কনফিউশন পর্ব ৩৮
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
যাদিদ বাসা থেকে বেরিয়ে হোটেলে এসে উঠেছে। তিরা একের পর এক ফোন করে যাচ্ছে, যাদিদ ফোন সাইলেন্ট করে ফেলে রেখেছে সামনেই। তিরার ছবিটা স্ক্রিনে ভাসছে। এই হোটেল থেকে তাদের বাসার একাংশ দেখা যায়। এখন প্রায় ভোর, তিরার ঘরে এখনো আলো জ্বলছে। যাদিদ সারারাত ধরে তিরার ঘরে জ্বলে থাকা আলোর দিকে তাকিয়ে বসে আছে। তিরার সাথে ওই ছেলেটার ছবি দেখে এবং চিঠি পড়ে যাদিদ নিজেকে সামলাতে পারছিল না। তার ইচ্ছে করছিল তিরাকে মেরে ফেলতে। এতকিছু করে আবার সব গোপণ করেছে, মিথ্যে বলেছে! অথচ সে কতটা সরল ভেবেছিল তিরাকে! এতটা অভিনয় একটা মানুষ করে কীভাবে? আর সেইবা কেন মাত্র এক বছরে মেয়েটাকে এত ভালোবেসে ফেলল? বিয়ের প্রায় এক বছর হলেও একসাথে থেকেছে মাত্র ১৩ দিন। মেয়েটা মাত্র ১৩ দিনে কী দিয়ে এত পাগল করে ফেলল যে সবকিছু ভুলে গিয়ে এক্ষুনি ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে! কি দিয়েছে? মিথ্যে ভালোবাসা ছাড়া আর কিছু না! অয়ন তিরাকে প্রথম চুমু খাওয়ার পর তিরা অনুভূতি লিখে কত লম্বা চিঠি লিখেছিল, ঠিক যেমনটা তাকে লিখতো তাদের বিবাহিত জীবনের প্রথম ৫ দিনের অনুভূতি! তিরা কি সবাইকেই এভাবে লেখে? তিরার কি সবার জন্যই এক ধরণের অনুভূতি হয়? সেতো কোনোদিন কোনো মেয়েকে ছুঁয়েও দেখেনি তবে তার কপালে এমন দশ ঘাটের জল খাওয়া এক মেয়ে জুটলো কেন? পরক্ষণেই যাদিদ নিজেকে ধিক্কার দিল তিরা সম্পর্কে এমন বাজে কথা ভাবার জন্য। এলোমেলো হয়ে গেছে আজ সে। বারবার মনে হচ্ছে তিরার একচ্ছত্র অধিকার তার নয়। সে অধিকার পাবার আগেও বহুজন এই অধিকার পেয়েছে! অসহ্য লাগছে সবকিছু। শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছে হয় তিরাকে নয় নিজেকে!
তিরা বারান্দায় বসে আছে। বহুদিন পর অয়নের ফোন নাম্বারটা সে আনব্লক করলো। ফোন করতেই ওপাশ থেকে অয়ন বলল,
“আহ! তোমার ফোনের অপেক্ষাতেই ছিলাম।”
“কেন এমন করলে?”
“ঋণ শোধ করার জন্য।”
“কীসের ঋণ?”
“মাত্র ৩ বছর আগের কথা ভুলে গেছো? কেন ছেড়েছিলে আমাকে?”
তিরা চুপ। অয়ন বলল,
“কারণটা তুমি বলেছিলে তোমার বাসায় আমাদের সম্পর্কের কথা জেনে ফেলেছে। তারা মেনে নেবে না। অথচ কারণটা ছিল তুমি তোমার কলেজের কোনো এক সিনিয়রের উপর ক্রাশ খেয়েছিলে। তুমি কারণটা না বললেও আমি জানতে পেরেছিলাম তিরা। কারণ আমি তোমার সাময়িক ক্রাশ থাকলেও তুমি ছিলে আমার ভালোবাসা। তোমার সব খোঁজখবর আমি রেখেছি। আমার পরে তুমি যতগুলো প্রেম করেছো সব জানতে পেরেছি। তোমার কোনো বয়ফ্রেন্ডের কাছেই যাইনি আমি কারণ কী জানো? কারণ আমি জানতাম তারা কেউই পার্মানেন্ট না। সবাই আমার মত সাময়িক। তোমার বিয়ের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আমার অপেক্ষা যে এত জলদি শেষ হয়ে যাবে ভাবিনি। তো মিসেস তিরা কেমন লাগছে এখন তোমার?”
“তুমি আমাকে ভালোবাসো অয়ন! এটা তোমার কেমন ভালোবাসা? আমি তোমাকে ছেড়ে এসেছি কিন্তু কোনো ক্ষতি তো করিনি। তুমি কীভাবে পারলে আমার এতবড় ক্ষতি করতে?”
