তুমি_তাই অরিত্রিকা আহানা পর্বঃ১৫

0
460

তুমি_তাই
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ১৫

কপালে ভেজা রুমাল চাপা দিয়ে একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ফুয়াদ। কিছুক্ষণ আগেই তাঁর কপাল বরাবর কোকাকোলার একটা ক্যান ছুঁড়ে মারা হয়েছে। এবং এত জোরে ছুঁড়ে মারা হয়েছে যে কপাল ফুলে ঢোল হয়ে গেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে যিনি ছুঁড়ে মেরেছেন তাঁর বিন্দুমাত্রেও আফসোস নেই। বরঞ্চ রাস্তার উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে ক্রমাগত চিৎকার করে যাচ্ছেন তিনি। তাঁর চিৎকারে ফুয়াদের কানে তালা লেগে গেছে। কানের কাছে শিঁইইই শিঁইইই টাইপ একটা আওয়াজ হচ্ছে।

ভর্তি পরীক্ষার দেওয়ার জন্য নিজের সার্টিফিকেট গুলো ফটোকপি করতে এসেছিলো তিন্নি। ফাইল থেকে পেপারগুলো বের করে দেখে নিচ্ছিলো কোনটা কোনটা ফটোকপি করতে দেবে, ঠিক তখনই কোথা থেকে একটা কোকাকোলার ক্যান এসে কাগজের ওপর পড়লো। ভেতরের অবশিষ্ট পানীয় পড়ে ভিজে গেলো সার্টিফিকেটের কাগজগুলো। তাড়াহুড়া করে গুলো ঝেড়ে ফেলতে গিয়ে সার্টিফিকেটের একাংশ টান লেগে ছিঁড়ে গেছে। ব্যস শুরু হয়ে গেলো লঙ্কাকাণ্ড।
কান্নাকাটি, চিৎকার চেঁচামেচি, ক্যান ছুঁড়ে মারা ব্যক্তির চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধারসহ সর্বোপরি তাঁর কপাল বরাবর পুনরায় ক্যানের বোতলটা ছুঁড়ে মেরেও শান্ত হলো না তিন্নি। রাস্তার উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে লোক জড় করলো ফুয়াদকে মারার জন্য।

ফুয়াদ ব্যতিব্যস্ত হয়ে সামনে এগিয়ে এলো। তার কপালে তখনো রুমাল চাপা দেওয়া। মানুষ জন হাঁ করে তামাশা দেখছে। এই নিতান্ত ভদ্রটাইপ ছেলেটার সঙ্গে তিন্নির ঠিক কি কারণে শত্রুটা থাকতে পারে সেটা ওরা বুঝতে পারছে না।

ফুয়াদ তিন্নিকে শান্ত করার বৃথা চেষ্টা চালিয়ে বিনয়ী গলায় ডাক দিলো,

-‘এক্সকিউজমি ম্যাম। আমার নাম ফুয়াদ…’

সে কথা শেষ করার আগেই তিন্নি তেঁতে উঠলো। পারলে সে আবার ফুয়াদের মাথা ফাটিয়ে দেয়। ক্ষিপ্ত কন্ঠে বললো,’ধন্য হলাম। ধন্য হলাম আপনার মত এমন অসভ্য লোকের নাম জানতে পেরে। আরো ধন্য হতাম যদি বাড়ি মেরে আবার আপনার কপালটা ফাটিয়ে দিতে পারতাম।’

-‘আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন। আমি আসলে ক্যানটা বিনে ফেলতে চেয়েছিলাম। ভুলবশত আপনার ফাইলের ওপর পড়ে গিয়েছে।’

-‘ভুলবশত? আপনি তিন মাইল দূর থেকে ক্যানের বোতল ছুঁড়ে মারবেন কেন? রাস্তাঘাট কি ক্যান ছোড়াছুঁড়ির জায়গা? এখন যে আমার সার্টিফিকেট গুলো নষ্ট হয়ে গেলো এর দায়ভার কে নিবে?’

