কনফিউশন পর্ব ৯
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
তিরা বেশিরভাগ দিন সকাল ও দুপুরের খাবার একসাথে খায়। আজও হয়েছে তাই। দুপুরে খাওয়ার পর আরশি টেবিল গোছাচ্ছিলো। তিরা বসে বসে মুরগীর হাড্ডি চিবুচ্ছে। আরশি সব গুছিয়ে টেবিল মুছতে মুছতে বললো,
“তিরা আমি বলেছিলাম না তোর কালা চণ্ডীদাস তোর জঘন্যতম চয়েজ?”
“হ্যাঁ। তুই তো সবসময় ওর দোষ ধরার জন্য বসে থাকিস।”
“লোকটা ভয়ঙ্কর সিগারেটখোর, অসভ্যও বটে তবে আজ তার সম্পর্কে একটা অন্য ব্যাপার জানলাম।”
তিরা অতি উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কী সেটা?”
“এই লোকটা তোর ক্রাশলিস্টের একমাত্র ব্রিলিয়ান্ট লোক!”
“সত্যি?”
তিরা উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়াতেই হাতের ধাক্কা লেগে প্লেটটা ছিটকে সরে গেলো। হাড্ডিগুলো আরশির সদ্য পরিস্কার করা টেবিলের এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিঁটিয়ে পড়লো। আরশি চোখ গরম করতেই তিরা বললো,
“আমি সব পরিস্কার করে দেব সোনা। তুই বলনা
কীভাবে বুঝলি চণ্ডীদাস ব্রিলিয়ান্ট? বলনা বলনা।”
আরশি তিরার প্লেটটা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে টেবিলটা আবার মুছতে মুছতে বললো,
“ওইযে বইটা পড়তে এনেছিলাম না?”
“হ্যাঁ।”
“ওটাতে কিছু বুকমার্ক ছিল৷ যেসব পৃষ্ঠায় বুকমার্ক ছিল সেসব চ্যাপ্টার সম্পর্কে তার মতামত ওই বুকমার্ক গুলোতে লিখে রেখেছিলো। আমি ওগুলো দেখে অবাক হয়ে গেছি। অনেক নলেজ আছে তার। আজকালকার ছেলেদের এত উন্নত ভাবনা! এটাও কী সম্ভব?”
একথা বলে আরশি রান্নাঘরে গিয়ে প্লেট ধোয়া শুরু করলো। তিরা প্লেটটা আবার টেবিলে রেখে আরশির পেছন পেছন রান্নাঘরে ঢুকলো। খুশিতে বাকবাকুম করতে করতে বললো,
“তার মানে তুই ফটোশ্যুটে যেতে রাজী?”
আরশি বিরক্ত হয়ে বললো,
“একথা কখন বললাম?”
“বলতে হবে কেন? তুই তো এতদিন কাব্যকে খারাপ বলতি, আজ ভাল বলছিস তার মানে যেতে আপত্তি নেই এটা আমি বুঝে নিয়েছি।”
“আমি আগে তাকে খারাপ বলিনি। বলেছি তাকে আমার পছন্দ না। আর আজও ভালো বলিনি। তার একটা গুণ চোখে পড়েছে সেটাই বলেছি। ভালো মন্দ বিচারের আমি কে?”
“তার মানে যাবি না?”
“না যাবো না। এই বিষয়ে আর কোনো কথা শুনতে চাই না। তোর প্লেটটা আবার কোথায় রাখলি? ওটা নিয়ে আয় ধুয়ে ফেলি।”
তিরা মুখ কালো করে প্লেট আনতে গেলো।
সন্ধ্যাবেলা তিরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাব্যর সাথে ফোনে কথা বলছিলো। আরশি যাতে আর কাব্যকে লোকটা বলতে না পারে তাই কাব্যর আসল বয়সটা জানা দরকার। তাই সে জিজ্ঞেস করলো,
“আচ্ছা কাব্য তোমার বয়স কতো বলো তো?”
“হঠাৎ বয়স জানতে হবে কেন তোমার?”
