আন্তঃনগরের_ভালবাসা লেখকঃ আবির খান পর্বঃ ০২

0
1035

#আন্তঃনগরের_ভালবাসা
লেখকঃ আবির খান
পর্বঃ ০২
কমলাপুর রেলস্টেশনের রেল লাইনের উপর হাঁটছি। কাঁধে ব্যাগটা ঝুলছে। ভাবছি, দ্রুতগামী ট্রেনটা আমাকে কত জোরে পিষে দিয়ে চলে যেতে পারবে। সামনেই একটা ট্রেন আসছে হর্ণ বাজিয়ে। আমি পাথরের মতো দাঁড়িয়ে যাই। অশ্রুসিক্ত নয়ন জোড়া ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে আসে। চোখ গুলো বন্ধ করে ফেলি। এটাই আমার জীবনের শেষ মুহূর্ত। সাতাইশ বছরের জীবনে মানুষের কাছ থেকে এক ফোঁটা ভালবাসা পাওয়ার আশায় পেয়েছি তুচ্ছতাচ্ছিল্যতা আর অবিরাম কষ্ট। আজ নিজের আপন মানুষের কাছে আমি মৃত। তাহলে আর বেঁচে থেকে কি হবে আমার? মা আমি তোমার কাছে আসছি। আর পারছি না এত কষ্ট এত অপমান এত তাচ্ছিল্যতা নিতে। সামান্য একটা হাত অকেজো বলে আমার কোন মূল্যই নেই। এ কেমন তোমার দুনিয়া আল্লাহ? মানুষের কি মন নেই? তারা কি পশুর চেয়েও পাষাণ হয়ে গিয়েছে? থাক, আর কি হবে এসব ভেবে। আল্লাহ চলে আসছি তোমার কাছে৷ আর পারবো না আমি এই বিষাক্ত দুনিয়ার মায়াজালে পিষে পিষে মরতে। তার চেয়ে দ্রুতগামী ট্রেনটাই আমাকে শেষ করে দিয়ে চলে যাক। ট্রেনটা খুব কাছে চলে এসেছে। বারবার হর্ণ দিয়ে যাচ্ছে। হয়তো আমাকে সরানোর জন্য। কিন্তু লাভ নেই। এটাই আমার জীবনের শেষ মুহূর্ত। চোখ বেয়ে বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পড়ছে অঝোরে। হিতাহিত জ্ঞান শূন্য এখন আমি। বিদায় এই পাষাণ্ড পৃথিবী। ট্রেনটা খুব জোরে হর্ণ বাজিয়ে যেই আমাকে পিষে দিতে যাবে ঠিক তখনই কে যেন আমাকে হ্যাচকা টান মেরে পাশে ফেলে দেয়। আমি হকচকিয়ে উঠি। কোন রকম নিজেকে সামলে উঠার আগেই সে আমার কাছে এসে কাঁপা কাঁপা রাগী কণ্ঠে বলে,

— এই পোলা কি করতে যাচ্ছিলা তুমি? পাগল হইয়া গেছো নাকি?

কোন রকম নিজেকে সামলে তাকিয়ে দেখি একজন বয়স্ক লোক। ময়লা একটা পাঞ্জাবি পরা, মুখে সাদা পাকা দাঁড়ি। দেখলাম লোকটা হাপাচ্ছে। বোধহয় দৌড়ে এসেছে আমাকে বাঁচাতে। তার পুরো শরীর কাঁপছে। আমি এখনো মাটিতে পড়েই আছি। লোকটা আবার কাঁপা কণ্ঠে বলল,

— মইরা যাওয়া দরকার আমার। আর হেয়ানে তোমার মতো জুয়ান পোলা কোন দুঃক্কে জীবন দিতে ছিলা? কি হইছে?

আমি মাথা নিচু করে বলি,

— চাচা, এই জুয়ান পোলার একটা হাত নষ্ট বিধায় তার পরিবারের কাছে আজ সে মৃত। এর চেয়ে কষ্টের আর কি আছে?

