কনফিউশন পর্ব ৩৭
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
যাদিদের চোখ থেকে যেন রক্ত ঝরছে। রাগে তার সারা শরীর কাঁপছে। ফর্সা মুখ লাল হয়ে গেছে। কপালে জমে আছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। দাঁতে দাঁত চেপে সে বলল,
“এসব কী তিরা? তোমাকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম না তোমার কোনো বয়ফ্রেন্ড ছিল কিনা? কী বলেছিলে?”
তিরা চুপ করে আছে, কী বলবে কিছু মাথায় আসছে না। ভয়ে আত্মা শুকিয়ে গেছে। যাদিদ আবার বলল,
“তোমাকে সরল ভাবতাম আমি এতদিন। কিন্তু তুমি যে এরকম মিথ্যেবাদী তা আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এই ছবি দেখার পর, চিঠি পড়ার পর বিশ্বাস হয়েছে। এমন চিঠি তো তুমি আমাকেও লেখো।”
তিরা ভয়ে ভয়ে বলল,
“এত রাগ করছো কেন যাদিদ এসব তো আমার পাস্ট। প্রেজেন্ট তো না।”
“মানুষের পাস্ট থাকতেই পারে তিরা। তোমার পাস্ট নিয়ে আমার কোনো হেডেক নেই। পাস্ট আমারও আছে কিন্তু আমি সেটা লুকাইনি। বছরে একদিন দেখা হওয়া গার্লফ্রেন্ডের কথাও আমি তোমাকে বলেছি, জীবনে যাকে ছুঁয়ে দেখতে পারিনি, একটা চুমু খাওয়ারও সুযোগ পাইনি কোনোদিন। আর তুমি? আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করার পরেও তুমি আমার চোখের উপর মিথ্যে বললে? আমি যদি জিজ্ঞেস না করতাম, তাহলে এখন সব জানতে পারলেও আমার খারাপ লাগতো না। আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি এটা ভেবে যে একটা মিথ্যেবাদীকে সরল ভেবে সংসার করছি আমি!”
“আমাকে মাফ করে দাও যাদিদ। এসব এত সিরিয়াসও ছিল না যে আমি তোমাকে বলব।”
“তাই বলে তুমি আমাকে মিথ্যে বলবে? মিথ্যে দিয়ে শুরু করবে নতুন জীবন? তোমার মিথ্যেটা এতই সত্যির মত ছিলো যে এই শকুনের চোখও সেটা ধরতে পারল না! আর সিরিয়াস ছিল না বলতে কি বোঝাতে চাইছ তুমি আমাকে? ছবিগুলো দেখো। চিঠিগুলোতে কি লিখেছিলে তা যদি ভুলে যাও তাহলে আবার পড়ো। পড়লেই বুঝতে পারবে তোমাদের সম্পর্ক কতটা সিরিয়াস ছিল তা আমার বুঝতে অসুবিধা হচ্ছেনা।”
তিরা চুপ। যাদিদ আবার বলল,
“তুমি বিয়ের পরেও কোনো একদিন কি স্বীকার করে নিতে পারতে না যে মিথ্যে বলেছিলে? আগে না বললেও অন্তত এই কদিনে আমরা তো অনেক ফ্রি হয়ে গেছি তিরা। তুমি বলতে পারতে। সব বাদ দিলাম। কিন্তু এই একটু আগেও যখন জিজ্ঞেস করেছিলাম তখনও অস্বীকার করলে? তখনও যদি বলতে তাহলে তোমার এক্স বয়ফ্রেন্ডের কাছে আমাকে ছোট হতে হত না। ছেলেটা যখন আমাকে সব বলেছিল তখন আমি ওকে বলেছিলাম, আমি আপনার কথা বিশ্বাস করিনা। আমার বউকে আমি চিনি। শুধুশুধু আমার সময় নষ্ট করবেন না। ছেলেটা তখন আমার কথা শুনে হাসছিল! আরো মজার ব্যাপার কি জানো সে প্রমাণ দিতে আমার বাসার সামনে পর্যন্ত চলে এসেছে। তোমার আরও অনেক প্রেমের কাহিনীই সে বলেছে তবে প্রমাণ দিতে পারেনি। আমি জানিনা কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যে। অথচ তুমি যদি আমাকে আগেই সব বলতে তাহলে আমি ওকে বলতে পারতাম, আমি সব জানি এন্ড আই ডোন্ট কেয়ার।”
তিরার প্রচন্ড কান্না পাচ্ছে। যাদিদ বলল,
“আর কী কী মিথ্যে বলেছ তিরা? এখন তোমার সবকিছুকেই আমার অভিনয় মনে হচ্ছে।”
“আর কোনো মিথ্যে বলিনি বিশ্বাস করো।”
“তোমাকে আর বিশ্বাস করতে পারছি না। একবার বিশ্বাস করে তোমার মিথ্যে ভালোবাসার জালে জড়িয়েছি। তবে আমার বলতেই হচ্ছে অনেক ভাল অভিনেত্রী তুমি। যার ভেতরে এতটুকু আবেগ অবশিষ্ট নেই তার ভেতরে ভালোবাসা জমিয়েছিলে তোমার এই অভিনয় দিয়ে!”
এবার তিরা কেঁদে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“আমার ভালোবাসা মিথ্যে নয় যাদিদ।”
যাদিদ তাচ্ছিল্যভরে খানিক তাকিয়ে সরে গেল। দ্রুতহাতে ব্যাগ গোছাতে লাগলো। তিরা যাদিদের কাছে গিয়ে বলল,
“তুমি কি চলে যাচ্ছ?”
