শিশির_ভেজা_রোদ্দুর Part_06

0
1917

শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
Part_06
#Writer_NOVA

কিছু সময়ের মধ্যে কনসার্ট শুরু হয়ে গেলো।দুইটা পারফরমেন্সের পর এখন একটু বিরতি দিয়েছে।কিন্তু আমার প্রচন্ড খিদে পেয়েছে। দুপুরে কিছু খাইনি।ভেবেছিলাম কনসার্টে আসার আগে খেয়ে নিবো।কিন্তু তাড়াহুড়োয় সব লন্ডভন্ড।পেটের ভেতর আমার ইঁদুরে ড্রাম পেটাচ্ছে।আমি তায়াং ভাইয়াকে জোরে চেচিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

—ভাইয়া কনসার্ট শেষ হলে কি আমাদের বিরিয়ানি দিবে না?আমি কিন্তু বিরিয়ানি না নিয়ে বাসায় যাবো না।

আমার কথা যারা যারা শুনছে তারা সবাই আমার দিকে গোল গোল চোখ করে তাকিয়ে রইলো।তায়াং ভাইয়া তো রেগে বোম।চোখ পাকিয়ে বললো,

—তোর ভাসুরের বিয়ে লাগছে তো, তাই এখানে বিরিয়ানির আয়োজন করে রাখছে।

—এই অনুষ্ঠানের জন্য আমাদের থেকে ৫০০ করে টাকা নিয়েছে। এখন বিরিয়ানি না দিলে আমি এখান থেকে এক পা-ও সরবো না।

—হ্যাঁ,আমিও তো বললাম।তোর ভাসুরের বিয়ে আজ।তোকে দিবে না তো কাকে দিবে বল?পুরো ডেকচি তোকে দিয়ে দিবে।

—এভাবে বলছিস কেন?আমার অনেক খুদা লেগেছে তায়াং ভাইয়া। তাইতো কথাটা বললাম।আমার তো খেয়াল নেই যে কনসার্টে বিরিয়ানি বিতরণ করে না।
যদি করে তাহলে তুই লাইনে দাঁড়িয়ে আমার জন্য নিয়ে আসিস।

—তোকে আমি বিরিয়ানির ডেকচিতে বসিয়ে দিবো।আমিও দেখি তুই কত বিরিয়ানি খেতে পারিস।

আমি ঠোঁট উল্টে বাচ্চাদের মতো করে বসে রইলাম।
হঠাৎ উত্তর দিক হতে একটু ঝামেলার ঈঙ্গিত পাওয়া গেলো।সারা কলেজ ছেয়ে গেলো মারামারি লেগেছে। উৎসুক জনতা সেদিকে ছুটলো।সাথে তায়াং ভাইয়াও। এনাজ তো কনসার্ট দেখছেই না।বরং মোবাইলে গেমস খেলতে মনোযোগী।আমার জুতার ভেতরে ছোট কংকর জাতীয় কিছু একটা ঢুকেছে। যেটা কিছু সময় পরপর আমাকে জ্বালাতন করেছে।আমি সেটা বের করতে আস্তে করে খুড়িয়ে খুড়িয়ে স্টেজের বাইরে চলে এলাম।যাতে এনাজ টের না পায়।আসলে দুই সারির মাঝে এতটা কম গ্যাপ যে উবু হয়ে জুতা থেকে কংকর বের করা সম্ভব নয়।জুতা খুলে বেশ কয়েকবার ঝাড়া দিলাম। এদিকটায় একটু আগে মানুষ থাকলেও এখন পুরো ফাঁকা। সবাই মারামারি দেখতে চলে গেছে। আমি জুতার কংকর বের করতে এতটাই ব্যস্ত ছিলাম যে আশেপাশে কোন দিকে তাকায়নি।

দাঁড়িয়ে যেই জুতা পরবো তখুনি কোথা থেকে একটা ছেলে দৌড়ে এসে আমাকে সাইড কাটিয়ে চলে গেলো।যাতে হালকা করে আমাদের দুজনের সাথে ধাক্কা লাগলো।তার দৌড়ের গতিতে আমি নিচে পরতে পরতে নিজেকে ব্যালেন্স করে ফেলায়,আর পরলাম না।সে সম্ভবত দৌড়ে ভেতর দিকে যেতে নিয়েছিলো। সে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,

—সরি বোন।

কথাটা বলে এক মিনিটও দেরী করলো না। আবার ভেতর দিকে দৌড় দিলো।আমি শুধু নিজের মনে বললাম, “আজব তো”। সে ততক্ষণে বহু দূর চলে গেছে। আমি আহাম্মকের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম।হলোটা কি?হঠাৎ কেউ আমার কানের সামনে জোরে চেচিয়ে বললো,

—এই যে মিস টিডি পোকা,এখানে কি করেন?

