কনফিউশন পর্ব ২৮
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
তিরা অসময়ে যাদিদের ফোন পেয়ে চমকে উঠলো। যাদিদের জন্য সে আলাদা রিংটোন ব্যবহার করে। এই রিংটোন বাজলেই সে যেখানেই থাকুক পাগল হয়ে ছুটে আসে। ফোন ধরে অবাক হয়ে বললো,
“তুমি এ সময়ে?”
“একটা ভালো এবং একটা খারাপ খবর দিতে ফোন করলাম। যদিও দুটো রিলেটেড।”
“খারাপটা আগে বলো।”
“আমাকে সাবমেরিনে পোস্টিং দিয়েছে।”
“সাবমেরিন না পানির নিচে থাকে?”
“হ্যাঁ।”
“কীভাবে থাকবে তুমি?”
“সবাই যেভাবে থাকে!”
“পারবে?”
“শান্তিতে সংগ্রামে সমুদ্রে দুর্জয়। আমরা দেশের জন্য সব পারি।”
তিরা মনে মনে বললো,
“আর বৌয়ের জন্য কিছুই পারোনা। বিয়ে কেন করো তোমরা?”
কিন্তু মুখে এ কথা বলার সাহস নেই। বললো,
“এবার ভালো খবরটা দাও।”
“আমার প্রোমোশন হয়েছে। আর সেজন্যই সাবমেরিনে পোস্টিং হয়েছে।”
তিরা বললো,
“এটা! আমি ভেবেছিলাম তুমি বুঝি আসবে একবার।”
“কীভাবে আসবো? আমাদের কোনো ঈদ নেই, বাবা মা মারা গেলে বা সন্তান জন্ম নিলেও আমরা মুখ দেখতে ছুটে আসতে পারিনা। বিয়ের আগে এই সবকিছুর জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে বলেছিলাম, তাই না?”
“তখন বুঝতে পারিনি এতোটা খারাপ লাগবে তোমাকে ছাড়া।”
যাদিদ হেসে বললো,
“ঠিকাছে তোমাকে আরেকটা সুযোগ দেয়া হলো, এখন থেকে তুমি নিজেকে প্রস্তুত করো।”
তিরার খুব কান্না পেলো। কিন্তু কাঁদলে যাদিদ রেগে যায় তাই তাড়াতাড়ি ফোন রেখে দিলো। আজ হঠাৎ তিরার মনে হলো যাদিদের উপর ক্রাশ খাওয়া এবং এই বিয়ে তার জীবনের অনেক বড় ভুল সিদ্ধান্ত ছিলো।
আরশি ছাদ থেকে চলে যাওয়ার আরো কিছুক্ষণ পর কাব্য নিচে গেলো। তার দেবে যাওয়া সোফাটায় অনেকক্ষণ ধরে শুয়ে রইলো। কোনো বই পড়লো না, একটা সিগারেটও খেলো না। একা একা সিলিং এর দিকে তাকিয়ে শুয়ে রইলো শুধু। কাব্য কথাগুলো সামনাসামনি বলেছে যাতে আরশির অভিব্যক্তি দেখে বুঝতে পারে যে সে ব্যাপারটা কীভাবে নিয়েছে। কিন্তু কথাগুলো শোনার সময় সে এতোটাই স্বাভাবিক ছিলো যে কারো বোঝার উপায় নেই তার মনের মধ্যে কী চলছিলো! শুধু একটা জিনিসই কাব্যর চোখে পড়েছে তা হলো লিভ টুগেদারের কথায় আরশি চমকে গিয়েছিলো তবে খুব সামান্য সময়ের জন্য। এটুকুতে কিছুই বোঝা যায় না। প্রচন্ড টেনশন হচ্ছে। তবে সব কথা বলতে পেরে এক অদ্ভুত প্রশান্তি লাগছে। এবার আরশি ওর জীবনে থাকুক বা দূরে সরে যাক, যেটা হবে সেটাকেই নিজের নিয়তি ভেবে নেবে কাব্য।
আরশি ছাদ থেকে ফিরতেই রশ্নি জিজ্ঞেস করলো,
“বাগানে গিয়েছিলি?”
“না ছাদে।”
“আজ কি সুন্দর জোৎস্না নারে?”
“হুম।”
“আমরিন ঘুমুচ্ছে, এই ফাঁকে নাস্তা বানিয়ে দেই। বল কী খাবি?”
“কিছু খাবো না।”
“শুধু চা খাবি?”
“চাও খাবো না।”
অবাক হলো রশ্নি,
“কেন?”
“ভালো লাগছে না।”
এ কথা বলে আরশি নিজের ঘরে ঢুকে বিছানায় বসলো। রশ্নি বললো,
“কী হয়েছে?”
