তোর শহরে ভালোবাসা পর্ব-১ এবং ২

0
1655

#তোর_শহরে_ভালোবাসা💜
পর্ব-১
#ফাবিহা_নওশীন

“এই মেয়ে শোনো,আমার ঘরে কিংবা আমার মনে কোথাও তোমার কোনো জায়গা নেই। শুনতে পাচ্ছো তুমি?”
বরের এমন কথা শুনে পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে সামান্তার। নিজের রাগকে সামলে রাখতে না পেরে ঝাঝালো গলায় জবাব দিলো,
–শুনেছি,ভালো করেই শুনেছি। আমি বয়রা না। এভাবে চেঁচাচ্ছেন কেন? না গেলাম আপনার ঘরে। আপনার ঘরে যাওয়ার জন্য আমি মরে যাচ্ছি না। যাবো না আপনার ঘরে। অদ্ভুৎ।
আন্টি আপনাদের বাসা দেখে যথেষ্ট বড় মনে হচ্ছে। আমাকে অন্য রুম দেখিয়ে দিন। আর নয়তো বলুন আমি চলে যাচ্ছি। এ বাড়িতে পড়ে থাকার জন্য আমি মরে যাচ্ছি না।

সামান্তার কথা শুনে আদিল থ হয়ে গেলো। ও সামান্তার কাছ থেকে এমন উত্তর আশা করেনি। ও ভেবেছিলো সামান্তা মাথা নিচু করে কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বলবে, জি। কিন্তু এ তো পুরাই লাল মরিচের গুড়ো।

সামান্তার ননদ নিশি বললো,
তুমি একা বাসায় যেতে পারবে?

সামান্তা বললো,
–কেন পারবোনা? আমি ওত পড়াশোনা না জানলেও বাসায় যাওয়ার মতো যথেষ্ট বিদ্যে আমার পেটে আছে।

সামান্তার শাশুড়ী আমতা আমতা করে সামান্তাকে বললো,,
–না না মা,তোমাকে কোথায় যেতে হবে না। আমি তোমাকে অন্য রুম দেখিয়ে দিচ্ছি।
সামান্তা শাশুড়ীর পিছু পিছু হাঁটা ধরলো।
আদিল ফ্যালফ্যাল করে সামান্তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো।

–কিরে কি দেখিস ভাইয়া?

নিশির কথায় ওর ঘোর ভাংলো। তারপর বললো,
–মেয়ে দেখেছিস কি তেজ?

নিশি বললো,
–দেখতে হবে না বউটা কার?
বলেই নিশি ভাইকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো।
আদিলের প্রচুর রাগ হচ্ছে। নিজের চুল নিজের ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। কেন গিয়েছিলো গ্রামে ঘুরতে।

সামান্তা দরজা লক করে ওড়না ছুড়ে ফেলে দিয়ে ওয়াশরুমে গেলো। প্রচুর রাগ হচ্ছে। মাথা গরম হয়ে গেছে। মাথায় ইচ্ছেমতো পানি দিয়ে মাথা ঠান্ডা করলো। তারপর হাতমুখ ধুয়ে রুমে এসে ফুল পাওয়ারে ফ্যান অন করে চুলের খোপা খোলে নিজের চুলগুলো এলিয়ে দিয়ে হাত পা সটান করে শুয়ে পরলো।

রাগে ফুসফুস করছে আর বলছে,
শালা,এই সামু কত ছেলেকে সোজা করেছে আর তুই তো……বর বলে গালিটা দিলাম না। যাইহোক তোকে যদি নাকে দড়ি দিয়ে না ঘুরিয়েছি তবে আমার নাম ও সামু না। আজ থেকে আমার একটাই টার্গেট বর তোকে টাইট দেওয়া। তোর এটিটিউটের কিমা বানিয়ে তোকে গিলাবো। যদি না পারি তবে নিজের নাম ছকিনা রাখবো।

