সিঁদুর শুদ্ধি নাফিসা মুনতাহা পরী পর্বঃ ৪৩

0
633

#সিঁদুর শুদ্ধি
নাফিসা মুনতাহা পরী
পর্বঃ ৪৩
.
এমন প্রখর আগুনে দেবকী পুরে ছাড়খাড় হয়ে যাবে। যেমনটা বিদ্যা জ্বলছে। জ্বীন গালিব তার মায়া প্রয়োগ করে বিদ্যার উপর। যাতে আগুন নিভে যায়। কিন্তু এতে আগুন না নিভে আরও দ্বিগুন হারে বাড়তে লাগলো। মনে হচ্ছে বিদ্যার শরীরে আগুনের ঢেউ খেলছে। গালিব কিছু একটা ভেবে নিচু কণ্ঠে বলে উঠলো,

—” বোন, আমি হিসাবের মিল খুঁজে পাচ্ছিনা। এটা কি হচ্ছে! আমিতো কোন কূল-কিনারাই খুঁজে পাচ্ছিনা। হে রহমান-রাহীম, আমায় পথ দেখাও।”

বিদ্যার শরীরের সাপটি আস্তে আস্তে পাথরে পরিনত হয়ে গেল। এই দৃশ্য দেখে তাহেরা চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো,

—” ভাইজান, আমার মায়াজালের অভিঙ্গতা এটাই বলে যে, যতক্ষন এই আগ্নি শিখা বিদ্যার শরীরে থাকবে ততক্ষন বিদ্যার শরীরের কোন ক্ষতি হবেনা। কারন এসব পিশাচদের শরীর অক্ষ্যত রাখার জন্য অনেক নিয়ম রয়েছে। একটা নিয়মের ভিতর সামান্যতম অংশ পড়লে তা কাজে দেয়। আমাদের প্রথম কাজ হল, বিদ্যার দ্বিতীয় সত্ত্বাকে খুঁজে বের করা। আমরা সফল হলেই মেয়েটা তার শক্তি ফিরে পাবে। কারন, তার মানব জিবনের ইতি ঘটেছে। এখন সে পিশাচরুপ ছাড়া কখনোই জাগ্রত হতে পারবেনা।”

গালিব, তাহেরা আর দেবকী এবার মাঠে নেমে পড়লো সেই বোতল বন্দী বিদ্যার শক্তি খুঁজতে। যে যার মত চেষ্টা করছে। যে কোন অবস্থায় নির্দিষ্ট সময়ের মধ্য সেই শক্তিকে খুঁজে বের করতে হবে।

এমন কষ্টের সময়গুলোও শেষ হতে লাগলো আস্তে আস্তে। দিন যায়, রাত যায়, সপ্তাহ পেরিয়ে মাসও চলে যায়। কিন্তু কোন সূরাহ্ পায়না তারা। এর মাঝে শ্যামল বাবু গোপনে শুধু বিদ্যার শরীর দেখে যায় আর চোখে জল ফেলে। অভির কোন খোঁজ পাওয়া যায়না। কাবির অভির বাসায় ফোন দেয় কিন্তু তাদের আর কোন খোঁজ পায়না। এক নিমিষেই যেন এতবড় একটা যৌথ পরিবার হাওয়া হয়ে যায়। তাদের খোঁজ কেউ আর দিতে পারেনা। এভাবে প্রায় আট মাস কেটে যায়। কিন্তু সমস্যা ???¿?¿।?।সমাধান হয়না।
এ¡?2?!!!এক্স??

অঞ্জনা দেবী নিজ ঘরে পালঙ্কে বসে আছে। অপুর রুমটা পুরে যাওয়ার পর আর সেই রুম ঠিক করা হয়নি। রুমটা ঠিক করতে হবে। মায়ের পার্মিশন নেওয়ার জন্য রনক মায়ের রুমে ঢুকেই দেখতে পেল, তার মা উদাশীনতায় মগ্ন হয়ে কিছু একটা ভাবছে। ইদানিং তার মা কারো সাথে তেমন একটা কথা বলেনা। ঘরের দোর বন্ধ করে চোখের পানি ফেলে। বিদ্যা বৌদি থাকলে কখনোই এমন হতোনা। কিন্তু সেতো আর ফিরে আসবেনা। সে এই বাড়ির সম্পর্কের সুতা কেটে অন্য ঘরে চলে গেছে সংসাX কথা বলতোনা।

