সিঁদুর শুদ্ধি #নাফিসা মুনতাহা পরী #পর্বঃ৩০

0
812

#সিঁদুর শুদ্ধি
#নাফিসা মুনতাহা পরী
#পর্বঃ৩০

..
অভিকে দেখে রত্নার অবস্থা যা খারাপ হওয়ার তা হয়ে গেছে। রত্না ধপ করে পড়ে যেতেই পিছনের মহিলাটি এসে ওকে ধরল আর সাথে সাথে রত্না বলে উঠলো,

–” আমাদের এখুনি এখান থেকে যেতে হবে। পরিকল্পনা আমাদের ভুল হয়ে গেছে।”

রত্নার কথা শুনে ধীরাজ সান্যাল দ্রুত ঋষির কাছে গিয়ে ওকে সহ নিজে ভ্যানিস হয়ে গেলেন। সাথে অন্যরাও চলে গেল।

ওরা চলে যেতেই অভি বুঝতে পারলো সমস্যা তাকে নিয়ে নয়, সমস্যা হল বিদ্যাকে নিয়ে। কিন্তু একজন মানবীর সাথে এত জ্বীন সত্ত্বার কিসের শত্রুতা থাকতে পারে! ঋষিও বলছিল বিদ্যা নাকি পিশাচ রানী। এটা কি করে সম্ভব! ওতো একটা মানুষ, তাহলে এসব কি হচ্ছে। এরা কারা, আর বিদ্যার কাছে তাদের কি চাওয়া থাকতে পারে? এতসব প্রশ্নের উত্তর শুধু আন্টিই দিতে পারে।
অভি বিদ্যার পাশে এসে বসল। তারপর ওর যা পরীক্ষা করার দরকার সব করলো কিন্তু কিছুই সমাধান হলোনা। বিদ্যা একটা মানুষ ছাড়া কিছুই নয়। অভি বিদ্যার পাশে সুয়ে পড়লো। তারপর একটু উচু হয়ে ওর গালের সাথে নিজের গাল ঘষিয়ে বিদ্যার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে সেখানে একটা কিস করে ঘুমিয়ে পড়লো।

রুমের জানালা খোলা। সকালের হালকা কুয়াশা জানালা ভেদ করে রুমের ভিতর অঝোর ধারায় তার তান্ডব চালিয়ে যাচ্ছে। বাহিরের ঠান্ডা হাওয়ায় পর্দা নিজের জায়গায় স্থির হতে পারছেনা। জানালার পর্দা এতে হয়তো খুবই রুষ্ঠ হয়েছেন। কারন তাকে একটু পরপরই স্থানচ্যুত হতে হচ্ছে। বাসায় কেমন মানুষ আসলো যে, সারা রাত এভাবে জানালা খোলা রাখে, তাও এই ঠান্ডাময় ঋতুতে।
অভি বিদ্যাকে বুকের ভিতর নিয়ে ঘুমিয়ে আছে। এমন সময় বিদ্যার শরীর কেঁপে উঠলো আর কপাল বেয়ে দরদর করে ঘাম নেমে যেতে লাগলো। অভি হঠাই চোখ মেলে দেখলো বিদ্যা কেঁপেই চলছে। অভি বিদ্যাকে ছেড়ে দিয়ে উঠে ওর পাশে বসলো। তারপর হাতের আলতো ছোয়া বিদ্যার শরীরে মেখে আস্তে সুরে বিদ্যা বলে কয়েকবার ডাক দিল।

অভির ডাকে বিদ্যা একবার চোখ খুলল তারপর আবারও ঘুমের দেশে হারিয়ে গেল। অভি আবার ওকে মৃদ্যু স্বরে ডাকতেই বিদ্যা হঠাৎই সোয়া থেকে উঠে বসে হাঁপাতে লাগলো। বিদ্যা এদিক ওদিক তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করলো, সে কোথায় আছে? ঘুমের রেশ এখনো কাটেনি।
কি হয়ছে বিদ্যা বলতেই বিদ্যা অভির দিকে চেয়ে বলল,

–” খু্ব খারাপ একটা স্বপ্ন দেখেছি।”

–“খারাপ স্বপ্ন! আমাকে কি বলতে পারবে, তুমি কি স্বপ্নে দেখেছ?”