“আমার লাগবে।”
কাব্যর মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। এতো দিন এমন একটা সুযোগই তো সে খুঁজছিলো। বললো,
“কত আর? আমি কি অত বুড়ো নাকি? এবার ৩৬ হবে মাত্র।”
“কী বলো এতো বয়স তোমার?”
“এ আর এতো কোথায়? পুরুষ মানুষের এই বয়স একটা বয়স হলো? সময়মতো বিয়ে দিলে তোমার বয়সী মেয়ে থাকতো আমার। তাই বলে নাতি নাতনি তো আর থাকতো না।”
“কি বলছো এসব তুমি!”
“কেন কি বললাম?”
তিরা আহত কন্ঠে বললো,
“আমি তোমার মেয়ের বয়সী?”
“হ্যাঁ আমার এক্স গার্লফ্রেন্ডকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিলো। সেই এক্স গার্লফ্রেন্ডের মেয়ের বয়স এখন ১৯ বছর। সেই মেয়েটা তো আমারও হতে পারতো। কিন্তু তখন বাবা রাজী হলো না তাই আর বিয়ে করা হলো না। তোমার বয়স কত?”
“আমার ১৮।”
“আরে তুমি তো আমার মেয়ের থেকেও ছোটো।”
তিরা চমকে উঠে বললো,
“তোমার মেয়ে মানে!”
“মানে এক্স গার্লফ্রেন্ডের মেয়ে।”
“ওহ। আচ্ছা কাব্য সত্যি কথা বলো তো। আমি তোমার বন্ধু নই?”
“হ্যাঁ অবশ্যই। আমি তো আমার মেয়ের সাথে বন্ধুর মতোই মিশি।”
“তোমার মেয়ে?”
“এক্স গার্লফ্রেন্ডের মেয়ের কথা বলছি। তুমিও আমার মেয়ের মতো। তুমিও আমার বন্ধু এজন্যই তো তোমাকে আমি তুমি করে বলার পারমিশন দিয়েছি। এজন্যই তো তোমাকে আমি দুবছরের বাচ্চা বলে ডাকি।”
তিরার মাথা ঘুরছে। সে জিজ্ঞেস করলো,
“তাহলে তুমি মাত্র অনার্সে কেন পড়ো?”
“ওইযে গার্লফ্রেন্ডের বিয়ে হয়ে গেলো? এজন্য দেবদাস হয়েছিলাম বহুবছর। এজন্য পড়াশোনায় গ্যাপ পড়ে গিয়েছিলো। এখন সার্টিফিকেট নেই বলে ভালো বিয়ে হচ্ছে না। এজন্য বাবা মা জোর করে আবার পড়াশোনা শুরু করিয়েছে।”
“ওহ! আচ্ছা এখন তাহলে রাখি। আরু ডাকছে।”
“ঠিকাছে।”
ফোন রেখে কাব্য হেসে ফেললো। আর ওদিকে তিরা ভাবতে লাগলো, কাব্য এসব কী বললো? কাব্যর বয়স ৩৬? তাহলে আরশি ঠিকই ধরেছিল? সে একটা ছেলে নয়, একটা লোক? এবার তিরার খেয়াল হলো কাব্য কখনো তাকে নিজ থেকে মেসেজ দেয়নি, ফোন দেয়নি। সে যেমন আগ্রহ নিয়ে অনেক কথা জিজ্ঞেস করতো কাব্য কখনো তার ব্যাপারে সেসব জিজ্ঞেস করেনি। মেয়ের চোখে দেখতো বলেই এতোদিন ধরে এরকম ছিল তাদের সম্পর্ক! আর সে এতো গাধা এই ব্যাপারটুকু বুঝতে পারলো না! সত্যিই তো মেয়ের চোখে না দেখলে তো আর দুবছরের বাচ্চা বলতো না। ভাগ্যিস তিরা কখনো মুখ ফসকে কাব্যকে ক্রাশ খাওয়ার কথাটা বলে ফেলেনি! গুলিটা একদম কানের পাশ দিয়ে গেছে!