তুমিতো সেই বিয়ে করলেই বিদ্যা! তাহলে তোমার জন্য আমি কেন, না ছিলাম? তোমরা নারীরা সত্যই মোহিনী রূদয়হীনা। তোমাদের কাছে কোন পুরুষের চোখের জলের মূল্য নেই। তোমরা পরিবার আর সমাজের দোহাই দিয়ে নিজেদের অবুজ আর অবলার চাদরে সাজিয়ে নাও। যাতে দোষের তীরের নিশানাটা তোমাদের দিকে না তাক করা হয়।
কথাগুলো ভাবতেই চোখ জলে ভরে উঠলো। চোখের জলে মনের কষ্টগুলো হাবুডুবু খাচ্ছে আর প্রানপনে সাঁতার কাটছে। কেন তুমি আমাকে বুঝলেনা বিদ্যা! আমার মাঝে কিসের কমতি ছিল? তুমি কি বুঝতেনা, আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসতাম আর আজও ভালোবাসি। দাদার জন্য প্রতিরাতে তোমায় ক্রন্দনরত অবস্থায় দেখতে দেখতে নিজেই সেই মায়ায় কবে আবদ্ধ হয়ে গেছি তা নিজেও বুঝতে পারিনি। তুমিতো বিয়ে করলে। তাহলে কোথায় গেল, দাদার প্রতি তোমার পাগলামির সেই চান-চাঞ্চল্য ভালোবাসা! যেই ভালোবাসার টানে তুমি কেঁদেছ এবং আমাদের সকলকেও কাঁদিয়েছ। তোমার ক্ষমা নেই বিদ্যা।

—” রনক, কিছু বলবি?”

মায়ের ডাকে রনক তার ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে এল। দ্রুত চোখের জল মুছে মায়ের কাছে এসে বলল,

—” মা, দাদার রুমটা ঠিক করে ফেলি। তুমি কি বল!”

আমি মারা যাই তারপর ঠিক করিস। ওটা ওভাবেই রাখ বলেই অঞ্জনা দেবী ডুকরে কেঁদে উঠলো। মায়ের এমন কান্না দেখে রনক গলা ঝেড়ে বলল,

—” বৌদিও কি এভাবে এখনো দাদার জন্য কান্নাকাটি করে মা! না নতুন স্বামীকে পেয়ে দাদাকে ভুলে গেছে?”

বিদ্যার কথা উঠতেই অঞ্জনা দেবী চুপ হয়ে গেল। মায়ের এমন চুপ হয়ে যাওয়া দেখে রনক অত্যান্ত রেগে গেল। মন চাচ্ছে গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিয়ে তার মাকে বিদ্যার নামে অভিযোগ করতে। সেদিন যদি তুমি আর বাবা একটু বিদ্যার জন্য কঠোর হতে তাহলে এমন দিন দেখতে হতোনা। তাকে আমাদের সারা জিবনের জন্য হারাতে হতোনা। সে আমাদের সকলের সাথে এখানেই বসবাস করতো।
২৫টা বছর কম নাকি! এত সহজ, এই ২৫টা বছরের মায়া এক নিমিষেই ছিড়ে ফেলা! বিদ্যা কেমন করে পারলো, সব সম্পর্ক ছিন্ন করতে?
রনক সেদিন সবার অজান্তে অন্ধকার রাতে নিজের সম্মান মাটি করে দিয়ে বিদ্যার পা দু’টো চেঁপে ধরে বলেছিল, বিদ্যা, আমি তোমাকে প্রচন্ড ভালোবাসি। তোমাকে ছাড়া আমি অন্য কাউকে বিয়ে করলে কোনদিনও সুখী হবোনা। আমাকে ফিরিয়ে দিওনা। আমি কোনদিনও তোমায় ছুয়েও দেখবোনা। তবুও তোমার কাছে থাকার একটা সুযোগ দাও। কিন্তু তুমি আমায় সুযোগ না দিয়ে কেঁদে কেঁদে বলেছিলে, অপুদাদাকে ছাড়া তুমি অন্য কোন পুরুষকে কল্পনাও করতে পারবেনা। কোথায় গেল সেই শ্রদ্ধা ভরা ভালোবাসা!

