বিবর্ণ-৭ম পর্ব

0
658

বিবর্ণ-৭ম পর্ব
#লেখনীতে_শাহরিয়ার

নিজের ইচ্ছেকে নিজের মনের মাঝেই মেরে ফেলি। বেঁচে থাকার জন্য এই সুন্দর পৃথিবীটাকে উপভোগ করার জন্য। মাঝে মাঝে চিন্তা করি এতো সকল খারাপ মানুষের ভিড়েও কেউ কেউ ভালো রয়েছে। হয়তো তাদের জন্যই পৃথিবীটা এতো সুন্দর লাগে।

রাতের খাবার খেয়ে ছাদে উঠতেই দেখি জাহাঙ্গীর সেই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। তবে আজ নিয়নের আলো দেখছে না। আজ আকাশের দিকে চেয়ে তারাদের দিকে চেয়ে রয়েছে। আমি ছাদে এসেছি তার খুব কাছাকাছি রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছি সেদিকর তার কোন খেয়াল নেই। অদ্ভুত এখন পর্যন্ততো এমন কোন দিন হয়নি আমি পাশে এসে দাঁড়িয়েছি আর জাহাঙ্গীর আমার সাথে কথা বলেনি। তাই প্রশ্ন করলাম কি ব্যাপার এতো মনোযোগ দিয়ে কি দেখছেন?

জাহাঙ্গীর: ওহ আপনি কখন আসলেন?

এইতো আসলাম, আজ নিচে না তাকিয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন কি ঘটনা?

জাহাঙ্গীর: না তেমন কিছু না এমনি। আজ জ্যোৎস্না রাত তাই চাঁদ দেখছি।

শুধুই কি চাঁদ দেখা নাকি অন্য কোন কারণ রয়েছে?

জাহাঙ্গীর: হুম আজ ইশিতার মৃত্যু বার্ষিকি। তাই ওকে স্মরণ করছি।

ওহ সরি।

জাহাঙ্গীর: সরি বলার কিছু নেই। তাছাড়া আজ জ্যোৎস্না রাত। খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে বসে কিংবা শুয়ে যেভাবে ইচ্ছে উপভোগ করতে পারেন আপনি চাইলে। আমিতো ভাবছি এখন শুয়ে শুয়ে চাঁদ দেখবো।

কথাটা বলেই জাহাঙ্গীর পাশের ছাদে শুয়ে পরলো। অসংখ্য তারার মাঝে একটা চাঁদ তার আলোয় আজ পুরো শহর আলোকিত হয়েছে। আমিও জাহাঙ্গীরের মত ছাদে শুয়ে পরলাম। দু’জন দুপাশে দুই ছাদে পাশাপাশি শুয়ে রয়েছি। দু’জনের দৃষ্টি দূর আকাশ পানে। দীর্ঘ সময়ের নিরবতা ভেঙ্গে আমিই বলে উঠলাম। আমার মনে হয় কোথাও জব পাবো না।

জাহাঙ্গীর: হঠাৎ এমন মনে হচ্ছে কেন?

এমনি, আসলে সবাইতো আর আপনার মত না।

জাহাঙ্গীর: আপনি কি জানেন বর্তমানে নারীরা অনেক স্বাবলম্বী নিজের মত করে উদ্যোগী হয়ে। বিভিন্ন রকম কাজ নিয়ে।

আমি কি তেমন হতে পারবো?

জাহাঙ্গীর: অবশ্যই পারবেন। যদি আপনার ইচ্ছে থাকে তবেই আপনি পারবেন।

কি করে পারবো? আসলে কি নিয়ে আমি শুরু করতে পারি?

জাহাঙ্গীর: অনেক কিছুই হতে পারে। হাতের কাজের জামা কাপড়, খাবার নিয়ে। কিংবা অন্য কোন কিছু নিয়ে।

ভালো বলেছেন। কিন্তু এগুলো মানুষের কাছে কিভাবে পৌঁছে দেয়া যাবে? তারা আমার সম্পর্কে বা আমার কাজের সম্পর্কে কি করে জানবে?