আমি ভয়ে কিছুটা চমকে সরে দাঁড়ালাম। পেছনে তাকিয়ে দেখি এনজিও সংস্থা। আমি চোখ পাকিয়ে বললাম,

— ছোট বাচ্চা মেয়েটার কি জান নিবেন?এমন করে কি কেউ ভয় দেখায়।আরেকটু হলে আমার প্রাণপাখি উড়াল দিতো।আর টিডি পোকা কে হ্যাঁ?

— তুমি।

— আমি কোন পোকা নই মানুষ।

—তুমি তখন টিডি পোকার মতো যেরকম ফালালে। তা দেখে এই নাম ছাড়া অন্য কোন নাম খুঁজে পেলাম না।তুমিও তো আমার নাম এনজিও-র সংস্থা রাখলে।আমি কি কিছু বলছি।

—ভালো হলো না কিন্তু।

—ভালো তো এখন হবে না।পায়ে ব্যাথা পাইছো তারপরেও কেন পাকনামি করে একা একা এদিকে এলে?আমার পারমিশন নিয়ে আসছো?আমি তো তোমায় খুঁজতে খুঁজতে শহীদ হয়ে যেতাম।

মুহুর্তের মধ্যে তার হাস্যজ্জ্বল মুখটা কালো মেঘে হানা দিলো।একে রাগ দেখলে আমার একটু, না না বেশিই ভয় করে।সবার সাথে কি সুন্দর হাসি মুখে কথা বলে।আর আমার সাথে তেজ দেখায়।সবার সাথে নরম, আমার সাথে গরম।এমনি খুদা লাগছে তার মধ্যে আবার বকা শুনতে হবে।আমি কোন উত্তর না দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম।এনাজ হালকা ধমকের সুরে বললো,

—ভেতরে চলো।

আমি কথা না বলে হাঁটতে লাগলাম। আমাকে খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটতে দেখে এনাজ তার হাত বারিয়ে দিলো।কিন্তু আমি ধরলাম না।যার দরুন উঁচু নিচু জায়গায় পা মচকে পরতে নিলাম।তখুনি আবার এনাজের বাহু খামচে ধরে ফেললাম।এনাজ আমার দিকে ঘুরে শয়তানি হাসি দিয়ে বললো,

—কেউ আমার হাতই ধরতে চায়নি। এখন আবার বাহু ধরে রেখেছে।

তার পিঞ্চ মারা আমার সহ্য হলো না। জলদী করে হাত ছাড়িয়ে ভেতরের দিকে চলে গেলাম।এনাজও আমার পিছু পিছু চলে এলো।

💖💖💖

আমরা এখন বসে আছি একটা টং দোকানে।এনাজের ইচ্ছে হয়েছে একসাথে চা খাওয়ার।কলেজে মারামারির রেশ ধরে বিশাল বড় ঝামেলা হয়ে গেছে। এখন বাকি কনসার্ট হয় কিনা তাতেও সন্দেহ আছে। তাই তায়াং ভাইয়া আমাদের নিয়ে চলে এসেছে। আমার ও তন্বীকে নিয়ে তার তো টেনশনের শেষ নেই। আমাদের মন খারাপ। পুরো কনসার্ট দেখতে পারিনি বলে। তন্বী আর আমি ফুসুরফাসুর করে মন খারাপের কথা শেয়ার করছি।তা দেখে তায়াং ভাইয়া ধমক দিয়ে বললো,

—এত কিসের আলাপ তোদের? সারাদিন মুখ চলতেই থাকে।একটু সময়ের জন্য কি চুপ থাকতে পারিস না।মাথা ধরে গেলো আমার।

তন্বী গাল ফুলিয়ে বললো,
—একটু কথা বললেই দোষ হয়ে যায়।

তায়াং ভাইয়া দিলো ওকে রাম ধমক।তাতে আমি সাবধান হয়ে গেছি।ঠোঁটে এক আঙুল দিয়ে বোকা ফেস করে সবার দিকে তাকাচ্ছি। তা দেখে তায়াং ভাইয়া চোখ দুটো ছোট ছোট করে বললো,

—হয়েছে আর ন্যাকা সাজতে হবে না। তুই যে কত ভালোর ছালা তা আমার জানা আছে। বাসায় আজকে শুধু যাই।আমিও দেখবো আমার হাত থেকে তোকে কে বাঁচায়। খুব বেড়েছিস না, এর শাস্তি তোকে পেতে হবে।

আমি চোখ দুটো বড় বড় করে ঠোঁট উল্টে বললাম,
—আমি আবার কি করলাম😕?