কতশত নারী আমার জন্য পাগল ছিল। কিন্তু আমি! আমিতো পাগল ছিলাম সেই ফুটফুটে বিধবা কিশোরী মেয়েটার উপর। তোমাকে আমি ঘৃনা করতে পারিনা বিদ্যা! যতবার বার তোমার উপর রাগ করে সরে যেতে চেয়েছি তত বারই ভালোবাসায় আষ্টে-পৃষ্ঠে একাকার হয়ে গেছি। ভালো থাকো সবসময়। আর অভিযোগ করবোনা। সবতো অভিযোগ ঐ উপরে যিনি আছেন তাকে করবো। কেন তিনি আমার ভাগ্য নামক খেলায় মেতে উঠলেন। এই যে, এত কষ্ট পাচ্ছি তার দাম কে দিবে? নাহ্ আর মায়ের সামনে থাকা যাচ্ছেনা। চোখের জলগুলো বার বার বিদ্রোহ করছে, তাদের নির্জন একটা জায়গা চাই। রনক রুম থেকে বের হওয়ার জন্য পা বাড়াতেই অঞ্জনা দেবী রনকের হাতটা খপ করে ধরে মৃদ্যু গলায় বলল,

—” তোকে কিছু বলার ছিল।”

—” পরে এসে শুনি?”

না এখুনি শুনতে হবে বলে অঞ্জনা দেবী রনককে জোড় করে কাছে টেনে এনে বসাল। তারপর গম্ভীর কন্ঠে বলল,

—” আমি জানি, এখন তোর মন কি বলছে! হাজারটা প্রশ্নে জর্জরিত করতে মন চাইছে তোর। আজ আমি সেই সব প্রশ্নের উত্তরই দিব।”

কথাগুলো বলে অঞ্জনা দেবী পালঙ্ক থেকে উঠে দ্রুত সদর দোরটা বন্ধ করে আবার ছেলের কাছে এসে বসলো। তারপর রনকের হাত ধরে বলল,

—” খুব রেগে আছিস?”

কথাটা আর শেষ করতে পারেনা। তার আগেই রনকের চোখের জল আর বাঁধ মানলোনা। টপটপ করে কয়েক ফোটা চোখের জল ঝরে পড়ল। তারপর নাক টেনে ভাঙ্গা গলায় বলে উঠলো,

—” কেন মা কেন! আমার সাথে কেন এমন হল? সে কেন তার কথার দাম রাখতে পারলোনা! আমার দোষটা কোথায় ছিল, সেটা একটু দেখিয়ে দিবে মা!”

অঞ্জনা দেবীর এখন মনে হচ্ছে, সেদিন যদি রনকের কথা মানত তাহলে আজ বিদ্যাকে হারাতে হতোনা। আমরা যে তাকে সত্যিই হারিয়ে ফেলেছি। আর কোন ভাবেই উপায় নেই তাকে আমাদের কাছে ফিরাতে। এমন কি আমি মৃত্যর সময়ও তাকে দেখতে পাবোনা। নিজের মেয়ে নেই। ওকে মেয়ের মত আগলে মানুষ করেছি আর আজ সে মৃত্যু পথযাত্রী। এটা যদি রনক জানে তাহলে পাগলের মত ছুটে যাবে ওর কাছে। না না এটা বলা যাবেনা ওকে।
অঞ্জনা দেবী কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা বের করে গ্যালারি ঘেটে একটা ছবি বের করে বললেন,

—” বিদ্যার বর, দেখতো এদের কেমন লাগছে একসাথে?”

রনক চোখের জল মুছে বলল,

—” আমি সহ্য করতে পারবোনা মা। আমার না দেখাটাই বেটার।”

—” তোর খুব আপনজন সে। দেখতো তাকে চিনতে পারিস কিনা?”

মায়ের এমন কথা শুনে রনক চমকে উঠলো। কাজের জন্য তাকে নানান দেশ ঘুরতে হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে কোনদিনও যাওয়া হয়নি। তাহলে সেই দেশে তার পরিচিত কে আর থাকতে পারে? কথাগুলো মনের মধ্য ঘুরপাক খেতেই অঞ্জনা দেবী ওর মুখের সামনে ফোনটা ধরলেন। ফোনে যা দেখলো, তাতে রনকের দুনিয়া কেঁপে উঠলো। অজান্তেই মুখ দিয়ে অস্পষ্ট শব্দটি বের হয়েই গেল। দাদা, দাদাকে সে কোথায় পেল?

