#না_চাহিলে_যারে_পাওয়া_যায় পর্ব ৩

0
729

#না_চাহিলে_যারে_পাওয়া_যায় পর্ব ২

#ফারহানা ইয়াসমিন

সকালে উঠে একমগ ব্লাক কফি খেয়ে ট্রেডমিলে আধাঘন্টা দৌড়। তারপর ফ্রেশ হয়ে একমগ প্রোটিন পাউডার খাওয়া রাযীনের প্রতিদিনকার রুটিন। গত পনেরো দিনে সেই রুটিনের ব্যত্বয় ঘটেছে। হন্যে হয়ে রুহির খোঁজ করতে যেয়ে নাওয়া খাওয়া ভুলতে বসেছিলো। নেহাতই বাবার জেদের কাছে হার মানতে হয়েছে, তা নয়তো ওই মেয়েকে খুঁজে এতো সময় নষ্ট করার মতো মানুষ রাযীন না। যে বিয়েটাকে সে মানেই না, যাকে বউ বলে স্বীকার করেনি কখনোই তাকে এতো কষ্ট করে খোঁজার কি মানে? পালিয়েছিলো রাযীন বাংলাদেশ ছেড়ে, ভেবেছিলো আর কোনোদিন ফিরবে না। কিন্তু ভাগ্য যে তার সে সংকল্পে হেসেছিলো তা কে জানতো? রাযীন ফিরে এলো, তাকে বাধ্য হয়ে ফিরে আসতেই হলো। শুধু তাই না, নিজের ফেলে যাওয়া বউ রুহিকে খুঁজে বের করতে হলো। কত পথ ঘাট চেনা হলো, গত কয়েকদিনে রাযীনের যেন কয়েকবছরের অভিজ্ঞতা হলো। আজ সকাল সকাল নিজেকে আয়নায় দেখে কেমন বুড়োটে দেখায়। রাযীন অনেকটা সময় আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকলো। পেটের ভুড়ি দেখা যাচ্ছে কি? গত কয়েকদিনের অনিয়মে স্বাস্থ্য বেড়েছে মনেহয়। রাযীন আলস্য ভরা দৃষ্টি নিয়ে ট্রেডমিলের দিকে তাকিয়ে রইলো। আজ কিছুই করতে ইচ্ছে করছে না তার। আলস্যটা কাল থেকে পেয়েছে। রুহির সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে। মেয়েটা এমন রিয়্যক্ট করবে এটা ধারনায় ছিলোনা। রাযীন ভেবেছিলো খুব পরিপাটি হয়ে সেজেগুজে থাকা একটা মেয়েকে দেখবে যার কথা হবে নরম। অথচ দেখা হলো চন্ডালিনির সাথে। একেতো চেহারায় কোন ছিরিছাঁদ নেই তারউপর কথাবার্তায়ও লেজেগোবরে। এমন রুড হয়ে কেউ তার স্বামীর সাথে কথা বলতে পারে? তাও আবার যদি হয় প্রথম দেখা? রাযীন এসে সোফায় বসে রুহির ছবিটা হাতে নিলো। বিয়ের সময় তোলা, যদিও কোনরকম মিল নেই ছবির সাথে। অবাক হয়ে লক্ষ করে রুহির পরিবর্তন গুলো মিলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। মেয়েদের স্বাভাবিক যে ব্রীড়া থাকে সেটা অনুপস্থিত রুহির ভেতর। খুব সাধারণ বেশ ভুষায় সজ্জিত রুহিকে কিছুতেই ছবির রুহির সাথে মেলানো যায় না। মেয়েটা আগে বেশ শুঁকনো ছিলো, এখন একটু স্বাস্থ্য হয়েছে। সেই সাথে চেহারায় এক ধরনের আত্মবিশ্বাস এসেছে। রুহিকে খুজতে যেয়ে রুহির সম্পর্কে অনেক কিছু জানা হয়ে গেছে রাযীনের। অনেক ঠোকর খেয়ে এতোদূর এসেছে বলে হয়তো মেয়েটার মধ্যে এক ধরনের কঠোরতা এসেছে। রাযীন ছবিটা দেয়ালে টাঙানো বোর্ডে ছবিটা আঁটকে দিলো। সামনে দাঁড়িয়ে থেকে ভাবছে কি করবে এরপর। কাল তো রুহি সরাসরি অস্বীজার, রাযীনের সাথে ফিরবে না। তাহলে এখন উপায়? চিন্তার অকুল সমুদ্রে হাবুডুবু খায় রাযীন। রুহি ছাড়া ফেরা যাবে না কিছুতেই। বাবা সে পথ আগেই বন্ধ করে দিয়েছে। ভেবেছিকে রুহি মেয়েটাকে হয়তো বুঝিয়ে সুনিয়ে বাড়ি নিতে পারবে। কিন্তু এখন বুঝতে পারছে এটা কতোটা কঠিন কাজ। অথচ এই কঠিন কাজটা করতেই হবে রাযীনকে। কিন্তু কিভাবে? ভাবতে ভাবতে মাথা হ্যাং হয়ে যায় রাযীনের কিন্তু কোন সমাধান খুঁজে পায় না। ঠিক করলো আজ ও নিজে যাবে রুহির কাছে। ঠান্ডা মাথায় আরো একবার বোঝানোর চেষ্টা করবে। মানলে ভালো না মানলে তখন অন্য ব্যনস্থা।

