শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
Part_25
#Writer_NOVA
ওয়েটার কফি দিয়ে গেলো। আমরা দুজন কফির কাপে চুমুক দিলাম। আড় চোখে তওহিদ ভাইয়া ও শারমিনের টেবিলের দিকেও তাকালাম। তওহিদ ভাইয়া একা একা বকবক করছে। শারমিন চুপচাপ তা সহ্য করছে। হঠাৎ নিরবতা ভেঙে এনাজ বললো,
— একটা সাইকোলজি জানো?
আমি মুচকি হেসে তার দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,
— কি?
— যে ভালোবাসাটা হুট করে একদম সীমা ছাড়া হয়ে যায় তা বেশিদিন থাকে না।
কথাটা শুনে আমি একটু নয় অনেক বেশি অবাক হলাম। আমার কাছে কথাটা ভীষণ ভালো লাগলো। মুখের মধ্যে বিস্ময় রেখেই বললাম,
— তাই নাকি! এটা তো জানতাম না।
— হ্যাঁ এটা সত্যি কথা। আশেপাশের অভিজ্ঞতা থেকে আমি তার প্রমাণও পেয়েছি।
— কথাটা ভীষণ ভালো লাগলো।
— আর যে ভালোবাসা হালকা হালকা আসে, আলতো করে গায়ে ছোঁয়া দেয় আস্তে আস্তে হয় সেটা অনেকদিন থাকে এবং সব অনুভূতিগুলো আস্তে আস্তে প্রকাশ পায়।
আমি মৃদু হেসে তার দিকে তাকালাম। মানুষটার মধ্যে আলাদা একটা ব্যক্তিত্ব আছে। এর সাথে কিছু সময় থাকলেই মনটা নিমিষেই ভালো হয়ে যায়। তার দিকে ভালো করে লক্ষ্য করলাম। আজকে এনাজের পরনে গেরুয়া রঙের টি-শার্টের সাথে অব হোয়াইট রঙের প্যান্ট। পায়ে বেল্ট জুতা, হাতে একটা ঘড়ি, চুলগুলো এলোমেলো। এতেই আমি ফিদা। আর কি লাগে? মেয়েরা কোরিয়ান ছেলেদের জন্য পাগল হয়ে যায়। কিন্তু আমার তো এই বাঙালি শ্যাম বর্ণের ছেলেগুলোকে বেশি ভালো লাগে। তাদের গায়ের রং ফর্সা না হলেও চেহারায় থাকে আলাদা একটা সৌন্দর্য। আর দাড়িতে এদের সৌন্দর্য যেন আরো বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। তবে এই ছেলে চুলগুলো সবসময় কেন যে এলোমেলো রাখে তাই আমি বুঝতে পারি না। মনে মনে ভাবলাম আজ এই প্রশ্নটা করবোই। কিন্তু কিভাবে শুরু করবো? সে কি না কি ভাবে আমায়। কিছু সময় ইতস্তত করে এদিকে সেদিকে তাকালাম। তারপর কিছুটা দম নিয়ে বললাম,
— আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিলো।
— হুম বলো। এর জন্য এত ইতস্তত হওয়ার মতো কিছু হয়নি। বলতে পারো আমি কিছু মনে করবো না।
— আসলে আমি….
— তুমি নিশ্চয়ই আমার চুলের কথা জিজ্ঞেস করবে। এগুলো সবসময় এলেমেলো থাকে কেন?
তার কথা শুনে আমি চোখ দুটো রসগোল্লা করে তার দিকে তাকালাম। সে কি করে বুঝতে পারলো? আমি মুখে অবাকের চিহ্ন রেখে জিজ্ঞেস করলাম,
— আপনি কি করে বুঝলেন?
এনাজ নিচের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। সামনের চুলগুলোকে পেছনের দিকে আঙুল বুলিয়ে এক চোখ মেরে বললো,
— সিক্রেট 😉!
— কোন সিক্রেট না। আপনি কি করে বুঝতে পেরেছেন তাই বলেন। নয়তো এই গেলাম আমি।
চেয়ার থেকে উঠতে নিলেই সে আমার এক হাত ধরে আটকিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললো,
— আরে না না কোথায় যেও না। বসো বসো বলছি। ব্লকমেইল ভালোই পারো টিডি পোকা ।
— আপনি কি বলবেন?