বিদ্যার চিবুক দিয়ে তখনো ঘাম বেয়ে পড়ছে। অভি ওর চিবুক মুছে দিয়ে আগ্রহ্য কন্ঠে বলল,

–” তুমি কি খুব ভয় পেয়েছ বিদ্যা! এই যে দেখ, আমিতো তোমার পাশেই আছি। তাহলে কেন ভয় পাচ্ছো?”

বিদ্যা অভির হাত শক্ত করে ধরে বলল,

-” আমি এমন স্থানে দাড়িয়ে ছিলাম সেই স্থান আমি চিনিনা। আমার আশে-পাশে অনেক মেয়ে দাড়িয়ে আছে। হয়ত কিছু ছেলেও অবস্থান করছিলো। কিন্তু আজব ঘটনা ঘটলো, প্রতিটা মেয়ের সাথে সাথে একটা করে জন্তু হাটছিল। ব্লাক চিতা, হোয়াইট-ব্লাক মেশানো চিতা, টাইগার, উলফ্, সহ হরেক রকম প্রানী। যার যেমন শক্তির ক্ষমতা তাদের কাছে তেমনই শক্তিশালী প্রানী অবস্থান করছিল। এমন সময় দেখি তুমি সেখানে অবস্থা করছো। আর তোমার পাশে একটা লায়ন অবস্থান করছে। মানে তোমার পাশে ছাড়া সেই কেশরধারী লায়ন কারো কাছে ছিলোনা। এমন সময় সেখানে একটা মেয়ে চলে আসে। তাকে দেখতে পাইনি। তার পিছনে লম্বা বড় বড় কোকড়ানো চুল আর তার পা ছিল উল্টো। তার পাশেও তোমার মত একটা লায়ন অবস্থান করছিল। কিন্তু সেটা সম্পূর্ন ব্লাক ছিল। ব্লাক লায়ন যে পৃথিবীতে থাকতে পারে সেটা আমার জানা ছিলোনা। এক পর্যায়ে সেই নারীর সাথে তোমার দন্ধ লাগে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের জন্য। হঠাৎই স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল।”

অভি সব শুনে বলল,

-” ওটা নিছক শুধুমাত্র একটা স্বপ্নই। আমিতো দেখছি একটা সামান্য স্বপ্ন তোমাকে কাহিল করে ফেলেছে। তাহলে তুমি আমাকে কন্ট্রোল করবে কিভাবে?”

বিদ্যা কিছু না বলে চুপ করে রইলো। খানিকবাদে আবার বলল,

–” অভি আমি সত্যি বলছি, স্বপ্নটা খুব ভয়ঙ্কর ছিল। জানিনা এমন স্বপ্ন কেন দেখলাম।”

অভি নিজেও অবাক হয়েছে বিদ্যার স্বপ্নের কথা শুনে। কারন বিদ্যা একজন সামান্য মানুষ হয়ে এই স্বপ্ন কিভাবে দেখছে। ইউরোপে সব থেকে বেশি প্যারানরমাল জনিত ঘটনা ঘটে। এমনকি তারা কালোবিদ্যা প্রচুর চর্চা করে। সেখানে কোন অশরী জাতিদের সাথে অন্য জাতির ভয়াভয় যুদ্ধ যদি হয় তাহলে তাদের এমন বার্তা পাঠানো হয়। আমি বুঝতে পারছি আমার জন্য আগামী দিনগুলো খুব ভয়াভয় হতে চলছে। কিন্তু আমার বার্তা বিদ্যার কাছে কেন ধরা খাবে? নাহ্ না মাথায় কিচ্ছু আসছেনা। বিদ্যাকে কি কিছু জিঙ্গাসা করবো? আমিতো নিজে দেখলাম ও সাধারন মানুষ ছাড়া কিছুই নয়।

–“আমি কিছু বলেছি অভি! তুমি কোন জবাব না দিয়ে চুপ করে কেন আছো?”