জাহাঙ্গীর: আমি আপনাকে সাহায্য করবো। এগুলো আপনাকে অনলাইনে প্রথমে শুরু করতে হবে। তারপর যখন পরিচিত হয়ে উঠবেন তখন অনলাইন অফলাইন দুই ভাবেই করতে পারবেন।

ঠিক আছে দেখি কি করা যায়।

জাহাঙ্গীর: দেখি না আপনাকে করতে হবে। এবং সেই সাথে আপনাকে সফল ও হতে আর সব শেষ আপনার মাধ্যমে অন্যদের কর্মসংস্থান তৈরি করতে হবে।

আচ্ছা ঠিক আছে। এখন বলুন মন ভালো হয়েছে।

জাহাঙ্গীর: আমারতো মন খারাপ ছিলো না। শুধু তাকে স্মরণ করছিলাম। আসলে তাকে আমি কখনো ভুলি না। সে আমার জীবনের অজানা এক অংশ। আমার জীবনের না বলা একটা গল্প। তাই তাকে নিয়ে ভাবতে হয়। কিন্তু মন খারাপ করি না।

খুব রাত হয়ে গেলো দু’জন গল্প করতে করতে। একটা সময় জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসলাম। নিচে নামতেই বাবা মায়ের ঘর থেকে চাপা কান্নার শব্দ পেলাম। কি হয়েছে বুঝার জন্য সেদিকে এগিয়ে আসতেই মা বাবাকে বলছে এভাবে ভেঙ্গে পরো না। নিশ্চই ভালো কিছু হবে। মেয়েতো আর ইচ্ছে করে এসে ঘরে বসে থাকেনি। আর তুমি শক্ত না হলে আমাদের কে সামলাবে? বাবা মাকে বলে উঠলো তাই বলে আমার মেয়েটার সাথেই এমন হতে হবে কেন?

মা বাবার কথা শুনে আমার চোখ দিয়েও পানি চলে আসলো। নিজেকে সামলে নিয়ে নিজের রুমে চলে আসলাম। দু’চোখের পাতা আর কোন ভাবেই এক করতে পারছিলাম না। বাবা মা আমাকে নিয়ে কত ভাবেন আর আমি কখনোই তা বুঝতে পারিনি। আমি শুধু আমার কষ্ট গুলোই দেখেছি, বুঝার চেষ্টা করেছি। কিন্তু বাবা মায়ের কষ্টটা কখনোই আমার ভাবা হয়নি। আজ তাদের কথা না শুনলে হয়তো কোনদিন জানতেই পারতাম না তারা আমাকে নিয়ে কতটা চিন্তা করেন। টপটপ করে চোখের পানি পরছে। আজ কোন ইচ্ছেই করছে না এ পানি মুছার জন্য, বরং নিজেকে কিছুটা শক্ত করে মনে মনে শপথ করলাম যে করেই হোক না কেন আমি প্রতিষ্ঠিত হবো। বাবা মায়ের মুখে হাসি ফোটাবো।

পরদিন সকালে মাকে বললাম আমি কিছু রান্না করবো।

মা: কি রান্না করবি?

ভালো কিছু আসলে আমি নিজের ব্যবসা শুরু করতে চাই।

মা: বেশতো তোর যা ভালো লাগে কর। কিন্তু যাই করিস না কেন ভেবে চিন্তে করিস। আমরা চুপ থাকলেও সমাজের মানুষ কিন্তু চুপ থাকবে না।

মায়ের কাঁধে মাথা রেখে আমার উপর ভরসা রাখতে পারো। তোমার মেয়ে এমন কিছু করবে না যাতে তোমাদের কোন কষ্ট পেতে হয়। দুপুরে রুমনকে দিয়ে বাজার থেকে দরকারি সব কিছু কিনিয়ে নিয়ে আসলাম। বিকেলের ভিতর রান্না করে তা খুব সুন্দর করে ডাইনিং এ সাজিয়ে বেশ কয়েকটা ছবি তুলে নিলাম। এরপর মাকে বললাম তুমি যদি অনুমতি দাও তবে আমি জাহাঙ্গীরকে এখানে আসতে বলি। আসলে উনি আমাকে বুদ্ধি দিয়েছেন। এসব করে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য।

মা: আচ্ছা ঠিক আছে আছতে বল আমিও ছেলেটাকে দেখি।

আমি নিজের রুমে যেয়ে জাহাঙ্গীরকে ফোন দিলাম। কয়েকবার রিং বাজতেই উনি রিসিভ করতেই আমাদের বাড়িতে আসতে বললাম।

জাহাঙ্গীর: কোন সমস্যা হয়েছে কি?

