কনফিউশন পর্ব ২৩

0
332

কনফিউশন পর্ব ২৩
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম

যাদিদ চলে যাওয়ার সময় তিরা অদ্ভুত এক কান্ড করলো। সে সবার সামনে বাচ্চাদের মতো চিৎকার করে করে কাঁদতে লাগলো। ওদিকে এই ঘটনায় যাদিদ কিছুটা অস্বস্তিবোধ করতে লাগলো। তিরার বয়স কম ঠিকাছে তাই বলে এমন অবুঝপণা করার মতো কম বয়স তো না। সে ডিফেন্সে চাকরি করে তাকে বেশিরভাগ সময় বাড়ির বাইরে থাকতে হবে এমনটাই স্বাভাবিক। এসব জেনেই তিরা তাকে বিয়ে করেছে। তাহলে এখন কেন এসব অবুঝপণা? অন্যদিকে তিরার জন্য তার মায়াও হচ্ছে। ইচ্ছে করছে এই মেয়েটার আশেপাশেই থাকুক সারাক্ষণ! কিন্তু সেটা যেহেতু সম্ভব না সেহেতু যাদিদ বাস্তবকে মেনে নেয়ার জন্য প্রস্তুত। তিরারও উচিৎ বাস্তবকে স্বীকার করে নেয়া।

আরশির ফোনটা বাজছে, তিরা ফোন করেছে। গতকাল থেকেই কিছুক্ষণ পরপর ফোন করছে কিন্তু আরশির এখন কারো সাথে কথা বলতে ভালো লাগে না। তাই ফোন ধরছে না। কড়কড়ে দুপুরেও আরশি জানালা লাগিয়ে পর্দা টেনে ঘর অন্ধকার করে রেখেছে। গত ৭ দিন ধরেই চলছে আরশির এই অন্ধকারবাস। সন্ধ্যা হলেও আরশি ঘরে আলো জ্বালায় না। এর মধ্যেই রশ্নি ঘরে ঢুকে বললো,
“আরশি ঘুমাচ্ছিস?”
আরশি তাকালো না, নড়লো না। যেভাবে শুয়ে ছিল সেভাবে থেকেই বললো,
“না ভাবী এসো।”
“তিরা ফোন করেছিলো আমাকে বলল তোকে নাকি অনেকবার ফোন করেছে? আমাকে বললো খুব নাকি জরুরি কথা আছে তোর সাথে!”
“কথা বলতে ইচ্ছে করছে না ভাবী।”
রশ্নি আরশির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
“ঠিকাছে তাহলে বলতে হবে না। আজকে আমার সাথে বের হবি একটু?”
“না, ভাল্লাগছে না।”
“বের হলে ভালো লাগতো, এভাবে বন্ধ ঘরে থাকলে কোনো চেঞ্জ আসবে না। এর আগেও তো প্রমাণ পেয়েছিস। তারচেয়ে চল কোথাও ঘুরে আসি।”
“ইচ্ছে করছে না ভাবী।”
রশ্নি জানে আরশি নিজ থেকে এ অবস্থা থেকে বের না হওয়া পর্যন্ত কেউ তাকে বের করতে পারবে না। তবুও চেষ্টা না করলে তো মনে শান্তি মেলে না!
“আচ্ছা রেস্ট নে, কিছু লাগলে আমাকে বলিস।”
রশ্নি চলে যাচ্ছিলো। আরশি ডেকে বললো,
“ভাবী শোনো..”
রশ্নি দাঁড়ালো। আরশি বললো,
“বাবুর ডাক নাম রেখেছি আমরিন, আমার নামের সাথে মিলিয়ে। ভালো নাম তোমরা রাখো।”
রশ্নি খুশি হয়ে বললো,
“বাহ খুব সুন্দর নাম তো! আমার দারুণ পছন্দ হয়েছে।”
“আমরিনকে আমার কাছে দিয়ে যাবে কিছুক্ষণের জন্য?”
রশ্নি একথায় যে কতটা স্বস্তি পেলো তা বোধহয় সে ছাড়া আর কারো পক্ষে বোঝা সম্ভব না। সে সাথে সাথে গিয়ে তার বাচ্চাকে নিয়ে এলো।

