#অপূর্ব_সমাপ্তি
পর্ব-১৪
বাবা আমাকে দেখতে এসে কেঁদে ফেললেন। অনেকক্ষণ মুখ লুকিয়ে কাঁদলেন। আমিও কাঁদলাম মাথা নিচু করে। এই কান্ডের পর তার সাথে চোখ মেলাব কী করে? বাবা সময় নিয়ে স্থির হয়ে বসে বললেন, “তোর সাথে যা হয়েছে সেসব আমার জন্য। তোর ওই বিয়েটা দেয়াই উচিত হয়নি। ওই জোচ্চোর ফ্যামিলির সাথে সম্পর্ক করেই ভুল করেছি। ছেলেটা এত ভালো ভালো কথা বলল যে ভুলে গেলাম একেবারে। ও যে এরকম হবে ভাবিনি আমি..”
“বাবা তোমার কোনো দোষ নেই। আমারই ভুল, আমি লড়াই করার আগেই হেরে বসে আছি। কিন্তু আর হারতে চাই না। আমি আবার বাঁচবো বাবা। ভালোভাবে বাঁচবো।”
বাবার বুকে মাথা রেখে আমি নতুন করে শক্তি পেলাম। অক্সিজেনের সাথে সাথে শুদ্ধ ভালোবাসা ঢুকে গেল মগজে। এইতো এই ভালোবাসার মানুষগুলোই তো বাঁচার অবলম্বন। এদের আঁকড়ে নিয়ে জীবনটা হেসে খেলে কাটিয়ে দেয়া যাবে।
হাসপাতালে আমি রইলাম আরও এক সপ্তাহ। এর মাঝে আরও দু’দিন এলেন মিতা। কিন্তু শোফালী আপা প্রতিদিন এলেন৷ যেদিন আমাকে হাসপাতাল থেকে ছুটি দেবে তার আগের দিন শেফালী আপা বললেন, “তোমার কি বাড়ি যেতে ইচ্ছে করছে?”
“জানি না কিছু।”
“বাড়ি গেলে আবার সেই আগের জীবনে ফিরে যাবে। প্রতিদিনের এক রুটিন, এক পরিবেশ! সাময়িক ভালো থাকলেও কিছুদিন পর আবার ডিপ্রেশন তোমাকে ঘিরে ধরবে। তোমার একটা ঝামেলাহীন পরিবেশে সময় কাটানো দরকার। প্রয়োজন নিজেকে নিয়ে ভাবার।”
“কী করব তাহলে আমি?”
“আমার সাথে যাবে? আমার বাড়িতে? তুমি তো জানোই আমি একা থাকি। পরিবারের ঝামেলা নেই। ক’টা দিন আমার বাড়িতে সাচ্ছন্দ্যে কাটাতে পারবে।”
অর্ধপরিচিত একটা মানুষের বাড়িতে গিয়ে থাকাটা অস্বস্তিকর হলেও এই মুহূর্তে আমার প্রস্তাবটা খুব ভালো লাগলো। বাড়িতে যেতে তেমন মন টানছে না। নতুন একটা স্নিগ্ধ পরিবেশের জন্য মন ছটফট করছে। আর তাছাড়া শেফালী আপাও এই কয়েকদিনে অনেক আপন হয়ে গেছেন। তার বাড়িতে থাকতে খারাপ লাগবে না হয়তো। আমি রাজি হয়ে গেলাম। এদিকে অবশ্য বাড়ির মানুষগুলোর জন্যও খারাপ লাগতে লাগলো। খুশবুকে ছাড়া থাকব? বাবা মা ও অস্থির হয়ে আছেন। তবে তাদের বোঝাতে হবে। বোঝাতে হবে নিজেকেও। আমার সময় প্রয়োজন। সবকিছু থেকে আলাদা হয়ে একটা মুক্ত পরিবেশ, কিছুটা একান্ত সময় দরকার নিজেকে টেনে তোলার জন্য।
.