“আমি তোমাকে ভালোবাসতাম তিরা। যতটা ভালোবাসতাম এখন ততটা ঘৃণা করি।”
তিরা ফোন রেখে দিল। আর কিছু বলার বা জানার নেই। অয়নও আর ফোন দিল না। অয়নেরও সম্ভাবত ওকে আর কিছু বলার বা জানানোর নেই। তিরা ফোন হাতে ধরে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আকাশের দিকে। তার যতগুলো বয়ফ্রেন্ড ছিল তার মধ্যে তিরা যতজনকে ছেড়েছে তারা সবাই যদি এভাবে যাদিদের কাছে এসে প্রমাণ দেয় তাহলে হয়তো এই বারান্দা থেকে লাফিয়ে পড়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবেনা তার। সে কত বড় বড় ভুলের উপর জীবন পার করছিল তা ভাবতেই শিউরে উঠছে এখন!
তিরা লিখতে বসলো। আরশি তাকে চিঠি লিখতে বলেছে যাদিদের কাছে। এখনো নাকি সময় আছে সব কনফেস করার। তিরা গুছিয়ে বলতে না পারলেও গুছিয়ে লিখতে পারে। চিঠি লেখা তার বহুদিনের অভ্যাস। তাই আরশি লিখতেই বলেছে। তিরা জানে না ঠিক হচ্ছে নাকি ভুল তবে সে লিখে চলেছে..
যাদিদ,
জানিনা তুমি এই চিঠি পড়বে কিনা। হতে পারে আমার নাম দেখেই ছুড়ে ফেলে দেবে। কিন্তু এমনও তো হতে পারে যে তুমি পড়বে! তাই লিখছি। ছোটবেলা থেকেই আমি খুব বোকা একটা মেয়ে। কেউ ইচ্ছে করলেই আমাকে যেকোনো কিছু বুঝিয়ে দিতে পারে। এটা তুমি নিজেও জানো। হয়তো এখন আর বিশ্বাস করো না।
যাই হোক, আমার একটা নেশা ছিল। ক্রাশ খাওয়ার নেশা। আমি প্রথম ক্রাশ খেয়েছিলাম বোধহয় ক্লাস ফাইভে পড়ি তখন। কোনো সুন্দর স্মার্ট ছেলে দেখলেই আমি ক্রাশ খেয়ে ফেলতাম। ক্লাসমেট, বন্ধু, পাশের বাসার ছেলে, দূরসম্পর্কের কাজিন, গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলে, কোচিং এর টিচার, বাসার টিচার, কলেজের টিচার, রেস্টুরেন্টের ওয়েটার, এমনকি বান্ধবীর চাচা মামাদের উপরেও ক্রাশ খেয়েছি আমি৷ ছেলেটা কে, কী করে, ভবিষ্যৎ কী কিছুই ভাবতাম না আমি। আমি সেকেন্ডের মধ্যে ক্রাশ খেয়ে ফেলতাম। আমি সুন্দরী তাই ক্রাশদের নজরে পড়তেও সময় লাগতো না। অয়ন ঠিকই বলেছে৷ আমি অনেকগুলো প্রেম করেছি। সবাই আমার ক্রাশ ছিল। আমি একজনের সাথে প্রেম থাকা অবস্থায় আরেকজনের উপর ক্রাশ খেয়েছি এমন ঘটনাও আছে। সবাই আমার ক্রাশ খাওয়া নিয়ে হাসাহাসি করত। বিশ্বাস করো যাদিদ আমার জাস্ট এসব ভাল লাগতো তাই করতাম। ব্যাপারটা যে আসলে কতটা সিরিয়াস কখনো বুঝতে পারিনি। অয়নের সাথে আমার সবচেয়ে বেশিদিন সম্পর্ক ছিল। এছাড়া কোনো সম্পর্কই আমার এক মাস দু মাসের বেশি টিকতো না। আমি ক্রাশ খাওয়ার পর সবার ব্যাপারেই খুব উৎসাহী থাকতাম। কিন্তু কিছুদিন পর ওই ভালোলাগাটা আর কাজ করতো না। অন্য সম্পর্কে যাওয়ার পর আগেরটা ভুলে যেতাম, খুব অনায়াসেই। কখনো মনেও পড়তো না আর।
যাদিদ আমি বুঝতে পারছি তুমি ওই ছবি আর চিঠিগুলোর জন্য কি ভাবছো! কিন্তু বিশ্বাস করো আমার অয়নের সাথে কোনো শারীরিক সম্পর্ক ছিল না। ইভেন কারো সাথেই না। এতটা সাহস বা ইচ্ছে কখনোই হয়নি। জানিনা আমার কথা তুমি বিশ্বাস করছো কিনা কিন্তু আজ এই চিঠিতে যদি একটা মিথ্যাও লিখি তাহলে যেন এই মুখ সত্যিই আর কখনো তোমাকে দেখাতে না পারি।
