তুমি_তাই অরিত্রিকা আহানা পর্বঃ২২

0
444

#তুমি_তাই
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ২২

তিন্নির কাছে সেদিন রাতে কোন ফোন এলো না। এ নিয়ে অবশ্য তাঁর কোন মাথাব্যথাও ছিলো না। মেহমানরা চলে যাওয়ার পরপরই ফ্রেশ হয়ে ঘুমাতে চলে গিয়েছিলো সে। সকাল থেকে বিয়ের ঝামেলায় দুদন্ড নিরিবিলি বসার সুযোগও হয় নি। সারাক্ষণ চিৎকার চেঁচামেচিতে কানের তালা ফেটে যাওয়ার উপক্রম। তাই সুযোগ পেয়ে আর দেরী করে নি। নিজের ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিয়েছে। তারপর একঘুমেই রাত পার।
পরেরদিন নিতান্ত কৌতূহল বশতই ফোনে কোন আননোন নাম্বার থেকে কল এসেছে কি মা চেক করলো। আসে নি দেখে আর বেশি মাথা ঘামালো না।

ফোন এলো দুদিন পরে। সন্ধ্যার সময়। তিন্নি তখন নিজের ঘরে বসে চুল আঁচড়াচ্ছিলো। এমন সময় ফুয়াদ ফোন করলো। কিন্তু সংকোচ আর অস্বস্তিতে ঠিকমত কথা বলতে পারে নি তিন্নি। সে নিজেও বুঝতে পারছিলো না কেন তাঁর এমন অস্বস্তি হচ্ছিলো? ফুয়াদ খুবই সাধারণ কথাবার্তা বলেছে। এতে লজ্জা পাওয়ার মত কিছুই নেই।

তাছাড়া, তিন্নি বিয়েটা করেছে কেবল করতে হবে বলে। এছাড়া আর অন্য কোন এক্সপেক্টেশন তাঁর নেই। ইমোশন তো বহুদূরের কথা। শেষমেশ ফুয়াদের কথার মাঝখানেই ফোন কেটে দিয়েছে সে। ফুয়াদ কল ব্যাক করলো কিন্তু রিসিভ করলো না।

দুদিন বাদে ফুয়াদ বাসায় এলো দেখা করার জন্য। দুপক্ষের আত্মীয়স্বজনরাও তাই চাইছিলো। বউ উঠিয়ে নেওয়া হয় নি তো কি হয়েছে? ফুয়াদ তো আসাযাওয়া করতে পারে। স্বামী স্ত্রীর মিল মহাব্বতেরও তো একটা ব্যাপার আছে! ফুয়াদের নিজেরও মনে হচ্ছিলো তিন্নির সঙ্গে দেখা করা প্রয়োজন। আর কিছু না হোক অন্তত কথাবার্তা সহজ করার জন্যে হলেও প্রয়োজন।

ঘুম ঘুম চোখে আড়মোড়া ভাঙলো তিন্নি। সামনের চেয়ারে বসা ফুয়াদকে দেখে চমকে গেলো। স্বপ্ন দেখছে ভেবে চোখ কচলালো।

ফুয়াদ সুতির কাজ করা একটা ধবধবে সাদা পাঞ্জাবী পরে এসেছে। নতুন জামাই লাগছে তাঁকে। ফোনে নিউজফিড স্ক্রল করছিলো সে।
তিন্নিকে চমকাতে দেখে হালকা হাসলো। ফোন পকেটে ঢুকিয়ে নিয়ে বললো,’তুমি খুবই সুখি একজন মানুষ। কারণ তোমার ঘুম ভালো ঘুম হয়।’

তিন্নি সোজা হয়ে বসলো। তাঁর পরনে একটা বেগুনী সেলোয়ার কামিজ। নাকফুল, চুড়ি সব খুলে রেখে দিয়েছে। ফুয়াদকে দেখে সেগুলোর কথা মনে পড়লো। খাটের পাশেই ড্রেসিংটেবিল। টেবিলের ওপর চুড়ি রাখা আছে। চিকন দেখে দুগাছি চুড়ি পরে নিলো সে। এলোমেলো চুলগুলো হাত খোঁপা করে বললো,’কখন এসেছেন?’