অতীত,,

আদিল চৌধুরী,বিখ্যাত পলিটিশিয়ান এবং বিজনেসম্যান আহনাফ চৌধুরীর ছেলে। বয়স ২৫। সাত বছর পর পড়াশোনা শেষে বিদেশ থেকে দেশে ফিরেছে। আহনাফ চৌধুরী দীর্ঘসময় পর ছেলেকে পেয়ে যতটা না খুশি তার চেয়ে বেশি সংকিত ছেলের চাল-চলন দেখে। আদিল যথেষ্ট হাসিখুশি হলেও অনেক অহংকারী। আশেপাশের কাউকে পাত্তা দেয় না। নিজের মতো চলে। নিজের জিদ আর ইগো বজায় রাখতে সবকিছু করতে পারে। পছন্দসই কিছু না হলেও ভাংচুর শুরু করে।
রাত-বিরাতে বাড়ি ফিরে। কোথায় যায়,কি করে তা সবার অজানা হলেও আহনাফ চৌধুরীর অজানা নয়। আদিল পুরো দুনিয়ায় কাউকে পরোয়া না করলেও বাবাকে ভিষণ ভয় পায়। বাবার সামনে মাথা নিচু করে কথা বলে। কিন্তু আহনাফ চৌধুরীর পক্ষ ছেলেকে সারাক্ষণ শাসন করা সম্ভব নয়। তিনি ব্যস্ত মানুষ। তাই তিনি ছেলেকে বিয়ে দিয়ে সংসারী করার সিদ্ধান্ত নেন। আর মেয়ে হিসেবে বাল্যবন্ধু মিরাজের মেয়ে সামান্তাকে তার মনে ধরেছে। মেয়েটা খুব ভালো। মেয়েটা যেমন শক্ত প্রয়োজনে তেমনি নরম, যথেষ্ট বুদ্ধিমতী, সুন্দরী।

ডিনার সময়-
চৌধুরী ম্যানশনে পুরো পরিবার একসাথে ডিনার করছে।
আহনাফ চৌধুরী বলল,
–আদিল,আগামীকাল আমরা গ্রামে বেড়াতে যাচ্ছি।তুমিও যাবে সব গোছগাছ করে রাখবে।
আদিল খাওয়া থামিয়ে বলল,
–গ্রামে?
–হুম।আমার বন্ধুর বাড়ি।
আদিলের গ্রামে ঘুরতে যাওয়া নিয়ে সমস্যা নেই।বরং ও অনেক এক্সসাইটেড। ও বিদেশে থাকতে বন্ধুদের কাছে থেকে গ্রাম সম্পর্কে অনেক কিছু শুনেছে। তাতে ওর গ্রাম দেখার আগ্রহ বেড়ে যায়।
–ওকে বাবা। আই হেভ নো প্রব্লেম।

আদিলের ছোট বোন নিশিতা। বয়স ২১।অনার্স ৩য় বর্ষে পড়ে। মেয়েটা খুবই মিশুক। আদিলের একদম উল্টো। সহজ,সরল অহংকার বলতে কোনো কিছু তার মধ্যে নেই। গ্রামে যাওয়ার কথা শুনে সকাল থেকেই গুছানো শুরু করে দিয়েছে।
আদিলের মা নয়ন তারা। তিনিও মেয়ের মতোই নিরংকারী,সুন্দর মনের মানুষ।

দীর্ঘ সময়ের জার্নি শেষে একটা বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামলো। দেয়ালে ঘেরা দুতলা বাড়ি। বাড়ির চারপাশে অসংখ্য গাছগাছালি। দরজার সামনে থেকেই সৌজন্যের সাথে সবাইকে ওয়েলকাম করলো চৌধুরী পরিবারকে। যথেষ্ট আদর আপ্যায়ন করা হলো। সবাইকে রুম দেখিয়ে দেওয়া হলো। আদিলের সবকিছু ভালো লাগলেও গ্রামের গরম সহ্য হচ্ছেনা। এখানে এসি নেই। ফ্যানের ফুল পাওয়ার দিয়েও শরীর ঠান্ডা করতে পারছে না তাই শাওয়ার নিতে গেলো। কিন্তু বাথরুমে বাথটাব নেই। কোনো রকমে শরীর ঠান্ডা করে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো।
দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে ভাইবোন মিলে গ্রাম দেখতে বের হলো। সাথে গিয়েছে সামান্তার ছোট ভাই সামির। বয়স ১৩। সামির ওদেরকে গ্রাম দেখাচ্ছে। নিশি তো সেল্ফি তুলতে তুলতে শহিদ হয়ে যাচ্ছে।
আদিলের গ্রাম খুব ভালো লাগছে। আঁকাবাকা পথ,গাছগাছালি,পুকুর-ডোবা,পুকুরে হাস পাক পাক করছে,খোলা আকাশ,ধান খেত,বিভিন্ন নাম না জানা শস্য ফলে রয়েছে।
হিমেল হাওয়ায় আদিলের চুল উড়ছে। অন্য রকম অনুভূতি হচ্ছে। বেশ ভালো লাগছে। মাঝে মাঝে ছবি তুলছে।
সবচেয়ে ভালো লেগেছে গ্রামের পাশে বয়ে যাওয়া নদী। নদীতে ছোট ছোট নৌকা চলছে। নিশি তো নৌকায় চড়বে বলে জিদ ধরেছে। কিন্তু সন্ধ্যা নেমে আশায় ওদের আর নৌকায় চড়া হলো না।

