তুমি_তাই অরিত্রিকা আহানা পর্বঃ৭

0
489

তুমি_তাই
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ৭

থানায় নিয়ে আসার পর থেকে এই পর্যন্ত নিলির ওপর অমানুষিক নির্যাতন করেছে পুলিশ। নানারকম ভাবে তাঁর মুখ দিয়ে কথা আদায়ের চেষ্টা করেছে। কিন্তু সেটা যখন সম্ভব হলো না তখন বাধ্য হয়ে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য তিনদিনের রিমান্ড চেয়ে কোর্টের কাছে আবেদন করলো।
সকল ধরনের নির্যাতনের অনুমতি পেয়ে গেলে নিলির মুখ থেকে কথা আদায় করা সহজ হয়ে যাবে।

দুদিন বাদেই কোর্টের হিয়ারিং। ধারণা করা হচ্ছে, আইনি আবেদনকে প্রাধান্য দিয়ে রিমান্ড মঞ্জুর করবে কোর্ট।

আজিজের বিরুদ্ধেও এখনো কোন শক্ত প্রমাণ জোগাড় করা সম্ভব হয় নি। জোগাড় করার খুব একটা চেষ্টাও পুলিশের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। তাঁরা ধরেই নিয়েছে নিলিই প্রধান আসামী। তাই আদালতে নিলিকে দোষী প্রমাণ করার চেষ্টাই চলছে।

রিমান্ড মঞ্জুর হয়ে যাওয়ার আশংকাটা শুনে থেকে ভয়ে, আতংকে নিলির সমস্ত শরীর অবস হয়ে আসছে। এই দুইদিনে তাঁর ওপর যেই পরিমান টর্চার করা হয়েছে তাতে করে যদি রিমান্ড মঞ্জুর করা হয় তাহলে আর সে বেঁচে ফিরতে পারবে কিনা সন্দেহ আছে। এর চেয়ে বেশি টর্চার সহ্য করার ক্ষমতা নিলির নেই।

অনেক ভেবে শেষমেশ নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচার জন্য তথ্য চুরির অপবাদ স্বীকার করার সিদ্ধান্ত সে। এছাড়া আর কোন উপায় নেই। স্বীকারোক্তি না দিলে এরা রিমান্ডে নিয়ে নিলিকে মেরে আধমরা করে ফেলবে। সামান্যতম মায়া দয়াও দেখাবে না।


এদিকে নিলির স্বীকারোক্তি দেওয়ার কথাটা খুব তাড়াতাড়ি অফিসের সবার কাছে পৌঁছে গেলো। পরেরদিন রেজোয়ানের পার্সনাল সেক্রেটারি জাহিদ এলো নিলির সঙ্গে দেখা করার জন্য। কিন্তু তাতে কোন লাভ হলো না। স্বীকারোক্তি ছাড়া পুলিশ নিলিকে জামিন দিতে অস্বীকৃতি জানালো।

ভাগ্যের নির্মম পরিহাস দেখে নিজের ওপর করুণা হলো নিলির। এভাবে তিল তিল করে কষ্ট পাওয়ার চেয়ে তো একবারে মরে যাওয়াই তো ভালো। কিন্তু মরে যাওয়া কি এতই সহজ? চাইলেও মরার কথা ভাবতে পারে না নিলি। অনেকের অনেক ঋণ শোধ করার বাকি আছে তাঁর। সেসব ঋণ শোধ করতে না পারলে যে মুক্তি নেই। অসহ্য বেদনায় বুকের ভেতরটা ভারী হয়ে এলো। কেন সৃষ্টিকর্তা তাঁকে এত দুঃখ দিলেন?

জাহিদের হাত ধরে হুহু করে কেঁদে ফেললো নিলি। অসহায়ের মত করুণা আর্তনাদ করে বললো,’বিশ্বাস করুন স্যার। আমি কোন ইনফরমেশন লিক করি নি। আমি কিচ্ছু জানি না। আমাকে আজিজ সাহেব বলেছিলেন মেইলটা রেজা গ্রুপের কাছে পাঠাতে।’

তাঁর কান্না দেখে জাহিদের মায়া হলো। গতদুইদিন ধরে আজিজের ওপর নজর রাখছে সে। লোকটার ব্যবহার হঠাৎ করেই কেমন যেন সন্দেহ জনক মনে হচ্ছে। কিন্তু সে-ই আসল কালপ্রিট কিনা সে বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারছে না। নরম মোলায়েম কন্ঠে সান্ত্বনা দিয়ে বললো,’আপনি কাঁদবেন না মিসেস নিলি। আমি দেখছি কি করা যায়।’

