রংধনু- ৮ম পর্ব

0
1848

রংধনু- ৮ম পর্ব
#লেখনীতে_শাহরিয়ার

দু’জন জানালার পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছি। রাত গভীর হচ্ছে। বৃষ্টির বেগও বেড়ে চলছে। মাঝে মাঝেই বিকট শব্দে বজ্রপাত হচ্ছে। ভয়ে আমি মাঝে মাঝেই শক্ত করে আজাদের হাত চেপে ধরছি। দীর্ঘ সময় দু’জন নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলাম।

আজাদ: যেয়ে শুয়ে পরো।

আপনি ঘুমাবেন না? রাততো অনেক হয়েছে।

আজাদ: হুম একটু পর।

আমি কথা না ঘুরে বিছানার দিকে হাঁটতে যাবো ঠিক সে সময় প্রচণ্ড শব্দে বজ্রপাত হতেই আমি ভয়ে পেয়ে পেছনে ঘুরে আজাদকে জড়িয়ে ধরলাম। এই প্রথমবারের মত আমি আজাদের বুকে আমার মাথা রাখলাম। দু’হাতে শক্ত করে তার পিঠে আস্থার হাত রাখলাম। হঠাৎ বুঝতে পারলাম আজাদও আমার পিঠে হাত রেখেছে। এভাবেই কিছুটা সময় কেটে গেলো। আজাদ হঠাৎ করেই আমার পিঠ থেকে হাত সরিয়ে নিতেই কিছুটা অভিমান এসে আমার মনের মাঝে বাসা বাধলো। আমি উনার স্ত্রী ভালোবাসা না দিক। উনাকেতো সব বলেছি ঝড় বৃষ্টির মাঝে বজ্রপাতের শব্দে আমার ভয় লাগে। কেন কিছুটা সময় তার বুকে মাথা রেখে থাকলে কি খুব ক্ষতি হয়ে যেতো? রাগে আরও জুড়ে তাকে জড়িয়ে ধরলাম।

আজাদ: কি হলো বিছানায় যাও।

ভয় লাগে আমার।

আজাদ: দুই হাতে দুই বাহুতে হাত দিয়ে কিসের ভয়?

জানিনা কিসের ভয়, আপনাকেতো বলেছি। আপনি এতোটা স্বার্থপর আর নির্দয় কেন?

আজাদ: আমি আবার কি করলাম?

কি করেননি আপনি একটু চিন্তা করুন, কথাটা বেশ কিছুটা অভিমান নিয়েই বলে উনাকে ছেড়ে দিয়ে, ঘুরতে ঘুরতে একটা মেয়ের মন কি আপনি বুঝেন। আপনার মত মানুষকে কি করে শুভ্রাপু ভালোবেসেছিলো এটাইতো আমি বুঝতে পারছি না। বলেই বিছানার দিকে রওনা হতেই পেছন থেকে আজাদ হাত টেনে ধরে। আমি ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করতেই আজাদ একটানে আমাকে ঘুরিয়ে তার শরীরের সাথে চেঁপে ধরে।

আজাদ: এতোটুকু একটা মেয়ে এতো জিদ তোমার কোথায় থাকে? এতো রাগ কি করে জমা করো মনের ভিতর?

আমি কোন জিদ বা রাগ করিনি। ছেড়ে দিন আমি কে জিদ বা রাগ করার?

আজাদ: কথা শুনে শক্ত করে বুকের সাথে চেপে ধরে তাইতো তুমি কে রাগ করার? শুভ্রাতো বোকা মেয়ে ছিলো তাইতো আমাকে ভালোবেসে ছিলো কিন্তু তুমি কেন বিবাহিত এক মেয়ের বাবাকে ভালোবাসতে গেলে?

আমি, আমি কেন আপনাকে ভালোবাসতে যাবো? বলেই ছুটতে চেষ্টা করলাম। আজাদ আরও শক্ত করে বাহু চেপে ধরলো। চোখের উপর চোখ রেখে আমাকে ভালোবাসো না? আমার মুখ থেকে আর কোন কথা বের হচ্ছে না। হারিকেনের নিভু নিভু আলোতে, বাহিরের ঝুম বৃষ্টিতে আর সমস্ত শরীর যেন কাঁপতে শুরু করলো। আজাদ মুখটা আমার মুখের খুব কাছে এনে কি হলো উত্তর দাও। আমি যেন কিছু বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। অনেক কিছু বলতে চেয়েও যেন কিছু বলতে পারছি না। অথচ আমার অধিকার আদায়ের জন্য। ভালোবাসি বলার জন্য এরচেয়ে ভালো কোন সময় আর হয়না। কিন্তু আজ সব কথারা অভিমান করেছে আমার সাথে।