—তুই কি করিসনি তাই বল।

এনাজ, তায়াং ভাইয়াকে থামিয়ে বললো,
—আহ্ কি শুরু করলি তোরা?এখন একটু থাম।তায়াং আমি জানি তোর মাথাব্যথা করছে।তাই চা খেতে এলাম।একসাথে চা খাওয়া হবে।সাথে একটু সময় ব্যয় করা হবে। (দোকানদারকে উদ্দেশ্য করে)মামা, চা হতে আর কতদূর?

—এই তো মামা হয়ে গেছে।

চায়ের কাপগুলো দোকানীর কাছ থেকে নিয়ে আমাদের সবার হাতে তুলে দিলো এনাজ।চায়ের কাপে চুমুক দিতেই একরাশ ভালো লাগা কাজ করলো।ক্লান্ত ভাবটা নিমিষেই হাওয়া হয়ে গেলো।চা শেষ হতেই উঠে পরলাম।মাথাটা অনেকটা পাতলা লাগছে।আমি এনাজের বাইকে আর তন্বী তায়াং ভাইয়ার বাইকে উঠলো।কিছু দূর যাওয়ার পর বাইক থামলো একটা বিরিয়ানি হাউসের সামনে।এতরাত হওয়ায় এই একটাই খোলা ছিলো।বাইক থেকে নেমে আমরা সবাই ভেতরে ঢুকলাম। একটা ছেলে এসে চেয়ার-টেবিল পরিষ্কার করে দিতেই আমরা বসে পরলাম।তায়াং ভাইয়া আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো,

—আমিও এখন দেখবো তুই কত বিরিয়ানি খেতে পারিস।তোকে বিরিয়ানির ডেকচিতে বসিয়ে দিবো।মান-সম্মান তো কিছু রাখলি না আমার।

ভাইয়ার কথা শুনে আমি কপাল কুঁচকে এদিক সেদিক দেখতে লাগলাম।এনাজ ও তন্বী দুজনেই মুখ টিপে হাসছে। আমি ওদের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাতেই ওরা মুখে হাত দিয়ে ফেললো।ছোট একটা দোকান।ভেতরে তিনটা টেবিল।প্রত্যেকটা টেবিলে চারটা করে চেয়ার।ছোট হলেও সবকিছু গোছানো ও পরিষ্কার। আমরা বসার মিনিটখানিক পর দোকানের সাহায্যকারী ছেলেটা এসে জিজ্ঞেস করলো,

—ভাই আপনেগো কি দিমু?

এনাজ হাসিমুখে বললো,
—চার প্লেট কাচ্চি।

—হাফ নাকি ফুল?

—ফুল দাও।

—আইচ্ছা। আপনারা একটু বহেন আমি এহনই লইয়া আইতাছি।

ছেলেটা ভেতরের দিকে চলে গেল।কিছু সময় পর চার প্লেট কাচ্চি নিয়ে ফিরে এলো।বিরিয়ানির ঘ্রাণে পেটটা মোচর দিয়ে উঠলো।খিদেটা আবারো জেগে উঠেছে। পাশের একটা ফিল্টার থেকে পানি নিয়ে সবাই হাত ধুয়ে এলাম।বিরিয়ানির সাথে অর্ধেক কাটা পেঁয়াজ, আস্ত একটা কাঁচামরিচ, এক পিস লেবু ও দুই পিস শসা। ঘ্রাণেই অর্ধেক পেট ভরে গেছে। যার জন্য আমি পুরো প্লেট সাবার করতে পারিনি।অর্ধেক খেয়ে আমার পেট পুরো ঢোল।আমি একপিস গোশতের কিছুটা অংশ ছিঁড়ে মুখে দিয়ে ভয়ে ভয়ে তায়াং ভাইয়াকে বললাম,

—আমি আর খেতে পারবো না।

তায়াং ভাইয়া কাঁচামরিচে একটা কামড় দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে কচকচ শব্দে চাবাতে লাগলো। যার মানে হলো তোকেও এখন আমি এই কাঁচামরিচের মতো চিবিয়ে খাবো।শান্ত গলায় বললো,