আমাকে এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দেয়ার প্ল্যান আমার বাবা মায়ের ছিল না। কিন্তু আমি পড়াশোনায় খুব একটা ভাল না তুমি জানো। তাই বাবা মা তোমার মত পাত্র পেয়েই বিয়ের কথা বলল। আমি কিছুতেই বিয়েতে রাজী হচ্ছিলাম না। আমার কেবলই মনে হচ্ছিল বিয়ে করে ফেললে আমি ক্রাশ খাব কী করে? কিন্তু আমি যেদিন তোমাকে প্রথম দেখি সেদিনই ক্রাশ খেয়ে ফেলি। তোমাকে বিয়ে করার জন্য আমি একদম পাগল হয়ে যাই। মনে হচ্ছিল তোমাকে বিয়ে করতে না পারলে আমার জীবন বৃথা। শুধু এইজন্য তুমি যখন আমাকে জিজ্ঞেস করলে আমার বয়ফ্রেন্ড ছিল কিনা আমি মিথ্যে বলেছি। সত্যি বললে যদি বিয়ে না হয় এই ভয় ছিল আমার! আমি যদি জানতাম তুমি আমাকে দেখেই বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিলে তাহলে হয়তো সেদিন মিথ্যে বলতাম না।
বিয়ের পর ৫ দিন ভালোবাসার উন্মত্ততায় কাটানোর পর যখন তুমি চলে গেলে আমি প্রায় পাগল হয়ে গেলাম। এত এত শূন্যতা জীবনে কখনো অনুভব করিনি আমি। তোমার জন্য আমার যেমন লাগতো কখনো কারো জন্য এমন লাগেনি। তখন বুঝলাম তুমি আমার জীবনের প্রথম প্রেম, প্রথম ভালোবাসা। তখন বুঝলাম এর আগে কাউকেই ভালোবাসিনি আমি। আমি শুধু ভেবেছি ভালোবাসি। সাময়িক মোহ বা ক্রাশ থেকেই একেকটা সম্পর্কে জড়িয়ে যেতাম।
তোমাকে যে সত্যিই ভালোবেসেছি তার আরেকটা প্রমাণ হচ্ছে আমার শেষ ক্রাশ তুমি। আমাদের বিয়ের প্রায় এক বছর হয়ে আসছে। এতদিনে আর কাউকে নজরেই লাগেনি। তোমাকে চোখে ভাসতো সবসময়। তোমার সাথে একটু কথা বলার জন্য, তোমাকে ভিডিও কলে একটু দেখার জন্য পাগল হয়ে থাকতাম আমি৷ এমনটা আমার কখনো কারো জন্য হয়নি। তোমাকে ভালোবাসি যাদিদ। আর তাই আজীবন তোমার সাথেই থাকতে চাই। গতকাল তুমি মুখ ফিরিয়ে চলে গেছো। বলেছো আমার মুখ আর দেখতে চাওনা। আমি জানি তুমি রাগ করে বলেছো। আমাকে শাস্তি দেয়ার জন্য তুমি চলে গেছো। অন্যায়ের শাস্তি আমি মাথা পেতে নিলাম। যতদিন ধরে এই শাস্তি তুমি আমাকে দেবে আমি সহ্য করব। আমি জানি তোমার রাগ একদিন শেষ হবে, তখন তুমি আমার কাছে ফিরে আসবে। কারণ তুমি আমার স্বামী, আমাকে ভালোবাসো তুমি।
একবার মিথ্যে বলে অন্যায় করেছি। সত্য গোপণ করাটাও অন্যায়। তাই আজ গোপণ করে রাখা সব সত্যি বলে দিলাম। মাফ করে দিও যাদিদ। তিরা খুব খারাপ মেয়ে না।
চিঠি লিখে শেষ করেও পোস্ট করার সাহস হচ্ছিল না তিরার। অনেক ভাবনা চিন্তার পর সপ্তাহখানেক বাদে অবশেষে চিঠিটা পোস্ট করল। আর কোনো উপায়ও নেই। যাদিদ তার ফোন ধরেনা। শতবার ফোন দিলেও একবার ধরেনা!
আরো কিছুদিন পর যাদিদ ডিউটি শেষে নিজের ঘরে ফিরে চিঠিটা পেল। তিরার নাম দেখেই ঝটপট খুলে পড়তে শুরু করলো। পড়া শেষ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। তারপর চিঠিটা ছিঁড়ে কুচিকুচি করে ফেলে দিল।
চলবে…