#না_চাহিলে_যারে_পাওয়া_যায় পর্ব ২০

0
520

#না_চাহিলে_যারে_পাওয়া_যায় পর্ব ২০
#ফারহানা ইয়াসমিন

“তোমার সাহস হয় কি করে আমার অনুমতি না নিয়ে একশো কোটি টাকার ফান্ড ওই ব্যাংকে জমা করার? টাকাটা অন্য বিজনেসে ইনভেস্ট করার কথা ছিলো এটা কি কেউ তোমাকে বলেনি?”
আফজাল রাগে চেচিয়ে উঠলো, কথা বলার সময় থরথর করে কাঁপছে। রাযীন ক্ষীন কন্ঠে উত্তর দিলো-
“আমিও বোর্ড অফ ডিরেক্টরদের একজন ছোট আব্বু। ডিসিশন নেওয়ার অধিকার আমারও আছে। আমি ভালো করে যাচাই বাছাই করেই ডিসিশন নিয়েছি। ব্যাঙ্কে ইনভেস্টমেন্ট আপাতত লাভজনক হবে স্টিল মিলের চাইতে।”
“হাউ ডেয়ার ইউ? তোর এতো সাহস আব্বুর মুখে মুখে তর্ক করিস? একেতো চুরি তারউপর সিনা জুড়ি?”
সৌরভ তেড়ে এলো রাযীনের দিকে। ঝিলিক তাকে থামালো। আফজাল ফোঁস করে উঠলেন-
“সেদিনের পুঁচকে ছেলে আমাকে তুমি বিজনেস শিখাচ্ছো? কোনটা লাভ কোনটা লস এসব কি আমি বুঝি না? আর তুমি একা ডিসিশন নেওয়ার কে? আমরা কি মরে গেছি সবাই?”
আফজাল তেড়েফুঁড়ে আসতেই শিখা আটকালো-
“আহ! এতো উত্তেজিত হয়ো না তোমার শরীর খারাপ করবে।”
চিৎকার শুনে রোজী এসে দাঁড়িয়েছে-
“কি হয়েছে আফজাল? কি করেছে রাজ?”
“কি করেছে সেটা আপনার গুনধর ছেলের মুখ থেকেই শুনুন ভাবি। দু’দিন হয়নি দেশে এসেছে এরমধ্যেই নিজের মনমর্জি মাফিক চলতে শুরু করেছে। বড়ভাই যতদিন সুস্থ ছিলো কখনো কি শুনেছেন ভাইজানকে বাদ দিয়ে আমি কোন কাজ করেছি? সেই সাহসই তো ছিলোনা আমার। আর আপনার ছেলে দু’দিন হলো বিজনেসে জয়েন করে আমার অনুমতি না দিয়ে ব্যাংকে একশো কোটি টাকা ইনভেস্ট করেছে। আপনি ওর কাছে জানতে চান এই সাহস সে পেলো কোথায়?”
রোজী বিস্মিত হয়ে রাযীনের দিকে তাকালে সে চোখ নামিয়ে নিলো-
“ছোট আব্বু যা বলছে তা কি সত্যি রাজ? কেন তুমি এ কাজ করলে?”
“প্রয়োজন ছিলো বলেই করেছি আম্মু।”
“প্রয়োজন! কি প্রয়োজন? তুমি তো এতোদিন দেশেই ছিলে না। এভাবে হুট করে এতো টাকা ইনভেস্টমেন্টের রিস্ক নেওয়া কি ঠিক হয়েছে?”
রোজী শান্ত স্বরে কথাগুলো বললো। রাযীন নিজেকে বাচানোর চেষ্টা করলো-
“ঠিক হয়েছে। আমি ভালো করে খোঁজ নিয়েছি।”
“কিন্তু তোমার উচিত ছিলো ছোট আব্বুর পারমিশন নেওয়া। ছিলো না?”
রাযীন জবাব দিলো না। আফজাল চাপা গলায় বললো-
“ভাবি ওকে বলুন টাকা ফেরত আনতে। আমার প্রজেক্ট মোটামুটি ফাইনাল করে রেখেছি এখন ইনভেস্টমেন্ট না পেলে লসের মুখে পড়তে হবে।”
“সেটা সম্ভব না ছোট আব্বু। আপনি বরং সৌরভ ভাইকে বলুন টাকা দিতে। গত মাসে পঞ্চাশ কোটি টাকা ফাইন্যন্স করেছে কক্সবাজারে নিজের নামে ফাইভ স্টার হোটেল নির্মানের প্রজেক্টে তাও আবার কোম্পানির লিকুইড ক্যাশ থেকে নিয়ে। যেটা নতুন শিপ তৈরির বুকিং মানি ছিলো। এখন শিপ এর নির্মানের জন্য প্রয়োজনীয় কাচামালের অভাবে সে প্রজেক্ট নির্দিস্ট ডেডলাইন পার হওয়ার পথে। এসব নিশ্চয়ই আপনি জানেন?”
আফজাল অবাক বিস্ময়ে সৌরভের দিকে তাকালো। সৌরভের মুখচোখে যেন কেউ কালি মেখে দিয়েছে। সে ততক্ষণে মাথা নিচু করে বসে পড়েছে সোফায়।
“ওহহহ, তোমরা দু’ভাই শুরু করেছো কি? এতো কিছু হয়ে যাচ্ছে আর আমি কিছু টের পাই না কেন? ব্যবসাটাকে কি ডুবিয়ে ছাড়বে তোমরা?”
আফজাল হতাশ হয়ে সোফায় লুটিয়ে পড়লো। রোজী পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করলো-
“এখন আর এসব নিয়ে কথা বলোনা আফজাল। অফিস থেকে এসেছো ফ্রেশ হও। যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। এখন মাথা গরম করে কিছু পাওয়া যাবে না। শিখা তুমি আফজালকে নিয়ে যাও। আর তোমরাও সবাই যার যার কাজে যাও।”
উপর থেকে শান্ত দেখালেও রোজীর ভেতরে ভাঙচুর হচ্ছিলো। তার স্বামীর এতো কষ্টে গড়ে তোলা ব্যবসার হাল বুঝতে বেগ পেতে হয়নি বেশি। ক্ষমতা পেয়ে সবাই যার যার মতো করে নিজের আখের গোছাতে চাইছে এটা তো একটা বোকাও বুঝতে পারবে। রোজী কি করবে ভেবে পেলোনা। তার কি কিছু করনীয় আছে?

