#বৃষ্টি_তোমাকে_দিলামপর্ব-১৫
বিয়ের অল্পদিন পরেই আমাকে চলে যেতে হলো ক্যাম্পাসে। পড়াশুনা শেষ তো করতে হবে! যদিও স্বপ্নের মতো দিনগুলো ছেড়ে যেতে বড় কষ্ট হচ্ছিল। গ্রামের বাড়ি থেকে ফিরে মনে হয়েছে বর্ষণের সাথে বিয়ে হয়ে ভালোই হয়েছে আমার। এইযে পাশাপাশি বাড়ি, চাইলেই এবাড়ি থেকে ওবাড়ি ছুটতে পারি, এরচেয়ে ভালো আর কী হতে পারে? মা বাবাকে রোজ দেখছি, আমার স্বামীর বাড়িতেও থাকা হচ্ছে।
চিনি রিনির দুষ্টুমি এখন যেন একটু কম। দুটিতে সারাদিন আমার পেছনে ঘোরে। আমি ওদের গোসল করিয়ে দেই, সাজিয়ে দেই, ঘুম পাড়িয়ে দেই, ওদের সাথে খেলি।
আমার শ্বাশুড়িও ভীষণ ভালো। এত ভালো মানুষ ইদানীং দেখা যায় কি না সন্দেহ। আমাকে একেবারে আদরে ভালোবাসায় জড়িয়ে রাখল।
আর বর্ষণ! সে যে ভীষণ রোমান্টিক সেটা আগে কখনো বোঝা যায়নি। আমি মুগ্ধ হয়ে ওর কথা শুনি। স্বপ্নগুলো শুনতে শুনতে ওর হাতের ওপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ি। সময়গুলো পাখির মতো উড়ে পালাল, আমিও ফিরলাম দৈনন্দিন জীবনে।
এবার মনে হলো পড়াশুনা যত দ্রুত শেষ হয় তত ভালো। ক্লাস করতে গিয়ে তীব্র আলস্য চেপে বসে, পড়তে বসলে ইচ্ছে হয় একটু কথা বলি বর্ষণের সাথে। মানুষের চোখে রঙিন চশমা বসে যায় টিনএজে। আমার পড়ল বিয়ের পর। যা দেখি সব সুন্দর লাগে। মেঘগুলোকে ডেকে ডেকে বলতে ইচ্ছে হয়, আমার একটা ভালোবাসার মানুষ আছে!
★
জগতের ধ্রুব সত্য হলো এই, সুখ বেশিদিন সহে না। কালো কালো মেঘের আঁধার ঢাকা এক দিনে বুঝি মেঘেদের পাল এসে আমার রঙিন চশমাটা তুলে নিয়ে গেল।
ক্লাস নেই বলে বসে আছি রুমেই। জানালার ধারে একটা চেয়ার টেনে বসেছি৷ আমার জানালা দিয়ে জারুলের গাছ দেখা যায়৷ এখন ফুল নেই। সময়টা শরৎকাল। তবু আকাশ মেঘে ঢাকা আজ৷ নীরা আপু ঘরে নেই। বর্ষণকে ফোনে পাচ্ছি না। মনটা খানিক খারাপ। হাতে খটোমটো একটা ইংরেজি বই। আমার মন পড়ে আছে দূর অজানায়।
হঠাৎ মোবাইলে টুংটাং নোটিফিকেশন। কোনো এক অপরচিত ব্যক্তি আমাকে মেসেজ পাঠাতে চায়। মেসেজ রিকোয়েস্টে গিয়ে তাকে পেলাম৷ মেয়ে আইডি। নাম লুবনা হাসান। মেসেজ দেখে আমার মাথায় বাজ পড়ল!
“আপনি বর্ষণ আহমেদের কে হন? তার সাথে আপনার এত কী প্রয়োজন?”