সামান্তা গিয়েছে মামার বাড়ি। এইচ.এস.সি. রেজাল্ট পাবলিশ হয়েছে। গ্রেট পয়েন্ট ভালো না হওয়ায় মন খারাপ তাই মামার বাড়ি ঘুরতে গেছে। গ্রেট পয়েন্ট ভালো কি করে হবে। যে মেয়ে পড়াশোনা ছেড়ে দস্যিপনা আর উদ্ভট কাজ করে বেড়ায় সে আর কি রেজাল্ট করবে। তবে এ নিয়ে বাবামায়ের কোনো আক্ষেপ নেই। বড় আদরের মেয়ে।

আদিল আর নিশি গ্রাম দেখে খুশি মনে বাড়ি ফিরেছে। সন্ধ্যায় আড্ডা দিতে দিতে আহনাফ চৌধুরী মিরাজকে নিজের ছেলের সাথে তার মেয়ের বিয়ের কথা বলল। প্রথমে মেয়ে ছোট বলে আমতা আমতা করলেও বন্ধুর রিকুয়েষ্ট রাখতে রাজি হয়ে গেলেন। সামান্তাকে যে আহনাফ প্রচন্ড ভালোবাসে সে তার অজানা নয়। মেয়ের সাথে তার অনেক সখ্যতা।
সামান্তার মায়ের সাথে আহনাফের প্রস্তাবের কথা জানালে তিনি অমত করেনি।
মিরাজ সাহেব মেয়েকে ফোন করে বাড়ি ফিরতে বললেন। সামান্তা সকালের নাস্তা সেড়েই বাড়িতে এসে পড়লো ড্রয়িংরুমে আহনাফ আংকেলকে দেখে খুশিতে দৌড় দিলো। আহনাফও সামান্তাকে দেখে বেশ খুশি।
সামান্তা আহনাফ আংকেলের পাশে বসেই রাজ্যের গল্প জোরে দিলো। আহনাফ আংকেলও সাথে গল্প করেই যাচ্ছে থামার নামে নেই। দুপুরে তাদের গল্প থামলো। সামান্তা নিজের রুমে গিয়ে একটা মেয়েকে শুয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
–কে আপনি?
নিশি ওকে দেখে অবাক হয়ে বলল,
–তুমি কে?
–আমি সামু,,মানে সামান্তা। এই বাড়ির মেয়ে। এইটা আমার রুম।
–ওহ,,বুঝতে পেরেছি। আমি নিশিতা। তুমি আমাকে নিশি বলে ডাকতে পারো।
সামান্তা উৎসাসিত হয়ে বললো,
–তুমি নিশি আপু। আহনাফ আংকেলের মেয়ে?
–হুম।
–আই এম সরি। আমি জানতাম না যে তুমিও এসেছো।
–ইটস ওকে। আমি কি তোমার রুমে থাকতে পারি?
— অবশ্যই কেন নয়।

দুজনে মিলে প্রচুর গল্প দিলো। মিশুক মনের হলে যা হয়। একজন যেন অন্য জনের বান্ধবী। কতদিনের চেনা। দুজনের মধ্যে বেশ ভাব হয়ে গেছে।

দুপুরের খাবার খেয়ে সামান্তা ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পরলো। তাই নিশি আর ওকে ডাকেনি। আদিল,আর সামিরের সাথেই গ্রাম দেখতে বের হলো। এর মাঝে আদিলের সাথে সামান্তার একবারো দেখা হয়নি।
নিশি আজ নৌকায় উঠেছে। পানিতে হাত দিচ্ছে আর বলছে সামির তুমি আরেকটু বড় হলেনা কেন?
সামির বললো,
–কেন আপু?
–তুমি আরো বড় হলে আমি তোমাকে বিয়ে করে এখানে থেকে যেতাম।
আদিল সেটা শুনে বলল,
–শাট আপ নিশি গ্রাম বেড়ানোর জন্য পারফেক্ট আজীবন থাকার জন্য নয়।
–উহহ,,
সামির তোমার বোন তো বেশ কিউট একদম তোমার মতো।
আদিল জিজ্ঞেস করল,
ওর আবার বোন আসলো কই থেকে? দুদিনে তো কাউকে দেখিনি।
–মামা বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলো। আজ সকালে এসেছে। দুপুরে খেয়ে ঘুমিয়েছে তাই আর ডাকিনি। মেয়েটা এত্ত ভালো কি বলব। দেখতেও বেশ।
আদিল নিশির কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, তুই একটা চিজই। সব মেয়েই তোর কাছে কিউট। নিজেকে একটু বদলা খেত কোথাকার।

