কনফিউশন পর্ব ৪৫
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
তিরা বিছানায় বসে আছে। তার পাশেই বসে আছে যাদিদ। তিরার হাত দুটো দুহাতে ধরে সে নরম গলায় বলল,
“এমন কেন করলে তিরা?”
তিরা চুপ। যাদিদ তিরার আরো কাছে গিয়ে তাকে বুকে টেনে নিল। তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি?”
যাদিদের বুকে মাথা রাখতেই তার হার্টবিট শুনতে পেল তিরা। সাথে সাথেই অস্থির লাগা শুরু হলো। এবার সে কাঁদতে শুরু করল। যাদিদ বলল,
“আমাকে আর কখনো মিথ্যে বলোনা তিরা। একটা মিথ্যের জন্য ৭ টা মাস চলে গেল আমাদের জীবন থেকে। তাও এত গুরুত্বপূর্ণ ৭ টা মাস।”
তিরার কান্না আরো বেড়ে গেল। যাদিদ তিরার মুখটা দু’হাতে ধরে চোখে চোখ রেখে বলল,
“আমি তোমাকে অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলেছি তিরা তাই মাফ করে দিয়েছি, নাহলে হয়তো আমাদের আর কখনো দেখা হতো না।”
তিরা অবাক হয়ে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো, যেখানে এতদিন দূরে থাকার জন্য এবং খোঁজখবর না নেয়ার জন্য যাদিদের মাফ চাওয়া উচিৎ ছিল সেখানে সেই কিনা মাফ করে দয়ার কথা বলছে! এ কার পাল্লায় পড়েছে সে!
যাদিদ গভীর রাতে ঘুম ভেঙে দেখল তিরা পাশে নেই। আতঙ্কিত হয়ে বাথরুমে যেয়ে দেখল সেখানে নেই। এরপর বারান্দায় যেতেই দেখতে পেল তিরা হাফ রেলিং দেয়া গ্রিলের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। যাদিদ তিরার কাছে গিয়ে বলল,
“কী হয়েছে? এখানে কি করছো?”
তিরা বলল,
“কিছু না। ভাল্লাগছে না তাই এখানে এসে দাঁড়িয়েছি।”
“হয়েছে এতরাতে এখানে দাঁড়াতে হবে না। ঘরে এসো।”
তিরা চুপচাপ ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল। যাদিদ পাশে শুয়ে হাত বাড়িয়ে দিল কারণ তিরা যাদিদের হাতের উপর শুতে খুব পছন্দ করে। তিরা যাদিদের কাছে এসে তার হাতের উপর মাথা রাখলো। অন্যহাতে যাদিদ তিরার চুলে হাত বুলিয়ে বলল,
“তুমি ছেলে চেয়েছিলে নাকি মেয়ে?”
“ছেলে।”
যাদিদ হেসে বলল,
“আমি কিন্তু মেয়ে হওয়াতেই বেশি খুশি।”
তিরা একটু হাসার চেষ্টা করল। তিরা এখন আর হাসে না, তেমন কথাও বলে না। কিছু জিজ্ঞেস করলে যন্ত্রের মত জবাব দেয়। যাদিদ জিজ্ঞেস করল,
“রাগ করে আছো আমার উপর?”
“না।”
“তাহলে এমন করছ কেন?”
“কেমন?”
“এইযে মনে হচ্ছে আমি তোমার পর কেউ। আমার কাছে আসছ না, কথা বলছ না, হাসছো না।”
“আমার হাসি পায় না।”
যাদিদ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো তিরার দিকে। তারপর হঠাৎ তার ঠোঁটে চুমু খেল। তিরা ভীষণ লজ্জা পেল। যাদিদ হেসে বলল,
“তার মানে তুমি ঠিক আছো।”
তিরা বলল,
“মানে?”
“এইযে চুমু খেতেই লজ্জা পেলে। মানে অনুভূতি এখনো সচল।”
এবার তিরা হেসে ফেলল। যাদিদ বলল,
“দেখেছো হাসিও পাচ্ছে এখন।”
তিরা যাদিদের আরো কাছে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলো। তিরার উঁচু পেট যাদিদের গায়ে লাগতেই তার এক অদ্ভুত অনুভূতি হলো। তিরা স্বাভাবিক হয়েছে দেখে মনটাও হালকা হলো। যাদিদ তিরার পেটে হাত বুলিয়ে বলল,
“রাগ করে থেকো না তিরা। তাতে নিজেরাই বঞ্চিত হব। গত ৭ মাস কাটতে না চাইলেও, ছুটির এই এক মাস দেখতে দেখতেই কেটে যাবে।”
তিরা অভিমানী সুরে বলল,
“নিজে তো ঠিকই এতদিন রাগ করে থেকেছ।”
“রাগ করে থাকলেও তুমিহীন থাকতে পারিনি একটি দিনও।”
তিরা মুখে ভেংচি কাটলো। যাদিদ বলল,
“সত্যি বলছি। প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে তোমাকেই ভেবেছি শুধু। তোমার কনফেস করা চিঠিটা পড়েই আমি তোমাকে মাফ করে দিয়েছিলাম। ওটা আমি ছিঁড়ে ফেলি যাতে আর কারো হাতে না পড়ে। কিন্তু বাকি চিঠিগুলো যত্ন করে রেখে দিয়েছি, বারবার পড়তাম। প্রতিদিন তোমার ছবি দেখতাম।”
তিরা অবাক হয়ে বলল,
“এত আগেই মাফ করে দিয়েছ? তাহলে আমার সাথে যোগাযোগ করতে না কেন?”
