#অপ্রিয়_প্রেয়সী পর্ব – ১৫
#লিখা_তানজিলা
সীমান্তর মুখভঙ্গিতে কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করছে না আইজা। আগের মতোই গম্ভীর ভঙ্গিতে ধীর পায়ে আইজার দিকে এগিয়ে আসছে সে। রিয়াদের দিকে একবার চোখ রাখতেই সে বেরিয়ে গেলো। আইজা ঠান্ডা চোখে সবটা দেখে যাচ্ছে।
এখানে প্রবেশ করতেই উদ্ভট এক গন্ধ নাকে ঠেকতে শুরু করেছিলো। তবে তার চেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো একটু আগেই গোডাউনের শেষ প্রান্তে ভাঙাচোরা এক জানালায় আইজার দৃষ্টি পড়তেই ও দেখলো ঠোঁটে মুখে রক্ত নিয়ে হাতের ইশারায় এক লোক ডাকছে ওকে। পরক্ষণেই রিয়াদ এসে দূর্বল লোকটাকে টেনে হিঁচড়ে ভেতরে নিয়ে গেলো। এখন সেই লোকটার ব্যপারে জিজ্ঞেস করতেই সীমান্তর মুখে লেগে থাকা গম্ভীরতার পরিমাণ আগের তুলনায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে।
সীমান্ত আইজার কাছে এসে ওকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেই ভাঙা চশমা গুলো হাতে কঠোর মুখভঙ্গিতে দেখে যাচ্ছে। আইজা অধৈর্য স্বরে প্রশ্ন করে বসলো,
-“আপনি আমার প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন না কেন? লোকটা কোথায়? এসব গুন্ডামি কবে থেকে করছেন আপনি?”
এটুকু বলতে না বলতেই কিঞ্চিৎ আঁতকে উঠলো আইজা। সীমান্ত হুট করেই ওর হাত চেপে ধরে নিজের সাথে কোথায় যেন নিয়ে যেতে শুরু করলো। আইজা সাথে সাথেই নিজের হাত মুচড়ে ছাড়িয়ে নাওয়ার চেষ্টা করছে। যদিও কোন লাভ হলো না। উল্টো সীমান্ত তার হাতের বাঁধন পূর্বের চেয়ে আরও বেশি মজবুত করে বসলো।
-“হাত টা ভেঙে ফেলবেন না-কি? আমার পা খুব ভালো কাজ করে! আমি নিজেই হেঁটে যেতে পারবো। এভাবে টেনে হিঁচড়ে হাত ভেঙে কোথাও নিয়ে যেতে হবে না! আজব তো! আপনি কী কানে শুনতে পান না!!”
আইজার চিৎকার করে বলা কথাগুলোর পরোয়া না করে সিঁড়ি বেয়ে সেকেন্ড ফ্লোরের শেষ প্রান্তের ছোট খাটো রুমটাতে নিয়ে গেলো ওকে সীমান্ত। এখানে এসেই কয়েক সেকেন্ডের জন্য থেমে গেলো সে। আইজা ক্ষুব্ধ চোখে কিছু একটা বলতে গেলেই সীমান্ত আইজার ঠোটের ওপর আঙুল রেখে ইশারায় চুপ হয়ে যেতে বললো। সীমান্তর এরূপ কাজে আইজার জমে থাকা রাগ টা যেন তরতর করে বেড়ে উঠলো।
যদিও এবার আইজা কিছু বলার চেষ্টা করলো না। চুপচাপ সীমান্তর উদ্ভট কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করলো। রুমের একপাশে মাঝারি সাইজের একটা টেবিল আর সাইডে দুটো চেয়ার। এর মধ্যে একটাতে বসে পড়লো সীমান্ত। অন্য চেয়ার টা নিজের সামনে টেনে এনে চোখের ইশারায় আইজাকে সেখানে বসতে বললো সে।
এবার আইজার ভ্রু জোড়া কুঁচকে এলো। সেটা দেখে সীমান্তর মুখভঙ্গিতে কয়েক সেকেন্ডের একটা অদ্ভুত পরিবর্তন দেখতে পেলো আইজা। যেন আইজাকে বিরক্ত হতে দেখা ভিষণ মজার ব্যপার। আইজা নিজের কুঁচকানো চোখ গুলো নিয়েই সীমান্তর সামনে থাকা চেয়ারের দিকে এগিয়ে গেলো। অনেক কিছু জানার আছে ওর সীমান্তর কাছ থেকে!
চেয়ার পর্যন্ত যেতে পারলো না আইজা। তার আগেই হুট করে আইজাকে হেঁচকা টানে নিজের কোলে বসিয়ে দিলো সীমান্ত। ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলো আইজা। পরক্ষণেই তীক্ষ্ণ নজরে সীমান্তর দিকে তাকালো ও। উঠে যাওয়ার চেষ্টা করতেই আইজার কোমরে হাত রেখে আরও জোড়ালো ভাবে ওকে নিজের সাথে মিশিয়ে ফেললো সীমান্ত। এক ঝাঁক অস্বস্তি আর বিরক্তি নিয়ে সীমান্তর বুকে হাত রেখে ধাক্কা প্রয়োগের মাধ্যমে নিজের থেকে তাকে সরিয়ে ফেলায় চেষ্টায় ব্যর্থ হচ্ছে ও।
-“আমার ভালো লাগছে না এসব?”
