অন্তরিক্ষ_প্রণয় পর্ব-৯(১ম অংশ)

0
512

#অন্তরিক্ষ_প্রণয় পর্ব-৯(১ম অংশ)
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথি

ঢাকা আসার পর প্রিয়তা রামিসার বাসায় থাকছে। তিনদিন হয়ে গেছে কিন্তু আকাশ প্রিয়তাকে একটা কলও করেনি। প্রিয়তা বারংবার অপেক্ষা করছে, এই বুঝি আকাশ কল করে বললো সব মিথ্যা ছিল! প্রাংক ছিল সব। কিন্তু না। আকাশ কল করেনি। প্রিয়তা একদম নিশ্চুপ হয়ে গেছে। রামিসা প্রিয়তাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করে জোর করে একটু খাওয়াতো পারে। রামিসা প্রিয়তাকে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে,

–তোমাকে শক্ত হতে প্রিয়তা। তোমাকে আগে এগিয়ে যেতে হবে। কারো জন্য জীবন থেমে থাকে না। তোমাকে নিজের পরিচিতি গড়তে হবে। বি স্ট্রং। মুভ অন করো।

প্রিয়তা শুধু শুনেই যায়। আরো দিন দুয়েক চলে যায়। প্রিয়তার একদিন হুট করে ব্লিডিং শুরু হয়। শরীরের নিম্নাংশ রক্তে ভিজে উঠছে। প্রিয়তার তখন মনে পড়ে সে প্রেগনেন্ট! এই পাঁচদিন সে ভুলেই গেছিলো যে সে প্রেগনেন্ট। আকাশের কাছ থেকে পাওয়া আঘাত এতোটা গাড়ো ছিল যে সে নিজের মধ্যেই ছিলনা। প্রিয়তা যে আকাশকে এতোটা পাগলের ভালোবাসে তা প্রিয়তা আকাশের সামনে প্রকাশ করতো না খুব একটা। তাদের সম্পর্কে খুঁনশুটি, ভালোবাসা, কেয়ার, চিন্তা সব ছিল। প্রিয়তা যে আকাশের সামান্য অনুপস্থিতিতে কতোটা ছটফট করতো তা সে আকাশের সামনে প্রকাশ করতো না। আকাশকে দেখলেই প্রিয়তার মুখে হাসির ঝিলিক ফুটতো।

“আমরা যখন কাউকে অস্বাভাবিক ভাবে ভালোবাসি তখন তা তার সামনে প্রকাশ করতে দ্বিধা হয় কারন মাঝে মাঝে অতিরিক্ত ভালোবাসা দেখলে বিপরীত পাশের মানুষটা আমাদের স্বাভাবিক করতে বা বিরক্ত হয়ে ছেড়ে যায়।”(পারসোনাল অপিনিয়ন)

প্রিয়তার চিৎকারে রামিসা হৃদয়ের সাথে কথা বলা অবস্থায় দৌড়ে আসে। রামিসাও ভয় পেয়ে যায়। রামিসা হৃদয়কে ফোনে বলে একথা। প্রিয়তা তাড়াহুড়ো করে ক্যাব বুক করে। প্রিয়তা শুধু “আমার বাচ্চা” এটা বলেই যাচ্ছে বিড়বিড় করে। রামিসা জলদি করে হসপিটলে নিয়ে যায় প্রিয়তাকে। হৃদয়, সাগর ও ইফাও সেখানে উপস্থিত হয়।

কিছু সময় পর ডাক্তার এসে বল,
–স্যরি! তার মিসক্যারেজ হয়ে গেছে। ৯ সপ্তাহের প্রেগনেন্সি ছিল। প্রথম বারো সপ্তাহ ক্রিটিক্যাল। অনেকে প্রেগনেন্সি বুঝতো না পেরে অনেক ভারী কাজ ও স্ট্রেস নিয়ে ফেলে বা খাওয়া দাওয়া ঠিক মতো করে না। তখন মিসক্যারেজ হয়ে যায়। উনাকে কেবিনে দেওয়া হবে। উনি একটু বেশি দুর্বল।

প্রিয়তা নিজেও মেডিকেল স্টুডেন্ট। সে সবার বিহেভিয়ার ও নিজের অবস্থা কল্পনা করে বুঝে যায় যে তার বেবিটাও আর নেই। সবাই তাকে একা করে দিয়েছে। প্রিয়তা পুরো বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। মুখ দিয়ে একটা শব্দও করেনা। এক ধ্যানে কি যেনো ভাবতে থাকে।

পরেরদিন প্রিয়তাকে রামিসা নিজের বাসায় নিয়ে আসে। রামিসা প্রিয়তার মূর্তির মতো অবস্থা দেখে কান্না করে। ইফারও কান্না করে খারাপ অবস্থা। আর প্রিয়তা! সে তো পাথর হয়ে বসে আছে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

