#না_চাহিলে_যারে_পাওয়া_যায় পর্ব ৮

0
520

#না_চাহিলে_যারে_পাওয়া_যায় পর্ব ৮
#ফারহানা ইয়াসমিন

গাড়ির পেছনের সিটে ঘুমন্ত রুহিকে ডাকতে যেয়ে রাযীনের রুক্ষ মেজাজ আরো বেশি রুক্ষ হলো। রুহি মুখ হা করে হাত পা ছড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে মুখের উপর ছড়িয়ে আছে, শাড়ীর আঁচল জায়গাতে নেই ফর্সা বুকের অনেকখানি দৃশ্যমান। কয়েক পলকের জন্য রাযীনের চোখজোড়া রুহির গলার বিউটি বোনে স্থির হয়ে ছিলো। মুখ পানে দৃষ্টি পড়তেই মুখ কুঁচকে ফেললো। ছিহ, কি বিচ্ছিরি ভাবে ঘুমায় মেয়েটা। উপরের পাটির দাঁতগুলো উঁচু, দু’পাশে দুটো গজ দাঁত দেখে মনেহচ্ছে রাক্ষসী। বাম গালে লালার রস শুকিয়ে দাগ হয়ে রয়েছে। রাযীনের গা গুলিয়ে উঠলো। দু’পা পিছিয়ে এলো। অসহায় দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকালো। ভাগ্যিস বাড়িতে পৌঁছার আগে গাড়ি থামিয়েছে। এমন অবস্থায় নতুন বউকে দেখা কারো জন্য সুখকর হতোনা। রাযীন পাঁচ মিনিট ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে পুনরায় ফিরলো গাড়ির কাছে। ঝুকে রুহির কাছাকাছি গিয়ে ডাকলো বারকয়েক। রুহির কানে সে ডাক গেছে বলে মনেহয় না। সে একফোঁটাও নড়লো না। রাযীন আবার ডাকলো তবে এবার গলার ভলিউম বেশ উঁচুতে। রুহি একটু নড়েচড়ে উঠে কাত হয়ে আবার ঘুমিয়ে গেলো। রাযীনের মেজাজ খারাপ হতে শুরু করেছে। মেয়েটার গা দিয়ে ভুরভুর করে বমির গন্ধ আসছে। কাছে গেলেই বমি পাচ্ছে তার। এখন একে ঘুম থেকে তুলবে কি করে? ভাবতে ভাবতে হঠাৎ পানির বোতলের দিকে রাযীনের চোখ গেলো। সে হাতভরে পানি নিয়ে রুহির মুখে ছিটিয়ে দিলো। রুহি ‘ওমাগো ওমাগো’ বলে চেচিয়ে উঠতে যেয়ে দুবার গাড়ির ছাদে বাড়ি খেলো। পরতে পরতে মাথায় হাত দিয়ে পুনরায় গাড়ির সিটে বসে পড়লো-
“উফফ মা, কোথায় আছি আমি?”
“শশুর বাড়ির কাছাকাছি।”
রাযীনের গলা শুনে বড় বড় চোখ করে তাকাতেই হাফ প্যান্ট আর ব্লু পোলো গেঞ্জি পড়া রাযীনকে দেখে চেচিয়ে উঠলো-
“আপনি এখানে কেন?”
রাযীন দু’হাত আড়াআড়ি ভাবে বুকের উপর রেখে বিরক্ত হয়ে রুহিকে দেখলো-
“আমি থাকবো না তো কে থাকবে? তুমি আমার গাড়িতে বসে আছো এখন।”
রুহি দু’হাতে কপাল চেপে ধরে গাড়ি থেকে নামতেই রাযীন পিছিয়ে গেলো।
“আমরা কি পৌঁছে গেছি?”
“আর দশমিনিটের পথ।”
“তাহলে এখানে থামলেন কেন?”
“নিজের কি হাল করেছো তা দেখেছো একবার?”
রাযীন একনজর রুহির পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঘুড়িয়ে আনলো। রুহি রাযীনের সাথে সাথে নিজেকে দেখে আঁতকে উঠে শাড়ীর আঁচল সামলায়। ছি ছি! একি হাল ওর? এই অবস্থায় শুয়ে ছিলো নাকি? সংকোচে আধমরা অবস্থা রুহির।
“মুখ হা করে ঘুমাও নাকি? এতো বড় হয়েছো তবুও লালা পড়ে মুখ দিয়ে। কাপড় চোপড়ের কোন ঠিকানা নেই। একটা উত্তর তো আরেকটা দক্ষিণ।”
