‘ একদিন তুমিও ভালোবাসবে ‘ 🌸❤️
||পর্ব~৩৫||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা
৫২.
কোয়েল রাজের পিছু নিয়ে এসে দেখলো রাজ ভার্সিটির বাইরে নিজের গাড়ির উপর এক হাত রেখে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষন আগের ঘটনার কথা মনে পড়তেই কোয়েল একটা শুকনো ঢোঁক গিললো আর ধীর পায়ে এগোতে লাগলো। রাজের পিছনে দাঁড়িয়ে বড়ো একটা নিশ্বাস নিয়ে রাজের কাঁধে হাত রাখলে রাজ মাথা তুলে কোয়েলের দিকে ফেরে। কোয়েলকে দেখে রাজ পকেটে হাত গুঁজে গাড়ির সাথে ঢেলান দিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে, সেই দেখে কোয়েল প্রশ্ন করে,
কোয়েল: এতক্ষন কোথায় ছিলে তুমি? আর আদিত্যদা এটা কি করলো? এভাবে জিয়াকে সবার সামনে অপদস্ত করার ফলে তো পরেশবাবু আরো ক্ষেপে যেতে পারেন। তখন কি…
রাজ: সৌভিক এর আগে কবার তোর সাথে কথা বলার বাহানায় তোকে ছোঁয়ার চেষ্টা করেছে?
কোয়েলকে বলতে না দিয়ে রাজ হঠাৎই হিম কণ্ঠে নিজের চাহুনি স্থির রেখে যেই প্রশ্নটা করলো সেটা কোয়েলকে ঘাবড়ে দিলো পুরোপুরি। কোয়েল কি উত্তর দেবে ঠিক করতে পারছে না ঠিক সে সময় রাজ আবার বললো,
রাজ: কিছু জিজ্ঞেস করেছি আমি?
কোয়েল: না, আমাকে কিছু করেনি। মৌকে প্রথম দিন থেকে ডিস্টার্ব করছিল জিয়ার সাথে…
রাজ: (কোয়েলের চোখের দিকে তাকিয়ে) মৌমিতা আসার আগে?
কোয়েল এবার মাথা নামিয়ে নিলো। কোয়েল জানে সে বেকার মিথ্যে কথা বলছে রাজকে কারণ রাজ সবই জানে। হুট করে চলে গেছিলো ঠিকই কিন্তু খোঁজ রাখেনি তা নয়। সব সময়ই খোঁজ রাখতো তা কোয়েল নিজেই জানতে পেরেছে এছাড়া আদিত্য তো ছিলোই খোঁজ দেওয়ার জন্যে। তাই সৌভিক কতবার কোয়েলকে বিরক্ত করেছে সেটাও রাজের জানার কথা। এটা কোয়েলের ধারণা, কোয়েল জানে না রাজের সম্পর্কে আদিত্যও কিছু জানতো না। সব বুঝেও কোয়েল মিথ্যেটা বলতে চাইছিলো কারণ এখন এমনিতেই রাজ সৌভিকের উপর রেগে আছে তার উপর কোয়েল সব সত্যি বলে দিলে আরো খারাপ হতে পারে বিষয়টা। কিন্তু শেষরক্ষা হবে বলে মনে হচ্ছে না আপাতত কোয়েলের। কোয়েল রাজের মুখের দিকে তাকালে দেখলো রাজ এখনও একভাবে ওর দিকে তাকিয়ে আছে,
কোয়েল: এখন এই নিয়ে কথা বলাটা কি জ…
কোয়েল রাজের চোখের দিকে তাকিয়ে আটকে গেলো। প্রত্যেকবার এমনই হয়, সে আটকে যায় ছেলেটার চোখে। মন চায় না তখন কিছু লুকোতে। বেশিরভাগ সময় ছেলেরা মেয়েদের চোখে আটকায় কিন্তু কোয়েলের ক্ষেত্রে বিষয়টা উল্টো। আর না পেরে বলেই দিলো সে,