শেফালী আপার ফ্ল্যাটটা বেশ বড়। সাদা টাইলস, সাদা দেয়াল আর হালকা নীল রঙের পর্দা। ফার্নিচারও সব হালকা রঙের। দশতলার ওপর প্রচুর আলোবাতাস আসে। দুটো ঘরেরই বড় বড় বারান্দা। কেমন একটা শান্তি শান্তি ভাব সর্বত্র।
আমাকে যে ঘরটা দেয়া হলো সেটার পূর্বদিকে বড় জানালা। দক্ষিণে বারান্দা। বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়ালে অনেকদূর পর্যন্ত চোখে পড়ে। প্রথমেই বড় একটা খেলার মাঠ। তারপর একটা ছোট পুকুর। তার ওপাশে কয়েকটা একতলা বাড়ি৷ তারপর বড় দালান৷ এতখানি খোলা জায়গার কারনে নিঃশ্বাস নিতে পারা যায় বুকভরে।
বারান্দায় একটা রকিং চেয়ারও আছে। সেখানে বসে চোখ বন্ধ করলাম। ক্লান্তিতে চোখ বুজে এলো। এখনো সুস্থ হইনি পুরোপুরি।
ঘুমিয়ে গেছিলাম। উঠলাম শেফালী আপার ডাকে। আপা চা নাস্তা নিয়ে এসেছেন। ছোট টি টেবিলে খাবার রেখে বেতের চেয়ার টেনে বসলেন। একটা নোনতা বিস্কুট মুখে দিয়ে বললেন, “কেমন লাগলো আমার ছোট্ট বাসা?”
“খুব ভালো। ছোট কোথায়? কত্তো বড়! আমি তো একা থাকতেই পারব না। আপনার একা একা লাগে না?”
“নাহ। অভ্যাস হয়ে গেছে।”
“আপনার পরিবারের বাকিরা কোথায় থাকে?”
“মা, বাবা, ছোট বোন মারা গেছেন রোড এক্সিডেন্টে।”
“ওহ! আর স্বামী?”
“বিয়েই করিনি!”
“কেন?”
“ইচ্ছে হয়নি রে। সারা জীবনেও এমন কাউকে পাইনি যে আমাকে বুঝবে, সাপোর্ট করবে।”
“অসুবিধা হয় না একা থাকতে?”
“তা তো হবেই। আমি নিজের মতো মানিয়ে নিয়েছি। কেউ কিছু বলতে আসলে আমিও ছাড়ি না। আমার কথার জন্যই লোকে সামনে কিছু বলে না। পেছনে বলে, বলুক! জানো, ঠেকে শিখেছি, যারা সামনাসামনি দরদ দেখাতে আসে, আমার ভবিষ্যতের চিন্তায় যাদের রাতে ঘুম হয় না, তাদেরই বিপদের সময় খবর পাওয়া যায় না।”
এক ঝলক হাওয়া এসে ছুঁয়ে দিয়ে গেল আমাদের। ব্যস্ত শহরের মাঝে উঁচুতে বসে নিরবতায় ডুবে গেলাম দুজনে। অনেক প্রশ্ন এসে মাথায় জমা হতে লাগলো। এলোমেলো চিন্তা, জীবনের অন্যরকম একটা দিকের সাথে নিজের জীবনটাকে মিলিয়ে কেমন একটা হাহাকার সৃষ্টি হলো বুকের মাঝে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কখনো কাউকে ভালোবাসোনি আপা?”
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে আপা বললেন, “ঠিক ভালোবাসিনি রে। সেই পর্যন্ত যেতেই দেইনি নিজেকে। তবে কখনো কখনো পছন্দ হয়েছে, চোখে লেগেছে। কখনো বা সেটার মাত্রাটা একটু বেশিই ছিল। কিন্তু এগুতে গিয়ে ধাক্কা খেয়েছি বার বার। নিজেকে সামলে ফিরে এসেছি আগের পথে। কাউকে কাউকে ভুলতে কষ্ট হয়েছে, তবে সেসব আবেগকে সংযত করার সামর্থ্য আমার আছে। সংসার সকলকেই করতে হবে এমন কোনো কথা আছে নাকি? এত ঝামেলা আমি নিতে পারব না রে। তারচেয়ে এই বেশ আছি!”