যাদিদ কোনো কথা বলল না। ব্যাগ গুছিয়ে কাপড় পালটে নিল। ওদিকে তিরা অনর্গল মাফ চেয়ে যাচ্ছে। একসময় যাদিদের হাত ধরে বলল,
“আরো দুদিন তোমার ছুটি আছে। যেওনা যাদিদ। প্লিজ।”
যাদিদ একটা কথারও উত্তর দিল না। হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ঘর থেকে বের হবে এমন সময় তিরা যাদিদের পা জড়িয়ে ধরল। তারপর কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“আমার ভুল হয়ে গেছে। এমন ভুল আর হবেনা। আর কখনো মিথ্যে বলব না। যেওনা প্লিজ। আমাকে মাফ করে দাও।”
“আমি তোমার পাগল প্রেমিক না যে তোমার অন্যায় মাফ করে দেব। শোনো তিরা, এখন বের হচ্ছি। বাবা মায়ের সামনে নাটক করে নিজেকে এবং আমাকে আর ছোটো করবে না আশা করি।”
“মাফ করতে না পারো শাস্তি দাও। কিন্তু এভাবে চলে যেয়ো না প্লিজ। আরো দুদিন ছুটি আছে, এই দুদিন প্লিজ থেকে যাও।”
“আরো দুদিন তোমার সাথে থাকা তো দূরের কথা, তোমার মুখও দেখতে চাইনা আমি।”
যাদিদ এ কথা বলে বেরিয়ে গেল। তিরা পেছন পেছন গেল। যাদিদ বাবা মাকে ডেকে বিদায় নিল। সে যেহেতু কখনো মিথ্যে বলেনা তাই শুধুমাত্র এটুকু বলল এক্ষুনি যেতে হবে। কেন সেটা আর বলল না। বাবা মা ভেবে নিলেন যাদিদের হয়তো কল এসেছে, ইমার্জেন্সি ব্যাক করতে হবে। তিরাকে কাঁদতে দেখে ভাবলেন স্বামী চলে যাচ্ছে বলে মেয়েটা কাঁদছে। রেহানা তিরার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“কেঁদোনা মা। যাদিদ আবার ছুটি ম্যানেজ করে ঠিক চলে আসবে দেখবে।”
ভেতরে ভেতরে কতকিছু হয়ে গেছে তা আর কেউ জানলো না।
তিরা কয়েকবার যাদিদকে ফোন করল। সে ফোন ধরলো না। তিরা কাঁদতে কাঁদতে রাত পার করে দিল। এখন ভোর। মাথা কাজ করছে না এখন আর। তিরা ছবি আর চিঠিগুলো নিয়ে বসলো। অয়নের সাথে তার কাপল ছবিগুলো দেখছে। তিরা তখন এসএসসি পরীক্ষার্থী। অয়নের সাথেই তার সবচেয়ে বেশিদিন সম্পর্ক ছিল, প্রায় ৯ মাস। এই ৯ মাসে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই তারা ডেটে যেতো। কত কত ছবি তুলেছে হিসেব নেই। ছবি দেখতে দেখতে একটা ছবি দেখে অবাক হয়ে গেল তিরা। ছবিতে অয়ন তাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে এবং সে অয়নের গালে চুমু দিচ্ছে। এমন ছবি সে কবে তুলল? সবচেয়ে বড় কথা সে মনে করতে পারছেনা সত্যিই সে অয়নকে কখনো চুমু দিয়েছে কিনা! এই ছবি এডিটেড নয়তো? অনেকক্ষণ ভাবার পর তার মনে পড়লো সে সত্যিই অয়নকে চুমু দিয়েছিল। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। তিরা ছবিগুলো সব ছিঁড়ে ফেলল। তারপর চিঠিগুলো একটা একটা করে সব পড়লো। তখন তিরার নিজস্ব মোবাইল ছিল না বলে দুজনেই নিয়মিত চিঠি লিখতো। কত ভালোবাসার কথা একেকটা চিঠিতে লেখা। কেন সে এত ভালোবাসার কথা অয়নকে লিখেছিল? সে কি অয়নকে সত্যিই এতটা ভালোবাসতো? কই যাদিদের জন্য যেমন লাগে এমন তো অয়নের জন্য লাগেনি কখনো। শুধু অয়ন কেন কারো জন্যই লাগেনি। তাহলে চিঠিতে এত ভালোবাসার কথা কেন লিখেছিল? অয়নকে ক্রেজি করার জন্য? সারাজীবন খেলার ছলে সে ক্রাশ খেয়েছে, প্রেম করেছে, ব্রেকাপ করেছে৷ এই ব্যাপারগুলো যে এতটা সিরিয়াস হতে পারে সে ব্যাপারে তার কোনো ধারণাই ছিল না। অথচ এসবই এখন তার জীবনে মৃত্যু ডেকে এনেছে। যাদিদের এমন মুখ ফিরিয়ে চলে যাওয়া মৃত্যু ছাড়া কিছু না। হাতের চিঠিটা রেখে আরেকটা চিঠি পড়েই থমকে গেল তিরা। এই মুহুর্তে তিরার হাতে একটা বিশেষ চিঠি। অয়ন প্রথম তিরাকে জড়িয়ে ধরায় তার কেমন লেগেছিল, প্রথম চুমু খাওয়ার পর কেমন লেগেছিল সব অনুভূতি এই চিঠিটাতে তিরা লিখেছিল। এই চিঠিটাও যাদিদ পড়েছে? কীভাবে সহ্য করেছে সে?
চলবে…