আদিল বাসায় ফিরে ছাদে উঠে দেখে একটা মেয়ে ছাদ থেকে নিচের দিকে ঝুঁকে আছে,কিছু একটা দেখার চেষ্টা করছে। লালচে আঁকাবাঁকা খোলা চুল। ঝুঁকে থাকায় আর চুল খোলা থাকায় ফেস দেখা যাচ্ছেনা। পিঠের কাছের চুলগুলো ভাগ হয়ে একভাগ নিচের দিকে হেলে পড়েছে আর একভাগ পিঠের উপর রয়েছে। হালকা গোলাপি রঙের ড্রেস পড়া। এক হাত দেখা যাচ্ছে। ফরসা হাতে মেহেদী দেওয়া। আদিল বুঝতে পারলো এটা সামিরের বোন নিশি যার কথা বলেছিলো। আদিলের ওর মুখটা দেখার ইচ্ছে হচ্ছে কিন্তু নিজের ইগো আর অহংকারের জন্য ছাদ ত্যাগ করলো একটা গ্রামের মেয়েকে দেখার জন্য বেহায়া হবে না।

রাতের বেলায় ডিনার শেষে আদিল শুয়ে শুয়ে ফোন টিপছে তখনই মা আর বোনের প্রবেশ।
–কিছু বলবে মা?
–ভাইয়া,ফোন রাখ। খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা। ইটস আর্জেন্ট।
আদিল ফোন রেখে নিশির মুখের দিকে চাইলো। ওর মুখ দেখে বুঝতে পারলো সিরিয়াস কিছু একটা হয়েছে।
আদিলের মা আমতা আমতা করে বলল,
–তোর বাবা তোর বিয়ে ঠিক করেছে সামান্তার সাথে।
আদিল শুয়া থেকে উঠে বলল,
–হুয়াট!! ইটস এ জোক?
–ভাইয়া সিরিয়াস। আগামীকাল সকালে বিয়ে। বাবা তোকে জানাতে বলেছে তাই জানালাম।
–ইম্পসিবল। আমি গাইয়া কোনো মেয়েকে বিয়ে করবোনা। আর আমার বয়স কত ২৫। এটা কি বিয়ের বয়স?
–তাতে কি সামুরও তো ১৮বছর। মেয়েটা খুব সুন্দরী আর খুব ভালো। বিয়ে করে নে।
–চুপ করবি তুই?
–আমাকে চুপ করিয়ে লাভ নেই। বিয়ে তোকে করতেই হবে।

সত্যিই করতে হয়েছিলো। পরেরদিন সকালে বাধ্য হয়েই বিয়ে করতে হয়েছে। বিয়ে করেই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো।
সামান্তার বাড়িটা বেশ পছন্দ হলেও বাড়ির বাইরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কালো পোশাকের গার্ডগুলোকে পছন্দ হলোনা।
নিশি সামান্তাকে আদিলের ঘরে দিয়ে এসে।আর আদিল ফ্রেশ হয়ে সামান্তাকে দেখেই ক্ষেপে যায়।এই প্রথম ও সামান্তাকে দেখলো তবে ভালো করে নয়।ওর হাত ধরে টানতে টানতে নিচে নিয়ে গিয়ে কথাগুলো বলল।

বর্তমান —
চিতকার চেঁচামেচিতে সামান্তার ঘুম ভেঙে গেলো।
আহনাফ চৌধুরী সব জানতে পেরে অনেক রেগে যায়। আর নিশিকে পাঠায় আদিলকে ডাকতে।
নিশি ডাকতে গেলে আদিল বলে,
–আমি কোথাও যাবো না,তুই বাবাকে গিয়ে বল ওই মেয়েকে বিদায় করতে।
–বাবা তোকে বিদায় করে দিলেও সামান্তাকে করবে না। তোর সমস্যা কি মেয়েটা দেখতে সুন্দর, চেহারার কাটিন ভালো সব দিকেই পারফেক্ট।
–সুন্দরী হলেও আদিলের বউ হওয়া যায় না। যোগ্যতা লাগে।
–তুই কি ওর সাথে মিশেসিছ? তাহলে কি করে বুঝলি
–আমার বুঝার দরকার নেই। তুই বের হ।