অঞ্জনা দেবী নিজেকে শক্ত করে বললেন,

—” সে এই মানুষটার জন্য অপেক্ষা করেছে দিনের পর দিন। তাই হয়ত প্রভূ ওর উপর খুঁশি হয়ে অপু রুপী অভিকে বিদ্যার কাছে পাঠিয়েছে। অপুর ২য় জন্ম এক নারীর জিবনেই ঘটেছে। বিদ্যাকে আর অভিযোগ করিসনা। ও সুখে থাকুক। মেয়েটা আমার জিবনে অনেক কষ্ট করেছে।”

রনকের সমস্ত কথা যেন বন্ধ হয়ে গেল। আর বসে থাকতে পারলোনা। উঠে দাড়াতেই ওর মা বলল,

—” বাবা, কথাটা কাউকে বলিসনা। মা আমার সুখে থাক।”

রনক কোন কথা না বলে রুম থেকে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল। অঞ্জনা দেবী আর ছেলের মনের কথা জানতে পারলোনা। নিজেকে এখন খুব হালকা লাগছে।

আজ অমাবস্যাতিথি। নির্জন সমুদ্র পাড়ে লালপ্রভা বসে আছে। আর তার সামনে কয়েকজন জটা ধারী ভয়ংকর নারী শূন্যতে বসে ভাঁসছে। তাদের চোখে-মুখে ক্রোধের ছাপ বেশ ভালোভাবেই বোঝা যাচ্ছে। ঋষির ভুলের খেসারত ঋষি ওর জিবন দিয়ে দিয়েছে। সাথে ঐ অমূল্য শক্তিকেও তারা হারিয়ে ফেলেছে। যেহেতু ঐ শক্তিটা এখনো বন্দী অবস্থায় আছে তাই কিছু পূজা করলে হয়ত তারা সেই শক্তিকে তাদের সামনে উপস্থিত করতে পারবে। সেই মোতাবেক অনুযায়ী তারা পূজার আয়োজন করেছে। সকলে মিলে “চেনাবতী ডাকিনী” পূজায় মত্ত্ব হলো। এটা এমন একটা ভয়ঙ্কর ডাকিনী বিদ্যা যা মনের সকল আশা নিমিষেই পুরুন করবে, যদি তা সফল ভাবে করতে পারে। আর যদি সামান্য পরিমান ভুল হয়, তাহলে অষ্টারম্ভের ৮ দেবী এদের কাঁচা চিবিয়েই খাবে। খুব সাবধানে তারা পূজার কাজে অগ্রসর হয়। প্রথমে তাদের শরীরের কিছু অংশ উৎস্বর্গ করতে হবে। আর তা করার জন্য সব নারীগন তারা তাদের হাতগুলো আগুনের উপর ধরলো। হাতগুলো তুলে ধরতেই এক অদৃশ্য শক্তি এসে এদের হাতের আঙ্গুলের গিড়া পর্যন্ত কেটে ফেলল। টপটপ করে কালো- লাল মেশানো রক্ত আগুনে পড়তে লাগলো। সামনে রাখা ভয়ানক নারী মূর্তিকে তাদের এখন খুঁশি করতেই হবে। কারন, তিনি খুঁশি হলেই তারা তাকে এখানে উপস্থিত করতে পারবে।

হ্যাঁ তারা সফল হয়েছে। সমুদ্রের পাড় হতে কিছুটা দুরে ময়ূরাকৃতি একটা অপরুপ সুন্দর মেয়ে দাড়িয়ে আছে। যার পুরো শরীর ময়ূরের মত আর মাথাটা শুধু একটা নারীর মাথার মত। তার চেহারার ঝলকে অমাবস্যার কালো অন্ধকারময় পাড় নিমিষেই যেন আলোক পুরীতে রুপান্তরিত হয়ে গেল। মানুষরুপী জন্তুটি পানির মধ্য দাড়িয়ে আছে। কোমড় অবদি পানি। পাখাদুটো পানিতে ঝুলে আছে। কিন্তু পানির মধ্য আরো উজ্জ্বল একটা আলো প্রকট হলো। প্রানীটির হাতে হারিকেন মত একটা প্রদ্বীপ জ্বলে আছে। পানির নিচে আগুন জ্বলছে, এটা যেন বিশ্ময়ের সীমানা ছেড়ে যায়। নারীরা উল্লাস করতে লাগলো। তাদের পূজা সফল হয়েছে। এখন সেই শক্তি শুধু তাদের হবে।