আজাদ আমার নিশ্চুপ থাকায় আমাকে ছেড়ে দিলো। ঘুরে সে আবার জানালার গ্রীল ধরলো। আমি পেছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরলাম। অস্ফুস্ট স্বরে ভালোবাসি আপনাকে।

আজাদ: কি বললে বুঝিনা জোড়ে বলো।

আমি শুভ্রাপুর জায়গাটায় কখনো নিজেকে দেখতে চাই না। তবে তার আশে পাশে কোথাও কি আমায় একটু জায়গা দেয়া যায় না। যাতে করে সবাই আমায় বলতে পারে ঐতো নিশাদের মা। আজাদের স্ত্রী। আমি কেমন করে আপনাকে ভালোবেসেছি তা জানি না। আপনাকে ভালোবাসার জন্য একটা কোন নির্দিষ্ট কারণ বলতে পারবো না। শুধু জানি আপনার সব কিছুতেই আমি মুগ্ধতা খুঁজে পাই। আর আপনাকে ভালোবাসার অধিকার আমার রয়েছে।

দীর্ঘ সময় চুপ থেকে আজাদ ঘুরে তাকাতেই আমার ভীষণ লজ্জা লাগতে থাকলো। কিভাবে কি বলে ফেললাম। হুট করেই আজাদ আমার কোমরে হাত দিয়ে টান মেরে তার বুকের সাথে লাগিয়ে নিলো। আমি দু’চোখ বন্ধ করে নিলাম।

আজাদ: কিভাবে মুগ্ধ হও এমন বেরসিক মানুষটার থেকে। যে তোমার সাথে ঠিকমত কথাও বলে না। তাকে কি করে ভালোবাসো?

চোখ মেলে তাকাতেই তার মুখটা আমার মুখের খুব কাছে দেখতে পাই। তার শ্বাস-প্রশ্বাসের তীব্রশব্দ আমার কানে এসে লাগছিলো। আমি কিছুই বলতে পারছিলাম না। বজ্রপাতের শব্দে যখন তাকে শক্ত করে চেঁপে ধরতে যাবো ঠিক তখনি আমার ঠোঁটের সাথে তার ঠোঁটের স্পর্শে সমস্ত শরীরে যেন বিদুৎ খেলে গেলো। আজ যেন এতো বছরের চাওয়ার প্রাপ্তী ঘটলো। আজাদের ঠোঁটের মাঝে নিজের ঠোঁট রেখে দু’চোখ বন্ধ করে খুব শক্ত করে আজাদকে জড়িয়ে ধরে রেখেছি। ঠিক কতটা সময় এমন ছিলাম জানি না। একটা সময় আমি বুঝতে পারলাম শূন্য ভাসছি। চোখ মেলে তাকাতেই বুঝতে পারলাম আমি আজাদের কোলে। লজ্জায় আমার সমস্ত চোখ মুখ লাল হয়ে গিয়েছে তা বেশ বুঝতে পারছি।

একপা দু’পা করে আজাদ যখন আমাকে কোলে নিয়ে খাটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো। তখন নিভু নিভু করা হারিকেনটা পুরোপুরিই নিভে গেলো। আমি খুব শক্ত করে আজাদকে জড়িয়ে ধরলাম। সকালে পাখির কিচিরমিচির শব্দে চোখ মেলে তাকালাম। পাশেই গভীর ঘুমে মগ্ন আজাদ। বাহিরের ঝড় বৃষ্টি সব থেমে গিয়েছে। আজাদের পিঠের নিচ থেকে খুব আস্তে করে টেনে শাড়ির আঁচলটা বের করে নিয়ে আসছি যেন উনার ঘুম না ভাঙে। এক সময় সফল ভাবে শাড়ির আঁচলটা টেনে নিয়ে এসে নিজের শরীরে প্যাঁচিয়ে নিয়ে চাদরটা আজাদের শরীরে টেনে আমি আস্তে করে রুম থেকে বের হয়ে এলাম।

সবাই তখনো গভীর ঘুমে ব্যস্ত আমি ফ্রেশ হয়ে নিজের রুমে চলে এসে জানালার পর্দা সরিয়ে দিতেই কিছুটা আলো ঘরে এসে প্রবেশ করলো।

এই যে শুনছেন? দুই তিন বার ডাক দিতে আজাদ চোখ মেলে তাকিয়ে হু।

উঠেন তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নিন।

আজাদ: এতো সকাল সকাল কেন?

আপনি এখন ঢাকাতে নেই গ্রামে আছেন। আমি নাস্তা বানাতে গেলাম। বলেই হাসতে হাসতে রুম থেকে বের হয়ে এলাম। বেশ কিছুক্ষণ পর মামী রান্না ঘরে এসে আমাকে দেখে। কিরে মা তুই এতো সকাল সকাল রান্না ঘরে কেন?

