প্রজাপতির_রং🦋 Part_15

0
1012

প্রজাপতির_রং🦋
Part_15
#Writer_NOVA

রাত নয়টায় ডাইনিং টেবিলে গোল হয়ে বসে ডিনার করছে ঠিকানাবিহীন বাড়ির মানুষ।জুলেখা বেগম সবাইকে সার্ভ করে দিচ্ছে। আরিয়ান এক হাতে মোবাইল গুতাচ্ছে আরেক হাতে খাবার খাচ্ছে। মুসকান তীক্ষ্ম চোখে সবাইকে খেয়াল করছে।তাজের দিকে ওর চোখ যেতেই দেখলো তাজ শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে খাবারের প্লেটে আঁকিবুঁকি করছে।ওর মন এখন এই জায়গায় নেই।

মুসকানঃ কি হয়েছে বড় ভাইয়া? তুই কিছু মুখে দিচ্ছিস না যে?

মুরাদঃ তাজরানের আবার কি হবে?

জুলেখাঃ কি রে তাজরান বাবা খাচ্ছিস না কেন?

কথাটা বলতে বলতে সেও তাজের দিকে তাকিয়ে চোখ ছোট ছোট করে ফেললো।তাজের যেনো কোন হুশ নেই। কারো কোন শব্দ না পেয়ে মিনিট তিনেক পর তাজের হুশ ফিরলো।সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলো সবাই উৎসুক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। তা দেখে বেচারা একটু ইতস্ততায় পরে গেলো।

তাজঃ তেমন কিছু না।তোমরা খাও।

আরিয়ানঃ তাজরান ভাই, তোর আজ কি হয়েছে রে?সারাদিন ধরে দেখলাম তুই অন্যমনষ্ক হয়ে কি জানি ভাবছিস।আশেপাশের কোন হুশ নেই। হুট করে কি নিয়ে এতো সিরিয়াস হয়ে গেলি?

মুরাদঃ এনিথিং রং মাই সান?

তাজঃ নো ড্যাড😊।

জুলেখাঃ কি হয়েছে বাবা? আমাকে বল।তোর কি শরীর খারাপ? নয়তো তোকে তো এত বিষন্ন আর চিন্তিত দেখায় না।

মুসকানঃ ভাইয়া নতুন প্রেমে-টেমে পরছিস নাকি।পরলে বলতে পারিস।পুরো সেটিং করিয়ে দিবো।(মুখ টিপে হেসে)

জুলেখাঃ মুসকান কি হচ্ছে এসব?

আরিয়ানঃ তুই পুচকি ইদুর নিজের পড়াশোনায় মন দে।অন্যের প্রেম নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না।

মুসকানঃ একদম কথা বলবি না তুই আমার সাথে। আমি কি তোকে কিছু বলেছি? সবসময় অন্যর বিষয় নাক গোলাতে আসে শয়তান বাঁদর। (মুখ ভেঙচিয়ে)

মুরাদঃ আরিয়ান,মুসকান থাম তোরা।

বাবার ধমকে আরিয়ান, মুসকান দুজনেই চুপ মেরে গেলো। তাজ চুপচাপ শুধু দুই লোকমা মুখে দিয়ে উঠে চলে এলো।তাজের আচরণে বাকি সবাই বেশ অবাক হলো। কারণ তাজ কখনো খাবার নষ্ট করে না।রুমে এসে বারান্দায় দাঁড়ালো। আজ ওর হঠাৎ করে অনেক সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে। যদিও সে আগে প্রায় সময় বন্ধুদের সাথে দু-চারটা টান দিতো।কিন্তু বহু বছর ধরে খায় না।এই বাসার কেউ সিগারেট খায় না।তবে আরিয়ানের কাছে থাকতে পারে। কারণ ওকে মাঝে মাঝে লুকিয়ে সিগারেট খেতে দেখেছিলো তাজ।সকালে নাভানের সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে তাজের সবকিছু এলোমেলো আর অসহ্য লাগছে।ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে ঐ বাচ্চা ছেলেটাকে কোলে তুলে নিতে।