বিদ্যার কথায় অভি ভাবনার জগৎ থেকে বের হয়ে আসতে বাধ্য হল। বিদ্যার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে দু’হাতে ওর গাল ধরে মুখে প্রসন্নতার ভাব এনে বলল,

–” বাসায় গিয়ে কি বলবেন, সেটা কি ভেবেছেন ম্যাডাম!”

এতক্ষনে বিদ্যার ওর বাসার কথা মনে পড়ল। বিদ্যা অভির হাত নিজের কাছ থেকে ছাড়িয়েই বেড থেকে নেমে একপ্রকার দৌড় দিয়ে ওয়াসরুমে ঢুকলো। তারপর ফ্রেশ হয়ে এসে অভিকে বলল,

–” আমার শাড়ী কই!”

বিদ্যার কথায় অভি আগ্রহ প্রকাশ না করে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে বিদ্যার দিকে চেয়ে রইলো। তারপর আদুরে গলায় বলে উঠলো,

–” আর একটু থাকলেই পারতে! আমি সব কিছু মানেজ করে নিতাম।”

অনেক থেকেছি মসাই, আর না। আমার কাপড়গুলো কই বলেই এদিক ওদিক তাকালো বিদ্যা। এমন সময় অভি বিদ্যার হাত ধরেই এক হ্যাচকা টান দিল তাতেই কাজ হয়ে গেল। বিদ্যা বিছানায় পড়ে যেতেই অভি দ্রুত উঠে ওকে নিজের বশে আনলো। তারপর বিদ্যার গলায় মুখ গুজে ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল,

–” বলছিনা আমি মানেজ করে নিব! আর একটু আমার কাছে তোমাকে থাকতেই হবে। এত জলদি ছাড়ছিনা তোমায়।”

বিদ্যা অনেক চেষ্টা করলো অভিকে ছাড়াতে কিন্তু ওর শক্তির কাছে নিজের শক্তি তুচ্ছ ছাড়া কিছুই নয়। তাই বিদ্যা শান্ত হয়ে চুপ করে রইলো।

অভি একটু মুচকি হেসে বিদ্যার মুখের উপর ঝুকে গিয়ে বলল,

–” আমার উপর কি তোমার খুব রাগ হচ্ছে বিদ্যা! তোমায় রাগলে না, জোস লাগে।”

ছাড়তে যখন মন চায়না একবারে বাসায় নিয়ে আসলেই পারতে! শুধু শুধু চুরি করে আমায় এখানে নিয়ে আসো কেন! ছাড় আমায়……!

–“ওকে যেতে দিতে পারি এক শর্তে!”

–“আমি ওসব শর্ত-টর্ত মানিনা আর মানবোও না। আমি বাসায় যাব।”

অভি বেড থেকে উঠে ওয়াসরুমে যেতে যেতে বলল,

–” বাসায় কেউ নেই। অন্তত রান্না টুকু করে যাও।”

আমি পারবোনা। নিজের কাজ নিজেকে করে খেতে হয়। বিদ্যার কথা হয়ত অভি শুনতে পায়নি। তার আগেই ওয়াসরুমের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে সে। কথাগুলো শুনলে হয়ত অভি নিশ্চয় এর জবাব দিত। বিদ্যা বেড থেকে নেমে ফোনটা হাতে নিয়ে দ্রুত রান্নাঘরে ছুটলো।
সব প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র গুছিয়ে নিয়ে ফোনটা অন করে দেখলো, মোট ২৭ বার কল। অভি হয়ত রাতে ওর ফোনটা সাইলেন্ট করে রেখেছে। বিদ্যা কিচেন থেকে রুমে এসে অভির হেডফোনটা নিয়ে কানে গুজে ওর শাশুড়ী মাকে কল দিল। কল দিয়েই বিদ্যা কিচেনে গিয়ে ময়দা মাখতে শুরু করলো।

একটু পর কল রিসিভ করে অঞ্জনা দেবী বেশ রাগী কন্ঠেই বলল,

–” বিদ্যা, তুই কি রিতেশকে কল দিয়ে কিছু বলেছিস?”