ময়ূররুপী নারীটি ধীরে ধীরে পাড়ে উঠে আসে। মেয়েটির গলায় সর্পমালা। পায়ে সর্প নূপুর। প্রতিটা পদক্ষেপে নূপুরনিক্বণে মুখরিত হচ্ছে চারপাশের পরিবেশ। প্রতিটা পদক্ষেপে আগুনের প্রজ্জ্বলিত লাভা বের হয়েই সেখান থেকে ধুয়া নির্গত হচ্ছে। এবার নারীটি এসে মহিলাদের সামনে দাড়াতেই ভয়ংকরী মহিলাগন মাথা নুয়ে তাকে কুর্নিশ করলো। নারীটি এবার কন্ঠের ঝংকার তুলে বলল,

—” আমার কাছে তোদের কি চাওয়া আছে?”

মহিলাগন বিনীতস্বরে সমস্ত কথা খুলে বলল। মহিলাদের কথা শেষ হতেই নারীটির বুক ভেদ করে ৫টা আলোকরশ্মি সাগরপারে আছড়ে পড়ল। সাথে সাথে সেখানে ভয়ানক ৫টি সাপ উদয় হলো। যাদের নিঃশ্বাসে বিসাক্ত ধুয়া নির্গত হচ্ছে। ৫টা জিহ্বাফলক লিক লিক করে বের হয়ে এল একসাথে। এরাই তোমাদের সমস্ত চাওয়া পূর্ন করবে। কথাগুলো বলেই নারীটি তার মায়া প্রয়োগ করে বিদ্যার উদ্দেশ্য। যাতে বিদ্যার দেহ এখানে এসে হাজির হয়।

জ্বীন গালিব আর তাহেরা বিদ্যাকে পাহাড়া দিচ্ছিলো। আর সুমুদ্র পাড়ে দেবকী লালপ্রভার উদ্দেশ্য উল্টা চ্যাল দেওয়ার জন্য সেও “চেনাবতী ডাকিনী” বিদ্যায় মেতে উঠেছে। নিজের শরীরকে বন্ধ করে সে চোখ বন্ধ করলো। তারপর তার কন্ঠে শুধু একটা মন্ত্রই উচ্চারিত হল,

“ওঁ শয়ং চেতনায়ং সর্ব শক্তি ভুতয়াং দিব্য তিলং স্বহাঃ”

৩৩৩ বার এই ডাকিনী মন্ত্র পড়ার প্রথম ধাপ শুরু করলো সে। দেবকীর সামনে সাধনার জন্য, ছাগলের কলিজা, মদ, ৭টি লং, ৭টি বাতাসা, একটি মাটির প্রদীপ রয়েছে। সে তার কাজ সফল করার জন্য আরো কিছু বিদ্যা প্রয়োগ করলো।

এদিকে বিদ্যা জলন্ত অবস্থায় বিছানা থেকে একটু উপরে উঠে শূন্যতে ভাসতে লাগলো। বিদ্যার এমন পরিনতি দেখে গালিব মুচকি হেসে বলল,

—” তাহেরা, আমাদের কাজ শেষ। কারন আজ যারা বিদ্যাকে আহ্ববান করছে তারা নিজের সাফল্যকে আহ্ববান করছেনা। আহ্ববান করছে তাদের যন্ত্রনাময় মৃত্যুকে। তারা নিজেও জানেনা, তাদের মৃত্যু তাদের কাছে কতটা দ্রুত ধেয়ে আসছে।”

গালিব আর তাহেরা চলে যাওয়ার আগে বিদ্যার শরীর মুক্ত করে দিয়ে গেল। বিদ্যা বাতাসে ভাসতে ভাসতে অদৃশ্য হয়ে গেল। বিদ্যা রুম থেকে অদৃশ্য হতেই দেবকী চোখ খুলল। ততক্ষনে দেবকীর মন্ত্র জপ করা শেষ হয়ে গেছে। দেবকীও বিদ্যার পিছে পিছে ছুটলো।