“তোমাকে কষ্ট দেয়ার জন্য। এটা বোঝানোর জন্য যে আমার সাথে মিথ্যে বললে কী হতে পারে!”
“আমাকে কষ্ট দিতে গিয়ে নিজেকে এভাবে কষ্ট দিলে কীভাবে?”
“আমি তোমাকে যতটুকু কষ্ট দিতে পারব তারচেয়ে অনেক গুণ বেশি কষ্ট দিতে পারব নিজেকে। বরং নিজেকে যতটা কষ্ট দিতে পারব, তোমাকে ততটা পারব না।”
“ভাল্লাগছে, খুব ভাল্লাগছে।”
যাদিদ ভ্রু কুঁচকে বলল,
“হঠাৎ?”
“এতদিন ভাবতাম আমি তোমাকে যতটা ভালোবাসি তুমি আমাকে ততটা বাসোনা। এখন বুঝতে পারছি তুমিও আসলে আমাকে আমার মত করেই ভালোবাসো।”
যাদিদ হাসলো। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“রাগ যতটা প্রকাশ করতে পারি ভালোবাসা ততটা পারি না।”
“সামনে থাকলে পারো, দূরে থাকলে পারো না।”
“হতে পারে। তুমিই ভালো বলতে পারবে।”
তিরা বলল,
“একটা কথা বলি?”
“বলো?”
“শুধু কি একটা মিথ্যের জন্যই এত রাগ? নাকি অন্যকিছু?”
যাদিদ তিরার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ওর গালে চুমু খাচ্ছিলে সেই ছবিটা দেখে সম্ভাবত আমার মাথার তার একটা ছিঁড়ে গিয়েছিল।”
তিরা চোখ নামিয়ে নিল। যাদিদ বলল,
“আর কিছু চিঠি পড়ে আমি এই দুনিয়াতে ছিলাম না। আমার সাথে অন্তরঙ্গ হয়ে তোমার যে অনুভূতি, সেইম অনুভূতি অন্যদের বেলাতেও। আবার সেটা তুমি তাকে ঠিক সেভাবেই লিখেছিলে যেভাবে আমাকে লিখেছিলে। মানতেই পারছিলাম না।”
তিরা ভয়ে ভয়ে বলল,
“অন্তরঙ্গ বলছো কেন? এতকিছু হয়নি। জড়িয়ে ধরা আর চুমু খাওয়া পর্যন্তই। এসবের তো একই অনুভূতি হবে তাইনা? মানুষ দুজন হলেই কি অনুভূতিও দুইরকম হবে নাকি?”
যাদিদ খিটখিটে করে উঠলো,
“আমি কী করে বলব? আমি তো তুমি ছাড়া কাউকে ছুঁয়েও দেখিনি। এক্স গার্লফ্রেন্ডকে জড়িয়ে ধরা চুমু খাওয়া তো দূরে থাক কোনোদিন হাত ধরারও সুযোগ পাইনি।”
“সুযোগ পেলে তো তুমিও এসব করতে তাইনা?”
যাদিদ চোখ বড় বড় করে তাকালো। তিরা ভয় পেয়ে প্রসঙ্গ পালটাল,
“আমি তাহলে প্রাউড ফিল করতেই পারি, তোমার জীবনের সবকিছুতে আমিই প্রথম।”
যাদিদ বলল,
“প্রথম হতে পেরেছ বলে এত আনন্দিত হওয়ার কিছু নেই। শেষও যে তুমিই হবে তার কি গ্যারান্টি?”
তিরা হঠাৎ মুখ কালো করে ফেলল। যাদিদ সাথে সাথে হেসে তিরাকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর চোখে চোখ রেখে বলল,
“তুমিই প্রথম, তুমিই শেষ, তুমিই একমাত্র।”
“তুমিও কিন্তু কিছুক্ষেত্রে আমার প্রথম এবং শেষ।”
“কোনক্ষেত্রে?”
“প্রথম ভালোবাসা এবং শেষ ক্রাশ।”
যাদিদ হেসে বলল,
“তোমার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে বিয়ে করেছিলাম। তখনো জানতাম না কখনো এত ভালোবাসতে বাধ্য হব এই আমি।”
তিরার এবার চোখে পানি এসে গেল।
চলবে…