নাইওরি পর্ব ৪

0
183

#নাইওরি পর্ব ৪
#মৌরি মরিয়ম

আজ আরও বেশি মেজাজ খারাপ হলো জেসমিনের। প্রেম নিবেদন করে বসেছে বাছাধন কিন্তু নিজের পরিচয় দেয়নি। দুই ক্রোশ দূর থেকে আসে উল্লেখ করেছে তার মানে দুই এক গ্রাম পার হয়ে তার বাড়ি। এর বেশি কিছুই জানার উপায় নেই। একতরফাভাবে চিঠি দিয়ে যাচ্ছে। কোনো উত্তর লাগবেনা তার? এ কোন রামবলদ?
জেসমিন এবার একটা দুই লাইনের চিঠি লিখলো। চিঠিটা এমন…

ভীতু রঞ্জুসাহেব,
সামনে আসার সাহস না থাকলে আর চিঠি দিয়েন না। ভীতুরা এই কামিনী ফুলের চোখের বালি।
ইতি জেসমিন।

পরদিন জেসমিন চিঠিটা মতির হাতে দিয়ে বলল, “যে আমারে চিডি দিছিল হে আবার আইলে এইডা হ্যারে দিবি।”
মতি ঠোঁট উলটে বলল,
“ক্যা দিমু?”
জেসমিন কটমট করে বলল,
“হ্যার চিডি আমারে ক্যা দিছিলি?”
“হে আমারে হাটের থিকা নারকলি আর বাদামের সন্দেশ কিন্যা দিছে।”
জেসমিন ভ্রুকুটি করলো। বাচ্চা ছেলেটাকে ঘুষ দিয়ে নষ্ট করছে লোকটা! সে বলল,
“আমারটা তারে দিলে আমি তোরে আমাগো খেলায় লমু। তোর আর দুধভাত থাহা লাগবে না।”
মতি দাঁত বের করে হেসে বলল,
“হাছা কইছো জেসমিন বু?”
“আল্লাহর কিরা।”
জেসমিন চোখ দুখানি বড় করে ফেলল। যেন তাকে অবিশ্বাস করা মতির মস্ত বড় অপরাধ।

জেসমিনের চিঠি পড়ে হেসে ফেলল রঞ্জু। তার এখন আর ঢাকা যাওয়ার জন্য কোনো হুতাশ নেই। বরং না যেতে পারলে সে বাঁচে। প্রতিদিন জেসমিনকে দেখতে যায়। মাঝে একদিন বাড়িতে কাজ থাকায় যেতে পারেনি। সেদিন যে কতটা অস্থিরতায় কেটেছে তা ভাষায় প্রকাশযোগ্য না। আজ যেতেই মতি এই চিঠিটা দিল। রঞ্জু সাথে করে আনা চিঠিটা আর দিল না, নতুন করে চিঠি লিখতে হবে। সে মতির কাছ থেকে কাগজ কলম নিয়ে চিঠি লিখতে পারতো অবশ্য। কিন্তু সে গভীর রাতে বারান্দায় বা জানালার ধারে বসে যে চিঠি লিখবে সেই চিঠিতে যতটা আবেগ, যত্ন মিশিয়ে দিতে পারবে তা কি এখন পারবে? অসম্ভব! বিশেষ মানুষটার জন্য সবকিছুই বিশেষ হওয়া চাই।

পরদিন জয়নাল মির্জা বাড়িতে থাকায় খেলতে যেতে পারেনি জেসমিন। সন্ধ্যার পর যখন জেসমিন পড়তে বসেছে তখন মতি বন্ধ জানালার ধারে এসে ডাক দিল,
“ও জেসমিন বু, আছো এহেনে?”
জেসমিন জানালা খুলে বলল,
“কী অইছে? তুই এত রাইতে আইছোস ক্যা?”
“রাইত কিয়ের? সন্ধ্যা অইছে হপায়। তুমি তো আইজ খেলতে আহো নাই তাই আইছি কি আর করমু? এই নেও তোমার চিডি।”
জেসমিন খামটা হাতে নিয়ে বলল,
“আইজ কী দিছে তোরে?”
মতি দাঁত বের করে বলল,
“কাইল হাটে লইয়া যাইব।”
“হাটে যাওনের আগে আমার লগে দেহা কইরা চিডি লইয়া যাইস।”
“আইচ্ছা বু।”
জেসমিন খামটা খুললো। কিছু কামিনী ফুলের পাশ থেকে চিঠিটা তুলে নিল।

প্রিয় জেসমিন,
তোমার কি কাঁচের চুড়ি পছন্দ? সেদিন যখন খেলছিলে, তোমার দু’হাতের চুড়িগুলো রিনিঝিনি করে বাজছিল। এর আগে কখনোই উপলব্ধি করতে পারি নাই কাচের চুড়ি জিনিসটা যে এত সুন্দর। নাকি তোমার হাতে উঠেছে বলেই তার মাধুর্য বেড়ে গেছে? সূর্যমনির হাটে সুন্দর কাঁচের চুড়ি ওঠে। হ্যাঁ ঠিক ধরেছ আমি সূর্যমনি গ্রামের ছেলে।
সুর্যমনিতে আমাদের বাড়ির দোতলায় আমার একলার রাজত্ব। ঘরের সামনেই বারান্দা। কিছুদিন আগে বারান্দায় একটা কাঠের চারকোনা টব বানিয়েছি নিজ হাতে। সেই টবে কামিনী ফুলের গাছ লাগিয়েছি। জানিনা ফুল কবে ফুটবে। আচ্ছা এই কামিনী গাছে পানি দেয়ার দায়িত্বটা কি তুমি নিবা ফুল?
তোমার চোখের বালি না। তোমার চোখের মণি হতে চাই। কখন কোথায় আসব বলে দাও। বান্দা সময়মতো হাজির হয়ে যাবে।
ইতি রঞ্জু।

চিঠি পড়তে পড়তেই জেসমিনের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো। কিন্তু চিন্তার বিষয় হচ্ছে দেখা টা করবে কোথায়? কেউ দেখে ফেললে কেলেংকারি হয়ে যাবে। অন্তত কেশবপুরের মধ্যে কোথাও দেখা করা যাবে না। তাহলে উপায়?

জেসমিন রঞ্জুর প্রথম দেখা হলো মতিদের পানের বরে। মানিক পুরোটা সময় তাদেরকে পাহাড়া দিল। জেসমিন রঞ্জু দুজনের কারও কোনো ভয় নেই কিন্তু সে ভয়ে তটস্থ। এই সম্পর্কের কথা জানাজানি হলে কী হতে পারে সে ধারণা তার আছে। কারণ সে চেয়ারম্যানকে চেনে। চেয়ারম্যান হিসেবে লোক ভালো তবে স্বার্থে ঊনিশ-বিশ হলে সে অতি ভয়ংকর। রঞ্জুকে শত বুঝিয়েও লাভ হয়নি। ওদিকে জেসমিন যে দাপুটে মেয়ে, একবার স্কুলে এক ছেলে ওর চুলের বেনী ধরে টান দিয়েছিল বলে মেয়ে হয়েও সেই ছেলেকে যে ধোলাই দিয়েছিল, ভীর জমিয়ে দেখেছিল লোকে। সেই ঘটনা মুখে মুখে রটে গিয়েছিল। এরপর থেকে আর কোনো ছেলে চোখ তুলে তাকাতে সাহস পায়নি। আজ সেই মেয়ে রঞ্জুর চিঠি পড়ে পাগল হয়ে দেখা করতে এলো! কী এমন লিখেছে রঞ্জু!

রঞ্জুকে দেখে মাথা ঘুরছে জেসমিনের। এত সুদর্শন ছেলে এ তল্লাটে সে কখনো দেখেনি। জামাকাপড়, চালচলন, কথাবার্তা সবকিছুতেই একটা শহুরে ভাব। জেসমিনের সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সে তার স্বভাবতই রঞ্জুকে সেসব বুঝতে দিতে চাইছে না। তাকে চুপ দেখে রঞ্জু বলল,
“কী ব্যাপার চিঠিতে তো খুব কথা শোনানো হয় আমাকে। এখন যে একদম চুপ?”
জেসমিন হেসে বলল,
“অত সুন্দর কইরা কথা কইতে পারিনা।”
“বেশি সুন্দর মানুষের অত সুন্দর কথা না বললেও চলে।”
“আপনে কি শহরে থাকেন?”
“আমি ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। সেখানকার হলে থাকি। ইউনিভার্সিটি বন্ধ থাকলে গ্রামে থাকি।”
“এহন কি ইনভার্সিটি বন্ধ?”
“হ্যাঁ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। কিছু গন্ডগোল চলছে। তাই বাড়ি এসেছি।”
“তারমানে আমনে আবার ঢাকা যাইবেন গিয়া?”
“ইউনিভার্সিটি খুললে যাব।”
“আচ্ছা আমনের গ্রাম না সূর্যমনি? তাইলে কেশবপুরে কেমনে আইলেন আর আমারেই বা কেমনে পাইলেন?”
রঞ্জু প্রথম দেখার ঘটনাটা বিস্তারিত বলতেই জেসমিন চোখ পাকিয়ে বলল,
“ও! আমনেই হেই লোক, যার জন্য মায় আমারে গাইলাইছিল!”
রঞ্জুর ঘটনাটা মনে পড়ায় সে হেসে ফেললো। জেসমিন বলল,
“হাইসেন না। আমনেরে একখান কথা আগেই কইয়া রাখি, আমি কিন্তু কামচোর। আমারে দিয়া কোনো কাম করাইতে পারবেন না। ওই গাছে পানি দেওন পর্যন্তই।”
রঞ্জু হেসে ফেলল। এই মেয়েটি সবার থেকে আলাদা। এই মেয়েটিকে তার নিজের করে লাগবেই লাগবে।

তাদের পত্র আদান-প্রদান চলমান রইলো। দুই পক্ষেই ফিস বাড়িয়েছে মতি ডাকপিয়ন। ইদানীং বেশ বড় বড় আবদার করে বসে সে রঞ্জুর কাছে। রঞ্জুও হাসিমুখে সেই আবদার পূরণ করে। এই ডাকপিয়ন হারালে যোগাযোগ বন্ধ। এরচেয়ে বিস্বস্ত ডাকপিয়ন আর হয় না। দেখা খুব কমই হয়, তবে হয়। কখনো উত্তরের শাপলার বিলে, কখনো কালিশুরির মেহগনি বাগানে, কখনো মতিদের পানের বরে।

চলবে…

আগের পর্ব
https://facebook.com/100044423166701/posts/547128340111267/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here