কোয়েল: তুমি চলে যাওয়ার পরেই বিরক্ত করা শুরু করেছিল। ও ভার্সিটিতে ফাস্ট ইয়ারে থাকলেও আমার স্কুল থেকে ফেরার সময় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতো। আমি এড়িয়ে যেতে গেলে একদিন হাত ধরেছিল আর আমি চড় মেরে দিয়েছিলাম। তারপর থেকে ও কিছু ক্ষতি করতে পারে এই ভেবে আমি আদিত্যদাকে আনতে যেতে বলেছিলাম আমায় কিন্তু কিছুদিন পর থেকে দেখলাম সৌভিকদা আদিত্যদার সাথে আসতে শুরু করলো। আদিত্যদার চোখের আড়ালে আমাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করেছিল ঠিকই কিন্তু পারেনি।
কোয়েল কথা শেষ করতেই রাজ কোয়েলের দিকে সরু দৃষ্টিতে তাকালে কোয়েল মুখ কাঁচুমাচু করে আমতা আমতা করতে করতে বললো,
কোয়েল: ইয়ে মানে প্রথমবার আদিত্যদার থেকে আড়ালে হাত ধরে ছিল তারপর থেকে আমি সতর্ক থাকায় কিছু করতে পারেনি। (মনে মনে– জমরাজ একটা! বলিয়েই ছাড়লো। হুহ!)
রাজ কোয়েলের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিজের সানগ্লাসটা পরে নিয়ে কোয়েলকে বললো,
রাজ: ভার্সিটি যা। ক্লাস আছে তো?
কোয়েল: তুমি কোথায় যাচ্ছো?
রাজ: কাজ আছে।
রাজের মুড ভালো নেই বুঝে কোয়েল রাজের হাত ধরে বাঁধা দিলো। রাজ কোয়েলের দিকে তাকালে রাজের চোখ থেকে সানগ্লাসটা খুলে নিয়ে কোয়েল বললো,
কোয়েল: কাওকে মারতে ধরতে যেতে হবে না। আমার সাথে ভার্সিটি চলো, গল্প করবো।
রাজ: আমি এখানে থেকে গেলেই তুই যেই জিনিসটা নিয়ে ভয় পাচ্ছিস সেটা হবে। তাই আমার চলে যাওয়াটাই ভালো হবে। এই পরিস্থিতিতে আমি নিজের মাথাটা ঠান্ডাই রাখতে চাই যেটা সৌভিককে দেখলে সম্ভব নয়। (কোয়েলের হাতের উপর হাত রেখে) তুই যা।
কোয়েল: তাহলে আদিত্যদা এমনটা করলো কেন?
রাজ: মৌমিতার পছন্দ না তাই। আগের দিন মে বি মৌমিতার কথার দ্বারা আদি বুঝেছিল যে, জিয়াকে এভাবে ইউস করাটা মৌমিতার পছন্দ না। এছাড়া আদিরও ভালো লাগে না, অন্য সময় হলে ব্যাপারটা আলাদা ছিল।
কোয়েল: মৌকে এই বিষয়টা আমার বলা উচিত তাই না? তাহলে ওদের মধ্যে দূরত্বটা আরেকটু কমবে। (উত্তেজিত হয়ে),
রাজ: একদমই না। মৌমিতা নিজে ফীল করুক যে আদি ওকে ভালোবেসে বদলে গেছে। তাহলেই ওদের মধ্যে দূরত্বটা কমবে। যেমন আদি নিজে থেকে ফীল করেছিলো, শুধু বুঝতে পারছিল না ফিলিংসটা কি? তখন আমি হেল্প করেছি। খুব তাড়াতাড়ি মৌমিতাও এই পজিশনে আসবে, তখন তুই বলিস। আসছি।
কোয়েল: কোথায় যাচ্ছো সেটা তো বলো? ওই টিনা ফিনার কাছে নাকি? (সরু চোখ করে)
এতক্ষনে রাজের ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো। বাঁকা হেসে উত্তর দিলো,
রাজ: হ্যাঁ।
কোয়েল: কি? (জোরে, রেগে)
রাজ: (অবাক হয়ে) কাম ডাউন কোয়েল। ও আর আমি এক অফিসে কাজ করি তাই বললাম কথাটা।
কোয়েল: সেই জন্যই এতো অফিস যাওয়ার তাড়া। কালকেও তাড়াহুড়ো করে গেলে আর আজকে সকালে আদিত্যদার সাথে এলে না। আসছি!
