#অপ্রিয়_প্রেয়সী পর্ব – ৩০
#লিখা_তানজিলা
ফ্লোরে বসে বিছানায় পড়ে থাকা ব্যাক্তিতে এক দৃষ্টিতে দেখে যাচ্ছে আইজা। সামনে থাকা সবকিছুই যেন ঘোলাটে! ওর বাবা গত দুই মাস যাবৎ কোমায়। আর এতো আদরের মেয়ে হওয়া সত্বেও কিছুই জানতে পারলো না ও!
-“আমাদের কিছু জানানো হয়নি কেন?”
আরফানের প্রশ্নের নিশানা ইনসিয়ার দিকে। সে এতোক্ষণ চুপচাপ একপাশে দাঁড়িয়ে ছিলো। আইজার চোখ ইনসিয়ার দিকে পড়তেই সে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
-“আঁখির এক্সিডেন্টের এক কী দুই ঘন্টা আগে আরমান ভাই তোমাদের মামার সাথে যোগাযোগ করেছিলো। সে সময় তার সাথে দেখা করতে পারেনি জামিল। কিন্তু দুইদিন পরে এখানেই কে যেন আরমান ভাইকে রেখে যায়। জামিল অনেক চেষ্টা করেছিলো লোকটাকে বের করার, কিন্তু সম্ভব হয়নি।”
-“আমি সে রাতের সিসিটিভি ফুটেজ দেখতে চাই।”
দীর্ঘ কয়েক মিনিটের নিরবতার পর মুখ খুললো আইজা। ওর চোখ জোড়া ক্লান্তিতে ভরপুর। তবুও গলায় কাঠিন্যতার রেশ রয়ে গেছে। গতকাল থেকে ঘুম সেরকম হয়নি। তারই প্রভাব হয়তো!”
-“এখন না। তোমাকে দেখতে ভালো লাগছে না। এই মুহুর্তে তোমার ঘুমের বেশি প্রয়োজন। নইলে আরো অসুস্থ হয়ে যাবে।”
ইনসিয়া আইজার কাঁধে হাত রাখতেই সে হাত সরিয়ে দিলো আইজা। রুক্ষ কন্ঠে বলে উঠলো,
-“আপনার কী করে মনে হলো এখন আমি ঘুমোতে পারবো! আমি…!”
-“তুমি এখন একা না আইজা। নিজের শরীরের যত্ন নেয়া তোমার জন্য কোন অপশন না। এটা জরুরি!”
শক্ত গলায় বলে উঠলো ইনসিয়া। তৎক্ষনাৎ ঝড়ের গতিতে উঠে দাঁড়ালো আইজা।
-“আমাকে নিয়ে আপনার ভাবতে হবে না। আমি ঐদিনের সিসিটিভি দেখতে চাই!”
এবার আইজার গলায় কোন কঠিনতা নেই। ক্রমশ কম্পিত হয়ে আসছে ওর কন্ঠস্বর। আইজার সামনে থেকে সরে এক দীর্ঘশ্বাস ফেললো ইনসিয়া। নরম গলায় বললো,
-“এই অবস্থায় তুমি চাইলেও কিছু করতে পারবে না। আগে নিজেকে শক্ত করো!”
আইজা কিছু বলার আগেই আরফান আইজাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
-“আমি দেখবো এদিক টা। তুই একটু রিলাক্স হো। আগে সীমান্ত এখান থেকে যাক। তারপর এ বিষয়ে কথা হবে।”
যে ঘরে আরমানকে রাখা হয়েছে তার সাথে এটাচ ছোট ঘরটায় আইজাকে নিয়ে গেলো আরফান। এই মুহুর্তে পাল্টা কিছু বলতেও যেন মুখ ভারী হয়ে আসছে। নরম বিছানায় গা পড়তেই চোখ আপনাআপনি লেগে এলো আইজার। যদিও ঘুমের দেখা নেই। শুধু চোখটাই যেন খুলতে চাইছে না। পেট ক্রমশ গুলিয়ে আসছে।
***
সীমান্তর কথায় জামিল কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে বললো,
-“এসব ভিত্তিহীন কথা বলে লাভ নেই। এখানে বসে থাকলে তোমার সময় নষ্ট ছাড়া আর কিছুই হবে না।”
জামিলের কথায় সীমান্তর এক ভ্রু উঁচু হয়ে এলো।
-“তুই থেকে সোজা তুমি! চমৎকার উন্নতি! কিন্তু এতো বাজে এক্টিং নিয়ে আমাকে চলে যেতে বলছেন! আপনার চোখ মুখের হাবভাব স্পষ্ট বলে দিচ্ছে, আমার ধারণা একদমই ভুল না। আমি দুই ঘন্টা পর্যন্ত এখানেই আমার সময় নষ্ট করবো। হয় শুধু আমার ওয়াইফের সাথে কথা বলে চলে যাবো। নয়তো ওয়াইফ আর ফাদার-ইন-ল দু’জনকেই এ জায়গা থেকে বের করবো!”
সীমান্তর আঁখি জোড়ায় এক অদ্ভুত ভঙ্গি ভর করছে। যেন ও আগে থেকেই সব পরিকল্পনা করে এসেছে।
-“তোমার কাছে কোন প্রমান আছে?”
-“প্রমান থাকলেও তো সেটা আমি আপনাকে দেখাবো না।”
সীমান্তর সোজাসাপটা জবাব। জামিল কয়েক সেকেন্ড সীমান্তর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে উঠে হনহন করে চলে গেলো। সীমান্ত মৃদু হেসে উঠে দাঁড়ালো। ক্লিনিকের বাইরে রাখা চেয়ারে বসলো ও। এখানকার হাওয়ায় দূষণমুক্ত একটা ভাব আছে। পকেট থেকে একটা ড্রপ বের করে দুই চোখে দিয়ে নিলো ও।
মেয়েটার মধ্যে যেন শুধরোনোর কোন ইচ্ছে নেই! সীমান্ত নিজের পাশে রিয়াদকে টের পেতেই তাকে গমগমে গলায় প্রশ্ন করে বসলো,
-“কী নিয়ে এতো গন্ডগোল হয়েছিলো এদিকে?”
রিয়াদ গতানুগতিক উপায়ে সবটা বলতেই একটু নড়েচড়ে বসলো সীমান্ত। সে সময়ের লোকগুলোও প্রায় নিভু নিভু চোখে ক্লিনিক থেকে বের হচ্ছিলো। সেদিক প্রায় অস্তমিত চোখেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছুড়ে মারলো সীমান্ত। বলতে গেলে চেষ্টা করলো। চোখের যা অবস্থা বেশিক্ষণ খুলেও রাখা যাচ্ছে না!
-“আইজার গায়ে কারো হাত পড়েনি তো!!”
হঠাৎ সীমান্তর কর্কশ গলায় কিঞ্চিত লাফিয়ে উঠলো রিয়াদ। তড়িঘড়ি কন্ঠে বললো,
-“না! বাকি সবারও আপনার মতোই অবস্থা!”
সীমান্ত রিয়াদের কথায় কিছু বলতে গিয়েও বললো না। ফোনে সময় চেক করলো ও। এখনো এক ঘন্টা পঞ্চাশ মিনিট বাকি।
***
হঠাৎ কারো পায়ের আওয়াজ টের পেতেই উঠে বসলো আইজা। বাইরে থেকে জামিল আর আরফানের কথা কাটাকাটির শব্দ কানে ভেসে আসছে।
-“সীমান্ত জানে আরমান এখানেই আছে।”
দ্রুত পায়ে সে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো আইজা। জামিলকে উদ্দেশ্য করে বললো,
-“কীভাবে? সীমান্ত জানলে নিশ্চয়ই নাজিমও জানে সবকিছু। এখন…!”
-“টেনশন করতে হবে না তোমাদের। এখান থেকে বেজমেন্টে গেলেই খুব সহজে বাইরে রাখা এম্বুলেন্সে আমরা বেরিয়ে যাবো! তোমরা নিজেদের তৈরি করো।”
জামিল আর আরফান মিলে ইতোমধ্যে আরমানকে বিছানা থেকে নামিয়ে নিয়েছে। ইনসিয়া এই মুহুর্তে এখানে নেই। আইজা থম মেরে সবটা দেখে যাচ্ছে। নাজিম শিকদার ওর বাবার ক্ষতি করার আগে একবারও সময় নষ্ট করবে না। সবকিছু ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে যে প্রান্ত থেকে পালিয়ে এসেছে সেখানেই বারবার ফিরে আসছে ও!
-“আমরা কোথাও যাবো না!”
আইজার কন্ঠে সকলের বিস্মিত দৃষ্টি ওর দিকে গিয়ে ঠেকলো।
-“আইজা তোমার জেদ দেখার সময় এখন কারো কাছে নেই। চুপচাপ আমি যা বলছি শোনো।
-“না! এখন পালিয়ে লাভ নেই। কতদিন পালাবো আমরা! কোন দোষে পালাবো!!”
আইজার কঠিন গলায় ওর দিকে তেড়ে আসলো জামিল। শক্ত গলায় বললো,
-“তোমার এই জেদের জন্য আমার স্ত্রীর এই ক্লিনিক আমি হেলায় ফেলবো না! আচ্ছা, তুমিই বলো, এরচেয়ে ভালো কোন আইডিয়া আছে তোমার কাছে? সীমান্ত বলেছে দুই ঘন্টার মধ্যে তুমি যদি ওর সামনে না যাও তাহলে আরমানের এখানে থাকার ব্যপারটা ফাঁস করবে ও। আমার চাকরিটা তো যাবেই সাথে এই ক্লিনিকটাও। আমরা পথে বসবো!”
জামিলের কথা এক দৃষ্টিতে শুনে গেলো আইজা। তারপর জামিলকে উপেক্ষা করেই আরফানের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“আমার জিনিসপত্রগুলো কোথায়? এনে দে আমাকে।”
-“এই মেয়ে কথা কানে যায় না তোমার?”
-“এই ক্লিনিকের কিচ্ছু হবে না। আমি সীমান্তর সাথে কথা বলবো!”
আইজা এ কথা বলতে না বলতেই ওর গালে সজোরে চড় বসিয়ে দিলো জামিল। তীক্ষ্ণ গলায় বলে উঠলো,
-“সবসময় জেদ আর জেদ! এতো জেদ ভালো না আইজা!”
-“আমার জেদের এখনো কিছুই দেখেননি আপনি মামা সাহেব!”
নিজের গালে হাত বুলিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে উঠলো আইজা।
এরই মধ্যে আরফান ভেতরের ঘর থেকে আইজার ছোট একটা পার্স এনে ওর হাতে রেখে জামিলকে উদ্দেশ্য করে ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“আপনার এখানে আশ্রয় নিয়েছি তার মানে এই না যে আমাদের গায়ে হাত উঠাবেন আপনি!”
-“থাক! এ নিয়ে পরে কথা হবে।”
ঠান্ডা গলায় বললো আইজা। পার্সটা নিয়ে বের হতে নিলেই জামিল শক্ত করে আইজার হাত চেপে ধরে বললো,
-“আমি জানি না তুমি কিসের ভিত্তিতে এতোটা সাহস দেখাচ্ছো। তবে একটা কথা বলে রাখছি, সীমান্তর উদ্দেশ্য কিন্তু শুধু তোমার সাথে কথা বলা না!”
আইজা মৃদু হেসে নিজের হাত ছাড়িয়ে বললো,
-” মাথায় এতো লোড নেবেন না। সীমান্তকে আমি আপনার থেকে হাজার গুণ ভালো করেই জানি।”
***
গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি কণা মাথায় পড়তেই উঠে দাঁড়ালো সীমান্ত। মানুষের সমাগম এই মুহুর্তে আগের থেকে অনেক কম। রিয়াদ সাথে নেই। ক্লিনিকের ভেতর অংশে গিয়ে দাঁড়ালো সীমান্ত। আবহাওয়াটা মন্দ না। অবশেষে বৃষ্টির দেখা মিললো। পাশে একজনের উপস্থিতি টের পেতেই কন্ঠে বিরক্তি এনে বললো,
-“রিয়াদ আপনি…!”
পাশে অতিসুন্দরী নারী চোখে পড়তেই থেমে গেলো সীমান্ত। কিছুটা অদ্ভুত চোখে তাকালো ও। এতক্ষণ যাবৎ যা যা নিজের মনে সাজিয়ে রেখেছিলো মেয়েটাকে দেখতেই সবটা যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। হুট করে শুকনো কেশে উঠলো ও।
-“এতো তাড়াতাড়ি আপনাকে দেখবো ভাবিনি।”
সীমান্তর কন্ঠে ক্রোধের কোন রেশ নেই। সম্পূর্ণ শীতল চোখে আইজাকে দেখছে সে। যেন কিছুক্ষণ আগেই আইজার বাবাকে নিয়ে কোন হুমকিই দেয়া হয়নি। মুহুর্তেই সীমান্তর কলার চেপে ধরলো আইজা। সম্পূর্ণ অনুভূতিহীন গলায় বলে উঠলো,
-“আপনি আমার পরিবারটা ধ্বংস করতে যেভাবে উঠে পড়ে লেগেছেন সেখানে ঘরের এক কোণে পড়ে থাকতে ইচ্ছে করলো না আমার। একা একা লড়াইয়ে কিসের মজা। আপনি আমার পাপাকে বরবাদ করুন। আমি বরবাদ করবো আপনার ভাইকে!!”
চলবে…