সৌরভ চলে যেতে যেতে রাযীনকে শিকারীর ন্যায় আপাদমস্তক জরিপ করলো। তার স্বপ্নের প্রজেক্টের খবর রা্যীন কি করে পেলো তাই তার মাথায় ঢুকছে না। অফিসেও বিশেষ কেউ এখবর জানে না। যারা জানে তাদের পক্ষে খবর ফাঁস করা সম্ভব না। তাহলে কে দিলো খবর? রাযীন তো দেশেও ছিলোনা এতোদিন। তার এতোবড় শুভাকাঙ্ক্ষী এখানে কে আছে যে সৌরভের খবর রাযীনের কাছে পৌঁছে দেয়। এতো সাহস কার হয়েছে? খুঁজে বের করতে হবে তাকে যত দ্রুত সম্ভব। ভাবতে ভাবতে নিজের রুমে গেলো সৌরভ, তার পেছন পেছন ঝিলিক। আজ কোনভাবে সৌরভকে রাগানো যাবে না নয়তো ঝিলিকের খবর করে ছাড়বে। যদিও রাযীনকে অপমান হতে দেখে ঝিলিকের মোটেও ভালো লাগছিলো না। হাজার হোক এক সময় দু’জনেই মিষ্টি একটা সম্পর্কে আবদ্ধ ছিলো। রাযীনকে অন্য কেউ অপমান অপদস্ত করছে এটা এখনো ঝিলিক সইতে পারে না। অন্তত আজকের ব্যাপার দেখে তাই বুঝতে পারলো সে নিজে। কিন্তু এসব কিছু ছাপিয়ে ঝিলিকের মনে অন্য প্রশ্ন উদয় হয়। প্রশ্ন হলো, রাজের মতো ছেলে হুটহাট কিছু করার মানুষ না। যে ছেলের বাবার ব্যবসা নিয়ে আগ্রহই ছিলো না সে কিনা সেই ব্যবসার টাকা অন্য কোথাও ইনভেস্ট করেছে শুনলে কেমন যেন খটকা লাগে। এতো বড় ইনভেস্টমেন্ট রাজ এমনি এমনি করবে এটা কেন যেন বিশ্বাস হয় না। এর পেছনে যৌক্তিক কারন নিশ্চয়ই আছে। কার জন্য এতো বড় রিস্ক নিলো রাজ?