“আসলেই ভালো আছ? কখনো অসুখ হলে, একা একা লাগলে ইচ্ছে করে না কেউ ভালোবাসুক?”
“করে। খুব করে। কিন্তু কী জানিস, কাউকে ভালোবাসতে ভয় হয়। কাছের মানুষ হারানোর যন্ত্রণা নতুন করে সহ্য করার মতো ক্ষমতা নেই। তারচেয়ে একাকিত্ব ঢের ভালো!”
অল্প সময়ের মনখোলা আলাপে আপা আমার ‘তুমি’ হয়ে গেল, আর আমি হয়ে গেলাম ‘তুই’। কতো মানুষ সারাজীবন একসাথে থাকলেও আপন হতে পারে না, কেউ কেউ আপন হয় অতিদ্রুত।
.
আপা অফিসের জন্য বের হয়ে গেলো এগারোটার দিকে। হাফ ডে ছুটি নিয়েছিলো আমার জন্য। আমি একা রয়ে গেলাম।
সেই বারান্দায় ফিরে রকিং চেয়ারে শুয়ে চোখ বন্ধ করলাম। একটা কথাই পেড়াচ্ছে আমায়, সে একটাবারও আমায় দেখতে আসলো না কেন? মা তো খবর দিয়েছিল তাকে। নাকি তার এখন আর গায়ে লাগে না এসব? আমি মরি কি বাঁচি কোনো কেয়ার নেই?
ভাবতে ভাবতে ফোন এলো। অবাক হয়ে দেখলাম অর্নার ফোন।
“কেমন আছ অর্না?”
“ভালো ভাবী। তুমি কেমন আছ?”
“ভালো।”
“তোমার ফোন দুইদিন বন্ধ ছিল কেন? কতবার ট্রাই করলাম। ফেসবুকেও পেলাম না।
“একটু অসুস্থ ছিলাম।”
“কী হয়েছে?”
“তেমন কিছু না। আচ্ছা অর্না তোমার ভাইয়া কোথায়?”
“কোথায় আর, অফিসে।”
“মা?”
“মা বাড়িতেই।”
“তোমার ভাইয়া কি ভালো আছে? মানে কয়েকদিনের মধ্যে কোনো পরিবর্তন দেখেছ?”
“না তো। কেন ভাবী?”
“এমনি। তারপর তোমার খবর বলো।”
“জানো ভাবী সেদিন ভার্সিটিতে…”
অর্নার গল্প করার তেমন কেউ নেই। সে ফোন করলে প্রচুর গল্প করে। আমার জন্য জমিয়ে রাখে অনেক কথা। আমিও আগ্রহ করে শুনি সবসময়। কিন্তু আজ কিচ্ছু মাথায় গেলো না। আমাকে অন্যমনষ্ক দেখে অর্নাও বোধহয় আর কথা বাড়ালো না। রেখে দিল ফোন। আমার মাথায় তখন ঘুরছে অন্য কথা, সে সব জেনেও স্বাভাবিক ছিল! ফোন করব একবার তাকে? না থাক। ভালো থাকুক সে। আমার তাকে আর প্রয়োজন নেই!
.