রাযীন নিষ্ঠুরের মতো একের পর এক বাক্যবান ছুড়ে দিচ্ছে রুহির দিকে। রুহি যেন মরমে মরে যাচ্ছে। অপমানে কান ঝা ঝা করছে। রাযীনের মুখের দিকে তাকানোর সাহস হলোনা। লোকটা আস্ত একটা অসভ্য। শুধু বিলেতে থাকাই সার কোনো ভদ্রতা শেখেনি। রুহি দাঁতে দাঁত চেপে গর্জন করলো-
“আপনি কিভাবে ঘুমান? জানেন? ঘুমন্ত অবস্থায় নিজেকে দেখেছেন কখনো?”
রাযীন থতমত খেলো। রুহি মিষ্টি করে শয়তানী হাসি দিলো, কন্ঠ খাদে নামিয়ে জবাব দিলো-
“আচ্ছা ভাববেন না এতো আমি দায়িত্ব নিয়ে জানাবো কিভাবে ঘুমান।”
রাযীন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। এই মেয়ে তো দেখা যায় ধানীলঙ্কা। পাল্টা জবাব দেওয়ার কথা মনে এলো না রাযীনের। রুহির কন্ঠ নরম হলো-
“আসলে তিন রাত না ঘুমানোর ফলে শরীরটা খারাপ লাগছিলো। বমি করে একেবারে নেতিয়ে গেছিলাম। এখন হঠাৎ ঘুম থেকে উঠার কারনে প্রচন্ড মাথা ধরে গেলো। আমাকে ঘুম থেকে ডাকা উচিত হয়নি আপনার।”
রাযীন কপাল কুঁচকে রুহিকে দেখলো-
“তো কি ঘুমন্ত তোমাকে কোলে নিয়ে বাসায় ঢোকা উচিত ছিলো?”
রুহি পূনরায় উগ্র মেজাজে ফিরে তড়িঘড়ি জবাব দিলো-
“তাই কি বলেছি আমি? খবরদার ঝগড়া করার চেষ্টা করবেন না। এমনিতেই শরীর খারাপ, আপনার সাথে কথা বলে আর নিজের বাকী এনার্জি লস করতে চাই না।”
রাযীন কড়া কথা বলতে যেয়ে নিজেকে সামলে নিলো-
“আচ্ছা ঠিকাছে। এখন একটু পরিপাটি হয়ে সামনে এসে বসো। আমরা বাড়ীর কাছাকাছি আছি। নতুন বউয়ের এমন অগোছালো ভাব ভালো দেখায় না। লোকে কথা বানাবে।”
“আমাকে যে এতো কথা বলছেন নিজে কি পরে আছেন?”
রুহি পাল্টা জবাব দেয়। রাযীন হাসলো-
“আমি ও বাড়ির ছেলে জামাই না। নিজের বাসায় ন্যাংটো গেলেও কারো কিছু বলার নেই।”
“সেটাই। আপনাদের তো চাইতে সুখী কে আছে? জায়গা চেঞ্জের ঝামেলা নেই, কাপড়ের খেয়াল না রাখলেও চলে, ইচ্ছে করলে বিয়ে করলাম ইচ্ছে হলো বউ ফেলে চলে গেলাম আবার ইচ্ছে হলো ফিরে এলাম। সব আপনাদেরই তো ইচ্ছে আর আমরা আপনাদের চাবি দেওয়া পুতুল।”
রাযীন খুব মন চাইছিলো জবাব দিতে কিন্তু শেষ মুহূর্তে মত বদলালো। এসব তোলা থাক, সঠিক সময়ে হিসেব নেবে। আপাতত মহারানী একটু বলে যদি সুখী হয় তো হোক। রুহি নিজেকে যতটা পারা যায় গুছিয়ে নিয়ে চুপচাপ সামনে এসে বসলো রাযীনের পাশের সিটে। রাযীন গাড়ী স্টার্ট দিলো আনমনে। বাড়ির ভাবনা আসছে মাথায়। ও যে আজ বউ নিয়ে আসছে সেটা কাউকে বলা হয়নি। ভেবেছে
বাবাকে সারপ্রাইজ দেবে। বাবা হয়তো খুশিই হবে কিন্তু মা কিভাবে মেনে নেবে কে জানে। মা আজকাল খুব বিক্ষিপ্ত থাকে, মনমেজাজ সবসময় উত্তপ্ত। স্বাভাবিক কথাও অস্বাভাবিক ভাবে নেবে। রুহিকে দেখে আবার কোন সিনক্রিয়েট না করে। রাযীন চিন্তিত মুখে গাড়ী ড্রাইভ করছে।

