#বৃষ্টি_তোমাকে_দিলামপর্ব-১৪

0
206

#বৃষ্টি_তোমাকে_দিলামপর্ব-১৪

ঈদের পর আমরা সবসময় গ্রামের বাড়িতে যাই। সবুজ ঘেরা বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত আর ঝিরঝির করে বয়ে চলা সরু নদীর পাশের চমৎকার একটা গ্রামে আমাদের পৈতৃক বাড়ি। সেখানে আগে বাবা চাচা ফুপুরা সবাই থাকতেন। দাদা দাদী মারা গেছেন আগেই। এখন শুধু ছোটো চাচা বাস করেন। তার গঞ্জে কাপড়ের দোকান আছে।

কুরবানীর ঈদের পরের সময়টা সবাই গ্রামে আসে। আমরা, মেজো চাচারা, ফুপুরা সবাই। এবারও চললাম। কেমন যেন খারাপ লাগছিল এবার যেতে। না গেলে হয়তো বর্ষণের সাথে কিছুটা সময় কাটানো যেত। বোধহয় এই প্রথমবার গ্রামে যাওয়ার উৎসাহে খানিকটা ভাটা পড়েছে।

ভোরে রওনা দিয়ে আমরা পৌঁছুলাম দুপুরের পর। দূর থেকে ইটের বাড়িটা হাতছানি দিয়ে ডাকছিল যেন৷ বাড়িতে ঢুকে মনটা শীতল হয়ে গেল। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলাম।

আজ আবহাওয়া মোটামুটি। বৃষ্টি হতে পারে, আবার নাও হতে পারে। মিঠে বাতাস দিচ্ছে। আমার প্রচুর কাজিন। তাদের সাথে বসে আড্ডা দিচ্ছি, সাথে চাচীর হাতের পিঠে খাচ্ছি অজস্র। বেশ লাগছে!

হঠাৎ বিকেলের দিকে শুনলাম কারা যেন আসছে। কারা আসছে সেই উত্তর আমি কোথাও পেলাম না। জানার চেষ্টাও করলাম না, মেতে আছি নিজের মতো। সন্ধ্যার দিকে যখন আকাশে লালচে আলোর খেলা চলছে, উঁচু তালগাছের মাথাটা আবছা হয়ে আসছে, তখন বাড়িতে কিছু লোকজন এলো।

আমি ঘর থেকে বের হলাম পরিচিত দুটি কন্ঠস্বর শুনে। দুটো ছোট্ট মেয়ে এসে আমার হাত ধরে বলল, “তুমি কেমন আছো?”

মেয়েদুটো চিনি-রিনি। ওরা এখানে এলো কেমন করে? তখনই বর্ষণের দেখা পেলাম। লাজুক মুখে হাসছে। ওর মা বাবাও এসেছে।

কিছু বুঝে ওঠার আগে আমি জানতে পারলাম বর্ষণের সাথে আমার বিয়ে। তাও সেটা আজই। ওকে আমি পছন্দ করি সত্যি, কিন্তু হুট করে বিয়ে হবে এটা কেমন কথা?

ভেতরের ঘটনা জানলাম রাতে বিয়ে পড়ানোর একটু আগে। সব আয়োজন আগেই করা ছিল। আমি মা বাবার সাথে রাগ দেখিয়ে একটা ঘরে গোজ হয়ে বসেছিলাম।

তখন তরী এসে বলল, “আপা তুমি রেগে আছ কেন?”

তরী ছোটো চাচার মেয়ে। কলেজে পড়ে। বয়সের তুলনায় অনেক পরিপক্ব, সব বোঝে। বললাম, “ওরা আমাকে কিচ্ছু জানায়নি কেন? আমি কি গ্রামের ছোট্ট মেয়ে যে জোর করে যা খুশি করা যাবে?”

তরী নিজেই যে গ্রামের মেয়ে সেটা খেয়াল হতেই চুপ হয়ে গেলাম। ও কিছুই মনে করল না। হেসে বলল, “গ্রামের মেয়েরা এখন শহরের মেয়েদের থেকে বেশি অ্যাডভান্স, বুঝলে? তোমাকে জানায়নি কারন সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিল।”

“এত জঘন্য সারপ্রাইজ মানুষ কিভাবে দিতে পারে?”

“এটার বুদ্ধি কিন্তু তোমার হবু বরের দেয়া।”

“সে আমাকে কিছুই জিজ্ঞেস করেনি।”

“ওমা সারপ্রাইজ কি জিজ্ঞেস করে দেয় নাকি? তাছাড়া সে বলেছে তোমার সাথে নাকি কথা হয়েছে। তুমি এমনিতেই বিয়েতে রাজি। আপাতত বিয়ে পড়িয়ে রাখবে। বাড়ির সবাই এখন একত্র হয়েছে, এটা ভালো সময়। দেরি করলে দেরি হতেই থাকবে। পরে একসময় দিনক্ষণ ঠিক করে ধুমধাম করে বিয়ের অনুষ্ঠান করা যাবে। মিয়া বিবি রাজি হলে বিয়ে ফেলে রাখতে হয় না।”

আমি তরীর কান টেনে বললাম, “পাকা বুড়ি হয়েছিস তুই! দাদীর মতো কথা বলছিস।”

তরী হেসে বলল, “মনে করো আমিই তোমার দাদী।”

“আমার ভালো লাগছে না রে তরী।”

“তুমি কি ওনাকে পছন্দ করো না?”

“করি।”

“তাহলে?”

