#না_চাহিলে_যারে_পাওয়া_যায় পর্ব ৩২

0
665

#না_চাহিলে_যারে_পাওয়া_যায় পর্ব ৩২
#ফারহানা ইয়াসমিন

“তোমার সাথে আমার কথা জরুরি কথা আছে।”
সৌরভ শাওয়ার নিয়ে বেরুতেই ঝিলিক তাকে ধরলো। সৌরভ বিরক্তি নিয়ে একপলক দেখলো তাকে তারপর বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। ভীষণ ক্লান্ত সে কাজেই কথা বলার মতো অবস্থা নেই।
বোনের দাফন শেষ করে ঘরে ফিরেছে। অনেকটা গোপনীয়তা অবলম্বন করে নুরীকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। সমাজের লোকেরা জানলে কানাঘুষা ফিসফিস, উঁচুস্তরে বাস করার জন্য এসব ব্যাপারে আপোষ করতে হয়। সৌরভ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে পাশ ফিরে শোয়। মায়ের কান্না দেখে আজ খুব কষ্ট হচ্ছিল সৌরভের। ঝিলিকের সাথে সম্পর্কটা নিয়ে ইদানীং মনের মধ্যে অনুশোচনা বোধ করলেও আজ মায়ের কান্না দেখে মনে হলো সে কোন ভুল করেনি। য করেছে ভালো করেছে। রাজের কোন হক নেই সুখে থাকার, বড় আব্বুর কোনো হক নেই ছেলেপুলে নাতি নাতনী নিয়ে আনন্দে সময় কাটানোর। ঝিলিককে নিয়ে সৌরভের মনের ক্লেদ একলহমায় কেটে গেলো। সেই সময় করা কাজের জন্য তার আফসোস নেই কোনো। আজ মনেহচ্ছে সে যা করেছিলো একদম ঠিক করেছিলো।

