#না_চাহিলে_যারে_পাওয়া_যায় পর্ব ১১

0
514

#না_চাহিলে_যারে_পাওয়া_যায় পর্ব ১১
#ফারহানা ইয়াসমিন

“আন্টি, আঙ্কেলের এ অবস্থা কবে থেকে?”
অবাক রুহির মুখ থেকে কথা সরে না। জিভ অসার হয়ে আছে, চোখ দুটোকে এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না।
“আন্টি!”
রুহি থমকে গেলো। রোজী স্থির চোখে চেয়ে বললো-
“শোন রুহি, জানি এই মুহূর্তে নতুন করে সব শুরু করা অনেক কঠিন। তবুও বলবো, যা করছো মন থেকে করো। অন্যকে ফাঁকি দিতে গিয়ে না হয় নিজেই ফাঁকিতে পড়বে। তুমি আমাকে আম্মা আর ওকে বাবা ডাকো শুনতে ভালো লাগবে। তাছাড়া আমরা এতোটাও খারাপ মানুষ নই যে তোমার জীবন অতিষ্ট করে তুলবো। হতে পারে গতবার সবকিছু ভুলভাল হয়েছে তার মানে এই না যে সবসময় ভুলই হবে। রাজ একবার না হয় ভুল করেছে এবার করবে না এই আশা করি।”
রুহি এবার খুব বিরক্ত লাগলো। বারে বারে যেন ওকেই ভুল প্রমানের চেষ্টা। সে রুক্ষ স্বরে বললো-
“আন্টি, পাঁচ বছর খুব অল্প সময় কি? আপনার ছেলের জায়গায় যদি আমি এমন কিছু করতাম তবে কি এতো সহজে মেনে নিতেন আমাকে? কিংবা আপনারা কি আমার অপেক্ষায় ছেলেকে বসিয়ে রাখতেন সারাজীবন? আমি জানি, তিনমাসও অপেক্ষা করতেন না তার আগেই বিয়ে করিয়ে এ বাড়ির জন্য নতুন বউমা নিয়ে আসতেন। অথচ দেখুন, এতোদিন পর আমি এসেছি এজন্য আপনারা কৃতজ্ঞ না হয়ে উল্টো আমাকে নানা ভাবে হেউ করার চেষ্টা করছেন। এটা কি ঠিক হচ্ছে?”
রোজীর মুখের কথা আঁটকে গেলো। সে বিস্মিত হয়ে রুহির দিকে তাকিয়ে আছে। রুহি মিস্টি করে হাসলো-
“কথা আমিও বলতে পারি শুধু শিষ্টাচার আর সৌজন্যতাবোধের কারনে চুপ থাকা। এটাকে দূর্বলতা ভেবে নিলেই মুস্কিল। আপনার ছেলের জীবনে ফেরার কোন ইচ্ছে ছিলোনা আমার। সে হাতে পায়ে ধরে নিয়ে এসেছে আমাকে কাজেই কোন বিষয়ে আমাকে চাপ দেবেন না প্লিজ।”
রোজী ক্ষর চোখে রুহিকে দেখলো-
“তোমার শশুর যখন সুস্থ ছিলো তখন তার চোখে চোখ রাখার সাহস ছিলো না আমার। শাশুড়ী মা বুবু সবাইকে খুশি করেই এই সংসারে থেকেছি আর তুমি প্রথম দিনেই আমার সাথে এমন স্বরে কথা বললে? বাহ বেশ ভালো।”
রুহির মন একটু নরম হলো। বেশি বলে ফেলেছে এই ভেবে নিজেকে শুধরে নিতে চাইলো-
“সরি মা, আমি বলতে চাইনি আসলে আপনি বাধ্য করলেন। আমি কিন্তু..”
রোজী হাত দেখালো-
“থাক কৈফিয়ত দেওয়ার দরকার নেই। এই মানুষটার কল্যানে তুমি আজ এখানে দাঁড়িয়ে আছো। মানুষটা যতদিন সুস্থ ছিলো ততদিন নিজের মনমর্জিতে চলেছে। না ছেলেদের না আমার কারো কথা শোনেননি। তোমাকে বিয়ে করানোর সিদ্ধান্তও তার একার। ছেলেটা বারবার বলার পরও কোন কথা শোনেনি। তার কারনে পাঁচটা বছর আমাকে একা একা কাটাতে হয়েছে। এখন যখন বিছানায় পড়েছে তখনও তার ইচ্ছে রাখার জন্যই আমাদের চেষ্টা। এটা মনে রেখো রাজও তোমাকে শখ করে এ বাড়িতে আনেনি। তার পেছনেও এই মানুষটার হাত আছে। আমাদের সবার প্রতি অন্যায় করে মানুষটা তোমার প্রতি ন্যায় করতে চায়। ভালো না ব্যাপারটা?”
রুহি ভীষণ অসহায় চোখে বিছানায় শুয়ে থাকা মানুষটাকে দেখলো। শরীরের অর্ধেক অংশ প্যারালাইজইড মানুষটা কেমন অসহায় দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। বাবা না বললে হয়তো এখানে আর ফিরে আসা হতোনা রুহির। এই সম্পর্কটা তাকে তিক্ততা ছাড়া আর কিছু দেয়নি। পৃথিবীর সব বাবারা কেন যে সন্তানের জীবন নিয়ন্ত্রণ করতে চায় এটাই বুঝে উঠতে পারে না রুহি। সন্তান একটা আলাদা সত্তা, তার ভালোলাগা মন্দলাগা আছে, নিজস্ব বিচার বিবেচনা বোধ আছে। বাবারা যা ভাববে সেটাই ঠিক আর সন্তানেরা যা ভাববে সেটাই ভুল এমন ধারণা থেকে কবে বেড়িয়ে আসবে সবাই?