কেন আবার নাস্তা বানানোর জন্য।

মামী: কেন আমি নাস্তা বানালে কি দেরী হয়ে যেতো নাকি?

আমি হেসে দিয়ে তা না মামী, আমারতো বেশী ঘুমানোর অভ্যাস নেই। ঘুম ভেঙে গেলো তাই ভাবলাম উঠে কাজ করি এইতো।

মামী: তাই বলে নতুন জামাই রেখে চলে আসতে হবে। এটা তুই ঠিক করিসনি।

তুমি যে কি বলো না মামী।

মামী: আমি ঠিকি বলি তুই যা তো এখন। তোর মামা দেখলে এখুনি আমাকে বকা শুরু করবে।

কিছুই বলবে না। ঐতো মামা উঠে গেছে। আমিতো সংসারের কাজই করছি তাই না।

মামা: কি হয়েছেরে মা।

কিছু না মামা। আমি রান্না ঘরে এসেছি দেখে মামী রাগ দেখাচ্ছে।

মামা: তা তোর রান্না ঘরে কেন আসতে হবে এই সকাল সকাল।

ঢাকা যেয়েতো আর রান্না ঘরে ঢুকতে পারি না। এখন সুযোগ এসেছে তাই আসলাম।

মামা হাসতে হাসতে চলে গেলেন। মামী তুই যা তো মা যেয়ে দেখ জামাই এর কিছু লাগবে কিনা।

বুঝেছি তোমার সহ্য হয়না আমাকে। এখনতো আমি পর হয়ে গেছি।

মামী: এসব কি বলছিস? তুইতো আমার আরেকটা মেয়ে।

আমি মামীকে জড়িয়ে ধরলাম। মামী বললো যাতো খুব দুষ্ট হয়ে গিয়েছিস।

আমি হাসতে হাসতে রান্না ঘর থেকে নিজের রুমে চলে আসলাম। আজাদ শার্ট গায়ে দিচ্ছিলো। আমাকে দেখে হেসে দিলো। সত্যিই মুগ্ধ কর হাসি। আমি পাশে দাঁড়িয়ে এমনি করে সব সময় হাসবেন।

আজাদ: বেশী হাসা নাকি ভালো না।

বলছে আপনাকে। হাসলেই আপনাকে সুন্দর লাগে। আর বাড়ির সকলেই চায় আপনি হাসি খুশি থাকুন।

আজাদ: আর তুমি কি চাও?

আমি আর কি চাইবো। সবার আনন্দেই আমার আনন্দ।

আজাদ: তাই বুঝি?

জ্বি তাই।

আজাদ: আচ্ছা আজ কোথাও ঘুরতে যাবে না?

আকাশের যা অবস্থা কোথায় যে ঘুরতে যাবো বুঝতে পারছি না।

আজাদ: কেন বৃষ্টি নামবে বুঝি? নাকি বিজলী চমকালে ভয়ে জড়িয়ে ধরবে?

আমার বয়ে গেছে সব সময় আপনাকে জড়িয়ে ধরতে।

আজাদ হুট করেই কোমর জড়িয়ে ধরে, তাহলে আর কি আমাকেই জড়িয়ে ধরতে হবে। বলেি ঠোঁট দু’টো আমার ঠোঁটের কাছে নিয়ে আসতেই দরজার ওপাশ থেকে ঝুমা বলে উঠলো আপু আসবো ঘরে। আজাদ দ্রুত আমাকে ছেড়ে দিয়ে শার্ট পরতে শুরু করলো। আমি হেসে দিয়ে আয় ভিতরে।

ঝুমা: ভিতরে এসে কি খবর তোমাদের আজ এতো তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে গেছো।

কেন আমি মনে হয় অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকি?

ঝুমা: তুমি থাকো না কিন্তু ভাইয়াতো থাকে। তার সাথে না হয় একটু শুয়ে থাকবে। তাতে করে নাকি ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়।

আজাদ: ঝুমার কান ধরে টান দিয়ে অল্প বয়সে বেশী পাকলে যা হয়।

ঝুমা: হাসতে হাসতে উফ ভাইয়া মোটেও আমার অল্প বয়স না। আপুর থেকে মাত্রই দুই বছরের ছোট। তাছাড়া আমার আঠারো পার হয়েছে।

আজাদ হাসতে হাসতে আর কয় দিন পর কুড়িতে বুড়ি হয়ে যাবে তাহলে। তাদের কথপোকথন শুনছি আর আজাদের হাসিতে মুগ্ধ নয়নে আমি তাকিয়ে রয়েছি। সত্যিই মানুষটার মাঝে কিছু একটা আসে।
#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here