🦋🦋🦋

রাতের অন্ধকারটা আমাদের কাছে পুরো ধোঁয়াসা।দিনে তুমি যাকে এক রূপে দেখবে রাতে সেই মানুষটাকে আরেক রূপে আবিষ্কার করবে।কালো অন্ধকারে তুমি বেশিরভাগ সময় মুখোশধারী লোকের আসল রূপটা দেখতে পারবে।হিংস্র ও পশু সমতুল্য মানুষগুলো নিজের রূপটা রাতেই ধারণ করে।তবে পৃথিবীতে যদি খারাপ মনুষ্যত্বের ও অন্ধকার না থাকতো তাহলে কিন্তু ভালো মানুষ ও আলোর এতো গুরুত্ব থাকতো না। খারাপ আছে বলেই ভালোর এত কদর।ভালো, খারাপ দুটোই কিন্তু একে অপরের পরিপূরক। দুটোর প্রয়োজন ছিলো বলেই মহান আল্লাহ তায়ালা তা সৃষ্টি করেছেন।

আকাশে আজ বিশাল বড় এক চাঁদ উঠেছে। তার আলোতে চারিদিক আলোকিত।সম্ভবত পূ্র্ণিমা হবে।চাঁদের আলোকদূতি ঘুটঘুটে কালো অন্ধকারকে ঠেলে ধাক্কিয়ে বহুদূর পাঠিয়ে দিয়েছে। হালকা ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। পুরো একটা রোমান্টিক ওয়েদার।সেই ওয়েদারে একা দাঁড়িয়ে গাছের পাতার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবছে রোশান।কপালে পরে থাকা চুলগুলো মৃদু বাতাসের তালে উঠানামা করছে।গভীর ভাবনায় মগ্ন সে।ভাবনার বিচ্ছেদ ঘটলো এক ফোন কলে।টাউজার প্যান্ট থেকে মোবাইল বের করে দেখলো আননোন নাম্বার। না চাইতেও রিসিভ করতে হলো।

রোশানঃ আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন?

—- রোশান দেওয়ান, রাইট।

রোশানঃ হুম আমি রোশান।কিন্তু আপনি কে?

—– এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেলেন আমায়? আমি আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী।

রোশানঃ সরি,চিনতে পারলাম না।

—– আপনার পাখির খবর যে আপনাকে দিয়েছিলো।আমি সেই শুভাকাঙ্ক্ষী।

রোশানঃ ওহ্ আপনি।হঠাৎ কি মনে করে আমায় স্মরণ করলেন?

—- নিশ্চয়ই কোন দরকার ছাড়া আপনাকে কল করিনি।

রোশানঃ তাতো নিশ্চয়ই। কি দরকার তাই বলুন।আপনি আমার পাখির খোঁজ দিয়েছেন। আপনি না থাকলে ওর কোন খোঁজও আমি পেতাম না কিংবা ওকে সেদিন তুলে নিতেও পারতাম না।তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ।

—- আমি নিজের স্বার্থ ছাড়া কোন কাজ করি না।আপনাকে এসব বলার পিছনে আমারও স্বার্থ ছিলো।

রোশানঃ কে আপনি বলুন তো?আপনাকে আমার খুব রহস্যময় মনে হচ্ছে।

—- আমি নোভার খুব কাছের মানুষ। আবার দূরের মানুষও।আপতত আপনাকে আমার পরিচয় দিচ্ছি না।আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিলো।আপনি কি এনাজের মৃত্যুর বিষয় কিছু জানেন?

রোশান কপাল কুঁচকে ফেললো। এই প্রশ্ন করার মানে কি? রোশান তো জানতোই না নোভার স্বামী কে? জীবনে এক পলক দেখেওনি।হ্যাঁ, এটা সত্যি সে নোভাকে ভালোবাসে।কিন্তু নোভার বিয়ের পর ওর কাছ থেকে পুরোপুরি সরে গিয়েছিল। নিজেকে ওর থেকে দূরে রাখার জন্য বিদেশে চলে গিয়েছিল। কিন্তু এনাজের মৃত্যুর সাথে ওর তো কোনরকম কানেকশন নেই। তাহলে ওকে এসব প্রশ্ন করছে কেন?

—- হ্যালো মিস্টার রোশান দেওয়ান। শুনতে পারছেন?

রোশানঃ আমি এই বিষয়ে কিছু জানি না। এনাজের মৃত্যুর খবরও আমি পাইনি।আপনি হঠাৎ এমন প্রশ্ন কছেন কেন?