রশ্নি আমরিন কে আরশির কোলে দিয়ে রান্নার অযুহাতে সামনে থেকে সরে গেলো। উদ্দেশ্য আরশিকে কিছুটা সময় নিজের মতো করে ভালো থাকতে দেয়া। কিন্তু রশ্নি অবাক হয়ে দেখলো আরশি আমরিনকে কোলে নিয়েই পর্দা সরিয়ে জনালা খুলে ঘর আলো করে দিলো। তারপর বিছানায় বসে চুপচাপ অনেকক্ষণ কোলে থাকা আমরিনের মুখের দিকে চেয়ে বসে রইলো। আরশির ভাবলেশহীন মুখ দেখে কারো বোঝার সাধ্য নেই সে আমরিনের দিকে তাকিয়ে কী ভাবছে বা আদৌ কিছু ভাবছে কিনা!

রাতেরবেলা আরশি তিরার ফোন ধরলো। তিরা জানে আরশি কেন ফোন ধরেনি। এমন পরিস্থিতিতে আরশি কারো সাথে কথা বলে না তাও সে জানে। আর এটাও জানে আরশির বর্তমান অবস্থার জন্য তার মা দায়ী। তাই ফোন কেন ধরেনি সেসব কথায় আর গেলো না। নিজের কথাই বললো।
“আরু প্লিজ হেল্প মি।”
তিরা কাঁদছিলো, কন্ঠ শুনেই বুঝলো আরশি। এবং প্রচন্ড অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“তা নাহয় করলাম কিন্তু তুই কাঁদছিস কেন?”
“আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। যাদিদকে ছাড়া এভাবে থাকতে পারবো না আমি। কী করবো আমি?”
“বুঝলাম না।”
“যাদিদ গত পরশু চলে গেছে। ওর ছুটি শেষ।”
“ছুটি শেষ বলেই তো এতো তাড়াহুড়ো করে বিয়ে হলো, এটা তো তুই আগে থেকেই জানতি।”
“হ্যাঁ কিন্তু ও যাওয়ার পর এই দুটো রাত আমি একফোঁটা ঘুমাতে পারিনি। দিনেও ঘুমাতে পারছি না।”
“কি বলছিস তোর তো কখনো ঘুমের সমস্যা ছিলো না!”
“ওকে ছাড়া আমি আর ঘুমাতে পারবো না।”
একথা বলে তিরা আরো জোরে জোরে কাঁদতে লাগলো। আরশি অবাক হচ্ছে কারণ তিরা বড় হয়ে কখনো কিছুর জন্য কাঁদেনি। এতোগুলো ব্রেকাপ হয়েছে কখনো কোনো ছেলের জন্য দুদিনের বেশি আফসোস করেনি কান্না তো দূরের কথা আর আজ সে যাদিদের জন্য এভাবে কাঁদছে! আরশির তো এসব বিষয়ে কোনো অভিজ্ঞতাই নেই তাই প্রথমে কি বলবে বুঝতে পারছিলো না। পরে একটু ভেবে বললো,
“আচ্ছা শোন শান্ত হ, এতোদিন একসাথে ছিলি তো তাই খারাপ লাগছে, ধীরে ধীরে অভ্যাস হয়ে যাবে।”
“অভ্যাস হবেনা তার আগেই মরে যাবো। এভাবে একটানা না ঘুমালে মানুষ বাঁচেনা, জানিস আমার প্রেশার লো হয়ে কি অবস্থা হয়েছিলো গতকাল? আমি আর ঘুমাতে পারবো না বোন।”
“পারবি, আমি যখন ঘুমাতে পারি তখন তুইও পারবি। শুধু সময় অতিবাহিত হওয়া প্রয়োজন। সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে!”
আরশির একথায় আচমকা তিরার কান্না থেমে গেলো। নিজেকে হঠাৎ ভাগ্যবতী মনে হলো কারণ ওর অবস্থা আরশির মতো নয়। সত্যিই তো আরশি ঘুমাতে পারলে তারও পারার কথা। তার মানে সত্যিই শুধু সময় অতিবাহিত হওয়া প্রয়োজন। সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে! তিরা বললো,
“তুই ঠিকই বলেছিস। আমি জানতাম তোর কাছে কোনো না কোনো সমাধান থাকবেই। এজন্যই কাল থেকে তোকে জ্বালাচ্ছিলাম।”
“কোনো ঘুমের ওষুধ খাস না আবার। তিন-চার মাইল দৌড়া বা কয়েশো দড়িলাফ দে। ক্লান্ত হলে এমনিতেই ঘুম আসবে।”
“আচ্ছা।”
ফোন রাখার পর আরশি এক গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেলো। যে তিরা কখনো কাঁদে না সে যাদিদের জন্য পাগলের মতো কাঁদছে, সেই মানুষটার শূন্যতায় সে ঘুমাতে পারছে না। তার মানে তিরা যাদিদকে ভালোবেসে ফেলেছে। সত্যিকারের ভালোবাসা! এতোদিন শুধু সে প্রেমই করেছে, কাউকে সত্যি সত্যি ভালোবাসেনি। আরশি সত্যিই চিন্তায় পড়ে গেছে, ভালোবাসা কি এমনই উন্মত্ত? একজনের অনুপস্থিতিতে আরেকজনের ভেতর এমনই শূন্যতার সৃষ্টি হয়? কই কাব্যর অনুপস্থিতিতে তার ভেতরে তো কোনো শূন্যতার সৃষ্টি হয়নি! এমনকি সেদিন ভাবী জিজ্ঞেস করার আগ পর্যন্ত মনেও পড়েনি কাব্যর কথা। তার মানে কি সে কাব্যকে ভালোবাসে তার এ ধারণাটা ভুল? তাহলে সে কাব্যকে এতো গুরুত্ব কেন দেয়? কাব্য তাকে ভালোবাসে বলে? অনেকক্ষণ চিন্তা করলো আরশি, এই প্রথম তার কোনো সমীকরণ মিলছে না!