★★★

“ইশশ, আঙুলের দাগ বসে গেছে। প্লিজ একটু বরফ লাগাতে দিন না?”
রুহি আইসব্যাগ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাযীন এতোক্ষণ মেজাজ খারাপ করে বসে ছিলো। আজকের ঘটনার রেশ অনেকদিন থাকবে। এর কনসিকোয়েন্স যে আরো খারাপ হবে সেটা ভালোই বুঝতে পারছে। সৌরভ এতো সহজে ওকে ছাড়বে না। আফটারঅল ওর গোপন খবরটা সকলের সামনে ফাঁস করে দিয়েছে। বসে বসে ভাবছিলো পরবর্তীতে সৌরভ কি করতে পারে। হঠাৎ রুহির দিকে তাকাতেই রুহি কথাটা বলে। রাযীন ওর পানে চেয়ে মুচকি হাসলো, নিজের চড় খাওয়া গাল পেতে দিলো-
“লাগাবে? লাগাও।”
রুহি খুশি হয়ে রাযীনের পাশে এসে বসলো। আইসব্যাগটা রাযীনের গালে লাগাতেই রাযীন ব্যাথায় অস্ফুটে চিৎকার করলো। রুহি দু’ঠোঁট গোল করে ফু দিতে দিতে সান্ত্বনা দেয় রাযীনকে-
“এই তো আরেকটু। তারপর ঠিক হয়ে যাবে। ব্যাথা হচ্ছে খুব তাই না?”
রুহি নিজের আগুল দিয়ে লালচে দাগ হয়ে থাকা গালের জায়গাটা ছুঁয়ে দিলো-
“আপনি আমার জন্য এতো ব্যাথা সহ্য করছেন এটা আমার বিশ্বাসই হতে চাইছে না। এতোকিছু কেন করছেন আমার জন্য? নিজেকে খুব ছোট মনেহচ্ছে।”
রাযীন ফট করে রুহির হাত ধরে ফেলে, ওর চোখে চোখ রেখে জানতে চাইলো-
“মানে কি? তোমার জন্য করবো কেন? ব্যবসায়ী কখনো নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছু করে না। ইনভেস্টমেন্টে লাভ না হলে কখনো টাকা ঢালতাম না। মনে রাখবে ব্যবসায়ীর প্রতিটা পদক্ষেপে লাভ থাকে।”
রুহি বোকা বোকা হাসি দিলো-
“তাই বুঝি? তা আমার ব্যংকে একশো কোটির ইনভেস্টমেন্টে কি লাভ বলুন তো?”
রাযীন মুচকি হেসে নিজেকে সামলে নিলো। আইসব্যাগটা রুহির হাত থেকে নিজের হাতে তুলে নিয়ে গালে চেপে ধরলো-
“তোমার আর জবে না গেলেও চলবে। বাসায় বসে বেতন নেবে। চাইলে যে কোন জায়গায় যে কোন সময় ট্রান্সফার নিতে পারবে। এতোকিছুর পরেও একশো কোটির ইনভেস্টমেন্টে লাভ আসবে। আসবে কি এসে গেছে অলরেডি। এই মনে করো তোমার হৃদয়ে জায়গা, তোমার সেবা এসব তো অনন্য দামী জিনিস। এগুলো বোনাস সহ বাড়ি গাড়ি পাচ্ছি সেটা কি কম পাওয়া? তাছাড়া টাকাটা কোথাও রাখা যাচ্ছে নিশ্চিন্তে এটাও কি কম পাওয়া?”