দু’দিন সময় নিয়ে ভেবে ভেবে আমি কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিলাম। আমাকে উঠে দাঁড়াতে হলে সবার আগে এই ফোঁড়াটা কাটতে হবে। তাকে ডিভোর্স দিতে হবে। আমার মতো ঘরকুনো স্বাভাবের অতি আবোগী সাধারণ মেয়ের জন্য সিদ্ধান্তটা সহজ ছিল না। তবে আমার আর উপায় নেই। এতদিন আশায় আশায় ছিলাম, এখন আশার আর কোনো জায়গা নেই। আমার জীবনেরও দাম আছে। তিলে তিলে মরার জন্য পৃথিবীতে আসিনি।
সবার আগে আমি কথাটা শেফালী আপাকেই বললাম।
রাতে খাওয়ার পর আমরা দুজনে বারান্দায় গিয়ে বসি। অনেক গল্প হয়। রাতের বেলা ঢাকা শহরটা অন্যরকম সুন্দর লাগে। ঝাঁঝালো দিনের শেষে আঁধারের স্পর্শে সব অন্যরকম হয়ে যায়। চারপাশে কৃত্রিম আলোরা খেলা করে। আকাশের তারারা দূরের বাড়িগুলোর জানালার টিমটিমে আলোর সাথে এক হয়ে যায়।
আমার কথাটা শুনে আপা খানিক্ষন চুপ থেকে বলল, “তোর মন থেকে ইচ্ছে হলে তুই এটাই কর।”
“কিন্তু আপা আমি ঠিক করছি তো?”
“তোর জীবন। কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন নেই। নিজের সিদ্ধান্ত যদি ভুলও হয় তবুও ভালো। জীবনে এতটা পস্তাতে হয় না। তবে আমার মতামত চাইলে বলব তুই ঠিকই করছিস।”
“থ্যাংক য়্যু আপা!”
“ওয়েলকাম! চল পার্টি করি।”
“কিসের পার্টি?”
“কিসের আবার? তোর সুবুদ্ধির জন্য!”
“এখন?”
“হু। বস। আমি আসছি।”
আপা দুটো কাচের গ্লাস আর একটা লম্বা বোতল নিয়ে এলো। আমি হা হয়ে গেলাম। “ছি! এটা কী?”
আপা হেসে বলল, “কেন খাবি না।”
“জীবনেও না।”
আপা খিলখিল করে হেসে ফেলল। বলল, “এইটা কোকাকোলা। বোতলটা জোগাড় করেছি এক বন্ধুর থেকে। মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে এসব খেতে। তখন মদের বোতলে সফট ড্রিংক খেয়ে পাগলামি করি। ভান করি মাতাল হয়েছি। হি হি।”
“এরকম করলে কী হয়?”
“মজা লাগে। তুই এত বোরিং কেন? নে ধর গ্লাস…চিয়ার্স…”
আমি অবাক হয়ে দেখলাম আপা এক চুমুকে খেয়ে নিল তরলটা। সিনেমাতে দেখা মদ খাওয়ার স্টাইল নকল করে চোখমুখ কুঁচকে ফেলল৷ তারপর আরেক গ্লাস ঢেলে খেয়ে ঢুলু ঢুলু চোখে তাকিয়ে বলল, “কি সুন্দরী? খাচ্ছ না কেন?”
এরকম বাস্তববাদী একটা মানুষের সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্র দেখে আমি অভিভূত হয়ে গেলাম। আমিও তার মতো চেষ্টা করলাম, কিন্তু হলো না বোধহয়। আমায় দেখে আপা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেল।
রাত বাড়তে থাকলো। দালানগুলোর জানালার আলো একটা একটা করে নিভতে থাকলো। বাতাসের বেগ বেড়েছে। বোধহয় বৃষ্টি হবে রাতে। আপা চুপ হয়ে বসে আছে। কিছুদিন ধরে মনে খচ খচ করতে থাকা একটা প্রশ্ন হঠাৎ করে ফেললাম, “আপা, তুমি আমার জন্য এতকিছু কেন করছ?”
আপা হেসে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “স্বার্থ ছাড়া কেউ কিছু করে না রে! তুই দেখতে অবিকল আমার ছোট বোনের মতো। আমি নিজের জন্যই তোকে আমার কাছে এনে রেখেছি।”
(চলবে)