লোকটা আস্তে আস্তে আমার কাছে হেঁটে এসে আমার ব্যাগটা নেওয়ার চেষ্টা করলো। আর বলল,

— তুমি আগে ওই দিকে আসো। এহানে থাকা ঠিক হবে না৷ বুড়া মানুষ আমি। বারবার তোমারে থামাইতে পারমু না।
— আমাকে বাঁচাতে গেলেন কেন? মরেই যেতাম। ঝামেলা শেষ হয়ে যেত৷
— এই পোলা চুপ করো। এদিকে আসো। আহ! ব্যাগটায় এত ওজন ক্যান? নিতেও পারতাছি না। মনে হয় বয়সের দোষ।

আমি বাম হাতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াই। তারপর উনার কাছ থেকে ব্যাগটা নিয়ে কাঁধে ঝুলাই। উনি খপ করে আমার বাম হাতটা ধরে আমাকে রেললাইনের কাছ থেকে দূরে নিয়ে যায়। আমার উদ্দেশ্য এখনো বদলায় নি। আমি শুধু ওনার সাথে যাচ্ছি এটা জানতে যে উনি কি চায়। যাইহোক আমাকে নিয়ে বয়স্ক লোকটা একটা নির্জন জায়গায় গিয়ে বসলেন। তারপর আমাকে বললেন,

— নিজেই নিজেরে মারা কতটা পাপ জানো তুমি? আত্নহত্যা করা মহা পাপ। কি করতে যাইতে ছিলা তুমি এডা? আল্লাহ তোমারে এই পাপের জন্য কত্তো বড়ো শাস্তি দিত তোমার ধারণা নাই।

কাঁধ থেকে ব্যাগটা পাশে ধপ করে পড়ে যায়। মাথাটা নিচু হয়ে যায়। চোখ থেকে টপ টপ করে নোনা জল গড়িয়ে পড়ছে। কান্না সিক্ত কণ্ঠে চাচাকে বললাম,

— নিজের পরিবারের কাছে যখন একটা মানুষ বেঁচে থেকেও মৃত কিংবা বোঝা হয়ে যায় তখন সে কিভাবে বাইরের মানুষগুলোর তুচ্ছ তাচ্ছিল্যতা সহ্য করবে বলেন? এরচেয়ে সত্যি সত্যিই মরে যাওয়াই আমার কাছে শ্রেয় মনে হয়েছে।
— তাইলে আমি বাঁইচা আছি কেমনে কও তো? যখন শরীরে শক্তি আছিল তখন রিকশা চালাইতাম। ট্যাকা ইনকাম করতাম। পোলাপান গো হাতে দিতাম। এহন যেই বয়স হইছে শরীরে কোন শক্তি নাই, ট্যাকা ইনকাম করতে পারি না আমার নিজের পোলাপান আমার পালা ওরা আমারে ঘাড় ধাক্কা দিয়া বাড়ি থেইকা বের কইরা দিছে। এই বুড়া বয়সে আমার না আছে কোন শক্তি না আছে কোন জায়গা। হাড়া দিন এহানে ওহানে ঘুরি। তাইলে তোমার আগে তো আমার মইরা যাওয়ার কথা। তাও বাঁইচা আছি। আল্লাহ বাঁচাইয়া রাখছে। মরি নাই৷ সকালে এক টুকরা রুটি আর রাইতে হোটেলের বাসি খাবার খাইয়া দিন ভালোই যাইতাছে। তাও মরি নাই। আর তুমি তো জুয়ান একটা পোলা। খালি একটা হাতই কাজ করে না৷ আর সবই তো ভালো আছে। দেখতেও মাশাল্লাহ। এত কিছু থাকার পরও মইরা যাবা? মিয়া বাঁইচা থাকো না। এই যে দুইটা পা, দুইটা চোখ, আর এই একটা হাত আছে৷ এগুলা দিয়া কি কিছুই করে খাইতে পারবানা? আর তোমারে দেইখা তো শিক্কিত মনে হইতাছে। আমি ত অশিক্কিত। আমার কোন কূলই নাই। তোমার জীবনের এহনো অনেক কিছু বাকি বাবা। মইরো না৷ মইরা গেলেই তো সব শেষ। আল্লাহর কাছে মাফ চাইয়া বাঁইচা থাকো। জীবনডা নিজের মতো কইরা বাঁচো। এই দুনিয়ায় কেউ কাউরে পাত্তা দেয় না। পাশে মানুষ মইরা থাককেও একবার তাকাইয়া চইলা যায়। তুমি দেখাই দেও সবাইরে এক হাত নষ্ট হইলেও মানুষ অনেক কিছু করতে পারে। আমার বিশ্বাস তুমি পারবা। আমার মতো ত আর বৃদ্ধ না তুমি যে কোন কাজই করতে পারবানা। এহনো কত শক্তি তোমার গায়ে। পারবা তুমি। অনেক পারবা।