—মাইর খেতে না চাইলে চুপচাপ খেয়ে নে।

—আমি আর খেতে পারবো না।

আমার কথা শুনে এনাজ বললো,
—আরে খেয়ে নেও টিডি পোকা। এতটুকু খাওয়া কোন ব্যাপার হলো নাকি।

তন্বীও আমার সাথে সুর মিলিয়ে বললো,
—আমিও খেতে পারবো না ভাইয়া।পেট ভরে গেছে। এতগুলো কে নিতে বলেছিলো তোমাদের। আমাদের জন্য হাফ প্লেট করে নিতে।

তায়াং ভাইয়া বললো,
—আমার মান-সম্মান তো কনসার্টে খেয়ে এসেছিস।তা খেয়েই তো পেট ভরে গেছে।এখন বিরিয়ানি খাবি কি করে? তবে তোরা খাবি না তো তোদের ঘাড়ে খাবে।এমনভাবে একজন বিরিয়ানির কথা বলেছে যেনো বাপের জন্মে বিরিয়ানি খায়নি।জলদী খা।নয়তো আমার হাত চলবে।

এনাজ বললো,
—থাক তায়াং জোর করিস না।এগুলো জোর করে খাওয়ার মতো জিনিস না।পরে দেখা যাবে বেশি খাওয়ার জন্য অসুস্থ হয়ে যাবে।

—তুই এদের চিনিস না।এরা ডায়েট করে।খেলে তো মোটা হয়ে যাবে। তখন ফিগার নষ্ট হয়ে যাবে না।এর জন্য খেতে চাইছে না।

—তায়াং ভাইয়া তোকে এসব কে বলেছে?

—কারো বলতে হবে না আমি জানি।কথা না বলে প্লেট এদিকে দে।আমার খাবার নষ্ট করা একদম পছন্দ না।

আমি শয়তানি হাসি দিয়ে বললাম,
—হইছে আর ঢং করতে হবে না।নিজে তো পুরো ডেকচি খেতে পারবি।তবে দেহের দিকেও একটু তাকাস।দিনকে দিন তো ফুলে ঢোল হচ্ছিস।হাতির মতো শরীর অলরেডি হয়ে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে রুমের দরজা কেটে তোকে বের করতে হবে।

তন্বী মুখ টিপে হেসে উঠলো। এনাজ একবার আমার দিকে তাকিয়ে আরেকবার তায়াং ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসতে লাগলো।তায়াং ভাইয়া বললো,
—আরেকটা কথা বলবি তো সব তোকে খেতে হবে।জলদী দিলে খাবো নয়তো তোকে খাওয়াবো।

আমি খুশি হয়ে বললাম,
—হ্যাঁ নিয়ে নে।আমরা দুজনেই সাইড করে খেয়েছি। বাকিগুলো ভালো আছে।

খাবার শেষ হওয়ার পর আমরা আবার বাইকে চরে বসলাম।এবার বাইক থামলো বাসার গেইটের সামনে।সাড়ে দশটার বেশি বাজে।এনাজ চলে যেতে চাইলে তায়াং ভাইয়া রাগারাগি করলো।তায়াং ভাইয়ার রাগের কারণে রাতটা আমাদের বাসায় থাকার জন্য রাজী হলো এনাজ।রুমে ঢুকে সবকিছু খুলে এদিকে সেদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখে ফ্রেশ হতে গেলাম।আজ আর কিছু গুছাতে পারবো না। ফ্রেশ হয়ে আসতেই দেখলাম তন্বী ইতিমধ্যে বিছানা তৈরি করে ফেলছে।দুজনের মধ্যে মশারি টানানো নিয়ে কথা কাটাকাটি লেগে গেলো।খালামণি এসে একদফা দুজনকে বকে গেলো।১. এই রাত-বিরেতে সামান্য জিনিস নিয়ে কথা কাটাকাটি করার জন্য। ২.সবার জন্য রাতের রান্না করে রেখেছিলো কিন্তু আমরা বাইরে থেকে খেয়ে এসেছি কেন? খালামণির বকা এক কান দিয়ে ঢুকিয়েছি।আরেক কান দিয়ে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছি।তারপর আমি আর তন্বী একসাথে মশারি না টানিয়ে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলাম।

বিছানায় শুতেই শান্তির ঘুম এসে চোখে ভর করলো।কিন্তু আমি যদি জানতাম পরেরদিন আমার জন্য কি অপেক্ষা করেছে,তাহলে হয়তো এই সাধের ঘুম আমার আজই ছুটে যেতো।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here