অতীত স্মৃতি আজ আরো একবার সৌরভের মনে হানা দিচ্ছে। বড় আব্বুর সাথে পারিবারিক বন্ধুত্বের সুবাদে ঝিলিকদের এ বাড়িতে আনাগোনা একদম ছোট কাল থেকে। ঝিলিককে মনে মনে পচ্ছন্দ করলেও রাজের পচ্ছন্দ বলে ঝিলিকের উপর থেকে নজর সরিয়ে ফেলেছিলো সৌরভ। কিন্তু হঠাৎ তাদের পরিবারে যে ঝড় উঠলো তাতে সব হিসাব নিকাশ পাল্টে গেলো। সবেমাত্র পড়া শেষ করে দেশে ফিরে বিজনেসে জয়েন করেছে সে। রাজ কেবল পড়তে গেছে আমেরিকায়। আলিফ আর নুরীর ব্যাপার জেনে তারা ভাইবোনেরা ভীষণ খুশি। সেই সময় কি থেকে কি হয়ে গেলো পরিবারটা এলোমেলো হয়ে গেলো। আলিফ মারা গেলো, নুরী মানসিকভাবে অসুস্থ হলো। কতো ডাক্তার দেখানো হলো কিন্তু নুরী সুস্থ হয় না। দিনদিন ওর অবস্থা খারাপ হতে লাগলো। যাকে দেখে মারতে আসে, অনেক সময় নিজেই নিজেকে আঘাত করে। বাধ্য হয়ে মা ওকে মানসিক হাসপাতালে এডমিন করায়। মাঝে মাঝে নুরীকে দেখতে হাসপাতালে যেতো সৌরভ। মাথার চুলগুলো আলুথালু, চেহারায় অসংখ্য আঁচড়ের ক্ষত আর পায়ে শিকল পড়িয়ে রাখা নুরীকে দেখে প্রায় পালিয়ে আসতো সৌরভ। তার এতো সুন্দর বোনটার এই হাল দেখে মানতে কষ্ট হতো। মায়ের কান্না আহাজারি সৌরভ পাগলপারা হয়ে যাচ্ছিলো। মনের মধ্যে প্রতিহিংসার ঢেউ ওঠে তার। ঝিলিক প্রায়ই বাড়ি আসতো, ওকে দেখেই প্ল্যানটা মাথায় আসে। পুরনো ভালোবাসা জেগে ওঠার সাথে প্রতিশোধ নেওয়ার এতো সহজ উপায় হাতছাড়া করে কোন বোকা? আমেরিকায় রাযীন লিভ টুগেদার করে এই বাক্য ছুঁড়ে ঝিলিককে কাবু করলো। তারপর প্রমান দেখানোর কথা বলে নির্জনে ডেকে নিয়ে ঝিলিককে দখল করা। এরপর ঝিলিককে ভয় দেখিয়ে বিয়েতে রাজি করাতে সমস্যা হয়নি আর। বড় আব্বু আর বড় আম্মু অবাক হয়েছিলো তার সাথে ঝিলিকের বিয়ের খবর শুনে। কিন্তু কেন যেন প্রতিবাদ করেননি। হয়তো আলিফ নুরীর ব্যাপার নিয়ে সংকুচিত ছিলো তারা। নতুন করে কোন ঝামেলা চাননি বলেই এই বিয়েতে টু শব্দ করেননি। শুধু অণুরোধ ছিলো রাজের কাছে যেন এই খবর না পৌছায়। রাজকে বিয়ে করাবেন তারপর যেন সৌরভের বিয়ের অনুষ্ঠান হয়। সৌরভ মেনে নিয়েছিলো বিনাবাক্যে।
বড় আম্মু অসুস্থ এই খবর দিয়ে রাজকে দেশে আনানো হয়। রাজকে বাধ্য করা হয় বিয়ে করতে। বড় আব্বু তখন তাড়াহুড়ো করে রাজকে রুহির সাথে বিয়ে করিয়ে দিলেও শেষ রক্ষা করতে পারেনি। রাজ ততদিনে তার সাথে ঝিলিকের বিয়ের খবর জেনে গেছে। বারকয়েক ঝিলিকের সাথে যোগাযোগ করেও যখন কথা বলতে পারেনি তখন অপমানিত রাজ বিয়ের রাতেই আমেরিকা পালিয়ে যায়। নাহ, এসবের জন্য সৌরভের আফসোস নেই কোনো। তখনও ছিলোনা এখনও নেই। শুধু মনে হয়েছে রাজ কষ্ট পেলে বড় আব্বুকে কষ্ট দেওয়া হবে। তার মা যেমন কেঁদেছে বড় আব্বুকেও কাঁদতে হবে। শুধু তার না হওয়া সন্তানের জন্য কষ্ট লাগে। এরমধ্যে নিস্পাপ জানটার কি দোষ ছিলো? তাকে কেন এই পৃথিবী ছাড়তে হলো? মুখে পানির ছিটা খেয়ে চোখ মেলে সৌরভ। গ্লাসে পানি নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে ঝিলিক। রাগ উঠলো সৌরভের, রাগান্বিত হয়ে উঠে বসলো-
“কি চাই? কেন বিরক্ত করছো?”
“আমার কিছু জানার আছে তোমার কাছ থেকে। কিছু প্রশ্নের জবাব চাই আমার।”
ঝিলিক ঠান্ডা গলায় কথাগুলো বললো। সৌরভ রাগে লাল চোখ দিয়ে ঝিলিককে ঝাঁজরা করে দিতে দিতে বললো-
“আমি এখন ভীষণ ক্লান্ত, তোমার সাথে কথা বলার মতো অবস্থায় নেই।”
ঝিলিক সৌরভের লাল চোখকে পাত্তা দিলো না। সে দাঁতে দাঁত চেপে বললো-
“তুমি সারাজীবন ব্যস্ত ছিলো কাজেই আজ এসব অজুহাতে পার পাবে না। আমি যা জানতে চাই তার উত্তর আজ তোমাকে দিতে হবে।”
সৌরভ চোখ কিছুটা সরু হলো, নিজেকে সামলে নিয়ে হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে অনুনয় করলো-
“আমি আজ সত্যিই ক্লান্ত। প্লিজ কাল কথা বলি?”
ঝিলিক তার সিদ্ধান্তে অনড় রইলো-
“না আজ এখনি। আমি জানতে চাই রাজের সাথে আমার সম্পর্ক আছে জানার পরও তোমার মনে আমার জন্য ভালোবাসা আসে কি করে? এতো নাটক করে আমাকে বিয়ে করলে কেন? তুমি বলে আমাকে ভালোবাসো অথচ এই পাঁচবছরে আমি তোমার ভালোবাসা টেরই পেলাম না। বলো, কেন আমার জীবন নষ্ট করলে? কেন আমাকে ব্লাকমেল করে বিয়ে করলে? এতো কিছু করার উদ্দেশ্য কি ছিলো তোমার?”
সৌরভ চমকে উঠলো, এতোদিন পর ঝিলিকের মুখে এসব কথা শুনবে ভাবেনি কখনো। উত্তর দিলে সম্পর্কটা যেমন সুতোর মতো বাঁধনে লটকে আছে সেটুকুও থাকবেনা।অথচ জবাবের অপেক্ষায় ঝিলিক একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। আজ ঝিলিকের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য সত্য বলা ছাড়া উপায় নেই। সৌরভ নিজেকে সামলে নিলো,
অসহায় দৃষ্টিতে ঝিলিকের দিকে তাকালো-
“দেখো ঝিলিক, আপু মারা গেছে গতকাল। একটু আগে আপুকে দাফন করে এলাম। মনটা এমনিতেই ভালো নেই, দয়া করে আজকের মতো এসব বাদ দাও। আমার মনটা ভালো নেই। একটু রেস্ট করতে দাও আমাকে।”