নিশি বাবার কাছে গিয়ে সব বললেই ওনি আরো রেগে যায়।
আদিলের মা বলল,
–তোমার ছেলে বোমের মতো। কখন বিস্ফোরিত হয় বলা মুশকিল।
আহনাফ চৌধুরী ছেলের ঘরের দিকে যেতে নিলেই সামান্তা বাঁধা দেয়।
–আংকেল। ছেড়ে দিন। আমি ঠিক আছি। আমি জোর করে কিছু চাইনা।
–কিন্তু,,
–কোনো কিন্তু নয়। আমার উপর ভরসা রাখো। তোমার ছেলে যদি বোমা হয় তবে আমি বারুদ। আমি ওকে সোজা করেই ছাড়বো। যদি না পারি তবে আমার নাম পাল্টে ছকিনা রাখবো।

আহনাফ চৌধুরী সামান্তার কথা শুনে হেসে দিলো।
তারপর ওর মাথায় হাত রেখে বলল,
–আমি জানি তুই ই ওকে সোজা করতে পারবি।এই বিশ্বাস আমার আছে। দোয়া করি সুখী হ।

চলবে,,,,,

#তোর_শহরে_ভালোবাসা💜
পর্ব-২
ফাবিহা নওশীন

এভাবেই দুমাস কেটে গেছে। সামান্তা আদিলের সামনে এই দুইমাসে একবারো পরেনি। একপ্রকার ইচ্ছে করেই আড়ালে থেকেছে।তবে রোজ সকালে নিয়ম করে আদিলের ঘরে গিয়ে চুপিচুপি আদিলকে দেখে আসে।আদিল তখন ঘুমে তলিয়ে থাকে।
সামান্তাকে একমাস যাবৎ একটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছে। ভার্সিটি,বাসা এ নিয়ে বেশ আছে। নিশি শুধু ননদই নয় খুব ভালো বন্ধু।আর আদিলের বাবা-মা নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসে।আদিলের মা সামান্তাকে বলে দিয়েছে,
ও যেন কখনো নিজেকে এই বাড়ির বউ না ভাবে বরং মেয়ে ভাবে।
সামান্তা এখন ওনাদের আংকেল আন্টির বদলে মা আর বাবা ডাকে।

অপরদিকে আদিল আর খোঁজ নেয়নি সামান্তা এই বাড়িতে আছে কিনা চলে গেছে। এই ব্যাপারে কাউকে কিছু জিজ্ঞেস ও করেনি। ওর ঘুম ভাংগে দুপুর ১২টা ১টায়।বিকেলে বাসা থেকে বের হয়ে ফিরে মাঝরাতে।ও ওর লাইফ নিয়ে ব্যস্ত।তাই বাসায় কে আছে না আছে সেটা ওর পক্ষে জানা সম্ভব নয়।
সামান্তা ৯টায় ভার্সিটির জন্য বেরিয়ে যায় ফিরে ২-৩টায়।কোনোদিন সন্ধ্যাও হয়।তাই দুজনকে সামনাসামনি হতে হয়না।তারউপর সামান্তা নিচের রুমে থাকে।ও হাল ছেড়ে দেয়নি বরং হাল ধরার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছে।প্রস্তুতি ছাড়া বড় খেলায় নামা বোকামি ছাড়া কিছুইনা।তাই এই খেলায় নামার আগে সবটা বুঝে নিচ্ছে।এখানকার পরিবেশ,ইচ্ছে-অনিচ্ছে,রুচি সবটাই আয়ত্ত করার চেষ্টা করছে।

ভার্সিটি অফ।বেকার বসে আছে।সামান্তার খোলা জায়গা খুব প্রিয় কিন্তু এই কালো পোশাকের গার্ডদের দেখলেই অস্বস্তি হয়।বাগানে গিয়ে যে একটু হাওয়া খাবে তারোও কোনো উপায় নেই।কারণ বাগানে কোনো প্রাইভেসি নেই।এখানে সেখানে বন্দুক নিয়ে ঘুরতেই থাকে।তাই ছাদে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।
ছাদে গিয়ে রেলিং ঘেঁষে নিচের দিকে ঝুকে আছে।এটা ওর পুরনো অভ্যাস।ঝুকে থাকায় অর্ধেক চুল পিঠে আর বাকি অর্ধেক চুল নিচের দিকে ঝুকে আছে।চেহারাও দেখা যাচ্ছেনা।শুধুমাত্র ফরসা হাত দেখা যাচ্ছে যা দাড়া রেলিং ধরে আছে।
আদিল ফেসবুকিং করতে করতে ছাদে এলো ছাদে এসেই এই দৃশ্য দেখতে পেলো।একটা মেয়ে আকাশি রংয়ের ড্রেস পড়া।ছাদে নিচের দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে।সবকিছুই আগের মতো শুধুমাত্র সেদিনের মতো হাতে মেহেদী পড়া নেই।