দুইদিন এভাবে থাকলেও তৃতীয়দিন প্রিয়তা কোন ফাঁকে বেরিয়ে যায় কেউ বুঝতে পারেনা। এরপর রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে আর সবাইকে ইশারাতে কিছু বলার চেষ্টা করে কিন্তু কেউ বুঝেই না। খাবার চুরি করে খায়। তারপর দেখা পায় নিয়ন ও রাত্রির।

_______________________________________________
বর্তমান,,

নিয়ন ও রাত্রি সব শুনলো। ওদের দুজনের চোখেই পানি চলে এসেছে। ওরা তিনজন এখন রাতারগুলের ওয়াচ টাওয়ারে উঠেছে। অনেক উঁচু টাওয়ার। সেখান থেকে রাতারগুলের পুরো ভিউ পাওয়া যায়।

নিয়ন মনে মনে তাচ্ছিল্য হাসে। কারন আকাশ প্রিয়তাকে যতোটা ভালোবেসেছে সেই লাস্ট ইন্সিডেন্টের আগে তার মতো নিয়ন নিজেও ভালোবাসে না। সবার ভালোবাসার ধরন এক না। প্রিয়তার মুখ থেকে প্রিয়তার জানা দিকটা শুনে নিয়নের মনে সন্দেহ হয়, “আকাশ এমনটা একদিনে কেনো করবে?”

রাত্রি জিজ্ঞাসা করেই বসে,
–তোমার কাছে কি আকাশের বন্ধুরা আকাশের মেহেরকে বিয়ে নিয়ে কিছু বলেনি? মানে ওদের বন্ধু রাতারাতি বিয়ে করে ফেলল আবার ওরাই তোমাকে ঢাকা নিয়ে গেল! ব্যাপারটা আমার কেমন জানি লাগলো।

প্রিয়তা অথৈজলের দিক থেকে নজর সরিয়ে সুবিশাল অন্তরিক্ষে তাকিয়ে সগোউক্তি করে,

“সে ভালোবাসুক বা না বাসুক, আমার অন্তরিক্ষে আমি শুধু তার প্রণয়িনী হয়ে থাকতে চাই। তার ভালোবাসার কিছুটা অংশীদার আমিও। হয়তো সব ছিল ছলনা! তবে আমার হৃদয় আজও তার জন্য। ছলনা করলেও যে এতোটা ভালোবাসা যায় তা সত্যি কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। একদিনে কিভাবে সে আমায় ভুলে গেল! কিভাবে আমায় দূরে ঠেলে দিল তা আজও ধোঁয়াশা। তার প্রণয়ের ছলনায় আমি পাগল হলাম। হারালাম নিজের স্বত্তা।
একটা সত্য,
তার থেকে পাওয়া কিছু অমূল্য প্রণয়ের অনুভূতি আমার সারাজীবনের পাওয়া। তার ধোঁকা আমার কাছে ছলনা। সবটা কুয়াশায় আবৃত।
আজও ভালোবাসি তাকে।”

নিয়ন ও রাত্রি অবাক হয়। কাউকে সত্যি এতোটা কিভাবে ভালোবাসে! পুরো কাহিনী শুনে নিয়ন এটাই চায়, আকাশ ফিরে আসুক! আগলে নিক তার প্রণয়িনীকে। ওদের ভালোবাসা এক অন্তরিক্ষ সমান হোক। যা অসীম।

নিয়ন এবার বলে,
–আমার মনে হয় আমাদের ঢাকা যাওয়া উচিত।

রাত্রি কথার মাঝে বাঁধা দিয়ে বলে,
–আকাশের বাড়ি তো চট্টগ্রাম। তো ঢাকা কেন যাবো? আগে চট্টগ্রাম যাবো।

নিয়ন মাথায় হাত দিয়ে বলে,
–ঢাকাতে আকাশের বন্ধুরা থাকে। আর আমার মনে হয়, আকাশ যদি চট্টগ্রাম থাকেও তার আগে ওর বন্ধুদের সাথে দেখা করা উচিত। সবকিছুর কারন জানতে হবে। কেনো আকাশ মেহেরকে বিয়ে করলো? কি হয়েছিল? আর আমরা যদি চট্টগ্রাম যাই আগে তাহলে মেহেরকে যদি সেখানে পাই তো প্রিয়তা ওকে দেখলে যদি আবারো রিয়াক্ট করে?

রাত্রির এবার বোধগম্য হয়। প্রিয়তা মলিন হেসে বল,
–কিছু হবে না আমার। আমি সহ্য করে নিবো।

নিয়ন উদাস স্বরে বলে,
–সবার তোমার মতো ভালোবাসার ক্ষমতাও থাকে না আর না কারো মতো নিজের ভালোবাসার মানুষটা অন্যে কাউকে পাগলের মতো ভালোবাসে এটা মানার সহ্য ক্ষমতা!

