#অপূর্ব_সমাপ্তি
পর্ব- ১৬
চওড়া ব্যস্ত সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে আছি৷ অনেক গাড়ি চলছে। কিছুতেই পার হতে পারছি না। অসহায়ের মতো চারপাশে তাকালাম। কোনো ফুটওভার ব্রিজ নেই। চারদিকে শুধু গাড়ি। হঠাৎ তাকে দেখতে পেলাম। সে পাশে এসে দাঁড়ালো। খানিক ফাঁকা রাস্তা পেয়ে সে আমার হাত টেনে নিয়ে গেল সামনে।
কিন্তু অর্ধেক পার হতেই একটা প্রাইভেট কারের সামনে পড়লাম। ব্যাস্ আরেকটু হলেই একসিডেন্ট হতো! আতঙ্ক কাটিয়ে ওঠার আগেই গাড়ির ভেতর থেকে বের হয়ে এলেন আমার শ্বাশুড়ি মা। রুদ্রমূর্তি ধারন করে আমার সামনে এসে জোরে চড় দিলেন গালে। আমি টলে উঠলাম। এর মাঝে সে হারিয়ে গেছে। কোথাও দেখলাম না তাকে। চোখের জমা হওয়া জলের কারনে ঝাপসা হয়ে এলো চারদিক।
প্রাইভেট কারটা শা করে ছুটে গেল সামনে দিয়ে। মাঝ রাস্তায় একা দাঁড়িয়ে আমি। দু’দিন দিয়ে ছুটছে গাড়ি। নড়তেও পারছি না, পা দুটো যেন কে আঠা লাগিয়ে দিয়েছে। ভারী হয়ে আসছে নিঃশ্বাস। বুকে আটকে থাকা যন্ত্রণা ঠিকরে বেরিয়ে এসে বলছে, মরে যাও তুমি! মরে যাও!
এর মাঝে হুট করে কোথা থেকে একটা হাত এসে আমার হাত ধরে ফেলল! উষ্ণ, শক্ত একটা ভরসার হাত। অতিযত্নে আমার হাতটা তুলে নিল তার হাতে। তারপর কেমন করে যেন গাড়ি বাঁচিয়ে আমায় নিয়ে যেতে থাকলো সামনে।
চারদিকে অনেক ধোঁয়া। আমি উদ্ধারকর্তার মুখ দেখতে পেলাম না। তার মাথা ঢাকা পড়েছে ঘন ধোঁয়ার আড়ালে। শুধু তার মুঠির ভেতর নিজের হাতটা আরও শক্ত করে চেপে ধরলাম৷ চোখ বুজে পার হয়ে গেলাম রাস্তা। ওপরাড়ে পৌঁছে হাতটা ছেড়ে দিল সে আমার। আমি তাকিয়ে দেখি কেউ নেই। সারা রাস্তা ফাঁকা। গাড়ি নেই, মানুষ নেই, শুধু আমি৷
ঘুম ভাঙলো। ঘেমে গেছি একেবারে। এতদিন হয়ে গেল, তবুও তাকে স্বপ্নে দেখি, সাথে থাকে শ্বাশুড়ি মা। প্রায় একই রকম স্বপ্ন ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে দেখা। পাশ ফিরে খুশবুর দিকে তাকালাম। মেয়েটা বড় হয়েছে এখন৷ ছোট্ট শরীরটা একটু একটু করে বাড়ছে তার৷ এক বছর বসয় হয়েছে৷
কথা বলতে শেখেনি ভালো করে। ‘বাবা’, ‘দাদা’, ‘মা’ ইত্যাদি শব্দগুলো আধো আধো বলতে পারে। আমায় ডাকে ‘তাতা’। সে হামাগুড়ি থেকে হাঁটতে শিখছে অল্প অল্প৷ হাঁটে তো না, সুযোগ পেলে দৌড়ায়। কিছুদূর দৌড়ে গিয়ে পড়ে যায়৷ পড়েই হেসে ফেলে নিজেই ওঠার চেষ্টা করে। দুধদাঁত চারটা বের হয়ে ভারি মিষ্টি দেখায় তাকে। ইচ্ছে করে চুমুতে ভরিয়ে দিতে মুখ। বুকের সাথে জড়িয়ে রাখতে ছোট্ট তুলতুলে দেহখানি।
খুশবুকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে আবার ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। ঘুম এলো না। উঠে পড়লাম। রাত জাগলে এখন আগের মতো বসে থাকতে ইচ্ছে করে না। তারচেয়ে পড়াশুনা করলে সময় কেটে যায় ভালো। ঝিনু অন্য ঘরে শিফট হয়ে গেছে। ঝিনুটা বড় হয়েছে। ছটফটে স্বভাব। আমার মতো বিষন্ন, গম্ভীর কারো সাথে থাকতে তার ভালো না লাগারই কথা। তার ওপর এই রাত জেগে আমার পড়াশোনার যন্ত্রণা!