-‘আপনি আমাকে বাঁচান প্লিজ। আমি আপনার পায়ে পড়ছি।’ বলতে বলতে মেঝেতে বসে পড়লো নিলি। কিন্তু পা চেপে ধরার আগেই তাঁর হাত ধরে ফেললো জাহিদ। পুনরায় সান্ত্বনা দিয়ে বললো,’কি করছেন মিসেস নিলি? আমিতো আপনাকে বলেছি আমাকে একটু সময় দিন। আমি আসল অপরাধীকে ঠিক খুঁজে বের করবো। আপনাকে বিনা অপরাধে কিছুতেই শাস্তি পেতে দেবো না।’ তাঁর কথা শুনে কিছুটা শান্ত হলো নিলি। চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালো। মলিনমুখে খানিকটা হাসার চেষ্টা করে বললো,’সরি স্যার। আমি আসলে আপনাকে বিব্রত করতে চাই নি। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমার কাছে আর কোন উপায় নেই।’

-‘আমি জানি। আপনি কিছু করেন নি। আপনাকে আমি কথা দিচ্ছি,খুবই শীঘ্রই আসল অপরাধী ধরা পড়বে। আপনি প্লিজ ধৈর্য রাখুন। এখন আসছি আমি।’

জাহিদ সেদিন নিলিকে পাহাড় পরিমান ভরসা দিয়ে গেলেও দুঃখের বিষয় হচ্ছে সেদিনের পর থেকে আর একবারও নিলির যোগাযোগ হয় নি তাঁর। মনে মনে হাল ছেড়ে দিলো নিলি। বাঁচার আর কোন সম্ভাবনা নেই। একমাত্র ভরসা ছিলো জাহিদ। সেও গায়েব হয়ে গেছে!

আগামীকাল কোর্টের হিয়ারিং। সময় যত ঘনিয়ে আসলো ভয়টা ততই বাড়ছে নিলির। আজিজের বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নি। অতএব দোষী নিলি। শাস্তি তাঁকেই ভোগ করতে হবে। ভাগ্যকে মেনে নিয়ে নিজেকে মানসিক ভাবে প্রস্তুত করার চেষ্টা করলো নিলি। কিন্তু যতবারই তাঁর প্রতি করা রেজোয়ানের নিষ্ঠুর আচরণগুলোর কথা মনে পড়লো ততবারই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। বিনা অপরাধে মিথ্যে অপবাদের দায়ভার মাথায় নিয়ে শাস্তি পেতে যাচ্ছে নিলি, এবার নিশ্চয়ই রেজোয়ান ভালো থাকবে। খুব খুশি হবে। তাঁর মনের আশা পূরণ হবে। রেজা গ্রুপের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণের টাকাটাও পেয়ে যাবে।

কিন্তু পরেরদিনই অবিশ্বাস্য একটা ঘটনা ঘটলো নিলির সঙ্গে। জাহিদকে সাথে করে রেজোয়ান নিজে এসেছে নিলির সঙ্গে দেখা করার জন্য। জাহিদের হাতে নিলির জামিনের কাগজ পত্র। রেজোয়ানকে দেখে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না নিলি। হতবম্ভ, বিস্মিত চেহারা নিয়ে জাহিদের দিকে চাইলো। জবাবে জাহিদ মুচকি হেসে মাথা দোলালো। সে তাঁর কথা রেখেছে। আসল অপরাধীকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিয়েছে।

সেদিন অন্য একটা নাম্বার থেকে নিলিকে কল করায় আজিজকে ধরতে পারে নি জাহিদ। কিন্তু নিলির ফোনে অটো কল রেকোর্ড সিস্টেম চালু থাকায় দুজনের মধ্যকার কথোপকথন আপনা আপনি রেকোর্ড হয়ে যায়। সেটা থেকেই আজিজের বিরুদ্ধে প্রমাণ জোগাড় করে পুলিশ।