“কিছু না ভাবি। হঠাৎ ভাল্লাগছে না। আমার কিছুক্ষণ একা থাকা প্রয়োজন।”
রশ্নি জানে বলার মতো কিছু হলে আরশি একবার জিজ্ঞেস করতেই তাকে বলে আর না বলার মতো কিছু হলে একশোবার জিজ্ঞেস করলেও বলে না। তাই আর জিজ্ঞেস করলো না। কাছে গিয়ে আরশিকে বুকে টেনে নিলো রশ্নি। আর সঙ্গে সঙ্গেই টের পেল আরশির শরীরটা তিরতির করে কাঁপছে যা এতোক্ষণ ওকে দেখে বোঝা যাচ্ছিলো না।! রশ্নি দরজা লাগিয়ে বের হয়ে গেলেও ভাবতে লাগলো এতো অস্থির হওয়ার মতো কী এমন ঘটেছে?
রশ্নি বের হয়ে যাবার পর আরশি আলো নিভিয়ে শুয়ে রইলো ঘন্টার পর ঘন্টা। অনেক কষ্টে এতোক্ষণ কাব্যর সামনে স্বাভাবিক হয়ে বসে কথা বলছিলো। কিন্তু ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড অস্থির লাগছিলো তার। শরীরে শক্তি নেই। ভালো-মন্দ সব অনুভূতিগুলো মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে।
কাব্যর আগে গার্লফ্রেন্ড থাকতে পারে এবং তার সাথে শারিরীক সম্পর্কও থাকতে পারে এমনটা আরশি একরকম ভেবেই নিয়েছিলো। কিন্তু ঠিক লিভ টুগেদারের মতো একটা ব্যাপার হজম করতে কষ্ট হচ্ছে। তবে সে এইসব নিয়ে চিন্তিত নয়। কারণ এটা একে তো কাব্য-তনিকার ব্যক্তিগত ব্যাপার তার উপর অতীত। বরং সে চিন্তিত কাব্যর কনফিউশন নিয়ে। কাব্য কি তার ব্যাপারেও কনফিউজড? নাকি তার ব্যাপারটা আলাদা? যেরকম মেয়ে কাব্যর ভালো লাগে বললো, সেতো ওইরকম না। তার ধারেকাছেও না। তাহলে কাব্যর তাকে কী করে ভালো লাগলো? শুধু ভালো লাগাই না, কাব্যর শেষ কথাগুলো প্রমাণ করে যে কাব্য তাকে ভালোবাসে। তাহলে?
আরেকটা ব্যাপার নিয়েও চিন্তিত আরশি। সেটা হচ্ছে কাব্যর অভিমান। কাছের মানুষ ভুল বুঝলে ভুল ভাঙায় না! কাব্য যে কিছু ব্যাপারে এতোটা চাপা স্বভাবের সেটা এতোদিন বুঝতে পারেনি আরশি। সে নিজে চাপা স্বভাবের, সঙ্গীও যদি অমনই জোটে তাহলে তো ঝামেলা। দুজন দুজনকে ভুল বুঝে বসে থাকবে! তারপর মেটাবে কে?
তবে সব দুশ্চিন্তা ছাপিয়ে প্রচন্ড রকমের এক ভালো লাগাও কাজ করছে। এক্স গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে এমন কেলেঙ্কারির কথা হবু গার্লফ্রেন্ডকে বলার মতো সাহস সবার থাকে না। কথাগুলো কাব্য নিজে না বললে কখনোই জানতে পারতো না আরশি। সবচেয়ে বড় কথা সে তনিকার দোষগুলো সামনে আনেনি। নিজের দোষগুলোই বলেছে। কাব্যর প্রতি আলাদা একটা শ্রদ্ধাবোধ কাজ করছে আরশির। জীবনটা অনেক বড় এবং অনেক জটিল। একটা ভালো প্রেমিকের চেয়ে একটা ভালো মানুষ জীবনসঙ্গী হিসেবে অনেক বেশি শ্রেয়!
এতোদিন আরশি-কাব্যর যে একটা প্রেমবিহীন সম্পর্ক চলছিলো তাতে আরশির একটা সূক্ষ্ণ অপেক্ষা ছিলো, কাব্য কবে তাকে প্রপোজ করবে সেই অপেক্ষা। কিন্তু আজ আরশি মোটামুটি সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছে কাব্য যদি প্রপোজ করে তবে সে তাকে সময় নিতে বলবে। কাব্য সময় নিয়ে সব কনফিউশন দূর করে তবে সামনে আগাক। তবে কাব্য বুদ্ধিমান ছেলে, সে হুট করে প্রপোজ নাও করতে পারে। তাই সে যদি নিজ থেকেই সময় নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তাতেও আপত্তি নেই। আরশির কোনো তাড়া নেই।
চলবে…