★★★

“তোর কি এখনো রুহির প্রতি ভালোবাসা আছে? রাজ ওকে ফেলে গেলে তুই ওকে আপন করে নিবি?”
শিখার এমন প্রশ্নে শুভ হচকে গেলো। আজকাল মন অন্যদিকে দেওয়ার আপ্রান চেষ্টা করছে শুভ। রুহিকে ভুলতে সব ধরনের চেষ্টা করছে কেবল কোন মেয়ের সাথে কথা বলতে পারে না। মাঝে কয়েকটা মেয়ের সাথে ডেটিং এর চেষ্টা করেছে কিন্তু আগাতে পারেনি। মেয়েদের সাথে কি কথা বলবে সেটাই খুঁজে পায় না। রুহিটা একটু তাড়াতাড়িই ওকে ভুলে গেলো। এতোটা তাড়াহুড়ো শুভ আশা করেনি। ওর আশা ছিলো রুহি ওকে ভালোবাসে, ওর কাছেই ফিরে আসবে। দু’জনে মিলে আলাদা একটা স্বর্গ বানাবে। ভেবেছিলো রুহিকে বিয়ে করে ছোট্ট একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে দু’জনে মিলে সুখের নীড় গড়ে তুলবে। এ বাড়িতে ফেরার কোন ইচ্ছে ছিলোনা শুভর। মাঝখান দিয়ে কি হয়ে গেলো। রুহি এখন রাজের বাচ্চার মা হবে। শুভর বিশ্বাস হয় না একদম বিশ্বাস হয় না। মাঝে মাঝে মনেহয় শুভ স্বপ্ন দেখছে, স্বপ্ন ভঙ্গের পর দেখবে সব আগের মতোই আছে। সে আর রুহি অফিস শেষে ছায়ানটের আবৃত্তি অনুষ্ঠানে যাচ্ছে। কিন্তু সেরকম কিছুই ঘটে না। উল্টো কাল রুহি হাসপাতালে গেলো। যে কোন সময় হয়তো বাচ্চা হওয়ার খবর পাওয়া যাবে। শুভ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে মায়ের পানে চাইলো-
“কেন বলোতো? হঠাৎ এ কথা কেন? রাজ ভাই ওকে ফেলে কেন যাবে? দু’জনে তো ভালোই আছে মনেহচ্ছে?”
“উপর দিয়ে দেখে কি সব বোঝা যায়? যা দেখছিস তা ভুলও হতে পারে।”
শিখা কাঠ কাঠ গলায় কথাগুলো বললো। শুভ ভ্রু কুঁচকে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো, কিছু বোঝার চেষ্টা করলো। তারপর স্বাভাবিক কন্ঠে বললো-
“ওরা দু’জন যদি ভালো থাকে তাহলে থাক মা। ওদেরকে আলাদা করার দরকার নেই। জরুরি না যে ওকে ভালোবেসেছি বলে পেতেই হবে। হ্যা এটা সত্যি যে একটা সময় আমার মনে হতো, রুহিকে না পেলে মনেহয় আমি মারা যাবো। কিন্তু এখন অনেকটাই সামলে উঠেছি। রুহি যেভাবে ভালো থাকে থাক।
ভালোবাসার মানুষকে পেতেই হবে এই থিউরিটাই ভুল। ভালোবাসার মানুষ অন্যের সাথে ভালো থাকলে ক্ষতি নেই। আমার কষ্ট হলেও আমি মেনে নেবো মা। ওদের ওদের হালে ছেড়ে দাও। আমি মন থেকে চেষ্টা করছি জীবনে এগিয়ে যাওয়ার।”
শিখার চোখ যেন কিছু সময়ের জন্য জ্বলে উঠে আবার নিভে গেলো। ছেলেকে কিছুটা সময় মন দিয়ে দেখলেন।
“ভালোই হলো তুই বুঝে গেছিস। আমিও মেয়েটাকে মেনে নিতে পারতাম না। তোর জন্য আমি তোর ছোট খালার মেয়েকে ঠিক করে রেখেছি। তবে রুহির ভাগ্য কষ্ট লেখা আছে শুভ। আর এতে আমার কিছু করার নেই। কষ্ট ওকে পেতেই হবে আজ হোক কাল। এখন ওর কষ্টের কারন ও নিজে কারন ও এ বাড়িতে ফিরেছে। ও যদি তোর সাথে সংসার পাততো তাহলে
এ বাড়িতে ফিরতো না আর ওর কষ্ট পেতে হতোনা। যেহেতু এ বাড়িতে ফিরেছে কাজেই অদৃষ্ট চায় ও কষ্ট পাক। এখানে আমার কোন হাত নেই।”
শুভ আঁতকে উঠলো-
“মা প্লিজ, তুমি ওর সাথে কিছু করবে না। আমি বলছি তোমাকে প্লিজ মা।”
শিখা উঠে দাঁড়ালো-
“আমি কিছু করবো তা তোকে কে বলেছে? তবে একটা কথা জানিয়ে রাখি তোর আগের দোয়া কবুল হয়েছে শুভ। তুই চেয়েছিলি রুহিকে। এখন ওকে পেয়ে গ্রহন না করা তোর ইচ্ছে। ওকে নিয়ে এতো ভাবিস না।”
শিখা চলে যাওয়ার আগে শুভর পিঠ চাপড়ে দিলো। দুশ্চিন্তায় শুভর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। মা এভাবে বললো কেন? কি হতে চলেছে রুহির সাথে?

চলবে—
©Farhana_Yesmin

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here