-‘আধঘণ্টার মত হবে।’

-‘আপনি বসুন আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।’

-‘বসেই তো আছি। তোমার কাজিনরা জোর করে আমাকে ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে।ঢুকে দেখি তুমি ঘুমাচ্ছো। কয়েকবার ডেকেছি, সাড়াশব্দ করছিলে না দেখে আর ডিস্টার্ব করি নি।’

-‘আমার ঘুম গাঢ়। ঘুমালে হুঁশ থাকে না।’

তিন্নি ফোন করে তাসলিমা বেগমকে ঘরের দরজা খুলে দিতে বললো। তার কাজিনগুলো ভয়ানক অসভ্য। ওদেরকে বললে খুলবে না। তাই বাধ্য হয়ে তাসলিমা বেগমকে ফোন করেছে। তাসলিমা বেগম এসে দরজা খুলে দিয়ে গেলেন।

তিন্নি ঘর ছেড়ে বেরোনোর সময় জিজ্ঞেস করলো ,’কি খাবেন? চা না কফি?’

যদিও এখানে আসার পর একবার নাশতা করেছে ফুয়াদ। কিন্তু এইমুহূর্তে এক মগ কফি ভীষণ প্রয়োজন। অনেকক্ষণ বসে থাকার ফলে শরীরে ঝিমুনি এসে গেছে। তিন্নির প্রশ্নের জবাবে হাসিমুখে বললো,’কফি।’

মিনিট পাঁচেক বাদে কফি নিয়ে পুনরায় ঘরে প্রবেশ করলো তিন্নি। কফির মগটা ফুয়াদের হাতে তুলে দিয়ে খাটের ওপর বসলো। ফুয়াদ কফিতে চুমুক দিয়ে বললো,’কফি ভালো হয়েছে।’

তিন্নি জবাব দিলো না। ফুয়াদ ঠিক কি উদ্দেশ্য এই বাসায় এসেছে সে জানে না। স্বামীর অধিকার প্রয়োগ করতে নাকি শুধু গল্পগুজব করতে? যাই হোক আপাতত দুটোর একটাতেও ইন্টারেস্ট নেই তিন্নির। কিছুদিন নিজেকে সময় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে।

-‘আসলে বিয়েটা এত হুট করে হয়ে গেছে যে আত্মীয়স্বজন কাউকেই ঠিকমতো জানানো হয় নি। তাই একটু ঝামেলা চলছে বাসায়। তোমাকেও ঠিকমত সময় দিতে পারছি না।’

-‘সমস্যা নেই। আপনি আগে বাসার সমস্যার সমাধান করুন।’

-‘বোঝার জন্য ধন্যবাদ।’

ফুয়াদ কফির মগ রেখে উঠে দাঁড়ালো। পকেট থেকে ফোন বের করে সময় দেখলো। রাত বেশি হলে বাসায় ফিরতে দেরী হয়ে যাবে। তাছাড়া ফেরার পথে একবন্ধুর সাথেও দেখা করার কথা আছে। তাসলিমা বেগমের সঙ্গে দেখা করেই বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।

তিন্নি দূরত্ব বজায় রেখে কিছুটা দূরে সরে দাঁড়ালো। ফুয়াদ ফোন পকেটে ঢুকিয়ে নিয়ে তিন্নির দিকে চাইলো। তাঁর দাঁড়ানোর ভঙ্গি যথেষ্ট আড়ষ্ট। ফুয়াদ সপ্রতিভ হাসলো। বললো,’তুমি কি আমাকে দেখে বিব্রত হয়েছো?’

তিন্নি চুপ করে রইলো। ফুয়াদ জবাব না পেয়ে নিজে থেকেই বললো,’হয়ে থাকলে আমি সরি। আমার আসলে ফোন করে আসা উচিৎ ছিলো। ট্রাস্ট মি, তোমাকে বিব্রত করার কোন ইন্টেনশন আমার নেই। আই অ্যাম এক্সট্রিমলি সরি।’

তিন্নি এবারেও জবাব দিলো না। এইমানুষটার সঙ্গে সেদিন রাস্তায় ঝগড়া হয়েছে তাঁর। যদিও ঝগড়াটা একতরফাই ছিলো। ফুয়াদ দোষ স্বীকার করে চুপচাপ মিটমাট করার চেষ্টা করেছে কেবল, রাগ যা করার তিন্নিই করেছে। কিন্তু প্রথম পরিচয়ের পর থেকে এইপর্যন্ত এই লোকটাকে কোনভাবেই ভায়োলেন্ট মনে হয় নি তাঁর। তবুও কেন সে স্বাভাবিক হতে পারছে না? এই প্রশ্নের উত্তর তিন্নির নিজেরও জানা নেই। এই মানুষটার সঙ্গে সে আদৌ স্বাভাবিক হতে পারবে কি না তাও জানে না। প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে বললো,’বিব্রত না। আমি আসলে একটু অন্যমনস্ক। আপনি কি আজকে থাকবেন?’