শাশুড়ীর এমন কথায় বিদ্যা নিচু গলায় বলল,

–” মা আমারতো যেতে দেরি আছে তাই বড় দাদাকে বাসায় ফিরতে বলেছি। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরবে এটাই তো স্বাভাবিক তাই না?”

বিদ্যার কথা যেন আগুনে ঘি ঢালার কাজ করলো। অঞ্জনা দেবী কর্কশ ভাষায় বলে উঠলো,

–” নিজে আসতে পারবিনা সেটা বললেই তো হত। শুধু শুধু বাসায় ঝগড়া বাঁধাতে কেন গেলি! তুই জানিসনা, রনকের বৌ কেমন?”

বিদ্যার চোখে জল ছলছল করছে। তবুও নিজেকে সংযত করে বলল,

–” মা, রনকের বৌয়ের আমি সমস্যা, দাদারা সমস্যা তাহলে তো মিতা আরও বেশি অন্যায় কাজ করার সুযোগ পেয়ে যাবে। আপনি আর কাকির সুবিধার জন্য লক্ষীদি কে বাসায় যেতে বলেছি।”

আমি এখনো মরে যাইনি, এখনো বেঁচে আছি। আমি থাকতে তুই সিদ্ধান্ত নেওয়ার কে? গেছিসতো দেশে ফুর্তি করতে, এখানে আসার কি দরকার? আমার জন্য ভাবার কে আছে? বেশ দরদভরা কন্ঠে বলে উঠলো সাধনা দেবী।

বিদ্যা কান্না কন্ঠে মুখে হাসি দিয়ে বলল,

–” মা, আপনি যে আমাকে খুব মিস করছেন, সেটা সহজে বলে দিলেই পারতেন?”

বিদ্যা আর ওর শাশুড়ীর কথা বলার মাঝখানে অভি পিছন দিক থেকে এসে বিদ্যাকে জড়িয়ে ধরে একটা কিস করে বলল,

–” বৌ, কি হয়েছে তোমার! আমাকে বল? এভাবে কান্না কন্ঠে কার সাথে কথা বলছ?”

অভির কথা শুনে ওদিক থেকে অঞ্জনা দেবী আর এদিক থেকে বিদ্যা দু’জনেই একদম স্থির হয়ে গেল। বিদ্যা অসহায়ের মত ঘাড় ঘুড়িয়ে অভির মুখের দিকে তাকানোর চেষ্টা করলো। সাথে সাথে চোখ দিয়ে টপ করে জল পড়ে গেল।

অভি কোন কিছু না ভেবে ফিসফিসিয়ে বলল,

–” আমি কি তোমায় খুব কষ্ট দিয়ে ফেলেছি বিদ্যা। স্যরি বউ।”

ওপাশ থেকে অঞ্জনা দেবী চিৎকার করে বলে উঠলো,

–” বিদ্যা, তুই আমার ছেলেকে কিভাবে ভুলে গেলি! ওকে বুকের ভিতর কবর দিয়ে তুই আবার কেমনে বিয়ে করলি! তোর কি অপুর কথা একবারও মনে পড়েনি! গিড়গিটির মত নিজের রুপ দেখেই ছাড়লি? তাইতো বলি মাস হওয়ার পথে তবুও মেয়ে বাড়ি ফেরার কথা বলেনা কেন? আমার সাথে আর কখনো কথা বলবিনা। তোর সাথে এখন থেকেই সমস্ত সম্পর্ক শেষ। আমাকে ভুলেও কল দিবিনা।”

মা, মা আমার একটা কথা শুনোন প্লিজ বলতেই কল কেটে গেল। বিদ্যা ডুকরে কেঁদে উঠলো সাথে সাথে। অভি নিজেই হতবাক হয়েছে। অভি বিদ্যাকে ছেড়ে দিয়ে বিদ্যার সামনে এসে দাড়িয়ে বলল,

–” অপুর মা ছিল?”