আদিলের বুঝতে বাকি রইলো না এটা কে। সামান্তা যে এখনো এই বাড়িতেই আছে সেটা বুঝতে পেরে রাগে ফেটে যাচ্ছে।তারপর আস্তে আস্তে পা ফেলে সামান্তাকে বুঝতে না দিয়ে ছাদ থেকে নেমে গেলো।

আদিল ওর রুমে বেডের উপর হাতের মুঠো শক্ত করে বসে আছে।তারপর উঠে গিয়ে ফুলদানিটা দেওয়ালে ছুরে মারলো।
–আমাকেই কিছু করতে হবে।ওই মেয়ের সাথে কথা বলতে হবে।ওকে আমার লাইফ থেকে বের করতে হবে।

আদিলের মা আদিলের বাবাকে বললো,
–সামু,ভার্সিটি যাবার জন্য রেডি হচ্ছে কিন্তু ড্রাইভার একটা কাজে গেছে এখনো ফিরেনি।
আহনাফ চৌধুরী পেপার পরছিলো।পেপারে থেকে চোখ তুলে বললো,
–তোমার ছেলে কই? ছেলেকে ডাকো।
–আদি তো এখনো উঠে নি। তুমি তো জানো দুপুরের আগে ওর ঘুম ভাংগে না।
–ওকে ডেকে তুলো। আমার বাড়িতে এসব নবাবি চলবেনা। বউ ভার্সিটি যাবার জন্য মানুষ পায়না আর সে পড়ে পড়ে ঘুমায়।
ওকে বলো সামুকে ভার্সিটি দিয়ে আসতে।

–আদি,এই আদি।উঠ বাবা।
–কি হলো মা,এই সকাল সকাল ডাকছো কেন?
–তোর বাবা অনেক রেগে আছে তুই যদি এখন না উঠিস তোর বাবা কেয়ামত ঘটিয়ে দিবে।
আদি উঠে বসলো,
–মা,আমি এখন উঠে কি করবো?
–ফ্রেশ হ,,সামান্তাকে ভার্সিটি দিয়ে আসবি। ড্রাইভার নেই।
আদির ঘুম উবে গেলো।
–কি!!!আদিল চৌধুরী এখন ড্রাইভারি করবে?আমি কাউকে কোথাও দিয়ে আসতে পারবোনা।
–আদি,,,ও তোর বউ।
আদির হটাৎ মনে পড়লো ওর তো সামান্তার সাথে কথা বলা প্রয়োজন তাই আর কথা না বাড়িয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেলো।

আদি গাড়িতে বসে আছে।অপেক্ষা করছে সামান্তার জন্য।
সামান্তা রেডি হয়ে বে হতে গেলেই নিশি ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
–সামু,ড্রাইভার কিন্তু আজ ভাই স্বয়ং।সো বি কেয়ারফুল।
–আচ্ছা,তাই নাকি। পেয়েছি সুযোগ। তোমার ভাইকে অল দ্যা বেষ্ট বলে এসো,আমাকে ভয় না দেখিয়ে।