না কোন সমস্যা নয়, তবে আপনাকে কিছু দেখাতে চাই।

জাহাঙ্গীর: আচ্ছা অফিস শেষ হলো ত্রিশ মিনিটের ভিতর আসছি।

কথাটা বলেই জাহাঙ্গীর ফোন কেটে দিলো। আমি যেয়ে ডাইনিং এ মায়ের পাশো বসলাম।

মা: কিরে আসবে ছেলেটা?

হুম আসবে ত্রিশ মিনিটের মত লাগবে। মা আর আমি গল্প করছি আর একটু পর পর দরজার দিকে তাকাচ্ছি কেন এখনো কলিং বেলটা বেজে উঠছে না। সময় কেন দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে না। এসব চিন্তা ভাবনা এসে আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। দেখতে দেখতে ত্রিশ মিনিট শেষ হয়ে চল্লিশ মিনিট হয়ে আসলো। মনে মনে ভীষণ রাগ করে ফোনটা হাতে নিলাম ফোন দিবো বলে এমন সময় ঘরের কলিং বেলটা বেজে উঠতেই আমি দ্রুত মায়ের কাছ থেকে উঠে যেয়ে দরজা খুলে দিলাম। জাহাঙ্গীর দু’হাত ভর্তি করে নানান রকম ফল ফলাদি নিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। আরে এসব কি ভিতরে আসুন।

জাহাঙ্গীর: মায়ের দিকে তাকিয়ে সালাম দিলো।

মা: সালামের উত্তর দিয়ে এসো বাবা ভিতরে এসো।

জাহাঙ্গীর ভিতরে আসতেই মা বসতে বলে কিচেনের দিকে এগিয়ে গেলো। আমি উনাকে বললাম আমার সাথে আসুন। ডাইনিং এসে টেবিলের উপর সাজানো খাবার গুলো দেখিয়ে বললাম এগুলো রান্না করেছি।

জাহাঙ্গীর: বাহ দেখতেতো দারুণ লাগছে।

আমি হেসে দিয়ে শুধু দেখতে নয় খেতেও বেশ ভালো লাগবে আশা করা যাচ্ছে।

জাহাঙ্গীর: দেখতে যেহেতু সুন্দর খেতেও ভালো লাগবে এটা আমি বিশ্বাস করি।

আমি হাসতে হাসতে প্লেটে খাবার বেড়ে জাহাঙ্গীরের দিকে এগিয়ে দিয়ে। যেহেতু বুদ্ধিটা আপনার সেহেতু প্রথম খাবারটা আমি আপনার জন্যই পরিবেশন করলাম। জাহাঙ্গীর কিছুটা ইতস্তত করতে লাগলো। আমি বললাম আমরাতো ভালো বন্ধু তাই নয়কি?

জাহাঙ্গীর: হ্যাঁ।

তাইতো আপনি যদি মনে করেন এটা আসলেই ভালো হয়েছে তবেই না হয় আমি উদ্যোক্তা হবো। নাহলে অন্য কিছু নিয়ে ট্রাই করবো।

দু’জন কথা বলছি এর ভিতর মা শরবতের গ্লাস হাতে নিয়ে ডাইনিং এ ঢুকলো। শরবতের গ্লাস মা জাহাঙ্গীরের দিকে বাড়িয়ে দিলো।

মা: তোমার কথা অনেক শুনি রত্নার মুখ থেকে, পাশের বাড়িতেইতো থাকো মাঝে মাঝে এসে ঘুরে যেতে পারো আমাদের এখান থেকে।