বিদ্যা শুধু মাথা নিচু করে মাথা নাড়িয়ে সায় দিল। অভি বিদ্যার চোখের জল মুছে দিয়ে বলল,

–” আমি তোমার সামনে থাকা অবস্থায় যেন দেখিনা তুমি চোখের জল ফেলেছ। আমার কাছ থেকে আড়াল হয়ে যত চোখের জল ফেলার ইচ্ছা হয় ফেলাবা কিন্তু আমার সামনে নয়। আমি যেন ফার্দার তোমার চোখে জল না দেখি।”

অভি কথাগুলো বলে কিচেন থেকে বের হয়ে চলে গেল। বিদ্যার দু’হাতে আটা মাখানো তাই আর ঐ অবস্থায় ওর শাশুড়ীকে কল দিতে পারলোনা।

এদিকে অঞ্জনা দেবী অঝোরে কেঁদেই চলছে। নিজের মেয়ে না থাকায় বিদ্যায় ছিল তার একমাত্র ভরসা ও কাছের মানুষ। সেও এভাবে তাকে ঠকালো! অপু ওর জন্য কি না করেছে। সেই অপুকে ও ভুললো কি করে! আর রাগ করে কল কেটে দিলাম বলে, কল ব্যাক পর্যন্ত করলোনা? এত পরিবর্তন চলে এল মেয়েটার! অঞ্জনা দেবী কিছুতেই মেনে নিতে পারছেনা বিদ্যার এই পরিবর্তন।

বিদ্যা দ্রুত ময়দা মিক্স করে পরেটা বেলাতো যাবে এমন সময় অভি আবার কিচেনে চলে আসলো। অচমকায় বিদ্যার প্যান্টের পকেট থেকে ওর ফোনটা নিতেই বিদ্যা কেঁপে উঠে বলল,

–” কি করছো অভি?”

অভি বিদ্যার ঠোটে ওর আঙ্গুল চেপে ধরে বলল,

–” শশশচুপ। ”

অভির কথায় বিদ্যা চুপ করে পরোটা বেলতে লাগলো। অভি বিদ্যার ফোন থেকে অঞ্জনা দেবীর নাম্বারটা নিয়ে নিজের ফোন থেকে তাকে কল দিয়েই ফোনটা বিদ্যার সামনে রাখলো।

অঞ্জনা দেবীর ফোনে কল আসতেই উনি দ্রুত ফোনে হাত দিয়ে দেখলো আননোন নাম্বার। তিনি ভেবেছিলেন বিদ্যা হয়ত কল দিয়েছে কিন্তু তার সমস্ত আশা ভঙ্গ হয়ে গেল। চোখের জল মুছে কলটা রিসিভ করতেই ওনার চোখ স্থির হয়ে গেল। বিদ্যা সামনে দাড়িয়ে আছে। ওর সিঁথি ভর্তি সিঁদুর। ছেলেদের পোষাক পড়ে আছে।

কল রিসিভ হয়েছে ৩০ সে. হল বিদ্যা তা জানেইনা। হঠাৎ অভি স্কীনের সামনে এসে হাত জোড় করে বলল,

–” মিসেস. অঞ্জনা দেবী, আপনি কেমন আছেন? আমি বিদ্যার হ্যাসব্যান্ড, অভি ভৌমিক ।”

অভিকে দেখে অঞ্জনা দেবীর সমস্ত কথা বন্ধ হয়ে গেল। অঞ্জনা দেবী তার স্মৃতির ভান্ডার থেকে শুধু অপুকেই হাতড়ে হাতড়ে খুজে বেড়াচ্ছে। অঞ্জনা দেবী স্মৃতির ভান্ডার আজ বড্ড বেঈমানী করছে। অভিকে দেখে অপুর মুখটা কিছুতেই মনে পড়ছেনা। এ সে কাকে দেখছে! এটা তো তার অপু। অপু………

অভি অঞ্জনা দেবীর কথা শুনে একটু হেসে বলল,

–” আপনার উপর আমার রাগ হয়েছে। আপনি আমার বিদ্যাকে কাঁদিয়েছেন। আপনার পানিসমেন্ট হওয়া উচিত। এখন আপনিই বলেন আপনাকে কি পানিসমেন্ট দেওয়া উচিত?”