আদি বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে। আমি আদিল চৌধুরী স্বয়ং ড্রাইভার হয়ে অপেক্ষা করছি আর ম্যাডামের খবর নেই।উফফ,,কতক্ষণ বসে থাকবো?
আদি বিরক্ত হয়ে গ্লাস খোলে বাড়ির দিকে চাইলো।সামান্ত আসছে। সাদা রংয়ের লং টপস,টপসের উপর গোল্ডেন কালারের ডিজাইন করা কটি,কালো জিন্স,লেডিস সো,কাধে লেডিস ব্যাগ,সাদা হ্যান্ড ওয়াচ,আঁকাবাকা লালচে চুলগুলো উড়ছে।মুখে কোনো সাজগোজ নেই তবুও স্নিগ্ধ লাগছে।
আদি পলকহীন ভাবে সামান্তাকে দেখছে।সামান্তার কোনো খেয়াল নেই।সে গাড়ির দরজা খোলে সোজা উঠে বসলো।সামনে কে আছে,কি আছে দেখার প্রয়োজন মনে করেনি।
গাড়িতে বসে ব্যাগ থেকে ফোন আর হেডফোন বের করে কানে গুজে দিলো।
আদির অনেক অস্বস্তি হচ্ছে সামান্তার সাথে যেতে।সামান্তার অবস্থা বুঝার জন্য লুকিং গ্লাসে চোখ রাখলো।সামান্তাকে নরমাল লাগছে।সে দিব্যি কানে হেডফোন গুঁজে দু’হাতে ফোন টিপছে।মাঝে মাঝে ফোনের দিকে চেয়ে ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু পড়ছে আর মুচকি হেসে আবারো টাইপ করছে।আদি স্পষ্ট বুঝতে পারছে সামান্তা চ্যাটিং করছে।
সামান্তার গা থেকে পারফিউমের মিস্টি ঘ্রাণ ভেসে আসছে।আদির অবাক হয়ে ওকে দেখছে।
মেয়েটা এত নরমাল ভাবে কি করে বসে আছে,সামনে কে আছে তাতে যেন কিছু এসে যায়না।কিন্তু আদির তো অনেক অস্বস্তি হচ্ছে।যাকে বউ হিসেবে মেনে নেয়নি তার সাথে একা গাড়িতে করে যাচ্ছে।তাও তাকে তার গন্তব্যে পৌঁছে দিতে।কি অদ্ভুৎ।
আদি তো সামান্তার সাথে কথা বলার জন্য এসেছে কিন্তু কি বলবে,কিভাবে বলবে বুঝতে পারছে না।তার চেয়ে বড় কথা ওর এখন কিছু বলতে মনে চাইছে না।এসব ভাবনায় বিভোর হয়ে গাড়ির স্পিড কমিয়ে দিয়েছে।
সামান্তার ৯টা ২০মিনিটের মধ্যে ভার্সিটি গেইটে উপস্থিত থাকতে হবে।নয়তো ঢুকতে পারবেনা।এভাবে গাড়ি চালালে নির্ঘাত ফিরে আসতে হবে।

কানে থেকে হেডফোন সরিয়ে বললো,
–এক্সকিউজ মি,,আপনি নতুন নাকি,,?বাবা যে কোত্থেকে এসব ড্রাইভার নিয়ে এসেছে আল্লাহ ই জানে।একটু জোরে ড্রাইভ করুন।আমার দেরি হয়ে যাবে।

আদি সামান্তার কথায় চমকে গেলো।আবার রাগ ও হলো আদিল চৌধুরীকে ড্রাইভার বলা হচ্ছে।পিছনে ঘুরে বললো,
আমাকে দেখে তোমার ড্রাইভার মনে হচ্ছে?
সামান্তা চোখ তুলে ওর দিকে কয়েক সেকেন্ড চেয়ে থেকে বললো,
–না আপনাকে ঠিক ড্রাইভার মনে হয়না,,কারণ ড্রাইভারদের ফেসে একটা ইনোসেন্ট ভাব থাকে যেটা আপনার ফেসে নেই।
আপনাকে কোথাও দেখেছি বলে মনে হচ্ছে। কোথায় দেখেছি বলুন তো?দূর,,বাদ দিন। ওসব পরে ভাবা যাবে। আপনি এখন প্লিজ একটু তাড়াতাড়ি ড্রাইভ করুন। আমার ফ্রেন্ডরা অপেক্ষা করছে।

আদি অবাকের সপ্তম আকাশে উঠে গেলো।এই মেয়ে আমাকে চিনে না।আদি পাল্টা প্রশ্ন করলো,
–তোমার কয়জন ফ্রেন্ড?
–৭-৮জন।
–কয়দিন যাবত ক্লাস করছো?
–একমাস।
–এই কয়দিনে ৭-৮টা ফ্রেন্ড বানিয়ে ফেলেছো?
–এ তো কম ই।আমার কলেজে ৫০জনের মতো ফ্রেন্ড ছিলো।
–ও,,এম,,জি,,(আমারো তো পুরো লাইফে এত ফ্রেন্ড হয়নি।)কয়টা বয়ফ্রেন্ড ছিলো?
–একটাও না।প্রেম করার আগেই তো বাবা ধরে এক লাফাঙ্গার সাথে বিয়ে দিয়ে দিলো।
আদি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
–হুয়াট ডু ইউ মিন বাই লাফাঙ্গা?
–লাফাঙ্গা মানে জানেন না?লাফাঙ্গা মানে হলো এই ধরুন উশৃঙ্খল,বখাটে,অহংকারী,একগুঁয়ে,
বদমেজাজি,অভদ্র,বেয়াদপ টাইপ ছেলে যারা বাপের পয়সায় ফুটানি করে।
আদি দাতে দাত চেপে সামান্তার সব কথা হজম করছে।ও সামান্তার সামনে নিজের পরিচয় দিতে চসিছে না এই মুহুর্তে।ও জানতে চায় আসলে সামান্তা ওকে কি ভাবে,,
তাই নিজের রাগ সব হাতের মুঠোতে রাখা স্টেয়ারিংয়ের উপর ঝাড়ছে।