জেল থেকে বেরিয়ে ধীরপায়ে তাঁর সামনে এসে দাঁড়ালো নিলি। তাঁর ঠোঁট ফোলা। মাঝখান থেকে কেটে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। গালের একপাশে কালশিটে পড়ে গেছে। মাথার চুল জটলা বেধে উষ্কখুষ্ক! তাঁর অবস্থা দেখে রেজোয়ানের চোখে পানি চলে আসার জো! নিরব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজেকে সামলে নিলো সে। বুকের ভেতরে পিনপিন ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। কয়েক মুহূর্ত নিরবে দাঁড়িয়ে থেকে বাইরে এসে দাঁড়ালো।

সে বেরিয়ে গেলে নিলিকে সঙ্গে নিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালো জাহিদও। কিন্তু কয়েকমিনিটও দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না নিলি। গাড়িতে বসার আগেই মাথা ঘুরে পড়ে গেলো। ঐ অবস্থায়ই তাঁকে নিয়ে সরাসরি হস্পিয়ালের দিকে রওনা দিলো জাহিদ এবং রেজোয়ান।

আধঘন্টা বাদে নিলির জ্ঞান ফিরলো। জ্ঞান ফিরতে আতংকিত চেহারা নিয়ে চারপাশে চাইলো। বেডের পাশে চেয়ারে বসে আছে রেজোয়ান। নিলিকে চোখ খুলতে দেখে হাতের কাগজ রেখে যথাসম্ভব শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলো,’এখন কেমন লাগছে?’

-‘ভালো!’

-‘কিছু খাবে?’

উপরে নিচে মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো নিলি। কিন্তু রেজোয়ান যখন পাশের টেবিলের ওপর রাখা ফলের ঝুড়ি থেকে একটা আপেল বের করে তাঁর হাতে দিলো তখন বহুদিনের অভুক্তের ন্যায় লজ্জা শরমের বালাই ভুলে সেটার ওপর হামলে পড়লো নিলি। বুভুক্ষের মত তাতে কামড় বসালো। রেজোয়ান চুপ করে তাঁর খাওয়া দেখে গেলো।
মোট মিলে গোটা তিনেক আপেল, তিনখানা ফ্রুট স্যান্ডউইচ এবং প্রায় হাফ কেজি আঙ্গুর খেয়েছে নিলি। তাঁর খাওয়া দেখে রেজোয়ানের মনে হলো আদিমযুগের বনমানুষরা যেমন হুট করে শিকারের সন্ধান পেলে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ঠিক তেমনি করে খাবারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে নিলি।

রেজোয়ানকে চেয়ে থাকতে দেখে বেশ লজ্জা পেলো নিলি। রাক্ষসের মত খেয়েছে সে। তাঁর দৈন্যদশা একেবারে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে রেজোয়ানের সামনে। লজ্জায়, শরমে ভেতরে ভেতরে একেবারে সংকুচিত হয়ে গেলো। এভাবে খাবারের প্রতি লোভ দেখানোটা মোটেই উচিৎ হয় নি। ইতস্তত করে বললো,’ওদের শক্ত রুটি আমি খেতে পারি নি। তরকারিতে ভীষণ ঝাল দেয়…!’

তাঁর কথা শেষ হওয়ার আগেই গলা খাঁকারি দিলো রেজোয়ান। মিথ্যে বলেছে নিলি। জেলে থাকা অবস্থায় একটা আধপোড়া রুটি আর আধবাটি ঝাল আলুর তরকারিকেই অমৃতের মতন খেয়েছে সে। কিন্তু এত অল্প খাবারে ক্ষুধার জ্বালা নিবারণ অসম্ভব।
ভাজির সঙ্গে একটা মরা টিকটিকিও পাওয়ার পরেও সেই খাবারগুলো খেয়েছে সে। কিন্তু সারাদিনের টর্চারের পর সামান্য এই খাবারটুকু পেটের এককোনায়ও পড়তো না। তাই চোখের সামনে খাবার দেখে নিজেকে সামলাতে পারে নি। কিন্তু রেজোয়ানের কাছে ভেতরের দুর্বলতা প্রকাশ করতে চাইলো না। রেজোয়ান হয়ত ভাববে সিমপ্যাথি আদায়ের জন্য মিথ্যা কষ্ট পাওয়ার নাটক করছে সে।

রেজোয়ান সেটা বুঝতে পেরে প্রসঙ্গ পরিবর্তন করতে চাইলো। কিন্তু সে কিছু বলার তার আগেই দরজার কাছ থেকে জাহিদের কন্ঠস্বর শোনা গেলো। হাতে ওষুধপত্র এবং ফলমূল নিয়ে ভেতরে ঢুকলো। ভেতরে ঢুকে নিলিকে উদ্দেশ্য করে উৎফুল্ল স্বরে বললো,’বাহ মিসেস নিলি? আপনার জ্ঞান ফিরে গেছে? এখন কেমন লাগছে? আগের চাইতে ভালো?’