-“এতো মুড সুইং কেন হয় আপনার বলুন তো? কখনো আমাকে নিজের ওপর আকৃষ্ট করতে চান আবার কখনও কাছে পেয়েও দূরে যেতে চান! সবকিছু তো আর আপনার ইচ্ছে অনুযায়ী হবে না!”
সীমান্তর শীতল কন্ঠ কানে বাজতেই হুট করে শান্ত হয়ে পড়লো আইজা। বেশ ঠান্ডা ভঙ্গিতে আইজাকে ব্যাঙ্গাত্বক কথাগুলো বলে ওর মাথার চুলগুলো খুলে দিলো সীমান্ত। নিজেকে সীমান্তর বাঁধন থেকে মুক্ত করার প্রচেষ্টা মুহূর্তেই বন্ধ করে দিলো আইজা। বাতাসে দুলতে থাকা আইজার খোলা চুলগুলোতে মুখ গুঁজে চুপচাপ বসে আছে সীমান্ত। আইজা নিজের কানের কাছে তার উষ্ণ নিশ্বাস অনুভব করতেই বন্ধ করে ফেললো চোখ জোড়া। সীমান্ত আইজার এক হাত আলতো ভাবে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো। তারপর নরম গলায় বললো,
-“যেদিন প্রথম আপনার কাছে এসেছিলাম মনে আছে?”
আইজার উত্তরের অপেক্ষা না করেই সীমান্ত আরও বলতে শুরু করলো,
-“আপনার চোখে আমার স্পর্শে কোন লাজ ছিলো না। আপনি বাঁধা ও দেননি আমাকে। বিনাবাক্যে নিজেকে আমার বাহুতে ছেড়ে দিয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে আমরা কেউই কাউকে ভালোবাসতাম না। হয়তো আপনার মধ্যে এক ধরনের আকর্ষণ খুঁজে পেতাম আমি! তাই নিজেকে আটকানোর ক্ষমতা ছিলো না। আপনি নিজ থেকেই আমার সম্পর্কে একটা ধারণা পুষে রেখেছিলেন। হঠাৎ এ ধারণা ভাঙলে আপনারই কষ্ট হবে। তাই বলছি, নিজের বর্তমান সীমা অতিক্রম করতে যাবেন না।”
এই মুহুর্তে কী অনুভব হচ্ছে বুঝতে পারছে না আইজা। নিজের পরিস্থিতি নিয়ে এক ধরনের দ্বিধা কাজ করছে আইজার মধ্যে। ও তো শুধু সুখী হতে চেয়েছিলো। সীমান্তকে বিয়ে করা থেকে এ পর্যন্ত নিজের জীবন নিয়ে সুখী হওয়ার যে প্রচেষ্টা ছিলো সেটা পুরোটাই এই মুহুর্তে মরিচীকার পেছনে ছুটে যাওয়ার মতে মনে হচ্ছে ওর কাছে। এ প্রচেষ্টার মাঝে ওর চোখ গুলো যেন এক অদৃশ্য পর্দা দ্বারা আবৃত হয়ে গেছে। হাসি পাচ্ছে আইজার। সীমান্তকে অন্ধ বলেছিলো কোন এক সময়। কিন্তু আসল অন্ধ তো এ পর্যন্ত আইজা নিজেই ছিলো!”
-“সীমা অতিক্রমের বাকিটাই বা কী আছে! আর এই মুহুর্তে কোন কিছুই আমাকে তেমন বিস্মিত করে না। তাই আমার জন্য না ভেবে নিজের অবস্থা নিয়ে ভাবুন। জায়গা টার রহস্য একবার বাইরে গেলে…!”
নিজের কোমরে হালকা চাপ অনুভব করতেই কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠলো আইজা। সীমান্ত রক্তচক্ষু নিয়ে আইজার দিকে তাকিয়ে আছে। সেদিন সাহিলের দিকেও ঠিক এভাবেই তাকিয়েছিলো সীমান্ত। সেই একই চাহনি!
-“আপনি কী চান ওদের মতো আপনাকেও এখানে আঁটকে রাখবো। আপনার পরিস্থিতির কথা ভেবে এতোক্ষণ নরম গলায় কথা বলেছি আমি। সবসময় এতো শান্ত হয়ে থাকবো তার কিন্তু কোন গ্যারান্টি নেই। আমার পারসোনাল ব্যপারে নাক গলানো বন্ধ করুন। সাথে নিজের মুখটাও!”
সীমান্ত তার এক হাত আইজার গলায় আলতো ভাবে রেখে তীক্ষ্ণ গলায় বলে উঠলো। যেন হুমকি দিচ্ছে।
-“আপনি কি আমাকে হুমকি দিচ্ছেন?”