হঠাৎ মুখ ফস্কে কথাটা বেরিয়ে যেতেই ভীষণ লজ্জায় পড়লো তিন্নি। মনের ভয় তাঁর মুখে প্রকাশ পেয়ে গেছে। ফুয়াদ কি বুঝেছে কে জানে। সে খুব স্বাভাবিক ভাবেই বললো,’না। আজকে তোমার সঙ্গে পরিচিত হতে এসেছি। বিয়ের দিনও ঠিকমতো কথাই বলতে পারি নি।’

তিন্নি পূর্বোক্ত প্রশ্নটা ধামাচাপা দিতে বললো,’না আসলে মা আপনার জন্য রান্না করছেন তো তাই।’

ফুয়াদকে খানিকটা চিন্তায় পড়ে গেলো। এখন সবে সাড়ে আটটা বাজে। ডিনার করতে গেলে অনেক দেরী হয়ে যাবে। এদিকে বন্ধুর সঙ্গেও দেখা করতে হবে। চিন্তিত মুখে বললো,’চলো তো মা কি করছে দেখি?’

গিয়ে দেখলো তাসলিমা বেগম সত্যিই চুলায় রান্না বসিয়ে দিয়েছেন। নতুন জামাই কিছুতেই না খাইয়ে ছাড়বেন না। ফুয়াদও জোর দিয়ে না করতে পারলো না। অভদ্রতা দেখায়। বাধ্য হয়ে থেকে গেলো। বন্ধুকে ফোন করে জানিয়ে দিলো আজকে দেখা করতে পারবে না।

এদিকে অনেকক্ষণ বাদে তিন্নির কাজিনরা সুযোগ পেয়ে দুজনকে জেরা শুরু করে দিলো। এতক্ষণ দরজা বন্ধ করে কি করেছে তাঁরা এই নিয়ে নানারকম লজ্জাজনক প্রশ্ন।

তিন্নি ইচ্ছে করেই চুপ করে রইলো। এই লোক কি বলে সেটা শুনতে চায় সে। ফুয়াদ মুচকি হেসে বললো,’তোমাদের আপুকে গান শুনাচ্ছিলাম।’

সবাই একসঙ্গে প্রশ্ন করলো কি গান। ফুয়াদ দুষ্টুমিষ্টি হাসলো। অনেকটা কবিতা আবৃতির সুরে গেয়ে উঠলো সে,
“একেলা পাইয়াছি হেথা,
পলাইয়া যাবে কোথা
চৌ-দিকে ঘিরিয়া রে রাখিছে
আমার শ্যালিকা গনে।
আজ পাশা খেলবো রে শ্যাম!”
তাঁর গান শুনে তিন্নি কাজিনরা সবাই হাসতে হাসতে একে অপরের গায়ে পড়লো। তিন্নিকে টিপ্পনী কেটে বললো,’তোমার বর কিন্তু ভীষণ দুষ্টু আপু!’
লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে নিলো তিন্নি। সে ভেবেছিলো ওদের সঙ্গে পেরে উঠবে না ফুয়াদ। লজ্জায় কাঁচুমাচু করবে। কিন্তু এখন তো দেখছে উল্টো, মজা নিচ্ছে এই লোক।

যতক্ষণ ছিলো ফুয়াদ সবার সঙ্গে দুষ্টুমি করেই কাটিয়েছে। তিন্নি কেবল চুপচাপ বসে ছিলো। এমন পরিস্থিতিতে বসে থাকা ছাড়া আর কিছু করার ছিলো না তাঁর। উঠে গেলে অভদ্রতা হতো। আবার কথা বলতেও সংকোচ লাগে। তাই চুপচাপ বসেই ছিলো। এরপর থেকে মোটামুটি ঐ বাসায় আসা যাওয়া হয় ফুয়াদের। তিন্নি যদিও পুরোপুরি ফ্রি হতে পারে নি তবে টুকটাক কথাবার্তা বলে এখন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here