রুহির ব্যাংকের সামনে দাড়িয়ে আছে প্রায় একঘন্টা। রাযীনের কাছে মনেহচ্ছে একযুগ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। রাযীনকে দেখামাত্রই রুহি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো-
“আপনি! আপনি কেন এসেছেন? দেখুন কালই আমি জানিয়ে দিয়েছি আমি যেতে পারবোনা। সম্পর্কটা থেকে আমি সেদিনই বেড়িয়ে এসেছি। এতোদিনে মন থেকেও মুছে ফেলেছি। এ ব্যাপারে আমার সিদ্ধান্ত নড়চড় হবেনা আর। প্লিজ আমার পিছু নেওয়া বন্ধ করুন। আমি যাবো না মানে যাবো না।”
“যেতে হবে না। শুধু আমার সাথে বসে এককাপ চা খাও আর কিছু না।”
রাযীন শান্তস্বরে কথা বলে। রুহি বিষ নজরে রাযীনকে আপাদমস্তক জরিপ করলো-
“কেন শুধু শুধু চা খাবো আপনার সাথে? আপনাকে কি আমি চিনি? বিয়ের সম্পর্ক ছাড়া কোনদিন কি কথা হয়েছে আপনার সাথে? তাহলে এমন অপরিচিত মানুষের সাথে কি চা কফি খাওয়া চলে?”
রাযীন ভারী অপ্রস্তুত বোধ করে। আশেপাশের লোকজন বারবার ঘুরে তাকিয়ে তাদের দেখছে। ব্যপারটা ভীষণ অসস্তিকর। রাযীনের মেজাজ গরম হয়ে যাচ্ছে বলে বারবার নিজেই নিজেকে শাসালো-
‘কুল রাযীন কুল। মাথা ঠাণ্ডা কর। তোর কিছুতেই রাগ করা যাবে না, কিছুতেই না। তোর ওকে মানাতে হবে এটাই তোর চ্যালেন্জ।’
রায়ীন রুহির গা জ্বলানো কথায় মিষ্টি করে হাসলো। তারপর মৃদুস্বরে জানতে বললো-
“তা অবশ্য খাওয়া যায় না। আসলে কালকে তুমি ওমন ভাবে চলে এলে। অনেককিছু বলার ছিলো তোমাকে কিন্তু কিছুই বলা হলোনা। আর তুমি পুরো কথা না শুনেই এমন প্রতিক্রিয়া দেখালে যে আমিও আর পুরোটা বলার সাহস করিনি। এখন যদি অভয় দাও তাহলে বলতে পারি।”
রুহি তার দৃষ্টি কোনোরুপ পরিবর্তন না করে সন্দিগ্ধ চোখে বললো-
“বলে যে একটা ভাত টিপলেই বোঝা যায় হাড়ির চাল ফুটেছে কিনা। কাজেই আপনার এক কথায় বুঝে গেছি আপনি পরে কি বলবেন। আর কিছু শুনতে চাই না শোনার ইচ্ছেও নেই।”
“কেন? কেন শুনতে চাও না? ভয় পাও? যদি আমার কথ শুনে আমার সাথে যেতে মন চায় এই ভয়ে? যতই শক্ত মনের মেয়ের ভাব ধরোনা কেন আসলে তো মনেপ্রাণে সেই চিরচেনা বাঙালি নারী। পুরো কথা শুনে দূর্বল হয়ে যাওয়ার ভয়ে কথাই শুনবো না।”
রাযীনের কথায় রুহি আত্নবিশ্বাসী হাসি দেয়-
“এসব ডায়লগ বলেও খুব একটা লাভ হবে না। এসব ফিল্মি ডায়লগ শুনে আমি কি বলবো ভেবেছিলেন? ওগো, কি বলবে বলো টাইপ এক্সপ্রেশন দেবো এটা নিশ্চয়ই ভাবেননি? ও কাম অন, আপনি আমেরিকার থাকা মানুষ, এতোটা লেম কথাবার্তা কি মানায় আপনাকে বলুন?”
