#যদি_প্রেম_দিলে_না_প্রাণে পর্ব১

0
712

#যদি_প্রেম_দিলে_না_প্রাণে পর্ব১

🖋️রিয়া সেন দত্ত 🖋️

কোর্ট থেকে বাড়ি ফেরার পর নিজেকে সম্পূর্ণভাবে চেম্বার এ বন্দী রেখেছে মৈনাক | গম্ভীর মুখে বসে আছে | এরকম গম্ভীর থাকলে তার সাথে কথা বলার ধৃষ্টতা কেউ দেখায় না | নিজের সমস্ত লোকদের সে জানিয়ে দিয়েছে, আজ আর কারোর সাথে সে দেখা করবে না | শরীরটা বড়ো ক্লান্ত |

মৈনাক বসু, কলকাতা হাইকোর্ট এর নামকরা ব্যারিস্টার | মৈনাকের বাবা এবং ঠাকুরদা দুজনেই উকিল ছিলেন কলকাতা হাইকোর্ট এ | কাজেই বংশপরম্পরায় ওকালতিটা মজ্জাগত মৈনাকের | চষা জমিতে পসার জমাতে খুব বেশি সময়ও লাগেনি মৈনাকের | অল্প সময়েই বেশ নামডাক তার |

উত্তর কলকাতায় বাড়ির একতলায় চেম্বারটা মৈনাকের দাদুর আমলে তৈরী | দাদুও ওই একই কাঠের চেয়ারে বসে মক্কেলদের সমস্যার কথা শুনতেন | এখন মৈনাক শোনে | পরতে পরতে ঐতিহ্যর বার্তা দেয় চেম্বারটা | নিজের পেশা সম্পর্কে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী মৈনাক |

চেম্বারটা একটা ছোটখাটো লাইব্রেরি বলা চলে | সেখানে একবার যখন সে ঢোকে তখন সে অন্য জগতের মানুষ | নিজের পেশা ছাড়া অন্য কিছু বোঝেনা | সেখানে সব ধরণের বই আছে | মৈনাক বই পড়তে ভালোবাসে |

❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤

চেম্বারে ঢুকে নিজের চেয়ারে বসে চোখ বুজে আছে মৈনাক | আজ সে আদালতে অপর্ণার কাছে একপ্রকার পর্যদস্তু হয়েছে | তার এতো বছরের অধ্যাবসাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে ওইটুকু মেয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে ও হারতে শেখেনি | স্পর্ধা তো কম নয় এ মেয়ের | গার্গী, অপালা, মৈত্রেয়ী এদের সম্পর্কে পড়েছে মৈনাক | বৈদিক যুগের বিদুষী নারী | যারা সব কিছুতে পারদর্শীনি ছিল |

এ দিন ইদ্রানীল চ্যাটার্জী এর এজলাসে অপর্ণাকে সেইরকম বিদুষী নারীদের মতোই মনে হয়েছিল মৈনাকের | অপর্ণার সাথে নিজের সহকারী বন্ধুর তর্কযুদ্ধটা তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছিলো মৈনাক | এরপর যখন সে নিজের মামলায় তর্ক শুরু করলো মনে হলো আদালত কক্ষে ঝড় চলছে |

এই প্রথম মৈনাক হারতে চায় কোন মামলা | কিন্তু নিজের পেশার সাথে এমনটা সে কখনো করেনি | মক্কেল যে দোষী তা সে নিজেও জানে | তবু পেশা তো পেশা-ই | মক্কেল কে বাঁচানোই তার লক্ষ্য | যদিও মৈনাকের মনে হচ্ছে এবারের যুদ্ধটা তার নিজের সাথে | কারণ অপর্ণা, মৈনাক বসুর দ্বিতীয় স্ত্রী |

❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤

অপর্ণা নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে ক্লান্ত হয়ে বসে ভাবছে | এ মামলা নিছক আর পাঁচটা মামলা নয় তার কাছে | এটা যুদ্ধ, নিজেকে প্রমাণ করার যুদ্ধ | এ যুদ্ধ যোগ্য স্ত্রী হবার যুদ্ধ |