রাত্রি বুঝে এটা। সে তাচ্ছিল্য হাসে। পাঁচ বছর ধরে যারে কারনে অকারনে পাশে থেকে সাপোর্ট করে গেছে আর সে সেটাকে শুধু বন্ধুত্ব মেনে গেলো। লুকিয়ে লুকিয়ে ভালোবাসলো যাতে বন্ধুত্বের মাঝে কোনো প্রবলেম না হয় কিন্তু এখন তো তার মনে অন্য রমণীর বিচরনটাকেও মেনে নিচ্ছে। এটাকে কি বলবে নিয়ন?

পরেরদিনই ওরা সিলেট থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। প্রিয়তা ঠিকঠাক জানে না আকাশের বন্ধুরা কোথায় আছে তাই ফেসবুকের সাহায্য নিয়েছে। প্রায় চার বছর পর নিজের ফেসবুক একাউন্টের একসেস নিলো প্রিয়তা।
প্রিয়তা ফেসবুক থেকে রামিসা ও হৃদয়ের আইডি খুঁজে বের করে। সেখান থেকে জানতে পারে তারা দুজন ঢাকার মুগ্ধা মেডিকেলে আছে। হৃদয়ের টাইমলাইন স্ক্রোল করতে করতে নিয়ন দেখে তিন বছর আগের একটা পোস্ট। সেখানে লিখা,

“আমাদের বন্ধু আকাশ আহমেদ অন্ত, আজ বাদ আসর ইন্তেকাল করেছে। আমাদের বন্ধুটি ব্লাড ক্যান্সারের লাস্ট স্টেজে ছিল। ছয় মাস আগে জানতে পারে তার ব্লাড ক্যান্সারের লাস্ট স্টেজ। বন্ধু আমাদের এতিম, তার বাবা-মা ছোট বেলায় কার এক্সিডেন্টে মারা গেছিলো এরপর তার পালিত চাচা রাস্তা থেকে ওকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে। এরপর চাচাও ওর মেডিকেলের তৃতীয় বর্ষে পড়াশোনা কালিন মারা যায়। লাস্ট স্টেজ আর বোনমেরু ট্রান্সপ্লেট ছাড়া আর কোনো চিকিৎসা নেই। কেমো থেরাপি দিলেও বোনমেরু ট্রান্সপ্লেট করতেই হতো। যেহেতু আকাশের রক্তের সম্পর্কের কেউ নেই তাই এটা সম্ভব হয়নি। এই ক্যান্সারের কারনে আকাশ তার ভালোবাসা, তার স্ত্রীকে ছলনা করে নিজের থেকে দূরে করেছে। ভালোবেসে পরিবারের অমতে বিয়ে করেছিল মেয়েটি। মেয়েটি যে প্রেগনেন্ট ছিল তা আকাশ নিজেও জানতো না। আকাশ অনেকদিন ধরেই নিজের অসুস্থতা আন্দাজ করে টেস্ট করাতে ভয় পাচ্ছিলো। তারপর যখন জানতে পারে তখন স্ত্রীর থেকে দূরে সরে আসার পরিকল্পনার করে আর তারপর তার স্ত্রীর এক সপ্তাহের মধ্যে মিসক্যারেজ হয়ে যায়। আর দুর্ভাগ্য বশত সেদিন দুপুরে আকাশের রক্ত বমি ও তারপর সেন্সলেস হয়ে যায়। ডাক্তাররা তাকে ঘুমের ইনজেকশন ও এক ব্যাগ রক্ত দেয়। আমরা আকাশকে তার স্ত্রীর মিসক্যারেজের খবরটা জানাতে চাইনি কিন্তু দুইদিন পর আকাশের স্ত্রী বাড়ি থেকে মিসিং হয়ে যায়। মেয়েটা আকাশের ছলনা, মিসক্যারেজ সবকিছুতে পাথর হয়ে গেছিলো। এরপর আমরা পরিচিত সবজায়গায় এমনকি মেয়ের বাবার বাড়িতেও খোঁজ করেও পাইনি। আমাদের বন্ধু নিজের শেষ সময়ে পৃথিবীতে থাকা তার একমাত্র আপনজনকেও দেখতে পারলো না। যদি সেদিন বাচ্চাটা মিসক্যারেজ না হতো তাহলে হয়তো আমাদের বন্ধু এই ইহজগতে নিজের অংশকে দেখে যেতে পারতো।
সবাই আকাশের আত্নার মাগফিরাত কামনা করে দোয়া করবেন।”

নিয়ন পুরো পোস্টটা পড়ে বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। সে প্রিয়তার দিকে তাকায়। প্রিয়তা তখন বাসের জানালা দিয়ে প্রকৃতি দেখতে ব্যাস্ত। নিয়ন রাত্রিকে ইশারাতে ডাকে তারপর মোবাইল এগিয়ে দেয় পোস্টটা পড়ার জন্য।

চলবে ইনশাআল্লাহ,
রাতে আবার পাবেন।
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। কার্টেসি ছাড়া কপি করবেন না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here