অঞ্জনা দেবী কান্না থেমে আদুরে গলায় বলে উঠলো,

–” অপু, বাবা আমার, আমার ভুল হয়ে গেছে বাবা। আমি কখনো আর বিদ্যাকে বকা দিবোনা। তুই আগেও যেমন বিদ্যার যত্ন নিতিস এখনো তাই নিচ্ছিস! আমার কথা কি তোর একবারও মনে পড়েনি!”

কথার মাঝখানে অভি বিদ্যাকে পিছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,

–” দেখেনতো, আমাদের কেমন মানিয়েছে? আপনি এখানে এসে আমাদের আর্শিবাদ করে যাননা! আমরা খুব খুঁশি হব।”

অভি বিদ্যাকে ফোনটা দিয়ে অঞ্জনা দেবীর জবাবের অপেক্ষা না করে সেখান থেকে চলে গেল। বিদ্যা পাশ ফিরে অভির চলে যাওয়ার দিকে চেয়ে রইল।

এদিকে অঞ্জনা দেবী গলা ফাটিয়ে বিদ্যা বলে চিৎকার দিল। শাশুড়ীর কথায় বিদ্যা ওর শাশুড়ীর দিকে চাইতেই সাধনা দেবী ছটপট করতে করতে বলল,

–” ও কই চলে গেল? আমার সাথে কথা না বলে ও কই চলে গেল? দোহাই মা, আমার ছেলেটার সাথে আমাকে কথা বলতে দে। আমি তোর কাছে জিবনে কিছুই চাইবোনা। আমার বুকে শুধু ছেলেটাকে ফেরত দে মা! সেই মুখ, সেই চেহারা, সেই কন্ঠ, সেই বয়স। এ আমার অপু ছাড়া কেউ নয়। ”

বিদ্যা দুই হাতের পিঠ দিয়ে চোখের জল মুছে বলল,

–” মা, ও অভি। আমাদের অপুদার পুর্নজন্ম হয়েছে অভি রুপে। ও UK কে থাকে। জানিনা আমাকে কিভাবে খুজে পেল। ওর কিছুই মনে নেই
পূর্ব জন্ম সম্পর্কে। ও সব ভুলে গেলেও আমাকে ওর স্মৃতি থেকে ভুলতে পারেনি।”
বিদ্যা অঞ্জনা দেবীকে অভির ব্যাপারে সব কিছু খুলে বলল।

অঞ্জনা দেবী বিদ্যার কথা শুনে শান্ত গলায় বললেন,

–” তোরা কবে বিয়ে করেছিস?”

–” এইতো কিছুদিন হল।”

আমাকে একবারো জানানোর প্রয়োজন বোধ করলিনা! কেন এমন করলি? ভালো থাকিস, এটাই তোদের দু’জনের জন্য আমার আর্শীবাদ রইলো। আমাকে ভুলেও কল দিবিনা।

অঞ্জনা দেবী কল কেটে দিয়েছেন। বিদ্যার মন অনেকটা হালকা হয়ে গেছে। কথাটা অবশেষে ফাঁস হয়ে গেল। মা এখন কাঁদবেন। যখন স্বাভাবিক হবেন তখন আবার আমার কাছে কল দিয়ে অভি সম্পর্কে জানতে চাইবে। বিদ্যা সব চিন্তা ভাবনা সমাপ্ত করে কাজে মন বসালো।
পরোটা, মার্টান, সবজি, ডাল, আরো ৩ পদের তরকারি রান্না করলো। তারপর চাল ধুয়ে রাইসকুকারে দিয়ে সব রেডী করে লাইন অন করে দিয়ে অভির কাছে চলে আসলো।