সমীকরণে আরো গোলমাল লেগে গেলো পরেরদিন। যখন তার নামে একটা পার্সেল এলো। পার্সেলটা খুলতেই সে একটা বই পেলো, অরুন্ধতী রায়ের ‘গড অফ স্মল থিংস’। বইটির প্রথম পাতায় লেখা, ‘এক গুণমুগ্ধ নারীর জন্য আরেক গুণমুগ্ধ নারীর এই বইটি ছাড়া আর কিছু খুঁজে পেলাম না। জন্মদিনের অনেক শুভেচ্ছা।’
হাতের লেখাটা চিনতে কষ্ট হলো না আরশির। ‘ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট’ বইটির ভেতরের বুকমার্কের লেখাগুলো পড়েছিল যে!

‘এক গুণমুগ্ধ নারীর জন্য আরেক গুণমুগ্ধ নারীর এই বইটি ছাড়া আর কিছু খুঁজে পেলাম না। জন্মদিনের অনেক শুভেচ্ছা।’
লেখাটায় বারবার হাত বোলাচ্ছে আরশি। এই দুটি বাক্যের ভেতর যেন অনেক না বলা কথা, বলতে চাওয়ার ব্যাকুলতা! না আসলে দুটি লাইনে নয়, দুটি শব্দে.. গুণমুগ্ধ নারী! মুহুর্তেই তার ফর্সা গালে লাল আভা জমে গেলো। কী ভীষণ লজ্জা যে লাগছে! এই মানুষটার সামনে কি আর কখনো যেতে পারবে সে? মানুষটা কি কক্সবাজার থেকে ফিরেছে? ফিরলে সে কি এতোদিন খুঁজেছিলো ওকে? খুঁজলে একবারো ফোন করেনি কেন?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here