তারপর ফুসফুস করতে করতে বললো,
–এতোই যখন অপছন্দ তবে বিয়ে করেছিলে কেন?

–ওই মিয়া আপনি কি বয়রা?কানে কম শুনেন?

আদি হকচকিয়ে গেলো।
–মানে কি?

–আমি কি বলেছি আপনি শুনতে পান নি?আমি বলেছি বাবা ধরে আমাকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে।নয়তো এই বয়সে কেউ বিয়ে করে?একটা প্রেম ও করতে পারলাম না।সামু তোর কপালই খারাপ।

আদি সামান্তার মনের কথা জানার জন্য।একটু বাজিয়ে দেখার জন্য বললো,
–তাহলে ডিভোর্স দিয়ে দেও।

–আরে আপনি তো ওই লোকের মতোই?

–কোন লোকের মতো?

–যেই গন্ডারের সাথে আমার বিয়ে হয়েছে।বাইয়াদ প্রাণী।মাই হাসব্যান্ড।

আদির সামান্তার মুখে হাসব্যান্ড কথাটা শুনে কেমন অদ্ভুৎ ফিলিংস হচ্ছে।

–তারপর আমি ওই লোকের মতো মানে?

–এই বিয়েকে ছেলে খেলা মনে করছেন? মনে চাইলে একজনকে বিয়ে করে নিলাম আর ভালো লাগলো না ডিভোর্স দিয়ে দিলাম।বিয়ে হলো আল্লাহর দেওয়া পবিত্র সম্পর্ক।একটা কাগজ কিংবা একটা সাইন এই সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারেনা।
যাইহোক আপনার সাথে আমার আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।চুপ করে গাড়ি চালান।
শহরের সব ছেলেরা এক।কোনো কিছুর মূল্য এদের কাছে নাই।
বিরবির করে কথাগুলো সামান্তা আদিকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললো।
সামান্তার কথাগুলো আদিকে খুব ভাবাচ্ছে।আদি চুপচাপ গাড়ি চালাচ্ছে কিছুক্ষণ পর জিজ্ঞেস করলো,
–তারমানে তুমি তাকে ছাড়বে না?

সামান্তা কি উত্তর দেবে ভেবে পাচ্ছেনা।বাইরের দিকে চেয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছে।দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিছুটা জোর করেই বললো,
–জানি না,,যে ছেলে মেয়েদের নূন্যতম সম্মান দেয় না তার সাথে আমি সত্যিই জানি না।আমাকে বিয়ে করেছে ভালো না বাসতো,,আমি তো ভালো বাসতে বলিনি,,একটু সম্মান তো দিতে পারতো,,সেটাও দেয়নি।
সামান্তাকে গলা ধরে এলো।চোখের কোনে পানি জমেছে।আদির চোখে তা এড়ায়নি।ওর কেন জানি খুব মায়া হচ্ছে।কোনো মেয়েই তার স্বামীর কাছে থেকে অবহেলা সহ্য করতে পারেনা।সে স্বামী যেমনই হোক।

গাড়ি এসে ভার্সিটির গেইটের সামনে থামলো।সামান্তা গাড়ি থেকে নেমে পিছনে না চেয়েই হাটা ধরলো।ওর জন্য ২টো ছেলে,২টো মেয়ে অপেক্ষা করছে।ও তাদের সাথে ভিতরে যাচ্ছে।

আদি তখনো সামান্তার দিকেই চেয়ে আছে।কেন জানি অদ্ভুৎ ফিলিংস হচ্ছে।সবকিছু এলোমেলো লাগছে।অস্থির লাগছে।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাড়ি স্টার্ট দিলো।
বারবার সামান্তার কথাগুলো কানে বাজছে।ওর ছলছল চোখগুলো বারবার ভেসে উঠছে।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here