— তুমি বারবার আমার চুলের দিকে তাকাচ্ছিলে। তাই বুঝতে পেরেছি।
— ওহ্ আচ্ছা। আর আমাকে সিক্রেট বলে বোকা বানানো হচ্ছিলো।
—😁😁
— দাঁত বের না করে এখন উত্তর দিন।
তার ও আমার হাতের দিকে তাকিয়ে বললাম,
—আমার হাত ছাড়ুন।
— ওফস সরি।
— এবার বলুন। চুলগুলো সবসময় এমন এলেমেলো থাকে কেন?
— আগোছালো জীবনে যখন গোছালো মানুষটা পার্মানেন্টলি আমার হবে। তখন তার ছোঁয়ায় আমিও গোছালো হবো। সাথে আমার চুলগুলো ঠিক হবে।
তার কথা বলার ভঙ্গি দেখে আমি মিটমিট করে হেসে ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
— তা আছে নাকি এমন কেউ? থাকলে বলেন। সব ব্যবস্থা করে দেই। অনেক দিন ধরে বিয়ে খাওয়া হয় না। আপনার বিয়েতে কব্জি ডুবিয়ে খাবো।
— সিরিয়াসলি তুমি সব ব্যবস্থা করে দিবে?
— হ্যাঁ,তাতে এতো অবাক হওয়ার কি আছে?
— ভেবেচিন্তে বলছো তো?
— জ্বি মহাশয়।
— আচ্ছা, কথাটা মাথায় রেখো। পরে আবার পল্টি মারবে না তো?
আমি ভাব নিয়ে বললাম,
— নোভা, পল্টি মারার মতো মেয়ে না।
— কথাটা মনের মধ্যে খোদাই করে লিখে রাখলাম। ভবিষ্যতে কাজে লাগবে।
— এখন বলেন কেউ আছে কিনা?
— হ্যাঁ,আছে তো।
— রিয়েলি😳!!!
— হুম, তাকে আমি অনেক অনেক ভালোবাসি। ভাবছি চাকরীটা হলে তার পরিবারের কাছে দ্রুত প্রস্তাব দিয়ে তাকে ঘরে তোলার ব্যবস্থা করবো।
তার কথা শুনে এক নিমিষেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো। মনের আকাশে তাকে নিয়ে যতটুকু ভালো লাগা ছেয়ে গিয়েছিল তা ধীরে ধীরে বিষাক্ত রূপ ধারণ করছে। এতো খারাপ লাগার তো কথা নয়। সে দেখতে,শুনতে সবদিক দিয়ে মাশাআল্লাহ। তার ভালোবাসার মানুষ থাকতেই পারে স্বাভাবিক। তাই বলে আমার কেন খারাপ লাগবে? আচ্ছা, তাকে ভালো লাগাটা কি ভালোবাসায় পরিণত হয়নি তো? আমি তো তার হাব-ভাব, কেয়ার, আমার প্রতি খেয়াল দেখে ধরেই নিয়েছিলাম সে আমাকে পছন্দ করে। এখন মনে হচ্ছে একটু নয় অনেক বেশি ভেবে ফেলেছি আমি। ভালোই হয়েছে এখন সব জেনে নিয়েছি। নয়তো ২য় বার আবার কষ্ট পেতে হতো। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে এনাজ মুখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বললো,
— এই যে ম্যাডাম, কোথায় হারিয়ে গেলেন?
ভেতরটা আমার পুড়ে যাচ্ছে তাও মুখে মিথ্যে হাসি ঝুলিয়ে রেখে জিজ্ঞেস করলাম,
— কই কোথাও না তো। তা আপনার ভালোবাসার মানুষটা কে তা কি জানতে পারি?
— এখন বলবো না। তাকে জানিয়ে নেই তারপর বলবো। মনে করো এটা সত্যিই একটা সিক্রেট।
— চলুন উঠি।
— আরেকটু সময় থাকি।
— নাহ আমার ভালো লাগছে না।
আমার ভালো লাগছে না শুনে উনি ব্যস্ত হয়ে গেলেন।দ্রুত উঠে আমার সামনে এসে জিজ্ঞেস করলো,
— কি হয়েছে তোমার? তুমি ঠিক আছো তো? শরীর খারাপ লাগছে?