কোয়েল এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে হনহনিয়ে পিছন দিক ফিরে হাঁটা শুরু করলো। রাজ তো বেকুবের মতো দাঁড়িয়ে আছে, বুঝেই উঠতে পারলো না ব্যাপারটা কি হলো, রানিং কি বলে গেলো কোয়েল। বুঝে উঠে সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে বললো,
রাজ: বিকেলে নিতে আসবো। (হেসে)
রাজের কথাটা শুনে কোয়েল দাঁড়ালো কিন্তু রাজের দিকে ফিরলো না। আবার হাঁটা শুরু করলো, রাজকে বোঝালো সে শুনেছে। রাজ সামান্য হেসে সানগ্লাসটা পড়তে গেলে দেখলো ওটা নেই। থাকবে কি করে? ওটা তো কোয়েল নিয়ে চলে গেছে। রাজের আর কি করার, ও চুপচাপ চলে গেল ওখান থেকে।
৫৩.
আমি এদিক ওদিক কোয়েলকে খুঁজছি এমন সময় আমার ফোন বেজে উঠলো। আমি ফোন ব্যাগ থেকে বার করতেই দেখলাম শ্বাশুড়ি মা ফোন করেছেন।
মৌমিতা: হ্যাঁ মা, বলুন।
শ্বাশুড়ি মা: কি আর বলবো? আমার আর কিছু বলার নেই।
মৌমিতা: কেন মা? কি হয়েছে? (ঘাবড়ে গিয়ে)
শ্বাশুড়ি মা: তুই জানিস না? আমি যে কদিন ধরে এখানে আছি তা টের পেয়েও তুই একবারও দেখা করতে এলি না আমার কাছে। (মন খারাপ করে)
মৌমিতা: (জিভ কেটে) আসলে মা, পড়ার চাপটা একটু বেশি তো তাই যেতে পারিনি। খুব তাড়াতাড়ি যাবো আর গিয়ে দেখা করে আসবো।
শ্বাশুড়ি মা: থাক, থাক। আর বাহানা দেওয়া লাগবে না। একদিন একটু সময় করে আসিস, কতদিন কথা হয় না ঠিক মতো তোর সাথে।
মৌমিতা: (হেসে) আসবো। ঠিক মতো খাওয়া-দাওয়া করছেন তো আপনি?
শ্বাশুড়ি মা: হ্যাঁ। তুই?
মৌমিতা: করছি মা। আচ্ছা আমি এখন রাখি? ক্লাসে যেতে হবে।
শ্বাশুড়ি মা: ঠিক আছে।
আমি ফোন রেখে কোয়েলের দিকে তাকালাম। কথা বলার মাঝখানেই কোয়েল আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে ছিলো। কোয়েলের হাতে একটা সানগ্লাস দেখে আমি জিজ্ঞেস করলাম,
মৌমিতা: এটা কার?
কোয়েল: জমরাজের। আবার কার?
মৌমিতা: (হেসে) তুই নিয়ে এসেছিস কেন?
কোয়েল: আরে ভুল করে। যাই হোক, চল ক্লাসের জন্য লেট হচ্ছে।
আমরা ক্লাসে চলে গেলাম। কিন্তু ক্লাস শুরু হওয়ার কিছুক্ষন পর থেকেই হঠাৎ করে কোয়েল অন্যমনস্ক হয়ে গেলো। মাঝে একবার ফোন চেক করেছিল, তারপর থেকেই এমন করছে। বার বার করে টাইম দেখছে জানো ওর কোনো কিছুর তাড়া। রাজদার কি কিছু হলো? না, সেটা হলে তো কোয়েল আমাকে বলতো। তাহলে কি এমন ব্যাপার? এই করতে করতেই ক্লাস শেষ হওয়ার ঘন্টা পড়লো। আমি বেরিয়ে কোয়েলকে কিছু জিজ্ঞেস করবো তার আগেই কোয়েল আমাকে বলে উঠলো,
কোয়েল: মৌ, তুই চলে যা। আদিত্যদা ওয়েট করছে তোর জন্য। আমার একটু কাজ আছে, আমি আসছি।
মৌমিতা: কি কাজ?
