
-তুই চাস না এমন কিছু হোক?
-রাকা!
ইচ্ছের কড়া গলা। রাকা দমলো না। শান্তভাবে বললো,
-কি হতে পারে, কি হতে পারে না, সেটা আমি, তুই, আমরা কেউই ঠিক করে দিতে পারি না ইচ্ছে। কিন্তু আমরা কে কি চাই, সেটা নিতান্তই আমরা জানি। তুই কি চাস, সেটা শুধু তোর মনই জানে। আমার শুধু একটাই অনুরোধ, ওই মনকে বেধে রাখিস না তুই। বাধা দিস না! সে অনুভূতি যার জন্যই হোক, তাকে নিজের করে নিস। প্লিজ ইচ্ছে! প্লিজ!
রাকার অনুনয়। ইচ্ছে উঠে দাড়ালো। সাথে রাকাও। ও বেশ বুঝলো ওর কথাগুলোই ইচ্ছের অস্থিরতার জন্য দায়ী। তবে তার জন্য ওদের বন্ধুত্ব নষ্ট হবে না, এ বিষয়েও নিশ্চিত রাকা। ইচ্ছে বেরিয়ে আসার জন্য পা বাড়িয়েও থেমে গেলো কি মনে করে। আবারো রাকার দিকে ফিরে তাচ্ছিল্যে বললো,
-ভালোবাসা আমার জন্য ধূসর মরুভূমির জলের মতো রাকা। হয় দুর্লভ, নয় মরিচীকা। সত্যিকার প্রেমজোয়ার পেলামই বা কই, প্রেমনোঙরে আটকাবো বলে? দোষটা কি আমার?
রাকা নিরত্তর। ইচ্ছে বললো,
-তবে হ্যাঁ! যদি সত্যিই কোনোদিন অনুভব হয়, এই সেই ভালোবাসার অনুভব, এই সেই প্রেমজোয়ার, কথা দিচ্ছি, সে জোয়ারে আমি সর্বস্ব উজার করে দেবো। সবটা! আর তখন পুরো পৃথিবী দেখবে ইচ্ছের ভালোবাসা। হার ক্রেজিনেস। কজ ইচ্ছে ও’ন্ট ফল ইন লাভ । শি উইল রাইজ ইন লাভ রাকা! শি উইল রাইজ ইন লাভ!
বলা শেষ করে ইচ্ছে রেস্ট্রুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গেলো। পেছনপেছন ছুটতে ছুটতে এতোক্ষনে মোবাইলে চলা কলটা কাটলো রাকা। সঙ্গেসঙ্গে বাইক ব্রেক করলো প্রাপ্ত। সবে যেনো ভেতর থেকে শ্বাস বেরোলো ওর। কানে গোজা ব্লুটুথটা কান থেকে খুলে, নিচের ঠোট কামড়ে ধরলো ও। ইচ্ছেকে ছেড়ে হসপিটাল থেকে চলে চলে আসলেও ওকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছিলো প্রাপ্তর। তাই ওই রাকাকে হসপিটাল যেতে বলেছিলো। ইচ্ছেকে দেখতে যেতে। কিন্তু রেস্ট্রুরেন্টে ঢুকে রাকা কল করেছিলো ওকে। ব্লুটুথে রিসিভ করে, কয়েকবার হ্যালো হ্যালো বলেও প্রতিত্তর পায়নি প্রাপ্ত। ভেবেছিলো রাকা হয়তো ভুলে ডায়াল করেছে। ও নিজেই কল কেটে দিতে যাচ্ছিলো। কিন্তু ইচ্ছের স্বর শুনে আর কলটা কাটতে ইচ্ছে করেনি ওর।
ওদের কথোপকথন শুনতে শুনতেই প্রাপ্ত বাইক চালিয়েছে পুরোটা পথ। কিন্তু ইচ্ছের শেষ কথায় কিছু তো ছিলো! গায়ের সমস্ত জোর যেনো সব হারিয়ে ফেললো ও হঠাৎই। মাঝরাস্তায় নিজের বিমুঢ় সত্ত্বাটা নিয়ে বাইক দাড় করিয়ে রেখেছে। “ইচ্ছে প্রেমে পরবে না, ইচ্ছে তো প্রেমে উত্তল হবে। প্রেমজোয়ারে উত্থানলাভ করবে সে। মাতবে, প্রেমপাগলামিতে।” কানে শুধু এই কথাগুলোই বাজতে লাগলো প্রাপ্তর। পেছনের হাজারো গাড়ির হর্নের শব্দ কানে আসলো না ওর। মনপ্রান জুড়ে বরং এক তীব্র লোভের সঞ্চারন, “ওই ইচ্ছেনদীতে ভরাডুবি হোক শুধু প্রাপ্তর। প্রেমজোয়ার হোক তো হোক,প্রাপ্তর নামে। শুধুই প্রাপ্তর নামে!”
#চলবে…