খোলা সুমুদ্র পাড়ে বিদ্যা উদয় হলো সেই নারীর কাছে। বিদ্যার শরীরে হাত দিতেই ওর শরীরের সমস্ত আগুন নিভে যায়। আর সাথে সাথে ওর শরীরের পাথুরে সাপটি জিবন্ত হয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। বিদ্যা অচেতন অবস্থায় শূন্যতে ভাসছে। এবার নারীটি তার ডানা মেলে শূন্যর উপর ইশারা করতেই বিদ্যার শক্তিরুপী বোতলটি হাজির হল। এখন এটা বিদ্যার শরীরে প্রতিস্থাপন করলেই বিদ্যা ঐ মহিলাদের আয়ত্বে চলে আসবে। কিন্তু সমস্যা হলো বোতলের মুখ বন্ধ করার সময় বৃন্দার রক্ত মিশিয়েছিল লালপ্রভা। যার কারনে এত শক্তিশালী হওয়া সত্তেও সেই অশরী বোতল থেকে মুক্তি লাভ করতে পারেনি। এখন তারা বৃন্দকে কোথায় পাবে? শেষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, বিদ্যার শরীর ঐ পঞ্চ সাপদের সামনে বলি দিয়ে তার অশরী শক্তিকে একেবারে হাতের মুঠোয় নিয়ে আসবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তারা সাপের কাছে অর্পন করলো বিদ্যাকে। সাপগুলো হিসহিস করে একসাথে বিদ্যার কাছে চলে আসলো। কিন্তু হঠাৎ একটা সাপ একবার বিদ্যার দিকে চায় আবার বোতলের দিকে একবার চায়। মনে হয় সে কিছু একটা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। বাঁকি চারটি সাপ বিদ্যার শরীর থেকে মাংস তুলে খাওয়ার জন্য এগুতেই অন্য সাপটি বিদ্যাকে ওদের মুখ থেকে ছো মেরে কেড়ে নিয়ে পেঁচিয়ে ধরেই বিপরীত দিকে ছুড়ে মারলো। বাঁকি চারটা সাপ ভাবলো, সে হয়ত একাই এই মানবীকে ভক্ষন করতে চায় তাই তারা ক্রুদ্ধ হয়ে ঐ সাপটিকে ধাওয়া করলো। সাপটিও পিছন ফিরে ক্ষপ করে বিদ্যাকে ধরে নিজেই নিজেকে বন্ধ করলো।

এদের একটা নিয়ম আছে। এরা যদি কোন কারনে নিজেই নিজেদের বন্দী করে তাহলে তার সিমানায় কেউ ভিরতে পারবেনা। এবার সাপটি শান্ত হয়ে লেজ গুটিয়ে তার উপর বিদ্যাকে রেখে সে বিশাল ফোনা তুলে বাঁকি চারটা সাপকে বুঝিয়ে দিল। এবার কাছে এসে দেখা। কে আসবি আয়।

চারটি সাপ তার কনিষ্ঠ ভ্রাতার এমন কান্ড দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। তারা তাদের ভাষায় তাকে তর্জনগর্জন করে শাসাতে লাগলো। কিন্তু তাদের শাসনে কোন কাজ হলোনা। সে ঐ একই ভাবেই বিদ্যাকে নিয়ে অটল হয়ে বসে রইলো। এরা খাঁচার ওপার থেকে একে যতই ডাকে সে ততই তাদের কথার তেল নিজ শরীরে মালিশ করে চুপ হয়ে থাকে। তারা অনেক বুঝানোর পর সাপটি ওর লেজ দিয়ে মাথা চুলকিয়ে ওর ভাষায় বলল,

—” মেয়েটিকে কিছু করবেনা তো তোমরা?”

—” না কিছু করবোনা। আগে তুই বের হয়ে আয়।”

কনিষ্ঠ সাপটি বিদ্যাকে ওখানে রেখেই চট করে বের হয়ে এল। সাথে সাথে বাঁকি চারটি সাপ ওর গলা চেঁপে ধরে বলল,

—” ওকে ওখানে রেখে এলি কেন?”

—” হুম, এই জন্যইতো আমি তাকে ওখানে রেখে এসেছি। আমিতো জানি, তোমরা মতলব বাজ। আহার রেখে ভালো কথা তোমাদের কানে যাবেই না। তাই এই ব্যবস্থা। আমি তো তোমাদের চিনি। তাকে তোমাদের হাতে দিলে কি কি করতে পারো তোমরা।”

১ম সাপটি কনিষ্ঠ সাপের কাছে এসে বলল,

—” মেয়েটির সাথে তোর কি এমন সম্পর্ক অাছে, যার জন্য তুই আমাদের কাজে বিঘ্ন ঘটাচ্ছিস?”