★★★

“তুমি কি ফোনটা খুলবে? তোমার বাবা ভীষণ চিন্তা করছে তোমাকে নিয়ে। তার সাথে একটু কথা বলো।”
রুমে ঢুকতেই রাযীন কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে গেলো রুহির। মোবাইলে নতুন নাম্বার নিতে হবে। শুভ ফোন দেবে এই ভয়ে রুহি সে নাম্বার বন্ধ করে রেখেছে।
“আপনার নাম্বার থেকে বাবাকে ফোন দিন আমি কথা বলবো।”
“কেন?”
“আমি আমার নাম্বারটা চালু করতে চাই না।”
“কেন?”
“সমস্যা আছে।”
“কি সমস্যা?”
রাযীন শয়তানি হাসি দিলো-
“প্রেমিকের কল আসবে তাই না?”
“হ্যা আসবেই তো। আসাটাই তো স্বাভাবিক নাকি?”
রুহি রেগে গেলো। রাযীন মুচকি হাসলো-
“আরে আসলে কথা বলবে। সমস্যা কি কথা বলতে? আমি তো সব জেনেই তোমাকে বাসায় এনেছি।”
রুহির মেজাজ ভালুক জ্বরের মতো ওঠানামা করে। সে দাঁত কিড়মিড় করে দু’হাত করজোড়ে রাযীনকে কুর্নিশ করে-
“আপনার বড় দয়া মহারাজ। আপনি মহান যে আমাকে কথা বলতে দিতে রাজি হয়েছেন। তা না হলে আমি তো মরেই গেছিলাম।”
রাযীন প্রথমটায় বুঝতে না পেরে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো পরক্ষণেই হো হো করে হেসে দিলো-
“আরে, তুমি তো জবরদস্ত অভিনয় জানো? নাটক করতে নাকি?”
রাযীনের কথা রুহির গা জ্বলে-
“শুনুন, আপনার হয়তো কোনো নীতি বা আদর্শ নেই জীবনে কিন্তু আমার আছে। আমি বলেছি আপনাকে সু্যোগ দেবো আর সেটা ভালো মতোই দেবো। কোনো লুকোচুরি করবোনা যদিও জানি এতো সততার পুরস্কার ভালো হবে না।”
রাযীন চোখ গোল করলো-
“তুমি জানো সততা দেখিয়ে লাভ নেই তবুও তুমি সৎ থাকবে। ব্যাপারটা খুব দারুণ। দেখো আমি কিন্তু বাপু এতো সৎ থাকতে পারবোনা। আমার প্রেমিকা আছে একটা স্প্যানীশ। ওকে ছাড়া কিছু ভাবতেই পারি না। নেহাৎ বাবার অসুস্থতার খবর পেয়ে ছুটে এসেছি।”
রুহি সরু চোখে রাযীনকে দেখলো-
“বাহ, তাহলে যে সেদিন আমাকে প্রেমিক নিয়ে নানা নীতিবাক্য ঝারলেন সেটা কি ছিলো?”
“ওতো একটু বলতে হয় বলে বলা। না বললে স্বামী সুলভ ব্যাপারটা থাকে না যে।”
রুহি অপ্রসন্ন মুখে রাযীনের কথা শুনলো। ভাবলো এ কেমন সম্পর্ক? দু’জনাই আরেকজনকে ভালবাসে তাহলে দু’জন একসাথে আছে কেন?
“কি ভাবছো এতো?”
“ভাবছি এসব রঙ তামাশার মানে কি? আপনি আপনার স্প্যানীশ গার্লফ্রেন্ড নিয়ে শান্তিতে থাকুক আমি আমার বয়ফ্রেন্ড নিয়ে। শুধু শুধু এই নাটকের মানে দেখি না কোন?”
রুহি প্রশ্নবোধক চাহনি দিতেই রাযীন চুপ করে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর বেশ নরম গলায় বললো-
“দেখো ব্যাপারটা তোমার কিংবা আমার নয়। আমি মোটেও চাই না তোমাকে জোর করে বেঁধে রাখতে। ইভেন তোমাকে পুনরায় জীবনে আনারও কোন ইচ্ছে ছিলোনা আমার। কিন্তু বাবার অবস্থা তো দেখছোই। এটা ছাড়াও বাবা কিন্তু ক্যান্সার আক্রান্ত। গলায় ক্যান্সারা বাসা বেঁধেছে। কেমো আর রেডিও থেরাপি দিয়ে এখন কিছুটা ভালো হলেও ডাক্তার আশাব্যন্জক কিছু বলেনি। তার কথা তিনি তোমার প্রতি অন্যায় করেছেন তাই তার সাজা পাচ্ছেন। তোমাকে এই বাড়িতে যথাযথ সম্মান দিয়ে কিছু প্রায়শ্চিত্ত করতে চান। তার যে অবস্থা তাতে তাকে থামানোটা আমার কাছে যৌক্তিক মনে হয়নি। একজন মৃত্যু পথযাত্রীর শেষ ইচ্ছে পূরণ করাটা সন্তান হিসেবে আমার দায়িত্ব। তুমি বলো আর কিছু কি করার আছে আমার?”