ফুয়াদ লজ্জিত মুখে অনুনয় করে বললো,

-‘আপনি যদি কিছু মনে না করেন তবে আমি আপনার পেপার গুলো নতুন করে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে পারি। টাকাপয়সা যা লাগবে আমি দেবো। ‘

-‘অবশ্যই দেবেন। কেন কিছু মনে করবো? জিনিস নষ্ট করেছেন, এখন সেটার ক্ষতিপূরণ দেবেন এখানে আমার মনে করার কি আছে? আপনি আজই যাবেন আমার সঙ্গে।’

ফুয়াদ মনে মনে অবাক হলেও রাজী হয়ে গেলো। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঝামেলা মিটিয়ে নিতে চাইলো। তিন্নির রাগ যদিও কমে নি তবে ফুয়াদের ফুলে থাকা কপালের দিকে তাকিয়ে খানিকটা শান্ত হওয়ার চেষ্টা করছে।

রিক্সায় উঠে ফুয়াদ খানিকটা আলাপ জমাতে চেষ্টা করলো। কারণ, তিন্নিকে সে প্রথম দেখাতেই চিনতে পেরেছে। এই মেয়েটার সঙ্গেই একবার বিয়ের প্রস্তাব উঠেছিলো তাঁর। কিন্তু কি একটা ঝামেলার কারণে ফুয়াদের ফুপু সম্বন্ধটা এগোতে দেন নি। এখন মনে হচ্ছে না দিয়ে ভালোই করেছে। এমন ঝগড়ুটে মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হলে ফুয়াদের জীবনটা তামা তামা হয়ে যেতো। এই বিষয়ে আর কোন সন্দেহ নেই।

তবে যাই হোক না কেন, ফুয়াদ এইমুহূর্তে ভীষণ লজ্জিত। সে খুবই রেস্পন্সিবল এবং ডিসেন্ট প্রকৃতির ছেলে। এরকম একটা আনসোশ্যাল কাজ তাঁর দ্বারা কোনদিন ঘটে নি। আজকে হঠাৎ কি হলো কে জানে। নেহায়েত ছেলেমানুষি করে ক্যানটা বিন বরাবর সই করতে গিয়েছিলো। তাতেই অঘটনটা ঘটে গেলো। সুতরাং তিন্নির রেগে যাওয়াটা একেবারেই অমূলক নয়। মোলায়েম কন্ঠে বললো,

-‘বিশ্বাস করুন আমি ইচ্ছা করে করি নি।আনফরচুনেটলি আপনার সঙ্গে ঘটনাটা ঘটে গেছে। কেন যে হঠাৎ ক্যানটাকে ছুঁড়ে মারতে গেলাম! ভেবেছিলাম টার্গেট মিস হবে না। সরি, এক্সট্রিমলি সরি।… আপনি কি এখনো আমার ওপর রেগে আছেন?’

-‘কেন রেগে থাকলে কি করবেন? পা ধরে মাফ চাইবেন?’

ফুয়াদ গলা খাঁকারি দিলো। নাহ! এই মেয়ের সঙ্গে কথা না বলাই ভালো। মানসম্মান রাখবে না। ঠোঁটকাটা, বদরাগী।
বোর্ড অফিসে পৌঁছানোর পর তাঁরা থানায় ডাইরী করতে বললো। সেখান থেকে তিন্নিকে নিয়ে থানায় গেলো ফুয়াদ। থানা থেকে জিডির কপি নিয়ে সেটা আবার বোর্ড অফিসে জমা দিতে হবে। একদিনে সমস্তটা সম্ভব নয়। তাই কালকে আবার বেরোতে হবে। থানা বেরোনোর পর ফুয়াদ ভদ্রতা রক্ষার্থে জিজ্ঞেস করলো,

-‘কিছু খাবেন? এতক্ষণ যাবত ঘোরাঘুরি করছেন নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছ?’

-‘তো?’