আমি হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম৷ বিয়ের কথাটা আপাতত দুই পরিবারের বাইরে কেউ জানে না। অনুষ্ঠান করে একেবারে জানানো হবে। ফেসবুকে রিলেশনশিপ স্ট্যাটাসও তাই বদলানো হয়নি। কিন্তু এটা আবার কে?
উত্তরে লিখলাম, “তাতে আপনার কী প্রয়োজন?”
মেয়েটা লিখল, “আমি ওর প্রেমিকা। ওর থেকে দূরে থাকবেন।”
আমার রাগে মাথা গরম হয়ে গেল। নিশ্চিত ফাজলামো করছে। কিন্তু কেন করছে? এতকিছু ভাবার সময় পেলাম না। মেয়েটাকে ব্লক করে দিলাম।
তারপর বর্ষণকে ফোন করলাম৷ ফোন ওয়েটিং। আশ্চর্য তো! কার সাথে কথা বলছে এক ঘন্টা থেকে?
কয়েকবার ডায়াল করার পর একসময় সে ফোন ধরে বিরক্ত গলায় বলল, “এত অস্থির হয়েছ কেন ধারা? ইম্পর্টেন্ট কলে ছিলাম।”
“তোমার এত জরুরি আলাপ কার সাথে করতে হয় ঘন্টার পর ঘন্টা? অফিস আদালতে চাকরি তো করো না! এত কিসের কথা? আর এই লুবনা হাসানটা কে?”
সে ততোধিক বিরক্ত হয়ে বলল, “তুমি কি কিছু শোনার অবস্থায় আছ? রাগে পাগল হয়ে গেছ।”
তার ঠান্ডা গলা শুনে আমার অসহ্য লাগতে শুরু করল। আমি যথাসম্ভব শান্ত গলায় বললাম, “আমি রাগ করছি না। তুমি বলো।”
“কী বলব?”
“লুবনা হাসান কে?”
“ফেসবুকে আমার গল্প পড়ে।”
“সে আমাকে মেসেজ দিয়ে বলেছে সে তোমার প্রেমিকা।”
বর্ষণ হো হো করে হেসে ফেলে বলল, “ওইটা একটা পাগল। এসব বলে বেড়ায়।”
“কাকে বলে বেড়ায়?”
“আমার ফেসবুকের সব মেয়ে ফলোয়ারদের।”
“কেন বলে?”
“একসময় আমাকে পছন্দ করত, আমি সাড়া দেইনি, তাই প্রতিশোধ নিতে।”
“বর্ষণ তুমি কি বুঝতে পারছ তুমি এলোমেলো কথা বলছ? তোমার ওপর প্রতিশোধ নিতে এসব করলে তুমি তাকে ব্লক করছ না কেন?”
“ফেসবুকে চাইলে হাজারটা আইডি খোলা যায়। সে একেকবার একেক আইডি দিয়ে আমাকে ফলো করে। ব্লক করে শেষ করা যায় না।”
আমি আন্দাজে একটা ঢিল ছুঁড়লাম৷ হঠাৎ ওই বুদ্ধি কোথা থেকে মাথায় এলো নিজেও জানি না। বললাম, “মেয়েটা আমাকে তোমার সাথে কথোপকথনের স্ক্রিনশট দেখিয়েছে। সেটা দেখেই বোঝা যায় তোমার সাথে তার কত গভীর সম্পর্ক।”
বর্ষণ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “আসলে একসময় আমাদের একটা সম্পর্ক ছিল, কিন্তু এখন নেই। তখনকারই স্ক্রিনশটগুলো।”
আঁধারে ছোঁড়া ঢিল লেগে গেলে মানুষ হয়তো খুশি হয়, আমার কলিজায় গিয়ে লাগল বুঝি ঢিলটা। মুখে ওড়না চাপা দিয়ে উত্থিত কান্নাটা আটকে কোনোমতে বললাম, “ডেট দেখেছি আমি। ওগুলো ইদানীংকালের।”
“ভুয়া স্ক্রিনশট ধারা। তোমাকে বোকা বানিয়েছে।”
“তুমি ওর সাথে কলেও দীর্ঘ সময় ধরে কথা বলো।”
“ও বলে। বাচাল একটা মেয়ে। আমি শুধু শুনি।”
“আমাদের বিয়ের পরেও তুমি ওর সাথে কথা বলেছ।”
“ধারা, ও চাচ্ছে আমার লাইফে ব্যাক করতে। কিন্তু তা কী করে সম্ভব? সেটাই বোঝাচ্ছিলাম। এর বেশি কিছু না।”
“তুমি আর কত মিথ্যে বলবে বর্ষণ? শুরু থেকে অবরত কথার ধরণ পাল্টে যাচ্ছ! একের পর এক নতুন কথা বলছ।”
“লুবনা তোমাকে আর কী কী বলেছে?”