চাচার চোখগুলো নোনা জলে ভরে গিয়েছে। সাথে আমারও। আর পারিনি। চাচাকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদলাম। চাচাও নিরবে কাঁদলেন আমার সাথে। আমি অনুভবই করতে পারছিলাম না এই বৃদ্ধ মানুষটা আমার চেয়েও এত বেশি কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছেন কিভাবে এতদিন! নাহ! এভাবে হার মানলে তো আমার জীবনের গল্প এখানেই সমাপ্তি হবে৷ বেঁচে থাকার যখন শেষ একটা সুযোগ পেয়েছি তাই শেষ একটা চেষ্টা আমি করবো। চাচা ঠিকই বলেছেন, জীবনটায় এবার নিজের মতো করে বাঁচতে হবে৷ চাচাকে ছেড়ে তার চোখ গুলো মুছে দিয়ে বললাম,

— এতটা কষ্টে থাকার পরও অন্যের কষ্টকে মুছে দিলেন। এই দুনিয়ায় এত কষ্ট পেলেও পরকালে আপনি অনেক সুখে থাকবেন চাচা৷ আল্লাহ আপনাকে অনেক ভালো রাখুক। অনেক বড়ো উপকার করলেন আমার। নতুন একটা জীবন ফিরে পেলাম মনে হচ্ছে। আমি শেষ একটা চেষ্টা করবো।
— জীবনে অনেক বড়ো হও বাবা। সেই দোয়াই করি। আর কখনো হতাশ হইয়ো না৷ আল্লাহর উপর ভরসা রাইখো।
— জি চাচা৷ আপনিও।

বলেই উঠে দাঁড়াই। পকেট থেকে একশো টাকার একটা নোট বের করে চাচার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলি,

— নিজের ছেলে ভেবে এটা রাখেন। আমার জন্য যদি একবেলা ভালো ভাবে পেট ভরে খেতে পারেন আমার খুব ভালো লাগবে৷
— না না বাবা টাকা লাগবে না৷ তুমি রাইখা দেও। তোমার কাজে দিবো।
— চাচা নেন এটা।

আমি একপ্রকার জোর করে ওনার পকেটে টাকাটা দিয়ে চলে আসি। আর পিছনে তাকাই নি৷ হাঁটতে হাঁটতে ভাবছি, আল্লাহর দুনিয়ায় এখনো কিছু মানুষ আছেন যারা ধন সম্পদের দিক থেকে ছোট হলেও মনের দিক থেকে তারা অনেক বড়ো। তারা অন্যের দুঃখকে নিজের করে নিয়ে তাকে ভালো করে দেয়। এসব মানুষদের জন্য হলেও আমাদের বেঁচে থাকা উচিৎ। বাসা থেকে আসার সময় আমার মানিব্যাগে সব মিলিয়ে তিন হাজার টাকা ছিল। এখন উনত্রিশত টাকা আছে। ভাবছি কোথায় যাবো? কি করবো? হঠাৎ দাঁড়িয়ে যাই আর ভাবি, এই বিষাক্ত শহরে আর থাকবো না৷ নাহলে কোন একদিন হয়তো আবার তাদের সম্মুখীন হবো। তার চেয়ে দূরে কোথাও চলে যাই। যেখানে আমাকে কেউ চিনবে না। একদম নতুন একটা জায়গা। কিন্তু কোথায় যাবো? হঠাৎই মাইকে শুনলাম বলছে, ধুমকেতু এক্সপ্রেস আর কিছু ক্ষণের মধ্যেই রাজশাহীর উদ্দেশ্যে রওনা হবে৷ হাতে একটা ঘড়ি ছিল। তাকিয়ে দেখি ১০ঃ৪৫ নাগাদ বাজে। মানে রাত ১১ টা নাগাদ ট্রেনটি রাজশাহীর উদ্দেশ্যে ছেড়ে দিবে৷ আর কিছু না ভেবে দ্রুত রেলস্টেশনে গিয়ে টিকিট কেটে ট্রেনে উঠে যাই। উদ্দেশ্য রাজশাহী চলে যাবো। দেখতে দেখতে ঠিক এগারো টায় ট্রেন ছেড়ে দিল। জানতে পারলাম ছয় ঘণ্টার দীর্ঘ যাত্রা। নিজের অসহায় অকেজো হাতটার দিকে তাকিয়ে আছি। আর মনে মনে ভাবছি, আমি পারবো তো বেঁচে থাকতে?

সকাল ৫ঃ১৩ মিনিট। মধুর কণ্ঠে ফজরের আজান কানে ভেসে আসছে। মাত্র রাজশাহী এসে পৌঁছালাম। আমার সাথে অনেকেই নেমেছেন। স্টেশন থেকে বের হয়ে ভাবছি কোথায় যাবো। কারণ জায়গাটা সম্পূর্ণ অপরিচিত। কিছু না ভেবেই একদিকে হাঁটা দিলাম। দেখলাম সামনেই একটা মসজিদ। মনটা খুশি হলো। এই নতুন জীবনের প্রথম প্রহরটা আল্লাহর ইবাদত দিয়েই শুরু হোক৷ মসজিদে ঢুকেই ওজু খানায় চলে গেলাম। বসে ওজু করছিলাম। আমি সব কিছু বাম হাত দিয়ে করছিলাম বিধায় আমার পাশ থেকে একজন ভারী কণ্ঠে বলে উঠেন,

— উহুম এটা তো ঠিক হচ্ছে না৷ এভাবে ওজু করে না ছেলে। ডান হাত দিয়ে করতে হয়। তোমার ওজু হচ্ছে না৷

আমি ঘুরে ওনার দিকে তাকিয়ে দেখি, আমার বাবার বয়সীই একজন লোক। আমি হাসি দিয়ে আস্তে করে বললাম,

— আঙ্কেল, আমার ডান হাতটা প্যারালাইজড। তাই বাম হাত দিয়েই সব করতে হয়।

আমার কথাটা শোনা মাত্রই আঙ্কেলটি পুরো স্তব্ধ হয়ে যায়। তিনি দ্রুত সরি সরি বলতে থাকেন। আমি তাকে থামিয়ে বলি,

— না না আঙ্কেল সমস্যা নেই। আপনি আমার গুরুজন প্লিজ আর সরি বলবেন না৷

এরপর আমি নামাজ পড়তে চলে যাই। অনেকটা কষ্টেই এক হাতে ভর দিয়ে নামাজটা পড়ি। নামাজ শেষে মসজিদের বাইরে চলে আসি। এসে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি একটু দূরে৷ বুঝতে পারছি না এখন কই যাবো? কি করবো? নিজেকে খুব অসহায় লাগছিলো। মনে মনে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাচ্ছিলাম৷ যেন আল্লাহ একটা পথ বের করে দেন। হঠাৎই একটু আগের সেই পরিচিত ভারী কণ্ঠটা আবার শুনলাম। আমার পিছন থেকেই,

— আরে বাবা তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছো যে? কোন সমস্যা?

আমি পিছনে তাকিয়ে দেখি সেই আঙ্কেলটা। আমি একটু হেসে বললাম,

— না না আঙ্কেল কোন সমস্যা নেই। আসলে এই শহরে নতুন তো তাই ভাবছি কোথায় যাবো কি করবো।
— কেন পরিচিত কেউ নেই তোমার এখানে?

আমি মাথা নাড়িয়ে না বললাম। তিনি কিছুক্ষণ আমাকে দেখে বললেন,

— তোমাকে দেখলাম অনেক কষ্ট করে নামাজ পড়ছিলে। বেশ ভালো ভদ্র ঘরের মার্যিত ছেলে মনে হচ্ছে তোমাকে। তাহলে তুমি এভাবে গন্তব্যহীন কেন বাবা?