—- সেটা আপনার না জানলেও চলবে। তবে এখন আপনার একটা হেল্প লাগবে।

রোশানঃ জ্বি বলুন।

—- নোভার একটা খালাতো ভাই আছে।তানভীর রহমান ওরফে তায়াং নাম।ওকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে হবে।

রোশান আৎকে উঠলো।এই আগুন্তক বলছে কি? তায়াং যে নোভাকে নিজের বোনের মতো দেখে এই কথাটা যেদিন থেকে জেনেছে সেদিন থেকে তায়াং-এর ওপর নজরদারি বন্ধ করে দিয়েছে রোশান।তার পাখিকে দেখে রাখার জন্য একটা ভাই আছে সেটা জেনে সে খুশি হয়ে গিয়েছিলো।তাকে মারার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারে না সে।যে নোভার ভালো চাইবে তার ক্ষতি তো রোশান করতে পারবে না।কিন্তু এই আগুন্তক বলছেটা কি???

রোশানঃ কি বলছেন আপনি?

—— আমি ঠিকই বলছি।আপনাকে এই তায়াং-কে মেরে ফেলতে হবে।

রোশানঃ আমি পারবো না। ওর সাথে আমার কোন শত্রুতা নেই।

—- আপনার নেই কিন্তু আমার আছে।ওর কলিজা অনেক বড় হয়ে গেছে। ও আবার এনাজের মৃত্যুর ফাইল ওপেন করতে চাইছে।

রোশানঃ কোনভাবে আপনি এনাজের খুনী নন তো?

—- আপনাকে যা বলছি তাই করবেন।আমি তায়াং-এর লাশ চাই। যদি ওকে মারতে না চান তাহলে আপনার পাখি আর পাখির বাচ্চাকে মেরে তাদের লাশ আপনার কাছে পাঠিয়ে দিবো।

হো হো করে হাসতে হাসতে কথাগুলো বলে কল কেটে দিলো অপর পাশের পরিচয়হীন সেই আগুন্তক।রোশান স্তব্ধ হয়ে গেলো।কে হতে পারে এই লোকটা? তবে সে যে এনাজের মৃত্যুর জন্য জড়িত তাতে রোশানের বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কপালের এক সাইড চিনচিন করে ব্যাথা উঠছে রোশানের।হুট করে মাইগ্রেনের ব্যাথাটা উঠে গেলো।ওর কপালেও কি শনি ঘনিয়ে আসছে??

🦋🦋🦋

পাক্কা আধ ঘন্টা ধরে খিচুড়ি নিয়ে বসে আছি। কিন্তু আমার মানিকচাঁদের খাওয়ার নামও নেই। হাত শুকিয়ে আঠা আঠা হয়ে গেছে। আর বাছাধন মুখে খিচুড়ি নিয়ে পানি পানি করে ফেলছে।কিন্তু গেলার নামও নিচ্ছে না ।সে এখন খুব মনোযোগ সহকারে খাতায় কলম দিয়ে আঁকিবুঁকি করছে।খেতে বসলেই তার আবার পড়াশোনা করার কথা মনে হয়।ইচ্ছে করছে কষিয়ে পিঠের মধ্যে দুটো দিতে পারতাম তাহলে মনটা শান্তি লাগতো।সারাদিন কাজ করে কার মন চায় খাবার নিয়ে বসে থাকতে।আজকালের বাচ্চাগুলো খাবার নিয়ে বহুত জ্বালায়।তার থেকে নাভানও বাদ পরেনি।

আমিঃ নাভান জলদী খাবার গিল।নয়তো তোর পিঠে দুড়ুমদুড়ুম তাল পরবে বলে দিলাম।খাবার নিয়ে এতো জ্বালাস কেন বাপ? মুখে দিবো গিলে ফেলবি।তা না করে ঘন্টার পর ঘন্টা খাবার নিয়ে বসে থাকিস।কার ভালো লাগে এতক্ষণ মুখে খাবার রাখতে।ধ্যাতা পোলা।আমাকে একটুও শান্তি দিবো না।

মুখ ঝামটা মেরে বালিশের সাথে হেলান দিলাম।সাথে সাথেই ঘুমপরী এসে হাজির।চোখটা লেগে আসা মাত্রই নাভানের ডাকে ঘুম ভেঙে গেলো।

নাভানঃ আম্মু ফোন।আম্মু,আম্মু ফোন।

আমিঃ কি হইছে?

নাভানঃ তোমার ফোন।

মাথা ঝাড়া দিয়ে মোবাইল হাতে নিলাম।মোবাইল স্ক্রিনে তায়াং ভাইয়ার নামটা জ্বলজ্বল করছে।কল রিসিভ করে বারান্দায় চলে গেলাম।

তায়াংঃ আসসালামু আলাইকুম, রহমতের কলাম।আপনি যার বান্দা আমি তার গোলাম।

আমিঃ আলাইকুমুস সালাম।কি ব্যাপার,মনটা আজ অনেক খুশি খুশি মনে হচ্ছে। ঘটনা কি?

তায়াংঃ কিছুই না।কেমন আছিস? আমার ভাগিনা কেমন আছে?

আমিঃ তোর ভাগিনা কি আমাকে ভালো থাকতে দিলো।সেই কখন থেকে ছোট এক বাটি খিচুড়ি নিয়ে বসছি।মাত্র দুই লোকমা খেয়েছে। আমার হাত আঠা আঠা হয়ে গেছে। তার গিলতে অনেক কষ্ট লাগে।তাই মুখে নিয়ে বসে থাকে।আর খাবার খেতে গেলেই পড়ালেখার কথা মনে পরে।আমার ব্রিলিয়ান্ট পোলা।

তায়াংঃ ও যেভাবে খায় সেভাবেই খাওয়াবি।এত কষ্ট লাগে কেন তোর? যদি বেশি কষ্ট লাগে আমাকে দিয়ে দে।আমি লালন-পালন করে বড় করবো তোকে লাগবে না।

আমিঃ এখন আসলের থেকে সুদের দরদ বেশি হয়ে গেছে।

তায়াংঃ আগামীকাল একটু দেখা করতে পারবি? তোর সাথে আমার গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। তাও ঐ তাজকে নিয়ে।

আমিঃ কি গুরুত্বপূর্ণ কথা? কলে বল।

তায়াংঃ না কলে বলা যাবে না। সমস্যা আছে। তুই একটু সময় বের করে আমায় কল করিস আমি চলে আসবো।

আমিঃ আগামীকাল তো অফিসে জয়েন হতে হবো।তার মধ্যে আবার দুইটা শো।আচ্ছা আমি ম্যানেজ করে নিবোনি।

তায়াংঃ দুই দিন ধরে না আমার মনে হচ্ছে কেউ আমাকে ফোলো করে।

আমিঃ কি বলিস এসব?(ভয় পেয়ে)

তায়াংঃ আমি সত্যি বলছি।আমার এমনটাই মনে হচ্ছে। তুই ভয় পাস না।আমি এসব ঠিক সামলে নিবো।অনেক ঘুম পাচ্ছে। পরে কথা হবে আল্লাহ হাফেজ। আমার মামার গায়ে ভুলেও একটা ফুলের টোকা দিবি না বলে দিলাম।

আমিঃ তুই সাবধানে থাকিস।তোর মামার গায়ে ফুলের টোকা নয় তার চেয়ে বেশি কিছু পরবে।

তায়াং ভাইয়া কল কেটে দিলো। আমার মনটা নিমিষেই খারাপ হয়ে গেলো।ওকে নিয়ে ভয় হয় ইদানীং। আমার জন্য ওর কোন ক্ষতি যেনো না হয়। তাহলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না। বারান্দা দিয়ে বাইরে তাকালাম।আজ আকাশে অনেক সুন্দর একটা চাঁদ উঠেছে। চাঁদের দিকে তাকিয়ে একটা রাতের কথা মনে পরে গেলো।এমন পূর্ণিমা রাতে একদিন আমি ও এনাজ বাইরে হাঁটতে বের হয়েছিলাম।সেদিন ফেরার পথে আমি হাঁটতে চাইনি বলে এনাজ কাঁধে করে আমাকে নিয়ে এসেছিলো।মানুষটাকে অনেক বেশি মিস করি।কথায় আছে না নাক থাকতে নাকের মর্ম বুঝি না আমরা।আমিও বুঝতে পারিনি।যখন পারলাম তখন তো সেই মানুষটা আর নেই। একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বারান্দা থেকে চলে আসতে নিলাম।তখুনি আমার চোখ পরলো রাস্তার সাথে দেয়ালটাতে।সোডিয়ামের আলোয় মনে হলো একটা ছায়ামূর্তি দেয়ালের আড়ালে সরে গেল।আমি ভয় পেয়ে দৌড়ে রুমে ঢুকে বারান্দার দরজা লাগিয়ে দিলাম।

#চলবে

রি-চেইক দেওয়া হয়নি।ভূল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন😊😊।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here