অভি বসে বিদ্যার ফোনে অপুর আগের পিক দেখছে। বিদ্যা ৬ বছরের শিশু তখন ছিল। অভি সব পিক খুটে খুটে দেখছে আর ভাবছে, অপুর সাথে আমার এত মিল! আমরা একই মেয়ের জন্য পাগল। আমি নিজেও জানিনা বিদ্যা আমার সমস্ত পছন্দের মধ্য ১ম পছন্দ কি করে হল! কেন আমার তাকে এত এত ভাল লাগে। সত্যিই কি আমার পূর্নজন্ম হয়েছে কথাটি মুখ দিয়ে প্রকাশ করতেই বিদ্যা দুর থেকে বলে উঠলো,

–” মায়ের সাথে কথা বলার সময় একবার ওনাকে মা বলে ডাকলে তিনি খুব খুঁশি হতেন।”

বিদ্যার কথায় অভি বিদ্যার দিকে চেয়ে চুপ করে রইলো। তারপর বলে উঠলো,

–” আমি আমার মাকে প্রচন্ড ভালোবাসি। আমার মাকে ছাড়া অন্য কাউকে মা বলে ডাকতে পারবোনা। সেটা তোমার নিজের মা হলেও। ঐ ডাকটা শুধু মাত্র আমার মমের অধিকার।”

–“উনিও তো তোমার মা অভি!”

–“যদি এটা আমার পূর্নজন্ম হয়েও থাকে তবুও আমার ঐ একটায় মা। এই বিষয়ে আমি একটা কথাও শুনতে চাইনা।”

–“তুমি তোমার পূর্নজন্মের কথা মানছো, কিন্তু তাকে কেন মা বলে স্বীকার করছোনা অভি! মা তো মায় হয়। তার কখনো পরির্বতন হয়না আর হবেওনা।”

শাট্ আপ, তুমি আমাকে শিখাইতে আসছো, মা কি জিনিস! আমি বলেছিনা, এ বিষয়ে আমি একটাও কথা শুনতে চাচ্ছিনা! কেন এক বিষয় নিয়ে আমার সাথে মিসবিহেভ করছো! তোমার অতীত জিবন শুধু মাত্র তোমার ছিল। সেই বিষয়ে আমি কিছু শুনতে চাইনা। আমার ভাল লাগেনা তোমার মুখে অন্য ছেলে আর তার পরিবারের কথা শুনতে। তুমি তাদের সাথে কি করবে সেটা কেবল তোমারই বিষয়। সেটা তোমার প্রবলেম, আমার নয় বুঝলে! এখানে তাদের সাথে আমার কোন লেনাদেনা নেই। কথাগুলো বলে অভি বিদ্যার ফোনটা বেডে ছুড়ে ফেলে দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল।

অভির এমন ব্যবহারে বিদ্যার অন্তর আত্ত্বা অবদি কেঁপে উঠলো। অভি পুরোটাই চেঞ্জ! কি হচ্ছে এসব। একটা মানুষ একমুত্ত্বের মধ্য কিভাবে এতটা চেঞ্জ হতে পারে!
বিদ্যা আর কোন কথা না ভেবে ওয়াসরুমে গিয়ে গোসল করে এসে আয়নার সামনে দাড়িয়ে শাড়ীটা পড়ে নিল। তারপর আয়নার দিকে চেয়ে নিজের রুপ দেখতে লাগলো। অভি কি এই চেহারার প্রেমে পড়েছে! তাহলে কি বিদ্যার কোন দাম নেই তার কাছে? আমি ভুল করছি তার কাছে ঘেঁষে! কথাগুলে ভাবতে ভাবতে বিদ্যার চোখে জল আসলো। বিদ্যা ওর চোখের পলক পরপর কয়েকবার ফেলে চোখের জল লুকানোর বৃথা চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু জল বের হবে বলেই পন নিয়েছে। তাই চোখকে ঝর্না বানিয়ে জল নদীর মত গাল বেয়ে চলতে লাগলো। বিদ্যা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে চুলের আড়ালে সিঁথিতে সিঁদুরের ছোয়া দিয়ে দিল। সধবা হয়েও সবার সামনে তাকে বিধবা সেজে থাকতে হয়।

বিদ্যা সব কম্পলিট করে এদিক ওদিক চেয়ে দেখলো, বেডের পাশে ল্যাম্পপোস্টের কাছে একটা নোটখাতা। বিদ্যা লিখতে বসল সেটা নিয়ে।