লাজে রুহির গালে রক্তিম আভা। লজ্জায় অধোবদন হয়ে মেঝেতে টাইলস দেখছে মন দিয়ে। তার ইচ্ছে করছে ছুটে পালাতে কিন্তু পা যেন স্ট্যাচু হয়ে গেছে নড়তেই পারলোনা। রাযীন ওর অবস্থা বুঝতে পেরে মুচকও মুচকি হাসছে।
“তা ম্যাডাম, গালে কি শুধু বরফই দেবো? কিন্তু এতে যে ব্যাথা যাচ্ছে না?”
রুহি ব্যস্ত হয়ে মুখ তুললো-
“কি ওষুধ দেবেন বলুনতো আমি এখনি লাগিয়ে দিচ্ছি।”
রাযীন রুহির ওষ্ঠের দিকে ইশারা করে-
“একটু স্পর্শ পেলেই আমি এই মুহুর্তে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবো। এর চাইতে ভালো মলম পৃথিবীতে আর একটিও নেই।”
রুহির চেহারা চেরি ফলের মতো লাল হতে শুরু করেছে। সে কপট রাগ হওয়ার ভাব দেখিয়ে বলে-
“আপনার স্প্যানীশ গার্লফ্রেন্ডকে ফোন করতে হবে দেখছি। গার্লফ্রেন্ড কে মিস করছেন খুব তাই না?”
“তা মিস করছি বটে কিন্তু আমার এখন স্প্যানীশ না দেশি বউয়ের আদর লাগবে।”
রাযীনের কথায় রুহি কান গরম হয়ে গেছে। সে সইতে না পেরে উঠে দাঁড়ালো-
“অসভ্য। দাঁড়ান আপনার গার্লফ্রেন্ডকে বিচার দিচ্ছি।”
“কোন সমস্যা নেই দিলে। ওটা অনেক উদার হয়। আমার উপর তুমি ভাগ বসালে কিছু মনে করবে না।”
রাযীন চোখ টিপলে রুহি চোখ বড় বড় করে তাকায়-
“আপনি সত্যি অসভ্য হয়ে গেছেন।”
রুহি চলে যেতে উদ্যত হতেই রাযীন ব্যাথায় ককিয়ে উঠলো। রুহি সাথে সাথে বসে পড়ে রাযীনের গালে হাত দিলো-
“ইশশশ, খুব ব্যাথা তাই না? কেন যে আমার জন্য এতো ঝামেলা কাঁধে নিলেন?”
রাযীন মিষ্টি করে হাসলো, আলতো করে রুহির থুতনি ধরে মুখটা ওর মুখের সামনে নিয়ে আসে। অপলক তাকিয়ে থাকে রুহির মুখের দিকে। প্রথমদিকে রুহির চেহারাটা চাকমা মেয়েদের মতো লাগলেও আজকে আর তেমন লাগছেনা। বরং ওর মোটামোটি ফর্সা মুখায়বরটি মায়াময় কোমল নরম আদর আদর লাগছে। চোখ দুটোর ঘোরে ডুবে যেতে যেতে রাযীন ফিসফিস করলো-
“তুমি আমার বউ না? বউয়ের জন্য একটা চড় কেন হাজার চড় খেতে রাজি আছি। এর চাইতে অনেক বেশি ব্যাথা সইতে রাজি। বউয়ের জন্য আমার জান হাজির।”

চলবে—
©Farhana_Yesmin

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here