কনফিউশন পর্ব ৭

0
536

কনফিউশন
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
পর্ব ৭

আরশি খানিক জিরিয়ে নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকছিলো। তিরা বাধা দিয়ে বললো,
“একী তুই এখন রান্নাঘরে কেন যাচ্ছিস?”
“রান্না করতে যাচ্ছি।”
তিরা হাসি হাসি মুখ করে বললো,
“তুই বাজার থেকে এতো কষ্ট করে এলি। তুই রেস্ট নে। আজকের রান্না আমি করবো।”
আরশি অবাক হয়ে বললো,
“কে করবে?”
“কেন আমি।”
“আজ সূর্য কোন দিকে উঠেছে?”
“ধ্যাত! আমি কি একটা দিন আমার ভাইবোনকে রান্না করে খাওয়াতে পারি না?”
“পারিস কিন্তু ইতিপূর্বে এই ঘটনা কখনো ঘটেনি তো তাই হজম করতে কষ্ট হচ্ছে!
” তুই চুপচাপ বসে থাক। আজ রান্না আমি করবো।”
তিরা চলে গেলো রান্না করতে। আরশির হাতে কোনো কাজ ছিলো না তাই ‘ফ্রিডম এট মিডনাইট’ বইটি পড়তে বসলো। পরীক্ষা ছিলো বলে বইটি এর আগে দু এক পাতা করে পড়েছে। এখন থেকে একদম মন ভরে পড়তে পারবে।

কাব্য মোটামুটি চিন্তায় পড়ে গেছে। এতদিন তার আরশিকে দেখতে ভালো লাগতো তাই দেখতো। কিন্তু আজ তাকে দেখার পর থেকে মনে হচ্ছে এটা শুধুই ভালোলাগা না। সে বাঁধা পড়ে যাচ্ছে আরশিতে। সারাদিন শুধু আরশির ভাবনাই ঘুরে ফিরে আসছে। আরশি কি তাহলে ভালো লাগার চেয়েও বেশিকিছু? কিন্তু আরশির তো তার প্রতি কোনো আগ্রহই নেই। অবশ্য থাকার কথাও না যেহেতু আরশি জানে তার বোন কাব্যর ব্যাপারে বিশেষভাবে আগ্রহী। বোন যাকে পছন্দ করে আরশির মতো মেয়ে তার দিকে ফিরেও তাকাবে না এটাই তো স্বাভাবিক। তাই তার প্রতি তিরার আগ্রহটা কমাতে হবে। তিরাকে যেভাবেই হোক বুঝিয়ে দিতে হবে কাব্য তার ব্যাপারে আগ্রহী নয়।

দুপুরে খেতে বসে আরশি তিরাকে বললো,
“কোত্থেকে শিখলি এতো ভালো রান্না?”
তিরা খুশি হয়ে বললো,
“সত্যি ভালো হয়েছে?”
“হ্যাঁ।”
“নাকি আমাকে খুশি করার জন্য বলছিস?”
“আরে না। সত্যি ভালো হয়েছে। এর আগে কখনো ভালো হয়েছে বলেছি?”
তিরা হেসে বললো,
“না।”
“আমি শুধু শুধু মিথ্যে বলিনা।”
“তা অবশ্য আমি জানি।”
“আচ্ছা তিরা এক কাজ করলে কেমন হয়?”
“কী কাজ?”
“চল আমরা ভাবীকে একবার দেখে আসি৷ গতমাসে তো পড়া পড়া করে একবারও যেতে পারলাম না।”
“চল কবে যাবি?”
“কাল সকাল সকাল চলে যাব। সারাদিন ভাবীর কাছে থেকে রাতে ফিরে আসবো।”
“আচ্ছা।”
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ। একসময় তিরা বললো,
“আরু আমার একটা আবদার আছে। তোকে পূরণ করতেই হবে। মানে কোনোভাবে না করা যাবে না।”
“ও আচ্ছা! আজকের এই রান্নাবান্না তাহলে ঘুষ ছিলো?”