রুহি বলতে যেয়ে থামে, একমিনিট দম নেয় ফের শুরু করে-
“আপনি প্লিজ আমার আশা বাদ দিন। বরং ডিভোর্স পেপার রেডি করুন। আমি খুশি মনে তাতে সাইন দেবো। আলটিমেটলি এরাই আমাদের গন্তব্য ছিলো। বহু আগেই এটা হওয়া উচিত ছিলো। এখন হলেও কোন ক্ষতি হবে না।”
রাযীন কথার খেই হারিয়ে ফেলে। আমেরিকায় সবচেয়ে বড় ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকে চাকরিকরা রাযীন কি বলবে ভেবে পায় না। যা বলতে চেয়েছিলো সব গুবলেট পেকে গেছে। এই মেয়ে ইস্পাতের মতো শক্ত, গরম না করলে বাকবে না এটা বুঝে গেছে ভালোমতোই। কিন্তু একে কিভাবে গরম করবে? কি বললে রেগে যাবে? শেষ চেষ্টা হিসেবে রাযীন অনুনয় করলো-
“প্লিজ, আই ইনসিস্ট। এককাপ চা খাওয়ার কথাই তো বলেছি রুহি। মানা করো না। কথাগুলো বলা আমার জন্য ভীষণ জরুরি। সব শোনার পর না হয় ডিসিশন নাও কি করবে কি করবেনা?”
রুহি তীব্র বিতৃষ্ণা ভরে ঘড়ি দেখলো। আজ শুভর সাথে জরুরি আলাপ ছিলো। কথা হয়েছিলো অফিস শেষ করে ধানমন্ডিতে কফিশপে বসবে দু’জন। শুভ হয়তো এতোক্ষণে চলেও এসেছে, তার অপেক্ষা করে আছে। রুহি না বলার জন্য মুখ খুলতে যেয়ে দেখে রাযীন ওর দিকে হাত জোর করে তাকিয়ে আছে। বার বার মুখে প্লিজ প্লিজ করে যাচ্ছে। রুহি হতাশ হয়ে মাথা নাড়ে-
“আপনাকে পাঁচ মিনিট সময় দেবো। এরমধ্যে যা বলার বলবেন। পাঁচ মিনিট মানে পাঁচ মিনিট। চলুন ওই সামনের টংয়ে যাই, ওরা চা ভালো বানায়।”
রাযীন খুশি হয়ে প্রায় নাচতে যাচ্ছিলো। যাক, মাছ শেষ পর্যন্ত টোপ গিলেছে তাতেই ও খুশি। এবার বরশী দিয়ে টেনে তুলতে পারলে হয়।

“আপনার সময় শুরু হচ্ছে এখন।”
রুহি ঘড়ির দিকে চোখ রেখে এ কথা বলতেই রা্যীন এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করলোনা-
“আমি আসলে তোমাকে বাসায় নিতে চাইছি ডিভোর্সের উদ্দেশ্যে। এই উদ্দেশ্য নিয়েই আমেরিকা থেকে এলাম। আমি শুনেছি মিউচুয়াল ডিভোর্সে হাজবেন্ড ওয়াইফ দু’জনকেই কাজি সাহেবের কাছে যেয়েই বলতে হবে আমরা ডিভোর্স চাই। তাহলে কোন বড় ধরনের ঝামেলা ছাড়াই আমাদের ডিভোর্স কার্যকর হবে দ্রুত।”
“তাই! এই কথা বলার জন্য এতো কষ্ট করে আপনি আমাকে খুঁজে বের করেছেন!”
রুহি বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে রাযীনের পানে। তার চোখের আঙিনা জুড়ে অবিশ্বাসের পর্দা।

চলবে—
©Farhana_ Yesmin

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here