জাহাঙ্গীর: জ্বি আন্টি চেষ্টা করবো আসার জন্য।

মা: না না চেষ্টা করবে কেন? যখন মনে চায় চলে আসবে আমাদের ভালো লাগবে।

জাহাঙ্গীর: জ্বি আচ্ছা।

মা: তোমরা গল্প কর আমি আসছি।

জাহাঙ্গীর: আন্টি আপনিও বসুন না।

মা: আমার একটু কাজ রয়েছে তোমরা গল্প করো।

মা উঠে চলে গেলেন নিজের কাজে। আমি চেয়ারে বসে বললাম খেতে শুরু করেন। জাহাঙ্গীর খেতে শুরু করলো। আমি জাহাঙ্গীরের খাওয়া দেখছি গভীর মনোযোগ সহকারে।

জাহাঙ্গীর: খেতে খেতে দারুণ হয়েছে রান্না। আমি শিউর আপনি অনেক দূর এগিয়ে যাবেন।

আমি হেসে দিয়ে এগুলা আসলে আপনার জন্যই রান্না করেছি। আসলে ব্যবসা করবো কি করবো না সেটা অনেক পরের হিসেব। তবে আপনি আমাকে এতোগুলো দিন মানুষিক ভাবে যে সাপোর্ট দিয়ে চলেছেন। তার জন্য আমি চির ঋণী হয়ে থাকবো আপনার কাছে।

জাহাঙ্গীর: কি সব ঋণের কথা বলছেন? মানুষের ধর্মই হচ্ছে মানুষকে সাহায্য করা। আর আমি মনে করি আমার দায়িত্বের মাঝে এটা পরে। তবে সত্যি বলছি আপনি শুরু করেন।

জাহাঙ্গীরের খাবার শেষ হলে মা কফি বানিয়ে নিয়ে আসলো তিনজনের জন্যই। কফি খেতে খেতে তিনজন গল্প করছি। পাশাপাশি জাহাঙ্গীর ফেসবুকে একটা পেইজ খুলে দিলো আমার জন্য। সাথে উদ্যোগক্তা রিলেটেড বেশ কয়েকটা গ্রুপে আমাকে এড করে দিলো। সেই সাথে আমার তোলা ছবি গুলোও গ্রুপ গুলোতে পোষ্ট করে দিলো। বাবা আসার আগেই সে আমাদের বাসা থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো।

রাতে নিজের রুমে বসে বসে ফেসবুকিং করছি আর ভাবছি এগুলার বাহিরে আর কি কি করা যায়। হঠাৎ মাথায় বুদ্ধি আসলো ঢাকা শহরের ভিতর আচার বেশ ভালো চলতে পারে। কেননা এখানে মানুষের এতো সময় কোথায় যে আচার তৈরি করবে। আর আমারতো আর সময়ের অভাব নেই। শুরু হয়ে গেলো আমার ব্যস্ততার দিন। পরদিন ছোট ভাইকে দিয়ে বাজার থেকে আচার বানানোর জন্য উপকরণ কিনে নিয়ে আসলাম।

দুপুরের আগে আগে ফেসবুক নোটিফিকেশন চেক করতে গিয়ে দেখতে পেলাম একজন খাবারের অর্ডার করতে চাচ্ছে। ইনবক্সে তার সাথে কথা বলে খাবার তৈরি করতে শুরু করলাম। তিনটার ভিতর তিনজনের খাবার রুমনকে দিয়ে তার অফিসে পৌঁছে দিলাম। এভাবেই শুরু হলো আমার প্রথম উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প। পরদিন থেকে নিয়মিত অর্ডার আসতে শুরু করলো আর শুরু হয়ে গেলো আমার প্রচণ্ড ব্যস্ততা।

সারা দিনের কর্ম ব্যস্ততার শেষে রাতে জ্যোৎস্নার আলোয় এলোমেলো বাতাসে পাশাপাশি ছাদে দাঁড়িয়ে সারাদিনের সব ক্লান্তি ভুলে জাহাঙ্গীরের সাথে গল্প করতে করতে আমি হারিয়ে যাই অজানা এক ভুবনে এভাবেই কেটে গেলো আরও তিনটি মাস।

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here