-‘না মানে খিদে না পেলে থাক।’

তিন্নি জবাব দিলো না। তাঁর মন মেজাজ ভালো নেই। ইদানীং আগের চাইতে অনেক বেশি খিটখিটে হয়ে গেছে সে। মায়ের সঙ্গে পর্যন্ত ঝগড়া বেধে যায়। আর ফুয়াদ তো বাইরের মানুষ। বললো,

-‘আমি এখন কিছু খাবো না। বাসায় যাবো।’

-‘ঠিক আছে আমি আপনাকে রিক্সায় তুলে দিচ্ছি।’

-‘লাগবে না। আমি উঠতে পারবো।’

-‘তাহলে আপনার ঠিকানা কিংবা ফোন নম্বরটা দিয়ে যান। কালকে তো আবার বোর্ড অফিসে যেতে হবে।’

এতক্ষণে কিছুটা শান্ত হলো তিন্নি। ছেলেটা নেহায়েত মন্দ নয়। অনিচ্ছাকৃত ভাবে একটা ভুল করে ফেললেও সেটা শুধরাতে চাইছে। নরম হয়ে এলো তাঁর গলা। বললো,

-‘আপনাকে আর যেতে হবে না। আমি জমা দিয়ে আসবো। ধন্যবাদ।’

-‘সেটা কি করে হয়? আমার জন্যই তো আপনার ক্ষতিটা হলো।’

-‘দেখুন আপনি নিজের ভুল বুঝতে পেরে আমাকে সাহায্য করেছেন তার জন্য আপনাকে থ্যাংক ইউ। এর বেশি আর কিছু করার প্রয়োজন নেই। অপরিচিত কারো সঙ্গে আমি নিজের ফোন নাম্বার কিংবা বাসার ঠিকানা কোনটা শেয়ার করতে রাজি নই। সরি। ভালো থাকবেন। আসি।’

কথা শেষ করে চট করে একটা রিক্সায় উঠে পড়লো সে। ফুয়াদ নিজেও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারায় নয় এই মেয়ের সঙ্গে তাঁকে আর কোথাও যেতে হবে না সেইজন্য। নিজের কৃতকর্মের জন্য ফুয়াদ অবশ্যই অনুতপ্ত কিন্তু তিন্নির সঙ্গে দেখা আবার করাটা খুবই কষ্টকর। ভালো মানুষেরও মেজাজ খারাপ হয়ে যাবে। রাগ উঠে যাবে ওর ত্যাড়াত্যাড়া কথা শুনলে। যদিও আজকে দোষটা ফুয়াদের কিন্তু সে বেশ বুঝতে পেরেছে তিন্নি স্বাভাবিকের তুলনায় একটু বেশিই রাগী। আবার ঝগরুটেও।

নিলির বাসার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে রেজোয়ান এবং জাহিদ। রেজোয়ান বারবার জাহিদকে ঠেলছে ভেতরে যাওয়ার জন্য। জাহিদ ভয়ে রাজি হচ্ছে না। নিলির মেজাজ খারাপ। গতকাল রাতেও জাহিদকে ফোন করে রেজোয়ানের নামে নালিশ করেছে। বারবার করে বলেছে জাহিদ যেন রেজোয়ানকে বোঝায় সে ভুল করছে। রেজার মতন একটা ভালো মানুষের সঙ্গে অন্যায় করছে রেজোয়ান। এরজন্য নিলি তাঁকে কোনদিন ক্ষমা করবে না।
আর সেই জাহিদকেই কিনা এখন রেজোয়ান নিলিকে কনভিন্স করার জন্য পাঠাচ্ছে! অসহায় লাগছে জাহিদের। এদের দুজনের মাঝখানে পড়ে তাঁর অবস্থা দফারফা হয়ে যাচ্ছে। দুজনে দুদিক থেকে খারাপ করে দেয়।

রেজোয়ান পুনরায় তাড়া দিলো। জাহিদ মিনমিন করে বললো,’না মানে বলছিলাম কি স্যার, কথাগুলো আপনি গিয়ে বুঝিয়ে বললে ভালো হতো না?’