৩য় সাপটি ঝাঝালো কন্ঠে হুংকার দিয়ে বলল,

—” দাদা, এখনো ওকে লাই দিচ্ছো? পিঠে ডান্ডার বারি পড়লে ও এমনি ঠান্ডা হয়ে যাবে।”

এবার কনিষ্ট আর ২য় সাপের মধ্য ঝগড়া বেঁধে গেল। তাদের ভাষায় যে যেমন পারছে কথার ফুল ঝুড়ি দিয়ে একে অপরকে ঝাড়ছে। এবার ২য় সাপটি বলল,

—” ও…..ই”

কনিষ্ঠ সাপও বুক ফুলিয়ে বলল,

—” তোকে ভয় পাই নাকি আমি!”

১ম সাপ এবার এদের মাঝখানে এসে ঝগড়া থামিয়ে দিয়ে বলল,

—” তোরা কি আমাদের বংশের মান-সম্মান রাখবি নাকি! আমাদের প্রতিনিধি হিসাবে পাঠানো হয়েছে। যাতে আমরা ঐ নারীকে সাহার্য্য করি। তা না করে তোরা নিজেদের মধ্য নিজেরাই লড়াই করছিস?”

—” দাদা, ওকে আগে থামতে বলুন।”

আমি কি থামবো মুর্খের দলগুলো। সবসময় আমাকে বল, আমি একটা গর্দভ ছাড়া কিছুই নয়। কিন্তু আমি আজ বলছি, আমি যদি গর্দভ হই তাহলে তোমরা মহা গর্দভ। কনিষ্ঠ সাপের এমন কথা শুনে ২য় সাপ এসে বলল,

—” কি বলতে চাচ্ছিস তুই? যা বলতে চাস খুলে বল।”

কনিষ্ঠ সাপ একটা হাই তুলে খুঁশি হয়ে বলল,

—” তোমরা তাকে চিনতে পারছোনা! সে যে আমাদের বিদ্যা মা। তোমাদের মনে পড়ছেনা! যখন আমরা রাজ্য থেকে পালিয়ে বাবা-মার সাথে এক দেশে গিয়েছিলাম তখন এক আফারীত বেঁটে জ্বীন আমাদের উপর আক্রমন করেছিল! আমাদের কয়েক ভাইবোনদের সে হত্যা করেছিল। তখন ঐ ছোট্ট মা আমাদের রক্ষা করে তার ঘরে নিয়ে গিয়েছিল। তারপর তার শরীরের উষ্ণ গরমে আমরা ডিম থেকে বের হয়ে আসি। কিছুদিন থাকার পর বাবা-মা আমাদের ওখান থেকে নিয়ে আসে। আসার আগে লালপ্রভাকে সাবধান করেছিল যাতে মায়ের ক্ষতি না করে! আমিতো লালপ্রভা কে দেখেই বুঝতে পেরেছি, এর মধ্য কিছু ঘোল আছে।”

কনিষ্ঠ ভ্রাতার কথায় বাঁকি চারজনের চোখ গোল হয়ে ওখানেই ঘুরতে লাগলো। ছোট ভাইকে ঠেলে ফেলে দিয়ে ৪জন খাঁচার সাথে চোখ লাগিয়ে বিদ্যাকে ভালো করে দেখতে লাগলো।

এদের স্বর্প ভাইদের এহেন কান্ড দেখে উপস্থিত সবাই তব্দা খেয়ে গেল। ময়ূরকণ্ঠী নারী হুংকার দিয়ে বলল,

—” এই, তোমাদের সমস্যা কি?”

নারীটির কথা শুনে ৫ স্বর্প ভাইগন এক সাথে পিছন ফিরেই মুখ দিয়ে আগুন ছুড়ে মারলো নারীটির দিকে। তারপর ফিসফিস শব্দে বলে উঠলো,

—” আমাদের সমস্যা তুই। দেখছিস, আমরা প্রাইভেট আলোচনা করছি এর মধ্য তোকে কে ঢুকতে বলেছে! আমাদের উপর নেতাগিরি দেখাতে আসিস?”