জবাবে মলিন মুখে সামান্য হাসলো নিলি। জাহিদ ওষুধের বোতলগুলো তাঁর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,’এই নিন আপনার ওষুধ। নিয়ম করে খাবেন। রক্তশূন্যতা দেখা দিয়েছে আপনার। গাফিলতি দিলে চলবে না।’
তারপর বিলের কাগজটা রেজোয়ানের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,’খরচের হিসেব স্যার। বিল আমি জমা করে দিয়েছি। ডাক্তার বলেছেন ভয়ের কোন কারণ নেই। তবে কিছুদিন অবজারভেশনে রাখতে হবে!’

রেজোয়ান চুপচাপ বিলের কাগজটা হাতে নিয়ে দেখলো। দেখা শেষে সেটা পুনরায় জাহিদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,’উনাকে বলবেন, সামনের মাসে এই টাকাটা উনার বেতনের অংশ থেকে কেটে নেওয়া হবে।’

রোগীর সামনে এই ধরণের কথাবার্তায় বেশ বিব্রত হলো জাহিদ। চট করে নিলির মুখের দিকে চাইলো। চোখভর্তি পানি নিয়ে নিজের অসহায়ত্ব লুকানোর চেষ্টা করছে মেয়েটা। হস্পিটালের খরচ বহন করার মতন সামর্থ্য তাঁর নেই। জাহিদকে উদ্দেশ্য করে বললো,’শুধুশুধু হস্পিটালের বিল বাড়িয়ে কি লাভ। অযথা পয়সা নষ্ট! আপনি বরং আজই আমার রিলিজের ব্যবস্থা করে দিন।’

জবাবে জাহিদ ইতস্তত করে বললো,’কিন্তু সেটা তো সম্ভব নয় মিসেস নিলি। আপনি অলরেডি অ্যাডমিট হয়ে গেছেন। কালকে ছাড়া রিলিজ সম্ভব না। এদিকে কালকে আবার হস্পিটালের বড় ডাক্তার ছুটি আছেন।উনাকে না দেখানো পর্যন্ত আপনি রিলিজ নিতে পারবেন না। আপনার শারীরিক কন্ডিশন সেটা পারমিট করবে না।’

-‘কিচ্ছু হবে না। আমি এখন একদম সুস্থ আছি। আপনি প্লিজ আজকেই রিলিজের ব্যবস্থা করুন।’

-‘আপনি বুঝতে পারছেন না মিসেস নিলি ওরা এখন দেবে না আপনাকে রিলিজ।’

-‘প্লিজ। একবার অন্তত চেষ্টা করে দেখুন।’

ফোন স্ক্রল করার বাহানায় চুপচাপ বসে দুজনের কথাবার্তা শুনছিলো রেজোয়ান। কিন্তু আর পারলো না। অসুস্থ শরীরে নিলির রিলিজ নেওয়ার তাড়া দেখে উঠে বেরিয়ে গেলো। বড্ড অসহায় লাগছে তাঁর।একনিমিষেই সব কিছু অর্থহীন মনে হচ্ছে। এতকিছুর পরেও একটা স্বার্থপর লোভী মেয়ের জন্য কেন এত কষ্ট হচ্ছে সে নিজেও বুঝতে পারছে না।

মানুষ চাইলেও অনেক সময় অনেক কিছু ভুলতে পারে না। তেমনি করে রেজোয়ানও পারছে না। হাজার চেষ্টা করেও সে ভুলতে পারছে না এই স্বার্থপর,লোভী মেয়েটাকেই একদিন নিজের চাইতে বেশি ভালোবেসে ছিলো সে। তাঁর সমস্ত কিছুর ওপর সবচেয়ে বেশি অধিকার ছিলো নিলির। অথচ সবচেয়ে বেশি ঘৃণা এখন তাঁকেই করতে হচ্ছে। একজন প্রেমিকের জন্য এরচাইতে দুঃখের, এর চাইতে বেদনার আর কি হতে পারে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here