আমার মাথাটা নিচু হয়ে যায়। কি বলবো ওনাকে? আমার দুঃখের কাহানি শুনেও বা উনি কি করবেন। আমি আস্তে করে বললাম,

— তেমন কিছু না আঙ্কেল। আমার হাতের সমস্যার জন্য আমার পরিবার আমাকে মৃত ঘোষণা করেছে। তাই তাদের থেকে দূরে চলে এসেছি।

আঙ্কেক আমার কথা শুনে পুনরায় স্তব্ধ হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন,

— তোমার নাম কি বাবা?
— মোঃ আবির আহমেদ।
— বাহ! সুন্দর নাম। কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি?
— জি আঙ্কেল অবশ্যই৷
— একটু দূরেই আমার বাসা। এই ৭/৮ মিনিটের পথ। যদি তুমি আমার মেহমান হয়ে আমার বাসায় যেতে আমার খুব ভালো লাগতো। তোমার মতো একটা ভালো ছেলেকে আমি যদি আজ এভাবে এখানে একা ফেলে যাই আমার কাছে খুব খারাপ লাগবে৷ যাবে আমার বাসায়?
— কি বলছেন আঙ্কেল? এটা হয় নাকি? আমি একটা অপরিচিত ছেলে। এভাবে আমাকে আপনার বাসায় নেওয়া কি ঠিক হবে? না না আঙ্কেল এটা হয় না। আপনি বলেছেন তাই অনেক। আমি দেখি অন্য কোথাও চলে যাবো।
— আমার কোন সমস্যা নেই আবির৷ তুমি চলো। তোমাকে না নিয়ে আমি যাচ্ছিই না। আমরা রাজশাহীর বাসিন্দা। মেহমানদের অনেক ভালো ভাবে আথিতেয়তা করতে জানি বুঝলে। প্লিজ চলো বাবা।

আঙ্কেল আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। তার কথার জালে আর জেদের জন্য আর নাই করতে পারলাম না। তিনি আমাকে এক প্রকার ধরে নিয়ে তার বাসার দিকে হাঁটা শুরু করলেন। হাঁটতে হাঁটতে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,

— ঢাকা থেকে এসেছো?
— জি।
— ওহ! ঢাকার মানুষ গুলো এমনিও ভালো হয় না বুঝলে। আমরা রাজশাহীর লোকেরা অনেক ভালো। এখানে তোমাকে কেউ কিছু বলবে না। বললে আমাকে বলবে। নিজের বাবার মতো ভাববে আমাকে। জানি তোমার আপন বাবা-মা তোমার সাথে..
— আঙ্কেল আমার মা নেই। যখন ছিলেন আমাকে অনেক আগলে রাখতেন।
— ওহ! সরি সরি। তোমার পরিবারে কে কে আছে তাহলে?
— বাবা, বড়ো ভাই, ভাবী আর একটা ছোট বোন। তাদের সবার কাছেই আমি বোঝা ছিলাম। আমার জন্য অবশ্য তারা অনেক অপমানিত হয়েছে অনেকের কাছে। তাই তাদের কাছে এখন আমি মৃত।
— আহ ওসব আর ভেবো না৷ আমরা মানুষেরা কতটা পাষাণ হয়ে যাচ্ছি দিন দিন। আল্লাহ আমাদের হেদায়েত দান করুন।
— আমিন।
— আমিন। তা বাবা তুমি পড়াশোনা কতদূর করেছো?
— বিবিএ এবং এম এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে ছি।
— বলো কি! মাশাল্লাহ মাশাল্লাহ। তাহলে তো অনেক মেধাবী ছাত্র তুমি। (অনেক খুশি হয়ে বললেন)

আমি স্থীর কণ্ঠে বললাম,

— লাভ কি এত মেধাবী হয়ে আঙ্কেল? পৃথিবীর সবার কাছে বাইরের সৌন্দর্য্যটাই আসল। আমার একটা হাতের সমস্যার জন্য আমি পুরোটাই বাদ হয়ে গিয়েছি।
— হতাশ হয়েও না বাবা। এরকমটা যারা ভাবে তারা আসলে মানুষই না। তাদের মাঝে কোন মনুষ্যত্বই নেই। তুমি আজ থেকে আমার এখানেই থাকবে। যতদিন খুশি থেকো। কোন সমস্যা নেই।
— ধন্যবাদ আঙ্কেল। আমার অনেক বড়ো উপকার করলেন। বলে বুঝাতে পারবো না৷