“জানি না। ভয় লাগছে।”

তরী বুঝল না কিসের ভয়। বলল, “ওনার সাথে কথা বলবে? লুকিয়ে ডেকে আনি?”

“কথা বলবার হলে মোবাইলেই বলতে পারি। ওর সাথে কথা বলার ইচ্ছে নেই।”

তরী শঙ্কিত গলায় বলল, “তুমি কি বিয়ে করবে না?”

“করব।”

“আচ্ছা। তাহলে ওঠো, ওরা অনেক কিছু এনেছে। সব দেখবে চলো। সাজতেও তো হবে। শাড়ি আমি পরিয়ে দেব। দেখো কত সুন্দর করে পরাতে পারি।”

কাবিননামায় সই করতে গিয়ে হঠাৎ সবকিছু কেমন বদলে গেল। আগের অনুভূতিগুলো শূন্যে মিলিয়ে গিয়ে নতুন চিন্তা ভর করল। গা ভর্তি শাড়ি গয়না আর চারদিকে লোকজন নিয়ে বসে থেকেও আমি এক মুহূর্তের মধ্যে বদলে গেলাম৷ এক পৃথিবী থেকে আরেক পৃথিবীতে পা দিলাম, যেখান থেকে আগের জায়গায় আর কোনোদিন ফেরত আসা যায় না। আমার পরিচিত জনেরা, বন্ধুরা, আমার প্রিয় ঘর, প্রিয় কৃষ্ণচূড়া গাছ, কেউ জানল না, আমি পর হয়ে গেছি।

এখন আমার সবচেয়ে আপন মানুষ সে, যার সাথে আমার পরিচয় অল্পদিনের। তাকে আমি ভীষণ পছন্দ করি, তবু কোথায় একটা কিন্তু কি থেকেই গেছে?

গ্রামেরই কিছু নিকটাত্মীয় এসেছিলেন। সবাই যেতে যেতে বেশ রাত হয়ে গেল। আমার তখন কথাটা মনে হলো। বর্ষণদের কোনো আত্মীয়ই তো আসেনি। তাদের কি জানানো হয়নি? এর উত্তর অবশ্য পেয়েছি অনেক পরে।

রাতে শুয়েছি পাশাপাশি। বর্ষণ চুপচাপ পড়ে আছে। কথাবার্তা বলছে না৷ বাইরে জোর হাওয়া বইছে। টিনের চালে গাছের ডাল বাড়ি খাওয়ার শব্দ আসছে। জানালার একটা পাল্লা খোলা। অদ্ভুত এক রাত! এমন রাত আর কখনো আসেনি। হয়তো আসবেও না৷ আমি নিজে কথা বলছি না৷ অপেক্ষা করছি সে কথা বলবে৷ এখানে আসা অবধি সে একটা শব্দও বলেনি আমার সাথে।

অপেক্ষার প্রহর খুব দীর্ঘ হলো না। বর্ষণ বলল, “স্যরি! আমি তরীর কাছে শুনলাম তোমার খুব মন খারাপ।”

“বাদ দাও, যা হবার হয়ে গেছে। আগের কথা তুলে লাভ নেই।”

“নতুন জীবন শুরু করার আগে পুরানো হিসেব মিটিয়ে ফেলা ভালো।”

“কোনো হিসেব বাকি নেই বর্ষণ। সব ঠিকই আছে। আমি হঠাৎ বিয়ে মেনে নিতে পারছিলাম না। কিন্তু হলো তো। এটা নিয়ে বেশি ভেবে কাজ নেই।”

“শীত লাগছে তোমার?”

“না তো।”

“তাহলে কাঁপছ কেন?”

“কোথায়?”

“তোমার হাত পা কাঁপছে অল্প অল্প।”

“কী যেন!”

বাতাসের সাথে পানির ঝাপটা আসতে শুরু করল। বৃষ্টি পড়ছে। বর্ষণ উঠে গিয়ে জানালা আটকে দিয়ে এলো। ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেল। ঘরে কয়েকটা মোমবাতি এমনি জ্বালিয়ে দিয়ে গিয়েছিল বাচ্চাগুলো। সেগুলোর আলোয় ঘর আলোকিত।

আমি বর্ষণের মুখের দিকে তাকালাম। মনে হলো বহু যুগের পরিচিত মুখ। আলোয় উদ্ভাসিত সেই মুখের দিকে তাকিয়ে অনায়েসে অজানা কোনো পথের দিকে পাড়ি দেয়া যায়।

কী সব যে ভাবছি! নিজেরই আজব লাগছে। গা শিরশির করছে। হাত পা কাঁপছে এখনো।

কয়েকটা চাচাতো বোন ফিসফিস করছিল বিয়ের আগে। বরকে তাদের পছন্দ হয়নি৷ ছেলেমানুষ এত ফরসা হলে মেয়েলি ভাব চলে আসে। তার ওপর এই ছেলে লজ্জা পায় অতিরিক্ত। আড়াল থেকে শুনে খুব বিরক্ত লাগছিল আমার।

এখন বর্ষণের চেহারা মোমের আলোয় ভীষণ লাজুক দেখাচ্ছে। টকটকে গায়ের রঙ, এলোচুল আর চোরা চাহনির মানুষটাকে দেখে যে কেউ প্রেমে পড়তে পারে। আমি বড় করে নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, “শোবে না?”

সে হাসল। দুই গালে টোল পড়ল। আমি বাক্যহারা হয়ে তাকিয়ে রইলাম৷ টিনের চালে ঝমঝমিয়ে পড়া বৃষ্টির মতো প্রেমে পড়লাম আমি। বহু আকাঙ্ক্ষিত প্রেম!

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here