আজ প্রত্যেক ক্ষেত্রে মৈনাককে ও বুঝিয়ে দিতে পেরেছে ও কোনও দিক থেকেই মৈনাকের অযোগ্য নয় | তার প্রতি ভালোবাসার লেশমাত্র নেই মানুষটার মধ্যে |

অপর্ণার মনে কোথাও একটা দ্বন্ধ চলছে | এ মামলা যে নিছক মামলা নয় সেটা অপর্ণা সেদিনই বুঝেছিলো যেদিন কোর্টে ওর বিপরীতে মৈনাককে সামনাসামনি দেখেছিলো | সে নিজে এই পেশায় মৈনাকের চেয়ে নতুন হয়ে মৈনাকের মতো একজন উকিলকে টক্কর দেওয়ার কথা ভাবছে |

যেন মক্কেল এর হয়ে নয়, নিজের অপমানের প্রতিশোধ নিতে অপর্ণা আসরে নেমেছে | দীর্ঘ ন’বছর ধরে এ জ্বালা বুকে নিয়ে ঘুরছে অপর্ণা | সে সধবা না কুমারী নাকি স্বামীর পরিত্যক্তা তা সে নিজেও ঠাওর করতে পারে না | বুকের ভেতরটা জ্বলতে থাকে অপর্ণার | “কেন করলো বিয়ে? দয়া দেখাতে?স্বামীর কোনও দায়িত্ব পালন করেনি | বিয়ের রাত থেকে অবজ্ঞা ছাড়া এ পোড়া কপালে কিছুই জোটেনি |” স্ত্রী হবার খাতায় কলমে সামাজিক স্বীকৃতিটুকু ছাড়া আর কিছুই তো দেয়নি সে তাকে | কিন্তু অপর্ণা যে তাকেই…..

এমন সময় ঘরের দরজায় টোকা অপর্ণা দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলো তার বড়ো ননদ দাঁড়িয়ে | নন্দাই হাতে মিষ্টির হাঁড়ি নিয়ে গলা বাগিয়ে বলছে “কি গো ছোট গিন্নী, শালা বাবু কে যে নাস্তানাবুদ করে ছাড়লে, তা বুড়ো বয়সে বেচারার আবার সইবে তো এমন অত্যাচার ?” বলেই একগাল হাসলেন |

বড় ননদ আর নন্দাই অপর্ণার কাছে ভগবানের থেকে কম কিছু নয় | আজ অপর্ণা যা কিছু তার পেছনে এই দুটো মানুষের অবদান অনস্বীকার্য |

❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤

“মেয়ের বয়স তো মাত্র আঠেরো এখনই বিয়ে দিয়ে দেবেন পঞ্চানন দা?” পাড়ার গৌড় মিত্তির বললো কথাটা | বিকেলে পুকুর পাড়ের আড্ডার ঠেকে তাস খেলতে খেলতে পঞ্চানন বললো “ইসসস দরদ দেখে আর বাঁচি না! মেয়ে আমার আমি বুঝবো | আমার পক্ষে ওই বুড়োধারীকে গলায় ঝুলিয়ে ঘোরা সম্ভব না, বিয়ের বয়স হয়েছে বিয়ে দিয়ে দেবো ব্যাস ঝামেলা শেষ |” মুখ বেঁকিয়ে গৌড় বললো “সে তোমার মেয়ে, তাকে জলে ফেলবে না ডাঙায় রাখবে সে তোমার ব্যাপার তবু এক পাড়া, এক গাঁয়ে থাকি তাই বললাম আর কি |” অন্যরা সাথে সাথে বলে উঠলো “হ্যাঁ হ্যাঁ বিয়ের যুগ্গি মেয়েকে ঘরে বসিয়ে রাখা ঠিক না পঞ্চানন | তুমি বিয়ের ব্যবস্থা করো |”