আঙ্কেল আসলেন। আরও অনেক কথা হলো আমাদের৷ মনে ভাবছিলাম আমার আপন বাবা যদি আমার সাথে এভাবে একটু কথা বলতেন তাহলে আমি তার পায়ে পড়ে থাকতান সারাদিন। কিন্তু..দেখতে দেখতে আঙ্কেলের বাড়ির সামনে চলে আসি। উনি বললেন,

— এই যে এটা আমার বাসা।
ওনার বাড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি তিনতলা একটা সম্পূর্ণ বাড়ি। বেশ সুন্দর দেখতে। দারোয়ান আমাদের দেখে সালাম দিল। আঙ্কেল দারোয়ানকে বললেন,

— হাকিম ও হলো আবির। আজ থেকে আমাদের বাসায়ই থাকবে। ও কিন্তু আমার আপন ছেলের মতো। নিচতলায় যে এক রুমের ফ্ল্যাটটা ফাঁকা আছে না সেটা সুন্দর করে পরিষ্কার করে ওর জন্য রেডি করো। আজ থেকে ও এখানেই থাকবে।
— জি স্যার এখনো করছি।
— আর শোনো, ওর ডান হাতটায় একটু সমস্যা আছে। মানে কাজ করতে পারে না। তুমি ওকে একটু সাহায্য করো যদি ওর দরকার হয় তো।
— জি জি স্যার অবশ্যই। ভাইয়া আপনার যে কোন প্রয়োজনে আমাকে ডাক দিবেন সেটা রাত ৩ টা হলেও সমস্যা নাই। (হাসি মুখে বলল)

আমি অবাক হয়ে আছি। চোখের কোণায় অশ্রুতে ভরে আসছে। আঙ্কেল আমাকে দেখে চিন্তিত হয়ে বললেন,

— একি বাবা! কি হলো? কাঁদছো কেন?

আমি দ্রুত চোখ মুছে মুচকি একটা হাসি দিয়ে বললাম,

— জীবনে এর আগে এত ভালো মানুষদের সাথে কখনো পরিচিত হইনি তো তাই খুশিতে অজান্তেই চোখে পানি চলে এসেছে।
— ধুর বোকা ছেলে। আজ থেকে আমরাই তোমার পরিবার।

আঙ্কেল আমাকে নিয়ে বাসার ভিতরে গেলেন। সিড়ি দিয়ে সোজা তিনতলায় চলে গেলেন। বেল দিতেই অপর পাশ থেকে, কে বলে মেয়ালি একটা কণ্ঠ ভেসে আসে৷ আঙ্কেল বলে উঠেন,

— মরিয়ম আমি খোল।

দরজা খোলা মাত্রই একটা মেয়েকে দেখলাম। মেয়েটা আমাকে দেখে দ্রুত ভিতরে চলে গেল। আঙ্কেল আমাকে বললেন,

— আসো বাবা ভিতরে আসো।

আমি ভিতরে ঢুকতেই একজন ভদ্রমহিলা আমাদের সামনে আসেন। সাথে মেয়েটাও। তার মাথায় কাপড়। আণ্টি আমাকে দেখে অবাক হয়ে আঙ্কেলকে জিজ্ঞেস করলেন,

~ ও কে?

আঙ্কেল হাসি মুখে বললেন,

— ও আমার ছেলে আবির। মরিয়ম তোর জন্য একটা ভাই এনেছি দেখ৷

এদিকে আমি দেখলাম আণ্টি আর মরিয়ম পুরো হতভম্ব হয়ে আমার আর আঙ্কেলের দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎই আণ্টি মাথায় হাত দিয়ে বলে উঠেন,

~ মারে এ আমি কি দেখছি? তোর বাবা এই বুড়া বয়সে বিয়ে করে একটা ছেলেও নিয়ে এসেছে সাথে। হায় হায় আমাদের এখন কি হবে?

আণ্টির কথা শুনে আমি পুরো বোকা হয়ে যাই আর আঙ্কেল হাসতে হাসতে বলেন…

চলবে…?

সবার ভালো সাড়া চাই তাহলে খুব তাড়াতাড়ি পরবর্তী পর্ব দেওয়া হবে। আর কেমন লেগেছে জানাবেন কিন্তু। আগের এবং পরবর্তী পর্বের লিংক কমেন্ট দেওয়া হবে। ধন্যবাদ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here