— ব্যস্ত হবেন না। আমার এমনি ভালো লাগছে না। আমি বাসায় চলে যাবো।
— আমি পৌঁছে দেই।
— না আমি চলে যেতে পারবো।
আমি দ্রুত পায়ে শারমিনদের টেবিলের সামনে এসে শারমিনকে উদ্দেশ্য করে বললাম,
— তন্বীকে বলে দিস আমি বাসায় চলে গেছি। ও যেন একাই চলে আসে। আমার ভালো লাগছে না।
কোনরকম সেখান থেকে রাস্তায় চলে এলাম। আমার এরকম তাড়া দেখে শারমিন পেছন থেকে ডাকলো। কিন্তু আমি কারো সাথে কথা না বলে রিকশা নিয়ে বাসায় চলে এলাম। রুমে এসে ধপ করে বেডে বসে পরলাম। না চাইতেও চোখ দিয়ে পানি পরতে লাগলো।আমি সবসময় একটু বেশি ভেবে ফেলি। যার জন্য পরে কাঁদতে হয়।
💖💖💖
পরেরদিন……….
❝কেসে পুছো
এ এসা কিউ❞
পরীক্ষার প্রশ্ন হাতে নিয়ে গান গাইছি। কিচ্ছু পারি না। গতকালের ঘটনার দরুন রাতে বই নিয়ে বসলেও পড়া হয়নি। মাঝে অসুস্থ ছিলাম। ঠিকমতো ক্লাশ হয়নি। বই নিয়ে বসাও হয়নি। সব মিলিয়ে আজ একটা বিচ্ছিরি অবস্থা। ছয় সাবজেক্টের আধা ঘণ্টা করে তিন ঘন্টা পরীক্ষা। প্রতিটা বিষয়ের জন্য নির্ধারিত সময় হলো আধা ঘন্টা। আধা ঘণ্টায় ২০ মার্কের পরীক্ষা। একটা সৃজনশীল প্রশ্ন আর ১০ টা নৈবিত্তিক। আমাদের কলেজের টিউটোরিয়াল পরীক্ষাগুলো এভাবেই নেওয়া হয়। প্রতিটা প্রশ্ন উল্টেপাল্টে দেখছি আর কলমের খাপ কামড়াচ্ছি। আমার তো মনে হচ্ছে একটাও পাস নাম্বার উঠাতে পারবো না। পাস নাম্বার না উঠালে তো তায়াং ভাইয়া কান ধরে উঠবস করাবে। আমি ফেল করলে যে কিভাবে ভাইয়ার কানে চলে যায় কে জানে। একদিন শুধু বলেছিলে কলেজে আমার পেছনে ও লোক লাগিয়ে রেখেছে। কিন্তু আজ অব্দি তাদের দর্শন পেলাম না। মনের দুঃখে তাই গান গাইতে লাগলাম।
❝রসিক আমার মন বান্ধিয়া
পিঞ্জর বানাইছে।❞
আরেকবার গান শুরু করতে না করতেই স্যার হুংকার দিয়ে বললেন,
— এই গান গায় কে রে? পরীক্ষা দিতে আসছো নাকি গান গাইতে? এতো গান গাইতে মন চাইলে খাতা জমা দিয়ে বাইরে গিয়ে গান গাও।
আমি মুখে হাত দিয়ে চুপ করে রইলাম। এবার গানের সুরটা একটু জোড়েই টেনে ফেলেছিলাম। যার দরুন স্যার শুনে নিয়েছে। আমি অসহায় চোখে একবার শারমিনের দিকে তাকাতেই দেখলাম ও আমার দিকে আগের থেকে তাকিয়ে আছে। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠলাম। শারমিনেরও আমার মতো অবস্থা। আমাদের হাসির শব্দ কি করে যে স্যারের কানে গেলো কে জানে। আমাকে ধমকে বললো,
— এই মেয়ে দাঁত কেলাচ্ছো কেন? পরীক্ষা দিতে এসেছো নাকি রং তামাশা করতে? আরেকবার হাসতে দেখলে খাতা নিয়ে বের করে দিবো।
— সরি স্যার। আমি বুঝতে পারি নি আপনি শুনে যাবেন। তাহলে আরেকটু আস্তে গাইতাম।
শেষের কথাগুলো বিরবির করে বলায় স্যার শুনতে পাইনি। শুধু “সরি স্যার” শুনেছে। আরেকবার ধমকের সুরে বললো,
— চুপচাপ লেখো। আরেকবার হাসলে কিন্তু খারাপ হয়ে যাবে।
কি আর করার স্যারের ধমক খেয়ে সিধা হয়ে গেলাম। আসলেই তায়াং ভাইয়া একটা কথা ভুল বলে না। আমি সোজা কথার মানুষ নই। ধাওয়া না খেলে ভালো হই না। আমাকে বকতে দেখে শারমিন মুখ আটকে মিটমিট করে হাসছে। ওর দিকে একটা খাইয়া ফালামু লুক দিয়ে প্রশ্ন হাতে নিয়ে যা পারি তাই লিখতে লাগলাম। তিন ঘন্টা শেষ হওয়ার আগেই আমি ও শরমিন দুজনেই বের হয়ে গেলাম।শারমিন মুখ টিপে হেসে বললো,
— কি রে পরীক্ষা কেমন দিলি?