“হ্যাঁ।”
আরশি হেসে বললো,
“আচ্ছা বল কি কথা। সাধ্যের মধ্যে হলে আমার ছোট্ট বোনের আবদার অবশ্যই পূরণ করবো।”
“তোর সাধ্যের মধ্যেই।”
“আচ্ছা তো বল।”
“আমি আর তুই একটা ফটোশ্যুটে যাবো।”
“ধুর এইসব ছবি টবি তুলতে আমার একদম ভালো লাগেনা তিরা।”
“যাবিনা?”
“সাথে যেতে পারি তবে আমাকে ছবি তোলার জন্য জ্বালাবি না। তুই তুলিস।”
“থ্যাংকস আরু আমি জানতাম তুই আমার কথা ফেলতে পারবি না।”
“কোথায় যাবি ছবি তুলতে?”
“সেটা কাব্য ঠিক করবে।”
“ফটোগ্রাফার কি তোর কালা চণ্ডীদাস?”
“হ্যাঁ। দারুন ছবি তোলে কাব্য।”
“আমি যাবো না।”
তিরা অবাক হয়ে বললো,
“মাত্র না বললি যাবি?”
“তুই তো আগে বলিসনি যে ওই লোকিটার সাথে ছবি তুলতে যাবি।”
“তুই বারবার লোকটা লোকটা বলিস কেন? ওকে তো দেখতে আমাদের বয়সীই লাগে। বয়স তো জানিনা কিন্তু পড়াশুনার হিসেবে ও আমাদের থেকে ৩ বছরের বড় মাত্র।”
“সাড়ে তিন বছর হবে।”
“হোক। তুই ওকে আর একবারও লোকটা বলবি না খবরদার বলে দিচ্ছি।”
“আচ্ছা। আমি জানতাম না ওনার সাথে যাচ্ছিস তাই রাজী হয়েছিলাম। ওনার সাথে আমি কোথাও যাবো না।”
“কেন? ও কি তোকে খেয়ে ফেলবে?”
“না আমি যাব না কারণ ওনাকে আমি অপছন্দ করি।”
“অপছন্দ করার কারণ?”
“প্রথমত, সিগারেটের গন্ধ আমি সহ্য করতে পারি না। বেশিক্ষণ এই গন্ধের মধ্যে থাকলে আমার মাথাব্যথা হবে। তুই ভালো করেই জানিস আমার মাইগ্রেন আছে।”
“এর সমাধান আছে তুই দূরে দূরে থাকবি। আর কোনো কারণ আছে?”
“আছে। দ্বিতীয়ত, উনি প্রচন্ড অসভ্য। এতো অসভ্যতা তুই তো হেসে উড়িয়ে দিস কিন্তু আমি হজম করতে পারিনা।”
“ছেলেরা তো একটু অসভ্য হবেই। নাহলে সে ছেলে বোরিং।”
“এজন্যই আমি ছেলেদের সাথে মিশি না।”
“আচ্ছা ধর তোর এরেঞ্জ ম্যারেজ হলো। তোর স্বামী কাব্যর চেয়ে বেশি সিগারেট খায়। কাব্যর চেয়েও বেশি অসভ্য, তখন তুই কী করবি?”
“এরকমটা হওয়ার চান্স নেই কারণ আমি সব জেনেশুনেই বিয়ে করবো।”
“হাহ। এতো কথা আমি জানিনা। আমার সাথে যেতে হবে ব্যাস। আমি একা যেতে পারবো না ওর সাথে।”
“একা যেতে পারবি না কেন? তুই কি বাসরঘরেও ওর সাথে আমাকে নিয়ে যাবি?”
“ধুর কয়দিন টেকে তার নাই ঠিক আর তুই আছিস বাসরঘর নিয়ে!”
“তুই সেদিন বিধবা হওয়ার কথা চিন্তা করলি যখন আমি তোর বাসরঘরের কথা চিন্তা করলে সেটা খুব একটা বেশিকিছু না।”
“এত কথা শুনতে চাইনা আরশি। আমি ছবি তুলতে যাবো তোর আমার সাথে যেতে হবে।”
“আমি যাবো না।”
“তুই যাবি।”
“আমি যাবো না। তুই ভালো করেই জানিস আমি এক কথা একবার না বলে দিলে তা আর হ্যাঁ হয়না।”
তিরা হতাশ হয়ে তাকিয়ে রইলো। আরশি চুপচাপ খেতে লাগলো।

তিরা ও আরশিকে দেখে খুশিতে লাফিয়ে উঠলো রশ্নি। দুজনকে একসাথে জড়িয়ে ধরে বললো,
“তোরা আসবি বললি না যে?”
তিরা বললো,
“সারপ্রাইজ!”
আরশি বললো,
“কেমন আছো ভাবী আম্মু?”
“ভালো। তোদেরকে খুব মিস করছি। অনেক কষ্ট হচ্ছে না তোদের?”
তিরা বললো,
“কষ্ট কোত্থেকে হবে? তোমার মত আরেকজনকে যে রেখে এসেছো। আরশি ঠিক তোমার মতো করেই সংসারটা সামলায় জানো?”
রশ্নি আরশির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো
“তাতো হবেই। বাচ্চাটা কত লক্ষী।”
আরশি হাসলো। তিরা বললো,
“ওকে আর বাচ্চা বলোনা৷ এই বয়সেই সে বুড়ো হয়ে গেছে। একটা ফটোশ্যুটে যেতে বললাম। তার সেকী ভাব সে যাবেই না।”
“ওমা কেন আরশি যাবিনা কেন?”
“ওর কালা চণ্ডীদাসের সাথে ও যাক। আমি কেন যাবো?”
ভাবী অবাক হয়ে বললো,
“কালা চণ্ডীদাস টা কে আবার? তিরার বয়ফ্রেন্ড না কতো ফরসা।”
আরশি হেসে বললো,
“ওটা কবেই বাদ!”
রশ্নি হেসে বললো,
“এ আবার কে?”
তিরা বললো,
“ভাবী তুমি আরশির কথায় নাচছো? কাজটা কি ঠিক হচ্ছে?”
“আচ্ছা সরি সরি ছেলেটা কে?”
“তুমি চেনো তাকে।”
“আমি চিনি! কে?”
“আমাদের নীচতলায় যে ভাড়াটে এসেছে সে।”
“ওমা কাব্য!”
“হ্যাঁ।”
“ছি ছি আরশি কাব্যকে তুই এভাবে পছাচ্ছিস? কতো সুইট একটা ছেলে!”
আরশি বললো,
“কীভাবে সুইট বলো এতো সিগারেট খায় যে আমার ওনাকে দেখলে ঘেন্না লাগে।”
রশ্নি হেসে বললো,
“হ্যাঁ তা একটু সিগারেট বেশি খায়। তবে ছেলেটা সত্যি ভালো। মনে নেই তোর ভাইয়া আর আমি যে সেইন্ট মার্টিনস আইল্যান্ড গেলাম? তখন কক্সবাজারে যতদিন ছিলাম ওদের বাসায়ই তো থাকতে হলো। তখনই কাব্যর সাথে পরিচয়।”
তিরা বললো,
“দেখেছিস ভাবী ঠিক চিনেছে ওকে। আর তুই হুদাই ওকে খারাপ প্রমাণ করার চেষ্টা করিস সবসময়।”
“খারাপ প্রমাণ করার চেষ্টা করবো কেন ও কি আমার শত্রু? আমার যা মনে হয় আমি শুধু তাই বলি।”
রশ্নি বললো,
“তবে তিরা ছেলে সিগারেট কিন্তু সত্যিই বেশি খায়। এক সন্ধ্যার এক্সাম্পল দেই শোন। আমরা বীচে যাব। আমি, সাহিল, অনন্ত, অনন্তর বৌ, কাব্য আর কাব্যর ছোটো ভাই অর্নব এই কয়জন বেরিয়েছি। অনন্ত গাড়ি বের করছে। গাড়িতে ওঠার আগে কাব্য বলে কি তোমরা ওঠো আমি একটা সিগারেট খেয়ে নিই, গাড়িতে উঠলে তো আর খেতে পারবো না। এরপর সিগারেট খেয়ে উঠলো। বীচে যেতে জাস্ট ১৫ মিনিট লেগেছে, গাড়ি থেকে নেমে আবার সিগারেট খেলো। আমরা এক ঘন্টা ডেক চেয়ারে বসে কাটালাম। আমি গুনেছি সে ওই এক ঘন্টায় ৫ টা সিগারেট খেয়েছে। এরপর গেছি কাঁকড়া খেতে। কাব্য বলে, তোমরা বসো অর্ডার দাও আমি একটা সিগারেট খেয়ে আসি। এরপর সিগারেট খেয়ে এসে কাঁকড়া খেলো। কাঁকড়া খেয়ে বেরিয়ে আবার সিগারেট খেলো। এরপর আমরা বার্মিজ মার্কেট ঘুরলাম, কেনাকাটা করলাম ততক্ষণে আরো দুটো খেলো। এরপর হেঁটে গাড়ি পর্যন্ত গেলাম তখন আবার বলে, তোমরা ওঠো আমি একটা সিগারেট খেয়ে নিই। বুঝতে পারছিস এক সন্ধ্যায় সে কতগুলো সিগারেট খেয়েছে?”
তিরা চোখ বড় বড় করে বললো,
“ও ভাবী তাহলে তো সত্যিই বিপদ!”
“কীসের বিপদ? কচুর বিপদ। কাব্য কত দারুণ একটা ছেলে জানিস? আর ওর ফ্যামিলির মতো ফ্যামিলি সব মেয়ের স্বপ্ন। কাব্যর মা যে কতো অসাধারণ তুই কল্পনাও করতে পারবি না। এমন শাশুড়ী পেলে জীবন ধন্য হয়ে যাবে যেকোনো মেয়ের। দুদিন থেকে আমি মায়ায় পড়ে গেছি। ওই সিগারেট একটা সমস্যা হলো? ছাড়িয়ে ফেলবি। সিগারেট খেলে চুমু খেতে দিবিনা। ব্যাস সিগারেট ও ছাড়বে ওর বাপ ছাড়বে।”
আরশি হেসে ফেললো। তিরার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। বললো,
“ভাবী এইজন্যই আমি তোমাকে এতো ভালোবাসি। এইসব বুদ্ধি আমার মাথায় জীবনেও আসবে না।”
এরপর আরশিকে দেখিয়ে তিরা আবার বললো,
“আর তোমার এই বুড়ী বোরিং ননদের মাথায় তো আরো এসব বুদ্ধি আসবে না। ও এতদিন আমাকে শুধু ভয় দেখিয়েছে কাব্যর সিগারেট খাওয়া নিয়ে। ভালোবাসার কিচ্ছু বোঝেনা ও।”
রশ্নি আরশিকে টেনে বুকে নিয়ে তিরার দিকে তাকিয়ে বললো,
“এই এই খবরদার আমার ননদকে বুড়ী বোরিং বলবিনা। আমার ননদ যেমন আছে তেমনই খুব ভালো আছে। একদিন এক রাজপুত্র এসে ওকে ভালোবাসা বোঝাবে। তখন ও সব বুঝবে।”
তিরা গাল ফুলিয়ে বললো,
“ও এখন আমি পর হয় গেলাম।”
রশ্নি বুকের আরেক পাশে তিরাকে টেনে নিয়ে বললো,
“না তো। তুইও তো আমার ননদ। আমার তিরিং বিরিং ননদ।”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here