চিটাগং শহরে রাত নেমেছে। ওরা রওনা হয়েছিলো তখন সকাল এগারোটা। হিসেব মতে সন্ধ্যায় চিটাগং পৌঁছানোর কথা। কিন্তু রাস্তায় জ্যামের কারনে আসতে আসতে রাত দশটা। রুহি মন দিয়ে রাস্তার দু’ধারের ঠিকানা গুলো দেখে। গতবারে এসব দেখার কথা মনেই হয়নি। এবার তাই সব খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে। ওরা এখন চিটাগং শহরের পাঁচ শাইল এলাকা। রুহির নিজের এলাকার কথা মনে পড়ে। ওরা ফেনি শহরে থাকতো। বাবার ব্যাংকে চাকরির সুবাদে কয়েক জায়গা ঘুরলেও শেষ পর্যন্ত বাবা নিজের জন্মস্থানে থিতু গাড়বার জন্যে মনস্থির করেছিলো রুহির ক্লাস নাইনে ওঠার সময়। বারবার স্কুল পরিবর্তন বেশ ঝামেলার কাজ। তাছাড়া সেই সময় হঠাৎ করে রুহির দাদা মারা গেলে দাদী একলা হয়ে যায়। দাদী নিজের বাড়ী ছেড়ে দূরে কোথাও থাকবেন না। রুহির বাবা দুইবোনের একটা মাত্র ভাই হওয়ায় মাকে দেখাশোনার দায়ভার তার কাধেই বর্তায়। বাবা তাই ফেনী শহরে নিবাস গাড়েন। ফুলগাজীর আনন্দপূরে রুহির দাদাবাড়ী। ফেনী শহর থেকে খুব সহজে বাড়ী যাওয়া যাবে বলেই এই ব্যবস্থা। বাবা প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে আনন্দপুরে দাদীর কাছে যেতো শনিবার চলে আসতো। বছর কয়েক যাওয়ার পর দাদী যখন অসুস্থ হলেন তখন দাদী তাদের সাথেই থাকতে লাগলেন নিয়মিত। তিন কন্যার মা হওয়ায় দাদী মাকে অপচ্ছন্দ করতো এটা রুহি বেশ বুঝে গেছিলো। অসুস্থ দাদীর সম্পূর্ন সেবা করার পরও মাকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল দিতো দাদী। রুহি সেসবের প্রতিবাদ করতো বলেই দাদী একদম অপচ্ছন্দনীয় ছিলো রুহি। সেই সময় বাবার চিটাগং পোস্টিং হলো। এক বৃহস্পতিবার বিনা নোটিশে বাবা আশরাফ আঙ্কেলকে নিয়ে হাজির। রুহি তখন ইন্টার পরীক্ষা দিয়ে বাড়িতে বসে আছে।ভর্তি কোচিং এর প্রস্তুতি নিচ্ছে। সে ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি বাবা আশরাফ চাচার ছেলের সাথে তার বিয়ে পাকা করেছে।
“নামো, এসে গেছি আমরা।”
এক ঝটকায় ফেনী থেকে চিটাগং এর সুগন্ধা রেসিডেনসিয়াল এ চলে এলো রুহি। যে বাড়ির সামনে গাড়ি থেমেছে সেটা বিশাল বড় প্যালেস বলা চলে। রুহি গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়িয়ে পূর্ণ দৃষ্টি মেলে বাড়িটাকে দেখলো। গাছপালায় ঘেরা বাড়িটাকে দেখলে যে কারো মন জুড়িয়ে যাবে। সবকিছু মনেহয় আগের মতোই আছে। মনেহয় কারন গতবার এতো মন দিয়ে দেখার সময় পাওয়া যায়নি। একদিন থাকার ভাগ্য হয়েছিলো এই প্যালেসে। পুরো বাড়ি দেখার সৌভাগ্য হয়নি তার আগেই নিজ বাসস্থানে ফেরত গেছিলো। গতবার না হয় থাকোনি কিন্তু এবার কতোদিন রুহি? নিজেকে প্রশ্ন করে মুচকি হাসলো কেবল।

চলবে—
©Farhana_Yesmin

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here