কোথায় কোন খাবার রাখা আছে, দুপুরে রান্না করতে হবেনা। কারন রান্না করা হয়ে গেছে। শুধু ওভেনে দিয়ে গরম করলেই চলবে। রাতে যেন বাহির থেকে খাবার অর্ডার করে আনে। না হয় কাবিরদের বাসায় গিয়ে খেয়ে আসে। কথাগুলো লিখে অভির ফোনের নিচে পেজটা রেখে বিদ্যা সবকিছু গুছিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল।

অভিকে আর দেখতে পায়না বিদ্যা। বাসা থেকে বের হয়ে একটা রিক্সা নিয়ে বাসস্ট্যান্ডে এল। তারপর একটা বাসে উঠলো।

অভি রুমে এসে দেখলো বিদ্যা নেই। বিদ্যা,,, বিদ্যা বলে কয়েকবার ডাক দিল। শেষে ফোনের নিচে চিরকুটটা পেল। চিরকুটটা পড়ে অভি হেঁসে ফেলল। কতটা রাগ থাকলে একটা মেয়ে তার হাবিকে অন্য মেয়ের বাসায় যেতে বলে। সে ভাল করেই জানে সেই মেয়েটা তার হাবিকে পাগলের মত চায়।

অভি ফোন, বাইকের চাবি নিয়ে রুম থেকে বের হল। তারপর বাইক স্টার্ট দিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেল। অভি মাঝে মাঝে চোখ বন্ধ করছে আর বিদ্যাকে ফোকাস করছে সে কতদুরে আছে। অভি বিদ্যার বাসের আগে এসে বাইক স্ট্যান্ড করলো। তারপর হাতের ইশারা করে বাসকে থামতে বলল। বাস থামতেই অভি দৌড়ে গেল। বিদ্যা জানালার পাশেই বসেছিল। অভি বাহিরে দাড়িয়েই জানালার কাচে হা করতেই মুখের গরম হাওয়া বের হয়ে কাচ ঝাপসা হয়ে গেল। অভি সেই আবছা কাচে আঙ্গুল দিয়ে লাভ চিহ্ন একে বলল,

–” খুব খুব ভালবাসি তোমায়।”

অভির এমন কান্ড দেখে বিদ্যা চোখ গরম করে জানালার কাঁচ সরিয়ে বলল,

–” শুধু একটা নিদিষ্ট মানুষকে ভালোবাসতে নেই, তার সাথে সম্পর্কের আশে-পাশে সকল মানুষদের ভালোবাসতে হয়। আজকের ব্যবহারে আমি খুব কষ্ট পেয়েছি।”

কথাগুলো বলে বিদ্যা বাসের ডাইভার কে বলল,

–” দাদা চলেন।”

অভি দাড়িয়ে রইলো রাস্তার পাশে আর গাড়ীটি চলল তার আপন গতিতে। অভির চোখটা ঝাপসা হয়ে এল। অভি আর একমুহুত্ত্বও সেখানে না দাড়িয়ে বাসায় চলে আসলো। তারপর রুমে এসে আসন পেতে আগে টুইংকেল আন্টিকে আহ্ববান করে সেই সিঁদুর দানীটার সমস্ত সিঁদুর হাতের তালুতে ঢেলে তাতে ফু দিতেই সমস্ত সিঁদুর ঘূর্নিপাকের মত ঘুরতে লাগলো। তারপর সিঁদুরগুলো বড় গোল চক্র ধারন করে অভির মাথার চারপাশে ঘুরতে লাগলো। এবার অভি চোখ বন্ধ করে ওর অতিত জিবনে ফিরে গেল……।

[] চলবে……..[]

সরাসরি ওয়েবসাইট এ পড়ুন: https://nafisarkolom.com/2020/10/sidur-suddhi-30/

আমার ব্যক্তিগত ফেইসবুক একাউন্ট: https://www.facebook.com/nafisa.muntaha

চাইলে আমার গ্রুপে জয়েন করতে পারেন: https://www.facebook.com/groups/nafisarkolom

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here