“ওকেই নাহয় জিজ্ঞেস করো।”
“ধারা ফোন কাটবে না।”
“কিছু বলবে?”
“স্যরি! মানুষেরই তো ভুল হয় তাই না? আর ও অনেক অতীতের বিষয়। এখন ওর সাথে আমার কিচ্ছু নেই। বিশ্বাস করো একবার। বিয়ের পর থেকে তোমাকে ছাড়া আর কিছু ভাবতেও পারি না আমি। ”
“ঠিক আছে।”
“তুমি ভুল বুঝছ এখনো।”
“হুম।”
“রাগ করে না লক্ষীটি।”
আমি উত্তর দেবার প্রয়োজন মনে করলাম না। ফোন কেটে মোবাইল বন্ধ করে ফেলে রাখলাম৷ ভীষণ কান্না পাচ্ছে। কেমন দুর্বল লাগছে। আমি চেয়ার থেকে উঠে বিছানায় যেতে যেতে মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম।
জ্ঞান ফিরল নীরা আপুর ঝাকুনিতে। পাশের ঘরের কয়েকজনকেও দেখলাম আশেপাশে। প্রথমটায় কিছু মনে পড়ল না। সব মনে পড়তেই বুকের ভেতর ফাঁকা লাগতে শুরু করল। চোখ ভিজে উঠল। কোনোমতে বললাম, “দুপুরে খাইনি তো, তাই হয়তো…”
নীরা আপু সবাইকে বিদায় করে আমাকে খাওয়াতে বসলেন। তার নিজের হাতের রান্না মাছের ঝোল আর পেঁয়াজ মরিচের ঝাল ভর্তা৷ খেতে খেতে আমার চোখ দিয়ে জল গড়াতে লাগল অনবরত। কিছুতেই থামতে পারছি না। নীরা আপু একটা প্রশ্নও না করে আমাকে খাওয়ালেন। তারপর হাত ধুয়ে এসে আমার কাছে বসে বললেন, “আমি ঘরে ঢুকছিলাম, তোর ফোনে কথা বলা শুনে আর ঢুকিনি। কার সাথে ঝামেলা হয়েছে আমাকে বলবি? বললে হালকা লাগবে।”
আমি আপুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললাম। খুলে বললাম সবটা।
আপু আমাকে বোঝালেন, “এতটুকুতেই কিছু বোঝা যায় না। আগে পুরোটা ভালো করে খতিয়ে দেখতে হবে। তুই আগে ওর ফেসবুক একটিভিটিজ ভালো করে দেখ। কিছুদিন কেমন ব্যবহার করে সেসব খেয়াল রাখ। প্রমাণ পেলে ধরবি। হতেও তো পারে, ছেলেটা সত্যি বলছে। বিয়ের আগে কিছু ছিল, এখন নেই। এরকম তো থাকেই বল? আর ও লেখক মানুষ, পাগল ফ্যান থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। তোর কি আগে কখনো ওকে চরিত্রহীন মনে হয়েছে?”