রান্নাঘরে গিয়ে চায়ের পানি চুলায় দিলাম। হঠাৎ একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। বিয়ের পরপর শ্বশুরবাড়িতে থাকার সময় একরাতে তার ঘুম আসছিলো না। একা একা জেগে থাকতে পারছিলো না বলে আমায় জোর করে ঘুম থেকে ডেকে তুলল। আধঘুমো আমাকে টেনেটুনে যখন সরাতে পারলো না তখন কোলে তুলে নিল।
তার গলা জড়িয়ে নিলাম শক্ত করে। সে আমায় নিয়ে বারান্দায় চলে গেল। চেয়ারে বসিয়ে কফি বানিয়ে আনলো দু’কাপ। তার ঘরেই ছোট একটা কফি তৈরির মেশিন আছে৷ নিজেই সবসময় বানিয়ে নেয়।
সেরাতে সারারাত গল্প হলো৷ ভোরের আজানের সময় গল্প শেষ হলো। সূর্য উঠলো আমাদের চোখের সামনে। ভোরের শীত শীত ঠান্ডা বাতাসে আমি তার বুকের মুখ গুঁজে তাকে জড়িয়ে উষ্ণতা খুঁজে নিলাম৷ সে আমায় আরো নিবিড়ভাবে আঁকড়ে ধরে রাখলো।
সে সময় সে প্রতিজ্ঞা করেছিলো, কখনো চোখের আড়াল হতে দেবে না আমায়।
হাহ! এক বছরও প্রতিজ্ঞা পালন করতে পারলো না!
ভাবনার জগতে এত গভীরভাবে ডুবে গিয়েছিলাম যে বাস্তবে যখন ফিরলাম, মনে হলো ঘুম ভেঙেছে। চায়ের পানি শুকিয়ে তলানিতে ঠেকেছে। আরেকটু হলে পাতিল পুড়তো!
পাতিল নামিয়ে ঘরে চলে গেলাম। একটা বই নিয়ে বসলাম। বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা ‘বিষবৃক্ষ’।
আগে ভাবতাম বাংলা অতি খটমটে একটা বিষয়। কিন্তু এখন মনে হয় এটা পড়ার জন্যই আমার জন্ম হয়েছে। যত পড়ি, ততই আশ্চর্য হই, মুগ্ধ হই!
.
থার্ড ইয়ারে ক্লাস করছি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত ক্লাস হয় না। স্টুডেন্টরা যায়ই না। আমি তবুও শিডিউল অনুযায়ী প্রতিদিন যাই। লাইব্রেরিতে বসে পড়াশুনা করি। সিলেবাসের প্রতিটা বিষয় বিস্তারিত পড়ি। প্রতিদিনের খবরের কাগজ খুঁটিয়ে পড়ি। ভালো লাগে এসব। ইদানিং অল্প অল্প লিখতেও পারি। কোনো নতুন বিষয় জানতে পারলে সেটার ওপর যত বই, জার্নাল আছে সব পড়ি। সাথে ইন্টারনেট তো আছেই। তারপর সেই বিষয়ে নিজের মতো করে গুছিয়ে কিছু লিখে ফেলি। খারাপ লাগে না নিজের লেখা পড়তে। ডায়েরিতে জমা থাকে কথাগুলো।
আমি লেখাগুলো শুধু মৃন্ময় স্যারকে দেখাই। সেকেন্ড ইয়ারের শেষের দিকে স্যারের ক্লাসগুলো ঠিকমতো করায় তার নজরে পড়ে গিয়েছিলাম। পরীক্ষার সময় তার কাছে বিভিন্ন বিষয়ে বুঝতে গিয়েছিলাম, তখন থেকেই তিনি আমাকে বেশ পছন্দ করেন। অনেক আশাও করেন আমার থেকে। আমার লেখা প্রতিটা আর্টকেল মনোযোগ দিয়ে পড়েন, প্রশংসা করেন, ভুল ধরিয়ে দেন। তিনি বাংলা ভাষার ইতিহাসের শিক্ষক। স্যারের সাথে ইতিহাস নিয়ে কথা বলতেও স্বাচ্ছন্দ বোধ হয়।
আবার স্যার আমাকে বই ধার দেন। বই কেনার উৎসাহও দেন। সিলেবাসের বাইরে এই ক’দিনেই অনেক কিছু পড়েছি। সব মিলিয়ে অন্য একটা জগতে ডুবে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টায় আমি অনেকটাই সফল। নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস দিন দিন বেড়ে চলেছে।
.
স্বপ্নময় বুকস্টোর নামক একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছি কয়েকটা বই কেনা দরকার। কী বই কিনব নিজেও জানি না। কয়েকদিন ছাত্র আন্দোলনের জন্য কলেজে যাওয়া হবে না। বই না কিনলে সময় কাটবে না। বাড়িতে এত লোকের মধ্যে খুশবুকেও সবসময় ভাগে পাওয়া যায় না।
দোকানের ভেতর এক বৃদ্ধ লোক বসে আছে। লোডশেডিং চলছে। গরমের মধ্যে একটা পত্রিকা দিয়ে বাতাস করছে নিজের গায়ে। আমি দোকানের ভেতরে গিয়ে বই দেখতে শুরু করলাম। লোকটাকে চিনি না। যে লোক সবসময় থাকে তিনি নেই।
বৃদ্ধ লোকটি হুট করেই আমার হাত টেনে ধরলেন। আমি প্রচন্ড অবাক হয়ে হাত টেনে নেয়ার চেষ্টা করলাম, কিন্তু লোকটার হাতে এত শক্তি যে আমার হাত তার থেকে ছাড়াতে পারলাম না। মধ্যদুপুরে চারপাশে লোকজন কম। দোকানটাও ফাঁকা। আমি আতঙ্ক নিয়ে তাকালাম। কিন্তু বৃদ্ধের মধ্যে খারাপ উদ্দেশ্য দেখতে পেলাম না। সে মনোযোগ দিয়ে আমার হাতের তালু দেখছে।
কিছুক্ষণ খালি চোখে বিভিন্ন এঙ্গেল থেকে দেখার পর একটা ম্যগানিফাইন গ্লাস বের করল। সেটা দিয়ে কী যেন ভালোভাবে দেখলো। আমি চুপচাপ দেখে গেলাম করেটা কী। কেন যেন মনে হচ্ছে বৃদ্ধ ভালো।
সে আমার হাত ছেড়ে দিয়ে বলল, “মা, তোমার বিয়েটা টিকলো না না?”
আমি কিছু না বলে হাতদুটো ভাজ করে দাঁড়ালাম। সে বলতে থাকলো, “তোমার সোয়ামীটা ভালা ছিল না, বড়ই খারাপ চরিত্র। তবে তোমার পরের সোয়ামী ভালা হবে। তার চরিত্র হবে একেবারে ফুলের মতোন। তোমারে রাজরানী বানায় রাখবে। তোমাদের একটা সন্তান হবে…”
আমি বের হয়ে এলাম দোকান থেকে। বদ্ধ উন্মাদ লোক। আজেবাজে বকবক করে যাচ্ছে!
রিকশায় উঠে বাসায় ফেরার পথে হঠাৎ মনে হলো, আচ্ছা ওই লোক এটা জানলো কী করে যে আমার প্রথম বিয়েটা টেকেনি? আন্দাজে বলল? তাও এত নিশ্চিত হয়ে? আজব!
.
আজ ছুটি। কলেজে যাওয়ার তাড়া নেই। ঘুম ভাঙলো দেরিতে। খুশবুও আমার সাথে সাথে দেরিতে উঠলো। ওকে খাইয়ে আমি নাস্তা করতে বসেছি। ও ফ্লোরে হামাগুড়ি দিচ্ছে। আমি খেতে বসেছি। তখনই ঘটলো ঘটনাটা।
বড় ভাইয়া কোথায় যেন যাবে, টুলে বসে জুতোর ফিতে বাঁধছিল। খুশবু তখনই এক দৌড় দিলো ভাইয়ার দিকে। ‘বাবা’ বাবা’ বলতে বলতে। ঠিক ভাইয়ার সামনে গিয়ে পড়ে যাওয়ার আগে ভাইয়া ধরে ফেলল তাকে। খুশবু খিলখিল করে হেসে ফেলল। মুখে বাবা ডাক রেকর্ডের মতো বাজছে। অথচ কেউ তাকে বলে দেয়নি এটা তার বাবা।
ভাইয়া জীবনের প্রথমবার খুশবুকে কোলে নিয়ে প্রথমেই খানিকটা ভ্যাবচ্যাকা খেয়ে গেল। হা করে তাকিয়ে রইল খুশবুর দিকে। খুশবু তার স্বভাবমতো ভাইয়ার গালে আদর করে দিল। খুশবুর বড় বড় মায়া চোখদুটো হাসছে! ভাইয়া হঠাৎই কেঁদে ফেলল। একদম বাচ্চাদের মতো। খুশবুকে জড়িয়ে ধরল। ভাইয়ার কান্না দেখে খুশবুও কান্না শুরু করল। এরপর দেখা গেল দু’জন দু’জনের কান্না থামানোর চেষ্টা! ভাইয়া চুমুতে ভরিয়ে দিল খুশবুর মুখটি! কিছুক্ষণ পর ভাইয়াকে দেখা গেল সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে। খুশবু তার বুকের ওপর চুপটি করে শুয়ে আছে। এই দুষ্টু মেয়ে জেগে থাকাকালীন একদন্ড চুপ হয়ে থাকে না। অথচ আজ বাবার আদর পেয়ে শান্ত হয়ে গেছে। সে কী অপূর্ব দৃশ্য!
আমরা স্থানুর মতো বসে আছি সবাই। খাবার ঠান্ডা হচ্ছে, কেউ দেখছি না। সবার চোখেই জল। বহুদিন পর মনে হলো খরতাপের শুস্ক মাঠে বৃষ্টির ফোটা পড়েছে। ভাবীর আত্মা যদি শান্তি পায় তো আজ পেয়েছে। আমি মনে মনে ভাবীর মিষ্টি মুখটি মনে করলাম। সে যেন ভেজা চোখে বাবা মেয়ের মিলন দৃশ্য চেয়ে দেখছে কোথাও থেকে।
ভাইয়া বর বের হলো না। খুশবুকে নিয়েই রইল। এতদিন পর তাকে মন খুলে হাসতে দেখা গেল। আমাদের সাথেও স্বাভাবিক হয়ে কথা বলল বহুকাল পর। তার মনটাও বদ্ধ ঘরে গুমরে মরছিলো। প্রাণটা ছটফট করছিলো সেই গুমোট অন্ধকার স্মৃতি থেকে বের হয়ে আসতে। আজ খুশবু তাকে টেনে আনলো ঝলমলে পৃথিবীতে। একদিনে আমি দেখলাম মেয়েটা কেমন আমায় ভুলে তার বাবার হয়ে গেল! তাতে অবশ্য আমার কষ্ট হলো না, হৃদয় প্রশান্তি পেলো।
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু