কনফিউশন পর্ব ৩৫

0
439

কনফিউশন পর্ব ৩৫
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম

আরশি কাব্য ঢাকার পাশ দিয়ে বয়ে চলা এক নদীতে ঘুরছে। বড় একটা নৌকায় উঠেছে। নদীর ঢেউগুলো নৌকার গায়ে লেগে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ করছে। আরশি সেদিকে চেয়ে আছে। কাব্যর মা ফোন করায় কাব্য নৌকার অন্যপ্রান্তে গুলুইয়ের উপর বসে সে তার সাথে ফোনে কথা বলছে। শাহনাজ বেগম বললেন,
“কোথায় তোরা?”
“ঘুরতে এসেছি, আপাতত নদীতে। জানো মা ও জীবনে প্রথম শাড়ি পরেছে তাও আমার জন্য। আমি পছন্দ করি বলে।”
“দেখেছিস তুই কত ভাগ্যবান? কুলাঙ্গার ছেলে তুই যদি ওকেও কষ্ট দিয়েছিস মেরেই ফেলব তোকে। আচ্ছা বাবা সত্যি করে বল তুই ওর ব্যাপারেও কনফিউজড না তো?”
কাব্য হেসে বলল,
“১% কনফিউশনও নেই মা। আমি ওকে সত্যি ভালোবাসি। ওর সাথে সারাজীবন কাটাতে চাই। ওর প্রতি আমার যে অনুভূতি এটাই ভালবাসা, এটা তনিকার বেলায় ছিল না মা।”
“তাহলে ভালোবাসার কথাটা এখনো বলে দিচ্ছিস না কেন?”
“সব সম্পর্কে ভালবাসি বলাটা জরুরি না মা। আমি যেমন জানি সে আমাকে ভালোবাসে, তেমনি সেও জানে আমি তাকে ভালোবাসি। এখনকার সম্পর্কটা যে কত মিষ্টি তুমি জানোনা। আর সবচেয়ে বড় কথা ওকে এখন ভালোবাসার কথা বলতে গেলেই সম্পর্কটা অন্যরকম হয়ে যাবে। তখন দুজনের জন্যই আগামী ৫ বছর দূরে থাকাটা কষ্টের হয়ে যাবে।”
“জানিনা বাপু, তোদের আজকালকার ছেলেমেয়েদের ব্যাপারস্যাপার বুঝিনা।”
কাব্য হেসে বলল,
“আচ্ছা এবার রাখো। মেয়েটা একা বসে আছে। রাতে কল দিচ্ছি।”
“আচ্ছা রাখ।”

কথা বলা শেষ করে কাব্য আরশির কাছে যেতেই আরশি বলল,
“তোমার মা তোমাকে খুব ভালোবাসে তাইনা?”
“হ্যাঁ। সব মায়েরাই তো তাদের সন্তানদের খুব ভালোবাসে।”
আরশি আনমনা হয়ে বলল,
“ঠিক বলেছ, আমার মাও আমাকে খুব ভালোবাসতো। আর বাবাও।”
কাব্য টের পেল আরশির বাবা মার কথা মনে পড়ে মন খারাপ হয়ে গেছে। কিন্তু বাবা-মা হারানো মানুষের জন্য আসলে সান্ত্বনা বানী কোনো কাজে লাগেনা। তাই কাব্য সেদিকে না গিয়ে চুপ করে রইল। আরশি বলল,
“জানো কাব্য আমি ছোটোবেলায় খুব চঞ্চল ছিলাম।”
“তাই!”
“হ্যাঁ যদিও ছোটোবেলা থেকেই ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ছিলাম কিন্তু সারাক্ষণ শুধু খেলতে চাইতাম, একদম পড়তে বসতে চাইতাম না। বাবা মা দুজনেই আমাকে নিয়ে খুব চিন্তিত ছিল। সেই আমিই কেমন শান্ত হয়ে গেলাম!”
কাব্য কিছু বলল না৷ শুধু তাকিয়ে রইলো আরশির দিকে। আরশি হঠাৎ কাব্যর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি জিজ্ঞেস করেছিলে না আমি হাসি না কেন?”
“হুম।”
“আজকে তোমাকে বলব, শুনবে কাব্য?”
“অবশ্যই আরশি। তোমার সব কথা আমি শুনব যা যা বলতে চাও।”
“ছোটবেলায় আমরা কক্সবাজার থাকতাম। আমাদের বাড়ি ছিল চকরিয়াতে। সাহিল ভাইয়া পড়াশোনার জন্য এখানে থাকত। আমাদের ওখানে থাকার কারণ বাবা রাজনীতি করতেন।”
“শুনেছি আংকেল সংসদ সদস্য ছিলেন।”
“কার কাছে শুনেছ?”
“ভাইয়ার কাছে শুনেছি।”
“বাবা কীভাবে মারা গেছেন তা শুনেছ?”
“না।”
“আমি তখন ক্লাস ফোরে পড়ি। ঈদ করতে সবাই এক হয়েছি। ঈদের আগে আগে একদিন সবাই মিলে বাজারে গিয়েছিলাম। আমি খুব ছটফটে ছিলাম। বাবা মা যখন কেনাকাটা করছিলেন আমি দৌড়ে একটা খেলনার দোকানে ঢুকলাম। সাহিল ভাইয়া আমাকে ফেরাতে আমার পিছুপিছু এল। ভাইয়া আসতেই আমি বায়না করতে শুরু করলাম আমার এটা চাই, ওটা চাই। ভাইয়া তো আমার অনেক বড়, আমি যখন ফোরে পড়ি তখন ও পড়াশুনা শেষ করে চাকরিতেও ঢুকেছে। ভাইয়া বলল যাওয়ার সময় আমার পছন্দের সব খেলনা কিনে দেবে। আমি কিছুতেই খেলনা না নিয়ে ফিরব না গো ধরে বসে থাকলাম। হঠাৎ দেখি বাজারের মানুষজন ছোটাছুটি শুরু করেছে, অনেক চেচামেচি। ভাইয়া আমাকে নিয়ে দোকান থেকে বের হতেই দেখতে পেলাম বাবাকে কিছু লোক কুপিয়ে মারছে।”
কাব্য আরশির কাঁধে হাত রাখলো। আরশি নীরবে কাঁদছে আর বলছে,
“চোখের পলকে ওরা বাবাকে কয়েক টুকরো করে ফেলল। হাত পা মাথা সব আলাদা। মা চিৎকার করছিলেন, ওরা মাকেও কুপিয়ে মেরেছে। আমি চিৎকারও করতে পারিনি! ভাইয়া আমার মুখ চেপে ধরে ছিল। এরপর আর কিছু মনে নেই৷ অজ্ঞান হয়ে যাই। যখন জ্ঞান ফেরে তখন আমি হসপিটালে। ভয়ংকর এক ট্রমার ভেতর দিয়ে দিন কাটাচ্ছিলাম। সাহিল ভাইয়া আমাকে ঢাকা নিয়ে আসে। আমি কাঁদতে পারতাম না, হাসতে পারতাম না। জগতের কোনো অনুভূতিই আমার ছিলো না। এত রক্ত দেখেছি যে রঙ আর দিনের আলো কোনোটাই সহ্য করতে পারতাম না। সারাদিন ঘর অন্ধকার করে দরজা বন্ধ করে বসে থাকতাম। কিছু খেতে পারতাম না। কত রাত যে কেটেছে আমার না ঘুমিয়ে তার কোনো হিসেব নেই। ভাইয়া বলল বাবা-মায়ের স্বপ্নগুলো পূরণ করলে তারা যেখানেই থাকুক সুখী হবে। তাদেরকে সুখী করার জন্য আমি দিন রাত পড়াশোনা করা শুরু করে দিলাম, ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া শুরু করলাম। কারণ বাবা-মায়ের স্বপ্ন ছিল আমাকে ডাক্তার বানানো আর মায়ের আরেকটা স্বপ্ন ছিল আমাকে তিন বেলা ঠিকমতো খাওয়ানো।”
এ কথা বলে আরশি হাসলো। কাব্য চুপ। তারপর আরশিই আবার বলল,
“কিছুদিন পর ভাইয়া রশ্নি ভাবিকে বিয়ে করে আনে। ভাবি তখন ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড ছিল, ওকে খুব পছন্দ করতাম। আমার জন্যই ভাইয়ার অত তাড়াতাড়ি বিয়ে করা। আমি সবার সাথে মিশতাম না।”
কাব্য এবার বলল,
“খুব কঠিন ছিল তোমার বড় হয়ে ওঠা।”
“হ্যাঁ খুব বেশি কঠিন, খুব বেশি বিষন্ন। যেখানে ভালোলাগার কোনো কিছুই নেই। যেখানে বেঁচে থাকাটাই অনেক কঠিন। মানুষজন আমাকে বুঝতে পারতোনা, এমনকি এখনো পারেনা। অন্য সব মেয়েদের মতো করেই আমার বয়স বেড়েছে, শারীরিক পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু জীবনটা অন্যসব মেয়েদের মত কাটেনি। আমার বোন তিরা আমার একমাত্র বন্ধু, যে সম্পূর্ণই আমার উল্টো। এছাড়া কখনো কোনো বন্ধু তৈরি হয়নি, কেউ আমার সঙ্গ পছন্দ করতো না, আমারো কাউকে ভালো লাগতো না। আমার জীবনের একমাত্র আনন্দের ঘটনা হচ্ছে আমার ভালো রেজাল্ট করা। এই একটা জিনিস আমাকে আনন্দ দিত, কারণ বাবা মায়ের স্বপ্ন পূরণের পথ সুগম হচ্ছিল।”
কাব্য চুপ। আরশি আবার বলতে শুরু করল,
“এরপর একদিন কীযে হলো! কখনো কারো চোখে না পড়া এই মেয়েটা একজনের চোখে পড়ে গেলো। জীবনে প্রথম কেউ মেয়েটার বিষন্নতার কারণ জানতে চাইলো। জীবনে প্রথম একটা মানুষ মেয়েটার খুব কাছে চলে এলো, মেয়েটাকে হাসালো, কাঁদালো। অনুভূতিহীন মেয়েটাকে পরিচয় করালো অনেক অনুভূতির সাথে। মেয়েটার বেঁচে থাকাটা এখন আর আগের মত কঠিন নেই।”
কাব্য আরশির চোখ মুছিয়ে দিয়ে হাত ধরলো। তারপর বলল,
“যেভাবে তোমার কাছে এসেছি, সেভাবেই আজীবন তোমার কাছে থাকব আরশি। অনেক হাসাবো, অনেক কাঁদাবো।”
আবারো আরশির দু’চোখ উপচে জল পড়তে লাগলো। ঠোঁটে হাসি।

তিরা খুলনা পৌঁছলো বিকেলবেলা। প্রচন্ড টায়ার্ড ছিলো সে, সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়লো। সন্ধ্যায় শাশুড়ি রেহানা আলমের ডাকে ঘুম ভাঙলো। তিনি বললেন,
“তিরা ওঠো কিছু খেয়ে নাও।”
“মা আমার ভালো লাগছে না। পরে খাব।”
“এবাড়িতে এরকম না খেয়ে তো থাকা যাবেনা। ঠিকমতো না খেয়ে না খেয়েই অসুস্থ হয়েছিলে তুমি। ওঠো খেয়ে নাও।”
তিরা অনিচ্ছাসত্ত্বেও উঠলো। খেয়েদেয়ে ঘরে যাচ্ছিল ঠিক সেই সময় কলিং বেল বাজলো। রেহানা বললেন,
“দেখো তো তিরা কে এলো।”
তিরা দরজা খুলতেই দেখে যাদিদ দাঁড়িয়ে। স্বপ্ন দেখছে নাকি সত্যি বুঝতে পারছেনা। যাদিদ তিরার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,
“সারপ্রাইজ!”
তিরা সাথে সাথে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। ঘটনাটা এত আচমকা ঘটলো যে যাদিদ ধরতেও পারলো না। রেহানা ছুটে এলেন। যাদিদ তিরাকে ধরে কোলে তুলে ঘরে চলে গেল। বিছানায় শুইয়ে দিতেই রেহানা বললেন,
“আগেই বলেছিলাম সারপ্রাইজের দরকার নেই, ওকে বলে দেই।”
“ধুর মা তেমন কিছু হয়নি।”
যাদিদ তিরার চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে দিতেই তিরা চোখ মেলে তাকালো। যাদিদকে এবং শাশুড়িকে হাসতে দেখে সে প্রচন্ড লজ্জা পেল। সে যাদিদের দিকে তাকাতেই পারছে না। সবকিছু অবিশ্বাস্য লাগছে। রেহানা বললেন,
“তুমি তো ভয়ই পাইয়ে দিয়েছিলে। সারাদিন কিচ্ছু খেতে চাওনা, মাথা ঘুরে তুমি পড়বে না তো কি আমি পড়ব?”
তিরা উঠে বসলো। যাদিদ মুচকি হাসছে। রেহানা বললেন,
“এখন তোমার জন্য এক মগ দুধ গরম করে আনব, পুরোটা খেতে হবে।”
রেহানা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই যাদিদ তিরার কাছে গিয়ে হাত বাড়িয়ে বলল,
“এই পাগল কাম টু মি।”
তিরা ঝাপিয়ে পড়ল যাদিদের বুকে। মুহুর্তের মধ্যেই কান্নায় ভাসিয়ে দিল তাকে। যাদিদ তিরাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কপালে গালে চুমু দিলো।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here