অপর্ণার মা বেশিদিন হয়নি মারা গেছে | এরই মধ্যে তার বাবা মদ ধরেছে | প্রতিদিন মদ গিলে আসে | অপর্ণা দুদিন বাড়িতে ঢুকতে দেয় নি | সেই রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বেশ কয়েকদিন বাড়ি ফেরেনি পঞ্চানন | মেয়ের জন্যে পাত্র খুঁজে তবেই ফিরবে | কানা হোক, খোঁড়া হোক যা পাবে তার গলায় ওই মেয়েকে ঝুলিয়ে দেবে | মেয়েকে ঘাড় থেকে নামানোর ব্যবস্থা করে তবেই বাড়ি ফিরবে সে | ছোট থেকেই ছেলে না হওয়ার জন্যে পঞ্চানন তার বৌকে কম গালাগাল করেনি | মাঝে মধ্যে মারধরও করেছে |

অপর্ণা শুনেছিলো ওর জন্মের পর ওর ঠাকুমা ওর মুখও দেখতে চায়নি | প্রথম বাচ্চা মেয়ে হয়েছে শুনেই বিলাপ করতে শুরু করেছিল ঠাকুমা কপাল চাপড়ে | যদিও অপর্ণার পরে গৌরীর একটা ছেলে হয়েও বাঁচেনি | তাই অপর্ণা ছিল গৌরীর প্রাণ | ঠাকুমা যতদিন বেঁচে ছিল গৌরীকে তিষ্টতে দেয়নি ওই মেয়ের জন্যে | চেলা কাঠ দিয়ে পর্যন্ত মেরেছে গৌরীকে |

সারাদিন সংসারে অক্লান্ত পরিশ্রম করেও শাশুড়ি আর বরের থেকে গালমন্দ ছাড়া আর কিছুই জুটতো না গৌরীর | শাশুড়ি মারা যাবার পর গৌরী তবু প্রতিবাদ করতো | এসব দেখতে দেখতেই অপর্ণা বড়ো হচ্ছিলো | তার বাবা যে তাকে সহ্য করতে পারত না সেটা সে জানতো | আর পাঁচজন বাবার মতো তার বাবা ছিল না | তাই বাবার কাছে ছোট থেকেই সে খুব একটা ঘেঁষতও না | মা -ই ছিল তার জগৎ | মা এর কষ্ট অপর্ণার বুকে বাজতো | তার জীবনের সব কথা শোনার সঙ্গী ছিল তার মা | অপর্ণা ছোটবেলায় মা কে বলতো “আমি যখন বড়ো হবো, তখন তোমায় কোনও কষ্ট করতে দেবো না |” মা আদর করে বলতো “পড়াশোনা কর, আমার মতো হোস না | ”

অপর্ণার মা চলে যাবার পর থেকেই বাপের এমন রূপ দেখে অপর্ণার খারাপ লাগে | নিজের বাবা অথচ শত্রুর ও অধম | কিন্তু কিছুই করতে পারে না | আগে সংসার ভালো মতই চলতো | বাবা অন্যর ক্ষেতে কাজ করতো | আর মা সেলাই করতো |

অপর্ণার গায়ের রঙটা চাপা | সেই নিয়ে গাঁ-এর সবাই একটু নাক উঁচু করলেও অপর্ণার মা কখনো এ বিষয়ে ভাবতেন না | কারণ তিনি জানতেন তার মেয়ের গায়ের রং কালো হলে কি হবে পড়াশোনায় সে ভালো | গৌরী নিজে পড়াশোনা করতে পারেনি | তাই খুব ইচ্ছে ছিল মেয়ে যেন লেখাপড়া করে বড়ো হয়, ভালো মানুষ হয় | সেবারে মাধ্যমিকে সে গাঁয়ের সবচেয়ে ভালো ফল
করেছিল | তাই স্কুল থেকেই অপর্ণার উচ্চ মাধ্যমিকের জন্যে সবরকমের সাহায্য করতো | স্কুলে সে মেধাবী ছাত্রী হিসেবেই পরিচিত ছিল | কিন্তু ফাইনাল পরীক্ষার আগেই অপর্ণার মা কয়েকদিনের অজানা জ্বরে চলে গেলো | তবু মেয়েটা ভালো ফল করেছিল | মা এর সব স্বপ্নপূরণ করতে চায় সে | কিন্তু তার ভাগ্য কি সঙ্গ দেবে?
সে নিজেও জানে তার বাবা তাকে এবার বিদেয় করবে |

❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤

(চলবে )
ছবি : গুগল

#🖋️রিয়া সেন দত্ত 🖋️

কোর্ট থেকে বাড়ি ফেরার পর নিজেকে সম্পূর্ণভাবে চেম্বার এ বন্দী রেখেছে মৈনাক | গম্ভীর মুখে বসে আছে | এরকম গম্ভীর থাকলে তার সাথে কথা বলার ধৃষ্টতা কেউ দেখায় না | নিজের সমস্ত লোকদের সে জানিয়ে দিয়েছে, আজ আর কারোর সাথে সে দেখা করবে না | শরীরটা বড়ো ক্লান্ত |

মৈনাক বসু, কলকাতা হাইকোর্ট এর নামকরা ব্যারিস্টার | মৈনাকের বাবা এবং ঠাকুরদা দুজনেই উকিল ছিলেন কলকাতা হাইকোর্ট এ | কাজেই বংশপরম্পরায় ওকালতিটা মজ্জাগত মৈনাকের | চষা জমিতে পসার জমাতে খুব বেশি সময়ও লাগেনি মৈনাকের | অল্প সময়েই বেশ নামডাক তার |

উত্তর কলকাতায় বাড়ির একতলায় চেম্বারটা মৈনাকের দাদুর আমলে তৈরী | দাদুও ওই একই কাঠের চেয়ারে বসে মক্কেলদের সমস্যার কথা শুনতেন | এখন মৈনাক শোনে | পরতে পরতে ঐতিহ্যর বার্তা দেয় চেম্বারটা | নিজের পেশা সম্পর্কে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী মৈনাক |

চেম্বারটা একটা ছোটখাটো লাইব্রেরি বলা চলে | সেখানে একবার যখন সে ঢোকে তখন সে অন্য জগতের মানুষ | নিজের পেশা ছাড়া অন্য কিছু বোঝেনা | সেখানে সব ধরণের বই আছে | মৈনাক বই পড়তে ভালোবাসে |

❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤

চেম্বারে ঢুকে নিজের চেয়ারে বসে চোখ বুজে আছে মৈনাক | আজ সে আদালতে অপর্ণার কাছে একপ্রকার পর্যদস্তু হয়েছে | তার এতো বছরের অধ্যাবসাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে ওইটুকু মেয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে ও হারতে শেখেনি | স্পর্ধা তো কম নয় এ মেয়ের | গার্গী, অপালা, মৈত্রেয়ী এদের সম্পর্কে পড়েছে মৈনাক | বৈদিক যুগের বিদুষী নারী | যারা সব কিছুতে পারদর্শীনি ছিল |

এ দিন ইদ্রানীল চ্যাটার্জী এর এজলাসে অপর্ণাকে সেইরকম বিদুষী নারীদের মতোই মনে হয়েছিল মৈনাকের | অপর্ণার সাথে নিজের সহকারী বন্ধুর তর্কযুদ্ধটা তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছিলো মৈনাক | এরপর যখন সে নিজের মামলায় তর্ক শুরু করলো মনে হলো আদালত কক্ষে ঝড় চলছে |

এই প্রথম মৈনাক হারতে চায় কোন মামলা | কিন্তু নিজের পেশার সাথে এমনটা সে কখনো করেনি | মক্কেল যে দোষী তা সে নিজেও জানে | তবু পেশা তো পেশা-ই | মক্কেল কে বাঁচানোই তার লক্ষ্য | যদিও মৈনাকের মনে হচ্ছে এবারের যুদ্ধটা তার নিজের সাথে | কারণ অপর্ণা, মৈনাক বসুর দ্বিতীয় স্ত্রী |

❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤

অপর্ণা নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে ক্লান্ত হয়ে বসে ভাবছে | এ মামলা নিছক আর পাঁচটা মামলা নয় তার কাছে | এটা যুদ্ধ, নিজেকে প্রমাণ করার যুদ্ধ | এ যুদ্ধ যোগ্য স্ত্রী হবার যুদ্ধ |

আজ প্রত্যেক ক্ষেত্রে মৈনাককে ও বুঝিয়ে দিতে পেরেছে ও কোনও দিক থেকেই মৈনাকের অযোগ্য নয় | তার প্রতি ভালোবাসার লেশমাত্র নেই মানুষটার মধ্যে |

অপর্ণার মনে কোথাও একটা দ্বন্ধ চলছে | এ মামলা যে নিছক মামলা নয় সেটা অপর্ণা সেদিনই বুঝেছিলো যেদিন কোর্টে ওর বিপরীতে মৈনাককে সামনাসামনি দেখেছিলো | সে নিজে এই পেশায় মৈনাকের চেয়ে নতুন হয়ে মৈনাকের মতো একজন উকিলকে টক্কর দেওয়ার কথা ভাবছে |

যেন মক্কেল এর হয়ে নয়, নিজের অপমানের প্রতিশোধ নিতে অপর্ণা আসরে নেমেছে | দীর্ঘ ন’বছর ধরে এ জ্বালা বুকে নিয়ে ঘুরছে অপর্ণা | সে সধবা না কুমারী নাকি স্বামীর পরিত্যক্তা তা সে নিজেও ঠাওর করতে পারে না | বুকের ভেতরটা জ্বলতে থাকে অপর্ণার | “কেন করলো বিয়ে? দয়া দেখাতে?স্বামীর কোনও দায়িত্ব পালন করেনি | বিয়ের রাত থেকে অবজ্ঞা ছাড়া এ পোড়া কপালে কিছুই জোটেনি |” স্ত্রী হবার খাতায় কলমে সামাজিক স্বীকৃতিটুকু ছাড়া আর কিছুই তো দেয়নি সে তাকে | কিন্তু অপর্ণা যে তাকেই…..

এমন সময় ঘরের দরজায় টোকা অপর্ণা দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলো তার বড়ো ননদ দাঁড়িয়ে | নন্দাই হাতে মিষ্টির হাঁড়ি নিয়ে গলা বাগিয়ে বলছে “কি গো ছোট গিন্নী, শালা বাবু কে যে নাস্তানাবুদ করে ছাড়লে, তা বুড়ো বয়সে বেচারার আবার সইবে তো এমন অত্যাচার ?” বলেই একগাল হাসলেন |

বড় ননদ আর নন্দাই অপর্ণার কাছে ভগবানের থেকে কম কিছু নয় | আজ অপর্ণা যা কিছু তার পেছনে এই দুটো মানুষের অবদান অনস্বীকার্য |

❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤

“মেয়ের বয়স তো মাত্র আঠেরো এখনই বিয়ে দিয়ে দেবেন পঞ্চানন দা?” পাড়ার গৌড় মিত্তির বললো কথাটা | বিকেলে পুকুর পাড়ের আড্ডার ঠেকে তাস খেলতে খেলতে পঞ্চানন বললো “ইসসস দরদ দেখে আর বাঁচি না! মেয়ে আমার আমি বুঝবো | আমার পক্ষে ওই বুড়োধারীকে গলায় ঝুলিয়ে ঘোরা সম্ভব না, বিয়ের বয়স হয়েছে বিয়ে দিয়ে দেবো ব্যাস ঝামেলা শেষ |” মুখ বেঁকিয়ে গৌড় বললো “সে তোমার মেয়ে, তাকে জলে ফেলবে না ডাঙায় রাখবে সে তোমার ব্যাপার তবু এক পাড়া, এক গাঁয়ে থাকি তাই বললাম আর কি |” অন্যরা সাথে সাথে বলে উঠলো “হ্যাঁ হ্যাঁ বিয়ের যুগ্গি মেয়েকে ঘরে বসিয়ে রাখা ঠিক না পঞ্চানন | তুমি বিয়ের ব্যবস্থা করো |”

অপর্ণার মা বেশিদিন হয়নি মারা গেছে | এরই মধ্যে তার বাবা মদ ধরেছে | প্রতিদিন মদ গিলে আসে | অপর্ণা দুদিন বাড়িতে ঢুকতে দেয় নি | সেই রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বেশ কয়েকদিন বাড়ি ফেরেনি পঞ্চানন | মেয়ের জন্যে পাত্র খুঁজে তবেই ফিরবে | কানা হোক, খোঁড়া হোক যা পাবে তার গলায় ওই মেয়েকে ঝুলিয়ে দেবে | মেয়েকে ঘাড় থেকে নামানোর ব্যবস্থা করে তবেই বাড়ি ফিরবে সে | ছোট থেকেই ছেলে না হওয়ার জন্যে পঞ্চানন তার বৌকে কম গালাগাল করেনি | মাঝে মধ্যে মারধরও করেছে |

অপর্ণা শুনেছিলো ওর জন্মের পর ওর ঠাকুমা ওর মুখও দেখতে চায়নি | প্রথম বাচ্চা মেয়ে হয়েছে শুনেই বিলাপ করতে শুরু করেছিল ঠাকুমা কপাল চাপড়ে | যদিও অপর্ণার পরে গৌরীর একটা ছেলে হয়েও বাঁচেনি | তাই অপর্ণা ছিল গৌরীর প্রাণ | ঠাকুমা যতদিন বেঁচে ছিল গৌরীকে তিষ্টতে দেয়নি ওই মেয়ের জন্যে | চেলা কাঠ দিয়ে পর্যন্ত মেরেছে গৌরীকে |

সারাদিন সংসারে অক্লান্ত পরিশ্রম করেও শাশুড়ি আর বরের থেকে গালমন্দ ছাড়া আর কিছুই জুটতো না গৌরীর | শাশুড়ি মারা যাবার পর গৌরী তবু প্রতিবাদ করতো | এসব দেখতে দেখতেই অপর্ণা বড়ো হচ্ছিলো | তার বাবা যে তাকে সহ্য করতে পারত না সেটা সে জানতো | আর পাঁচজন বাবার মতো তার বাবা ছিল না | তাই বাবার কাছে ছোট থেকেই সে খুব একটা ঘেঁষতও না | মা -ই ছিল তার জগৎ | মা এর কষ্ট অপর্ণার বুকে বাজতো | তার জীবনের সব কথা শোনার সঙ্গী ছিল তার মা | অপর্ণা ছোটবেলায় মা কে বলতো “আমি যখন বড়ো হবো, তখন তোমায় কোনও কষ্ট করতে দেবো না |” মা আদর করে বলতো “পড়াশোনা কর, আমার মতো হোস না | ”

অপর্ণার মা চলে যাবার পর থেকেই বাপের এমন রূপ দেখে অপর্ণার খারাপ লাগে | নিজের বাবা অথচ শত্রুর ও অধম | কিন্তু কিছুই করতে পারে না | আগে সংসার ভালো মতই চলতো | বাবা অন্যর ক্ষেতে কাজ করতো | আর মা সেলাই করতো |

অপর্ণার গায়ের রঙটা চাপা | সেই নিয়ে গাঁ-এর সবাই একটু নাক উঁচু করলেও অপর্ণার মা কখনো এ বিষয়ে ভাবতেন না | কারণ তিনি জানতেন তার মেয়ের গায়ের রং কালো হলে কি হবে পড়াশোনায় সে ভালো | গৌরী নিজে পড়াশোনা করতে পারেনি | তাই খুব ইচ্ছে ছিল মেয়ে যেন লেখাপড়া করে বড়ো হয়, ভালো মানুষ হয় | সেবারে মাধ্যমিকে সে গাঁয়ের সবচেয়ে ভালো ফল
করেছিল | তাই স্কুল থেকেই অপর্ণার উচ্চ মাধ্যমিকের জন্যে সবরকমের সাহায্য করতো | স্কুলে সে মেধাবী ছাত্রী হিসেবেই পরিচিত ছিল | কিন্তু ফাইনাল পরীক্ষার আগেই অপর্ণার মা কয়েকদিনের অজানা জ্বরে চলে গেলো | তবু মেয়েটা ভালো ফল করেছিল | মা এর সব স্বপ্নপূরণ করতে চায় সে | কিন্তু তার ভাগ্য কি সঙ্গ দেবে?
সে নিজেও জানে তার বাবা তাকে এবার বিদেয় করবে |

❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤

(চলবে )
ছবি : গুগল

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here