সাপদের ছোড়া বিষাক্ত আগুনে অপরূপা নারীটি জ্বলে-পুরে ছাড়খার হয়ে গেল। নারী ভষ্ম হতেই ১ম সাপটি বলল,

—” আর কারো কোন কথা আছে? না, থাকলে বলতে পারো তোমরা! ভষ্ম হওয়ার যদি মনে ইচ্ছা পোষন থাকে তাহলে ঝটপট বলে ফেল। কে আগে ভষ্ম হতে চাও!”

এবার ৪র্থ সর্পটি বাজখাঁই গলায় বলল,

—“ফের যদি দেখি আমাদের বিরক্ত করা তাহলে…..।”

আর কথা বলতে হলোনা। ভয়ংকর মহিলা সহ লালপ্রভা ভয়ে আৎকে উঠেছে। কোন জিনিসের পাল্লায় পড়েছে তারা।
তারা তাদের সমস্ত শক্তি ব্যয় করে এই শক্তিগুলোকে আহ্ববান করেছে। আর তারাই আজ তাদের বিপক্ষে।

কনিষ্ঠ সর্পটি প্রস্তাব রাখলো, দাদা, আমরা আমাদের শক্তি দিয়ে মাকে তো আবার জাগ্রত করতে পারি। তাহলে আমরা এখনো চুপ করে আছি কেন? সে কথাগুলো বলেই মায়া বলে বিদ্যাকে কাছে নিয়ে আসলো।
বড় তিন সর্প এক সাপে পরিনত হল। তারপর তিনমাথা ধারী সাপে রুপান্তরিত হয়ে লেজ গুটিয়ে বিশাল ফোনা তুলে দাড়িয়ে পড়ল। বাঁকি দু’টো সাপ বিদ্যাকে সেই গোল লেজের আসনে বসিয়ে দিয়ে বিদ্যার দুই পা নিজেদের শরীর দিয়ে পেঁচিয়ে হাঁটুর সাথে ফোনা তুলে বিদ্যার দিকে মুখ করে তাকালো। তারা এক সাথে রশ্মি প্রয়োগ করলো বিদ্যার মাথায়।
এতে বিদ্যা যেন জাগ্রত হল। সাথে সাথে বিদ্যার দুই হাত, নিচের দুই সাপের মাথার উপর রেখে চোখ বন্ধ অবস্থায় চিৎকার করে বলল,

—” আমি আমার সমস্ত শক্তিকে আহ্ববান করছি। সে যেখানেই থাকুকনা কেন, আমার শরীরে যেন হাজির হয়।”

পরক্ষনেই একটা বিকট শব্দে আশে-পাশের মাটি কাঁপিয়ে বোতলটি ভেঙ্গে এক আলোক রশ্মি ছুটে এসে বিদ্যার বুকে আঘাত করলো। বিদ্যা প্রচন্ড শক্তিতে ঝাকুনি দিয়ে উঠলো। ৫টি সাপ আরও শক্ত করে বিদ্যাকে জড়িয়ে ধরলো। এবার বিদ্যা চোখ খুলতেই ওর চোখ দিয়ে আলোক রশ্মির তীব্র ছিটা এসে মাটিতে পড়তেই সেখানে বিষ্ফোরন ঘটলো। বিদ্যার কণ্ঠে শুধু একটা কথায় শোনা গেল,

—” লালপ্রভা, আমাকে চিনতে পেরেছিস! আমিতো তোকে ভুলি নাই, আমার চোখের সামনে আমার প্রিয় অপুদাকে তুই কিভাবে কতটা কষ্ট দিয়ে মেরেছিস। এবার সময় এসেছে পাপের বিনাশ করার।”
সর্প আসনে বিদ্যাকে দেখে মনে হচ্ছে কোন সর্পদেবী তার আসনে বসে রাজত্ব পরিচালনা করছে।

[ চলবে…..]

………………………………..
লেখিকা, নাফিসা মুনতাহা পরী
———————————
© কপিরাইট: উক্ত কন্টেন্টটি লেখিকার সম্পদ। লেখিকার নাম এবং পেজ এর ঠিকানা না দিয়ে কপি করে নিজের নামে চালিয়ে অন্য কোথাও পোষ্ট করা আইনত দন্ডনীয়।

সরাসরি ওয়েবসাইট এ পড়ুন: https://nafisarkolom.com/2020/12/sidur-suddhi-43/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here