সীমান্ত মৃদুস্বরে হেসে বললো,
-“শুরু টা আপনি করেছেন।”
আইজা নিজের গলায় রাখা সীমান্তর হাত চেপে ধরে বলে উঠলো,
-” এসব বলে শুধু শুধু আমার আর নিজের সময় নষ্ট করবেন না। আমার আপনি বাদেও ভাবার অনেক কিছুই আছে। সত্যি বলতে আমি এখনো নিশ্চিত নই যে, আমার মায়ের এক্সিডেন্টটা কোন পরিকল্পিত খুন ছিলো না!”
-“আপনি কী কাউকে সন্দেহ করছেন?”
সীমান্তর প্রশ্নের সাথে সাথে কোন জবাব দিলো না আইজা। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠলো,
-“আমি কাকে সন্দেহ করছি সেটা তো আপনাকে জানাবো না।”
-“যাকেই সন্দেহ করুন না কেন এই বিষয়ে কিছু করতে যাবেন না!”
সীমান্তর শক্ত গলায় বলা কথাগুলোর জবাবে আইজা তীক্ষ্ণ স্বরে বলে উঠলো,
-“আপনার কাছে হয়তো এই বিষয় বলা সহজ। আমার জন্য না। আপনি পারতেন চুপ থাকতে যদি কেউ আপনার পরিবারের কাউকে খুন করতো!”
আইজার কথায় মুহূর্তেই সীমান্তর চেহারার রঙ পালটে গেলো।
আইজার দিকে তাকিয়ে একটা ক্ষুব্ধ নিশ্বাস ছেড়ে তৎক্ষনাৎ আইজার হাত ধরে সেই অফিস রুমের সাইডে এটাচ একটা রুমের দরজা খুলে সেখানে অনেক টা ছুঁড়েই ঠেলে দিলো ওকে। আইজা দরজার দিকে এগোনোর আগেই ওর মুখের ওপর ঠাস করে দরজা আটকে দিলো সীমান্ত। আইজা দরজা খোলার চেষ্টা করতেই বুঝতে পারলো লক করা। সীমান্ত কী ওকে সত্যি এখানে আঁটকে রাখবে না-কি! আইজার কথায় সীমান্তর এই প্রতিক্রিয়া বেশ ভাবাচ্ছে ওকে।
বাইরে হঠাৎ ভাঙচুরের শব্দ শুনতেই লাফিয়ে উঠলো আইজা। দরজায় থাকা বেশ ছোট এক ছিদ্র খুঁজে পেতেই সেখানে চোখ রাখলো আইজা। সীমান্ত নিজের মাথার চুলগুলো টেনে ধরে ফ্লোরে পড়ে আছে। কিছু একটা ভেঙেছে হয়তো। দরজায় পুনরায় কড়া নাড়তে গিয়েও থেমে গেলো ও। হাত টা কেন যেন ভিষণ কাঁপছে। এতোক্ষণ গরগর করে অনেক কিছু বলে দিলেও এখন আর ভালো লাগছে না। মনের ভেতর টা ভিষণ ভারী মনে হচ্ছে। মাথাটা ভনভন করছে। মস্তিষ্কে শুধু একটা কথাই বেজে যাচ্ছে। এই মুহুর্তে এ ঘর থেকে বের হতে হবে! আইজা নিজের আশেপাশ টা মনোযোগ দিয়ে দেখে যাচ্ছে। কিছুটা ওপরের দিকে একটা বন্ধ জানালা দেখে থেমে গেলো ও। এই জানালা খুললে বাইরে বের হওয়া সম্ভব।
পাইপ বেয়ে কোনমতে নিচে নেমে এলো আইজা। আয়নার নিজের অবস্থা দেখলে হয়তো আঁতকে উঠবে ও! পা টাও টনটন করে উঠছে।খালি পায়ে বেকায়দায় লাফিয়ে পড়েছে দেখে হয়তো! মাথায় এলোমেলো হয়ে থাকা চুলগুলো কোনমতে ঠিক করে চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো ও।
রিয়াদ একটা গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ফোনে কার সাথে যেন কথা বলছে। আইজা লুকিয়ে গাড়ির কাছে যেতেই গাড়ির পেছনের সীটে সেই লোকটিকে বাঁধা অবস্থায় দেখলো। আইজার প্রথমেই সন্দেহ হয়েছিলো এই বাঁধা লোকটাকে কোথাও তো দেখেছে। যদিও এখন মনে পড়ছে না।
আর এই রিয়াদ তো মালি সেজে বাড়িতে থাকে সারাদিন! সরাসরি জিজ্ঞেস করলে কোন উত্তর ও পাবে না। তাই কিছু একটা চিন্তা করে গাড়ির পেছনের ডিকিতে লুকিয়ে পড়লো আইজা। আর কতো সিক্রেট জায়গায় কী কী চলছে জানতে চায় আজ ও!
চলবে…