“না আপু!”
“তাহলে? তুই একটু ধৈর্য ধরে দেখ কী হয়। পরেরটা পরে ব্যবস্থা করা যাবে। এভাবে কাঁদে ছোটো বাচ্চারা। চোখ মোছ। চল লনে যাই। মেয়েরা ক্রিকেট খেলছে, সেখানে বসব।”
আমি আপুর সাথে বের হয়ে এলাম। সেখানে দেখা নীনার সাথে। ওর সাথে বন্ধুত্বটা এখন একেবারে ঝিমিয়ে পড়েছে। কথাই হয় না বলতে গেলে। ওকে দেখলাম খুশিতে ঝলমল করছে। আমার পাশে বসে বলল, “জানিস, ওর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম।”
আমার এসব শোনার কোনো আগ্রহ হলো না। বললাম, “ওহ।”
“অনেক ছবি তুলেছি। এত ইচ্ছে করছে আপলোড দিতে, কিন্তু মহাশয়ের নিষেধ! তোকে দেখাই, তুই আর কাউকে দেখাবি না প্রমিজ?”
ওর প্রেমিককে দেখার ইচ্ছে না থাককেও হ্যাঁ বলে দিলাম। বেচারি সুখে আছে, থাকুক।
নীনা আমাকে মোবাইলে একটা ছবি বের করে দেখাল। আমি শুধু ওর প্রেমিককে দেখলাম স্তব্ধ হয়ে। হাসিমাখা মুখে বর্ষণ দাঁড়িয়ে আছে নীনার একটা কাঁধ জড়িয়ে, ওর চোখে চোখ রেখে। এটা কি সম্ভব? নাকি আমি ভুল দেখছি? ভুল শুনছি? সন্দেহ আমার মাথা খারাপ করে দিয়েছে? হ্যালুসিনেশন হচ্ছে? বর্ষণের সাথে নীনার যোগাযোগ হবে কেমন করে?
আমাকে নীনা একটা ধাক্কা দিয়ে বলল, “কী হলো তোর? স্ট্যাচু হয়ে গেছিস কেন? কেমন বল তো ও? অনেক হ্যান্ডসাম না?”
নীরা আপু কোথায় একটা গিয়েছিল। কখন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে জানি না। নীনাকে বলল, “ওর বোধহয় শরীর খারাপ লাগছে। একটু আগে সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিল। আমারই ভুল হয়েছে এখানে নিয়ে আসা।”
নীনা উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল, “তাই তো! ওকে কেমন যেন দেখাচ্ছে। ধারা! চল তোকে ঘরে দিয়ে আসি।”
আমি অনেক কষ্টে চোখের পানি আটকে রাখলাম৷ চুপচাপ উঠে ওদের হাত ধরে নিজের ঘরে গেলাম।
নীরা আপু নীনাকে বাইরে নিয়ে কথাবার্তা বলে বিদায় করে দিলেন। দরজা আটকে আমার পাশে বসে কাঁধে হাত রেখে বললেন, “নীনার বয়ফ্রেন্ড তোর বর?”
আমি মাথা ঝাঁকালাম শুধু। আপু বলল, “ওর সাথে নাকি ফেসবুকে পরিচয়। ছেলেটা বোধহয় জানে না নীনা তোর বান্ধবী।”
আমি ধরা গলায় বললাম, “নীনাই কেন আপু?”
আপু ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “কে জানে! আমার যার সাথে সাত বছরের সম্পর্ক ছিল, সেও আমার পাশের বাড়ির মেয়েটাকে পছন্দ করে বিয়ে করে ফেলল! আমার কী দোষ ছিল আজও জানি না। এদের বোধহয় জন্মই হয় বহুগামী হওয়ার জন্য!”
আমি আর পারলাম না। চিৎকার করে কেঁদে ফেললাম। আপু আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখলেন শক্ত করে।
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু