প্রেমানুরাগ পর্ব-২৪

0
1066

প্রেমানুরাগ পর্ব-২৪
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথি

ইশা ও প্রিয়মের বিয়েটা সুন্দর ভাবে মিটে গেল। বাসর ঘরে গেট ধরার সময় প্রেমা আবার ছেলে পক্ষে চলে গেছে। মোট কথা সে দুই পক্ষে থেকেই বেনিফিট নিবে। বিয়ে বাড়ির গেটও ধরেছিল। প্রিয়া, প্রিয়ম এগুলো নিয়ে ঝামেলা করলেও প্রেমা শুনবে না। প্রেমার ভাষ্যমতে,

“বিয়েতেও তো আমি সব দিক সামলেছি তো আমি কেনো এক্সট্রা বেনিফিট পাবো না!”

সব ঝামেলা শেষে বিয়ে, রিসিপশন সব শেষ হলো। দুই মাস পর অনুরাগ ও প্রেমার আনুষ্ঠানিক বিয়ে। এদিকে জারিফের পরিবার প্রিয়ার পরিবারের কাছে প্রিয়মের বিয়ের দিনই প্রিয়ার সাথে জারিফের বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। মূলত জারিফ তার বাবা-মা কে বলেছে। জারিফ প্রিয়াকে এখনি জানাতে মানা করেছে। শত হোক জারিফ এখন প্রিয়ার টিচার! বিয়ের কিছুদিন আগে সারপ্রাইজ দিবে সবাই। প্রিয়া এখন জানলে জারিফ প্রিয়ার ক্লাশ নিতে গেলে এম্বেরেস ফিল করবে। প্রেমা ও অনুরাগের বিয়ের পরেই জারিফ ও প্রিয়ার বিয়ে হবে।

________
দেখতে দেখতে কেটে গেছে ২ মাস। প্রেমার হলুদ সন্ধ্যা আজ। হলুদ শাড়ি ও সাথে তাজা রঙবেরঙের ফুলের সাজে সজ্জিত প্রেমা। অনুরাগ ও তার বাবা বাংলাদেশে এসেছে আবারো। সাথে কিছু ফ্যামেলি ফ্রেন্ড, রিলেটিভ ও অনুরাগের ফ্রেন্ডরা এসেছে। অনুরাগ ও প্রেমার একসাথেই হলুদের অনুষ্ঠান হচ্ছে। এবারো জোরে মিউজিক ছাড়তে মানা তবে কম ভলিউমে মিউজিক ছেড়ে নাচ-গান হচ্ছে। প্রেমাকে ও অনুরাগকে প্রথমে প্রেমার মা-বাবা ও অনুরাগের বাবা হলুদ দেয় এরপর আস্তে আস্তে বাড়ির বড়রা তারপর ছোটরা।

প্রিয়া স্টেজের সামনে চেয়ার নিয়ে অন্যমনষ্ক হয়ে বসে আছে। তার সবকিছু স্বপ্নের মতো লাগছে। প্রিয়া আজকেই জানতে পেরেছে জারিফের সাথে তার বিয়ে ঠিক হয়েছে। তার যেনো বিশ্বাস হচ্ছে না। কোনো হই-হুল্লোরে যেনো মন নেই। জারিফ ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছে তবে সে খাবারের দিকটাতে ছিল বলে প্রথমেই আসতে পারেনি। কিছুক্ষন পর ফ্রি হয়ে প্রিয়ার পাশের চেয়ারে ধপ করে বসে। প্রিয়া হকচকিয়ে উঠে। জারিফ তা দেখে মিটমিট হাসে তারপর গাঁ ছাড়া ভাব নিয়ে বলে,

–এই মেয়ে যাও এক গ্লাস জুস নিয়ে আসো। পতি সেবা করো! বুঝলে মেয়ে!

প্রিয়া নিরুত্তর থেকে উঠে গিয়ে জুস নিয়ে আসলো। জারিফ ভেবেছিল প্রিয়া ঝ/গড়া করবে কিন্তু প্রিয়া একটা রাও করলো না। জারিফ গ্লাসের জুস অর্ধেকটা খেয়ে প্রিয়ার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,

–এই নেও বাকি অর্ধেক খাও!

প্রিয়া হা করে জারিফের দিকে তাকিয়ে আছে। সে জারিফের এমন বদলানো ব্যাবহার নিয়ে দ্বিধান্বিত। জারিফ তা দেখে বলে,

–হবু বউ তুমি আমার। সো এটুকু করাই যায় আর আরেকটা সারপ্রাইজ হচ্ছে, কাল আমাদের আকদ হবে।

প্রিয়া এবার চোখের পলকও ফেলছে না। ওর মনে হচ্ছে ওর দিন-দুনিয়া ঘুরছে। হঠাৎ সে ঢলে পরে যেতে নিলে জারিফ ধরে ফেলে। বেচারি প্রিয়া সেন্সলেস হয়ে গেছে। স্টেজের সকলে এটা দেখে থমকে যায়। প্রেমা ও অনুরাগ স্টেজ থেকে নেমে আসতে নিলে জারিফ তাদের মানা করে ইশারাতে। জারিফ প্রিয়াকে কোলে করে নিয়ে যায় প্রেমার রুমে। ইশা ও সিয়া সাথে এসেছে। জারিফ প্রিয়াকে বিছানায় শুইয়ে দিলে ইশা প্রিয়ার মুখে হালকা করে পানির ঝাপটা দিতে থাকে আর সিয়া স্যালাইন গুলছে। জারিফ রুম থেকে চলে যায়। আজকের জন্য প্রিয়াকে সে অনেকটা শকড করেছে তাই আর দেয়া সমীচীন না।

হলুদের অনুষ্ঠানের মধ্যে প্রেমা অনুরাগ অনেক ছবি তুলে ইন্স্ট্রাতে পোস্ট করে সাথে ক্যাপশন,
“বসন্তে রাঙিল হলুদিয়া পাখি!”

হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হয় রাত ১২টায়। প্রেমার অনেকটা ক্লান্ত লাগছে। এখনো দুই হাতের উপরের পিঠে মেহেদী দেওয়া বাকি। প্রেমা নিজের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ঘুম দিয়েছে। ইশা ও মিম প্রেমার দুই হাতে মেহেদী দিয়ে দিচ্ছে। সিয়া প্রিয়াকে মেহেদী পড়াচ্ছে। দুজনের হাতেই ওদের জীবন সঙ্গীর নাম লেখা হয়েছে।

_______
“প্রহর শেষে আলোয় রাঙ্গা সেদিন চৈত্রমাস,
তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ।”
[রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার পংক্তি যেনো হৃদয় ছুঁয়ে যায়। কবিগুরুর ভাষ্যমতে আজও কিন্তু চৈত্রমাস! নিজ নিজ অর্ধাঙ্গিনীর চোখে নিজের প্রেমিক মনের সর্বনাশ দেখছে।
মেরুন কাতান সাথে ভারী গহনা ও ব্রাইডাল লুকে পুরো পুতুল লাগছে প্রেমাকে। অনুরাগ গোল্ডেন ও মেরুনের মিশেলে শেরওয়ানী পড়েছে। প্রিয়া পড়েছে রেড ওয়াইন রঙের সিল্ক শাড়ি সাথে মেকওভার। জারিফ পিচ কালারের ডিজাইনার পাঞ্জাবি। মোট কথা দুই জুটিকে অসাধারণ সুন্দর লাগছে।
অনুরাগ প্রেমাকে নিজে হাত বাড়িয়ে ধরে স্টেজে তুলেছে। অনুরাগ প্রেমার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে,

–আহ রানী! নজর টিকা দিয়েছো তো? হায়! আমারি না নজর লেগে যায়!