— তুই যেমন দিছিস।
— দেখছিস এগুলো কোন কামকাজ।
— কেন কি হয়েছে?
— সিট উল্টাপাল্টা ফালাইছে।
— এরা সবসময় এমন করে। ইহা নতুন কিছু নয়।
— এবার আল্লাহ আল্লাহ করে পাস নাম্বার উঠলেই হয়। নয়তো এবারো ফেল।
— ইস, শখ কত! যেই পরীক্ষা দিছিস আবার পাস করার চিন্তা করিস কেমনে?
— এসব কথা পরে। তুই কালকে কিছু না বলে এভাবে কফি হাউস থেকে বের হয়ে গেলি কেন? এনাজ ভাইয়া কি কিছু বলছিলো?
— আরে না সে কি বলবে?
— তাহলে এভাবে চলে গেলি কেন?
— এমনি ভালো লাগছিলো না।
হঠাৎ আমার চোখ গেলো নিচের দিকে। আমি শারমিনকে ডেকে বললাম,
—ঐ শারমিন নিচে দেখ। ঐ মেয়েটা তোর ফুপাতো বোন না?
— হুম। আচ্ছা তুই একটু দাঁড়া। ওর সাথে আমার কথা আছে। তুই এখানেই দাঁড়াস। কোথাও যাস কিন্তু আবার।
— জলদী আসিস।
শারমিন সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলো। আমি স্টোর রুমের সামনে দিয়ে পায়চারি করতে লাগলাম। মোবাইল হাতে নিয়ে এদিক সেদিক ঘুরছি। তন্বীদের পরীক্ষা আগামীকাল। তাই আজ ওদের বন্ধ। আমাদের আবার আগামীকাল বন্ধ। দোতালার এই স্টোর রুমে তেমন মানুষ চলাচল করে না। কিরকম ভুতুড়ে পরিবেশ বিরাজ করে। সেটার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় খেয়াল করলাম তালা দেওয়া নেই। কিন্তু আমার জানামতে সবসময় এটা তালা মারাই থাকে। ভেতর থেকে কিরকম শব্দ আসছে। কেউ আলমারি কিংবা শোকেস খুললে যেরকম কেচর কেচর শব্দ হয় অনেকটা সেরকম।কখনো ভেতরে যাওয়া হয়নি। আজ তালা না দেখে ভেতরটা দেখতে খুব ইচ্ছে করলো। তাছাড়া শব্দ কিসের সেটা জানতেও মনটা উৎসুক হয়ে গেলো।
কৌতূহলবশত দরজাটা হালকা ঠেলে ভেতরে উঁকি দিতেই এক জোড়া বলিষ্ঠ হাত এসে আমাকে ভেতরে টেনে নিয়ে গেলো। সাথে দরজাটাও বন্ধ করে দিলো।আমি ভয়ে চোখ বন্ধ করে চিৎকার দেওয়ার আগেই সে আমার মুখ চেপে ধরলো। চোখে শক্ত করে কাপড় বেঁধে দিয়ে পেছন থেকে দুই হাতে গলা জড়িয়ে ধরলো। আমি আমার দুই হাত দিয়ে তার দুই হাত সরিয়ে দিতে চাইলাম। কিন্তু এত শক্ত করে ধরেছে যে আমার মতো পুঁচকে মেয়ের ঐ বলিষ্ঠ হাত সরানোর শক্তি নেই। আমার ভয়ে হাত-পা কাঁপা-কাঁপি শুরু করে দিছে। সাথে ভীষণ অস্বস্তিও লাগছে। কেন যে পাকনামি করে এখানে এলাম। এখন যদি আমাকে মেরে গুম করে দেয়। কিন্তু সে আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মুখ গুঁজে রেখেছে। আমার হাত-পা ভয়ে জমে গেছে। সে আমার মুখ ছেড়ে দিয়েছে। তবুও আমি চিৎকার করতে পারছি না। মনে হচ্ছে কেউ টুটি চেপে ধরে রখেছে। হঠাৎ কাঁধে ঠান্ডা স্পর্শ পেতেই চমকে উঠলাম। সে কান্না করছে। কিন্তু কেন? আমি বড়সড় ঢোক গিলে আমতাআমতা করে জিজ্ঞেস করলাম,
— কে? কে আপনি?
#চলবে