-‘আমি যতবার বলেছি ও কানে তোলে নি। ওর ধারণা আমি বানিয়ে বানিয়ে রেজার নামে খারাপ কথা বলছি। তাই তুমি গিয়ে বলবে। ওর রিয়েকশন যদি পজিটিভ হয় তখন আমি ভেতরে ঢুকবো।’

বাহ! তারমানে ঝড় যা যাক , সব জাহিদের ওপর দিয়েই যাক। রেজোয়ান সেইফ থাকলেই হলো। স্বার্থপর সুবিধাবাদী লোক একটা!
মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো জাহিদ। সে-ই বোধহয় প্রথম ব্যক্তি যে কি না বসের হয়ে তাঁর প্রেমিকার ঝাড়ি খেতে যাচ্ছে। অথচ সে নিজে এই জীবনে একটা প্রেম করতে পারে নি। অর্ধেক জীবন কেটে গেছে রেজোয়ানের সমস্যার সমধান করতে করতে। পারিবারিক কিংবা ব্যবিসায়িক যাই হোক না কেন রেজোয়ানের সকল সমস্যার সমাধানে জাহিদের ভূমিকা অতুলনীয়।

রেজোয়ান অবশ্য এসব কিছু ভাবছে না। তাঁর ধারণা জাহিদের সঙ্গে কোনরূপ খারাপ ব্যবহার করবে না নিলি। জাহিদকে সে রেজোয়ানের চাইতে বেশি ভালো জানে। কিন্তু আধঘন্টা বাদে যখন জাহিদ চুপসে যাওয়া বেলুনের মত মুখ করে বেরোলো তখন রেজোয়ানের ধারণাটা পালটে গেলো। জাহিদ হতাশভাবে মাথা দুলিয়ে বললো,

-‘আই অ্যাম সরি স্যার। আই কান্ট হেল্প। সি ইজ এক্সট্রিমলি ফেড আপ উইথ ইউ। বিয়ের দিন মি. রেজাকে কিডন্যাপ করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। ‘

জাহিদকে দেখে প্রথমে খুশিই হয়েছিলো নিলি। ভেবেছিলো রেজোয়ানের কুকীর্তির কথা সব জানাবে। রেজার মুখ থেকেই শুনেছে সে রেজোয়ান নাকি বিয়ের দিন রেজার কিডন্যাপ করার হুমকি দিয়েছে। মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছে।
সবশুনে মনে মনে রেজার প্রতি দুঃখ বোধ করলো নিলা। তাঁকে হেল্প করতে গিয়ে বেচারা বিনাদোষে বারবার রেজোয়ানের হাতে অপদস্থ হচ্ছে। ভীষণ রাগ হলো নিলির। জাহিদের সঙ্গে এর একটা বোঝাপড়া করে নিতে চাইলো। হয় জাহিদ রেজোয়ানকে বুঝাবে নতুবা নিলি নিজে থানায় গিয়ে রেজায়ানের নামে কমপ্লেইন করে আসবে।
কিন্তু এসবের মাঝখানে জাহিদের মুখ থেকে উলটো রেজার বদনাম শুনে খেপে গেলো। তাঁর ধারণা, রেজোয়ানের শেখানো বুলি কপচাতেই এসেছে জাহিদ। তাই রাগে দুঃখে, ভদ্র ভাষায় কিছু কথা শুনিয়ে দিয়ে বেরিয়ে যেতে বললো।
জাহিদের মুখে সব শুনে রেজোয়ানের একই সঙ্গে মেজাজ খারাপ এবং অসহায় লাগছে। রেজা খুব ভালোভাবে ব্রেনওয়াশ করেছে নিলির। কারো কথা বিশ্বাস করছে না সে। এভাবে চলতে থাকলে বিয়েটা কোনতেই ঠেকাতে পারবে না রেজোয়ান। জাহিদকে অপেক্ষা করতে বলে সে নিজে গেলো নিলির সঙ্গে কথা বলার জন্য।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here