“বুঝলাম। কথাগুলো তো আগেই বলতে পারতেন আমাকে? এতো নাটক কেন করলেন?”
রাযীন দীর্ঘ শ্বাস ফেললো-
“সরি।”
“সরি! তাতে কি এই সমস্যার সমাধান হবে?”
রুহির রুক্ষ কন্ঠ শোনা গেলো।
“আচ্ছা, তোমার সাথে একটা ডিল করি এসো। আমরা দু’জনে মিলে সুন্দর একটা নাটক করি। ভালো স্বামী স্ত্রী সেজে অভিনয়। বাবা যতদিন জীবিত আছে ততদিন। তারপর তুমি তোমার রাস্তায় আমি আমার রাস্তায়।”
রাযীন কন্ঠ যথেষ্ট মোলায়েম করে বলতেই রুহি দু’হাত ভাজ করে পেটের উপর রাখলো-
“সেটা কতোদিন?”
রা্যীন বেশ চিন্তিত হলো-
“কতোদিন? সেটা কিভাবে বলি? উপর ওয়ালা ছাড়া এর উত্তর কারো জানা আছে বলে মনেহয় না।”
“আপনার কাছে কি মনেহয় এটা খুব ভালো পরিকল্পনা?”
“তোমার কাছে বেটার কিছু থাকলে বলো৷ এখন তো সব জানলেই।”
রাযীন হাল ছেড়ে দেওয়া ভঙ্গিতে বললো।
“আমি বরং আঙ্কেলের সাথে কথা বলি। তাকে বুঝিয়ে বলি আমি এখানে বউয়ের মর্যাদা চাই না। বরং ডিভোর্স হলেই আমাদের জন্য ভালো হবে।”
“এতো অসুস্থ একজন মানুষকে তুমি এসব বলবে? আর ইউ ম্যাড?”
রাযীন উত্তেজিত হয়ে গেলো। রুহি ঠান্ডা গলায় বললো-
“সত্য কথার চাইতে ভালো কিছু হয়না। এখন ওনার ইচ্ছে পূরণে চারটে জীবন নষ্ট হবে সেটা তো আরো খারাপ। তারচাইতে ওনাকে বুঝিয়ে বললে উনি নিশ্চয়ই বুঝবে?”
রাযীন নিজের মাথার চুল টেনে ধরলো-
“তোমার বাবার এমন কিছু হলে কি এতোটা কঠোর হতে?”
রুহি স্থানুর ন্যায় বসে রইলো। এমন প্রশ্নের কি উত্তর হয় তার জানা নেই। রাযীন কন্ঠে মধু ঢালে-
“প্লিজ রুহি, এমন কিছু করোনা প্লিজ। আমি তো তোমাকে বিরক্ত করছি না। কিছুই চাই না আমার, শুধু শেষ মুহূর্তে বাবার এই মনস্কামনা পূর্ণ করায় আমায় সাহায্য করো। আমি কথা দিচ্ছি, তুমি যেভাবে চাইবে সেভাবেই সব হবে। আমি তোমার সাথে একটুও বাজে ব্যবহার করবোনা, তোমার থেকে দূরত্ব বজায় রাখবো। যদি বাবার কিছু হয় তুমি না হয় তোমার সেই মনের মানুষের কাছেই ফেরত যেয়ো?”
রুহি কোন জবাব দিলো না। তার সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। কি হচ্ছে কেন হচ্ছে সব চোখের সামনে। নিয়তি এই নাটকের প্ল্যান আগেই করে ফেলেছে। তারা কেবল অভিনয় শিল্পী অভিনয় করে যাচ্ছে। হঠাৎ মাথায় প্রশ্নটা উকি দিয়ে গেলো।
“আচ্ছা, আপনি কি আমার কারনে দেশ ছেড়ে পালিয়েছিলেন?”
আচমকা রুহির প্রশ্নে টালমাটাল হয় রাযীন। ওর দেশ ছাড়ার কারনটা ও নিজে কি ঠিকঠাক জানে যে রুহিকে জানাবে? হ্যা, বিয়েটা তখন মনের উপর একটা আলাদা চাপ তৈরি করেছিলো এটা ঠিক তবে বাড়ি ছাড়ার এটা মুল কারন না। সেই কারনটা রাযীনের একান্ত ব্যক্তিগত যা কাউকে বলা হয়নি কখনো।

চলবে—
© Farhana_Yesmin

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here