কোয়েল: পরে বলবো। আসছি আমি।
মৌমিতা: রাজদা ঠিক আছে তো?
কোয়েল: হ্যাঁ, ও ঠিক আছে।
কোয়েল চলে গেলো হুরপার করে। আমিও বাইরের দিকে হাঁটা ধরলাম। মাথার মধ্যে অনেক কিছু ঘুরছে কিন্তু কিছুতেই হিসেব মেলাতে পারছি না। কেন জানো মনে হচ্ছে আমি জানি কোয়েল কোথায় গেল কিন্তু সিওর হতে পারছি না। এইসব ভাবতে ভাবতেই আদিত্যের গাড়ির সামনে পৌঁছে গেলাম। উনি আমাকে চিন্তিত দেখে জিজ্ঞেস করলেন,
আদিত্য: কি হয়েছে?
মৌমিতা: হম? না, কিছু না।
আদিত্য: কোয়েল কোথায়?
মৌমিতা: জানি না। বললো কি একটা কাজ আছে। আমাকে তো চলে যেতে বললো আপনার সাথে।
আদিত্য: ওহ বুঝে গেছি। (হেসে)
মৌমিতা: কি বুঝেছেন? (গম্ভীর ভাবে)
আদিত্য: রাজ আসবে ওকে নিতে আবার কি? (হেসে)
মৌমিতা: সত্যি কি শুধু তাই? (আনমনে)
আদিত্য: তা নয় তো কি। আমিও যেমন চিন্তা করি রাজও তেমন চিন্তা করে…
আদিত্যের কথা শেষ হওয়ার আগেই আমি ওনার দিকে সরু দৃষ্টিতে তাকালে উনি আমতা আমতা করে বলেন,
আদিত্য: কোয়েলের! আমিও যেমন কোয়েলের চিন্তা করি, রাজও করে। সেটাই বলছিলাম। চলো, পৌঁছে দি তোমায়।
আমি হেসে ফেললাম উনি পিছন ঘুরতেই। কিন্তু ভার্সিটির দিকে তাকাতেই আবার চিন্তা হতে লাগলো। কেন জানো একটা খটকা লাগছে।
আদিত্য: আসবেন তো ম্যাডাম? কতক্ষন ওয়েট করিয়ে রাখবেন ড্রাইভারকে?
মৌমিতা: উফ! অসহ্য।
আমি গাড়িতে বসলে উনি গাড়ি স্টার্ট করেন আর আমি সকালে মায়ের ফোন করার কথা ওনাকে বলতে শুরু করি।
অন্যদিকে,
রাজ: ক্লাস শেষ হয়েছে অনেক্ষন হয়ে গেলো। মানছি আমি ১৫ মিনিট লেট করেছি বাট ওর মধ্যে ও বেরিয়ে গেছে? আমার আগে বেরিয়ে যদি থাকে তাহলে তো আমাকে ফোন করতো, সেটাও তো করেনি। তাহলে কি বেরোয়নি এখনও? ওহ, ম্যাডামের তো আবার লাইব্রেরিতে সময় কাটানোর অভ্যেস। ওখানেই আছে নিশ্চিত তাই জন্যেই ফোন সাইলেন্ট।
রাজ গাড়ির সামনে অনেক্ষন অপেক্ষা করার পর নিজের মনে কথাগুলো বলে ভার্সিটিতে ঢুকে লাইব্রেরির দিকে চলে গেলো। লাইব্রেরিতে গিয়ে দেখলো কোয়েল সেখানে নেই। ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে বাইরের দিকে আসতে গেলেই রাজ দাঁড়িয়ে যায়….
[#ফিরে_আসবো_আগামী_পর্বে🥀]
আইডি- কোয়েল ব্যানার্জী