প্রেমা লাজুক হাসে। তারপর ওদের জায়গায় গিয়ে বসে। কাজি এসে ওদের আবার বিয়ে পড়িয়ে যায়। এরপর জারিফ ও প্রিয়ার বিয়ে পড়ায়। পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ ওরা। আস্তে আস্তে বিয়ের সব কার্যকর্ম শেষ। প্রেমারা তো কাল সপরিবারে ইন্ডিয়া যাবে তাই বিদায়ের কান্নাকাটি নেই। তবে কবুল বলার সময় প্রেমা ও প্রিয়া দুজনেই অল্প-বিস্তর কান্না করেছে।

প্রেমার রুমে ওদের বাসর সাঁজানো হয়। অনুরাগের কাছে টাকা চাইতে হয়নি। অনুরাগ নিজেই দিয়ে দিয়েছে। অনুরাগ রুমে ঢুকে দেখে প্রেমা খাটের মধ্যিখানে বসে আছে। আবছা মোমবাতির আলো ও গোলাপ, কাঠগোলাপ, বেলি ফুলের ও অন্যান্য ফুলের সৌরভে সুরভিত পুরো রুম। পুরো রুম যেনো এক মায়াপুরি! আর মায়াপুরির মায়াবিনী যেনো অনরাগকে আকর্ষিত করছে নিজেন দিকে। অনুরাগ আস্তে আস্তে প্রেমার পাশে গিয়ে বসে। প্রেমা তৎক্ষণাৎ কেঁপে উঠে। অনুরাগ প্রেমার বড় ঘোমটা খুলে কপালে হাত দিয়ে দোয়া পড়ে তারপর কপালে চুমু দেয়। অনুরাগ কিয়ৎক্ষণ তার মায়াবিনী রাজরানীর দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। প্রেমা অনুরাগের এহেনো চোখের ঘোর লাগা দৃষ্টি দেখে লজ্জাবতী লতার ন্যায় নুইয়ে পড়ে। ঘোর ভাঙে বাহির থেকে বাজি ফুটানোর শব্দে। প্রেমার বাবাকে অনেক রিকুয়েস্ট করে তিন-চারটা বাজি ফুটানোর পারমিশন পেয়েছে। দ্বিতীয় বাজিটা যখন কৃষ্ণ নভোলোকে আলোর বিচ্ছুরন ঘটাবে তখন বড় করে লেখা উঠবে “প্রেমানুরাগ”।
অনুরাগ প্রেমাকে বলে,

–চলো ব্যালকনিতে যাই। ওরা বাজি ফুটাচ্ছে।

প্রেমা ও অনুরাগ ব্যালকনিতে গেলে অনুরাগ মেসেজ করলে সাথে সাধে দ্বিতীয় বাজিটা ছোরা হয় আর কয়েক সেকেন্ড অন্তর তারকাখচিত অম্বরে “#প্রেমানুরাগ” ভেসে উঠে। প্রেমা অবাক হয়ে মুখে হাত দিয়ে ফেলে। অনুরাগ পেছোন থেকে প্রেমাকে জড়িয়ে ধরে সগোউক্তি করে,

–তুমি, আমি মিলে নামের আঙ্গিক ও ভালোবাসার বিশেষত্বে #প্রেমানুরাগ।

প্রেমা কোনো শব্দ উচ্চারন না করে সময়টাকে উপভোগ করতে ব্যাস্ত। গার্ডেনে প্রিয়া ও জারিফ, সানাফ ও সিয়া, ইশা ও প্রিয়ম তিন জুটিও তাদের সময়টা উপভোগ করছে। প্রিয়াকে জারিফ নিজ উদ্যোগে আগলে নেয়।

পরাশিষ্টঃ—

ইন্ডিয়াতেও খুব সুন্দর ও জমকালো ভাবে রিসেপশন হয়েছিল। সব মিলে পারফেক্ট। প্রেমা, অনুরাগ ও অনুরাগের বাবা ৪ বছর ধরে ইংল্যান্ড থাকে। অনুরাগ মুভি ছেড়ে দিয়েছে বলতে গেলে। প্রায় তিন বছর আগে তাদের প্রথম সন্তান “প্রহর খান অভ্র” জন্ম নেয়। অনুরাগ এই পাঁচ বছরে মাত্র একটা মুভি ও একটা শর্টফ্লিম করেছে। আজ ওরা সপরিবারে বাংলাদেশে আসছে। দুই মাস আগে প্রিয়া ও জারিফের প্রথম পুত্র সন্তান হয়েছে নাম তার “জিহাদ আহমেদ প্রত্যুষ” আর ইশার সাড়ে চার মাস আগে প্রথম কন্যা সন্তান হয়েছে নাম তার “ইলহাম হাসান প্রিতী”।
প্রেমারা তখন আগে বাংলাদেশে আসতে চেয়েছিল কিন্তু ভিসা জটিলতার কারনে আর আসতে পারেনি। এরপর প্রেমা এখন কাটায় কাটায় তিন মাসের প্রেগনেন্ট। তিন মাস পর ফ্লাই করতে পারবে বলে গুনে গুনে তিন মাস হবার পর ফ্লাইটে উঠেছে। সানাফ ও সিয়ার তো সাড়ে তিন বছরের মেয়ে আছে। নাম তার “সেহের হাসান রোজা”।

বাংলাদেশে এসে সবাই ফ্যামিলি টাইম খুব সুন্দর করে পালন করছে। ছেলেদেরকে বাচ্চা সহ বসিয়ে রেখে মেয়েরা রান্নাঘরে রান্না করছে বা বসে বসে আড্ডা দিচ্ছে। প্রিয়া ও ইশার বাচ্চা কান্না করলেই তখন জারিফ ও প্রিয়ম ওদের ডেকে নিয়ে যায়।
অভ্র অনুরাগের কোলে বসে উঁকি দিয়ে চোখ বড় বড় তরে দুইটা বাবুকে দেখছে। একবার অনুরাগের কোল থেকে নেমে বাবুদের গালে আস্তে করে হাত দেয়। সবাই অভ্রর কাজ দেখে হাসছে। কিছুক্ষন পর অভ্র সেহেরের সাথে খেলা শুরু করে।

দিনশেষে যখন রাতের আঁধার নামে তখন জারিফ ও প্রিয়া তাদের ছেলেকে ঘুম পারিয়ে ব্যালকনির দোলনায় বসে। প্রিয়া জারিফের কাঁধে মাথা রাখে। প্রিয়া হঠাৎ করে বলে,

–আপনার কি অতীতের অনুভূতি জাগ্রত হয়?

জারিফ প্রেমাকে নিজের সাথে আরো গভীর ভাবে আগলে নিয়ে বলে,
–একদম না। আমি তো এই চঞ্চল ভীত হরিণির মায়ায় মত্ত।

আর কোনো মুখ নিঃসৃত বুলি প্রকাশ পায়না। সবটা এখন অনুভবে।

প্রিয়ম ঘুমন্ত ইশার কপালে ভালোবাসার স্পর্শ দিয়ে মেয়েকে সহ হাত দিয়ে আগলে নেয়। প্রেমা বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে গেছে। অনুরাগ অভ্রকে এতোক্ষন ঘুম পারাচ্ছিল আর সানাফের সাথে কথা বলছিল। এসে দেখে তার বউ বই বুকের উপর রেখে ঘুমিয়ে গেছে। অনুরাগ ঘুমন্ত ছেলেকে বিছানার একপাশে শুইয়ে দেয় সাথে কোলবালিশ দিয়ে দেয়। অতি সন্তর্পণে প্রেমার বুকের উপর থেকে বইটা সরিয়ে প্রেমাকে হালকা উঠিয়ে বিছানার হেডবোর্ডে ঠেকানো বালিশটা সোজা করে দেয় বিছানায় তারপর প্রেমাকে ঠিক করে শুইয়ে দিয়ে নিজেও প্রেমা ও অভ্রর মাঝে শুয়ে পড়ে। তারপর মৃদু আওয়াজে সগোউক্তি করে,

–ভালোবাসি রাজরানী!

ভালো থাকুক পবিত্র ভালোবাসা গুলো।

————————————সমাপ্ত————————–
অবশেষে দীর্ঘ এক মাসে শেষ করলাম গল্পটি। ধন্যবাদ সকলকে পাশে থাকার জন্য। আশাকরি পরবর্তীতেও পাশে থাকবেন। ভালোবাসা সকলকে। মন্তব্য জানাবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here