বারান্দা থেকে তিরা যখন ঘরে এলো আরশি তখন চুলে তেল লাগাচ্ছিলো। তিরার গোমড়া মুখ দেখে জিজ্ঞেস করলো,
“কী হয়েছে? হঠাৎ মন খারাপ হয়ে গেল কেন? কোনো খারাপ খবর? কার সাথে কথা বলছিলি?”
তিরা আরশির সামনে বসে ঠোঁট উলটে বললো,
“আরু তোর কি মনে হয় কাব্যর বয়স কত হবে?”
“দ্যাখ ছেলেদের বয়স ধরা মুশকিল। শুকনা পাতলা ছেলেদের বয়স ধরা আরো মুশকিল। কিন্তু একথা জিজ্ঞেস করছিস কেন কী হয়েছে?”
“আমি অনেক বড় একটা ভুল করে ফেলেছি রে। যদিও কেউ জানেনা তবুও নিজের কাছে নিজেরই লজ্জা লাগছে।”
“কী হয়েছে সেটা তো বলবি।”
“ভাগ্যিস আমি কাব্যকে ক্রাশ খাওয়ার কথাটা বলিনি।”
“বললে কী হতো?”
“কেলেঙ্কারি হয়ে যেতো।”
“কীসের কেলেঙ্কারি?”
“কাব্য আমাকে মেয়ের চোখে দেখে। ওইযে দুবছরের বাচ্চা বলে? এজন্যই বলে।”
আরশি অবাক হয়ে বললো,
“কী যা তা বলছিস? মাথা ঠিকাছে তোর?”
তিরা এবার কাব্যর সাথে ওর পুরো কনভার্সেশনটা আরশিকে বললো। সব শুনে আরশি স্থির হয়ে বসে রইলো। তিরা বললো,
“আমি এখন কী করবো?”
“কিছুই করতে হবে না। খুলনা গিয়ে ঘুরে আয়। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“সত্যি?”
“কোচিং এর কেমিস্ট্রি স্যারের কথা ভুলে গেছিস?”
“কোন কোচিং?”
“নাইনে পড়ার সময় আমরা যে স্যারের কাছে কোচিং এ কেমিস্ট্রি পড়তাম? স্যারকে দেখে ক্রাশ খেয়ে ফেললি। স্যারও ভাব জমালো। দুদিন রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেলো? তারপর জানলি সে বিবাহিত? তার বৌ এসে তোকে ঝাড়লো!”
“ওহ হ্যাঁ তুই সেই ফালতুটার কথা বলছিস? আমার খেয়াল ছিলো না।”
“তার বেলায়ও সব কথা জানার পর তুই লজ্জায় মরে যাচ্ছিলি। কিন্তু দুদিন পর তো ভুলে গেলি। এটাই স্বাভাবিক। এই লোকটাকেও ভুলে যাবি।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ।”
“আমি কালই খুলনা যাবো। দেখি অনলাইনে টিকিট আছে কিনা।”
“যাওয়ার আগে বইটা ওনাকে ফেরত দিয়ে যাস।”
“কেন তুই বরং ফেরত দিয়ে আরো বই নিয়ে আসিস। এখন তো ছুটিই।”
“কেন বাজারে কি বইয়ের অভাব?”
“তা না।”
“এটা কোথাও পাচ্ছিলাম না৷ ওনার কাছে পেয়ে এনেছি৷ তাই বলে সব বই আনতে হবে কেন?”
“আচ্ছা আমি দিয়ে দেব।”
তিরা অনলাইনে টিকিট খুঁজতে লাগলো।
আরশির মাথা ঝিমঝিম করছে। শরীরটা তিরতির করে কাঁপছে। সন্ধ্যে থেকে বাতি নিভিয়ে শুয়ে আছে সে। সে এতদিন ভেবেছে শুধু তিরা নয় কাব্যও তিরার প্রতি আগ্রহী। কাব্যর প্রথমদিনের চায়ের দাওয়াত থেকে শুরু করে বুয়া খোঁজার ছুঁতোয় দোতলায় আসা, বাজার তুলে দেয়া সবকিছুই তিরার সাথে দেখা করার জন্য করেছে বলে ভেবেছে। কিন্তু আজ সে যে নাটক করলো তা ভাবাচ্ছে আরশিকে। তিরা সহজ সরল মেয়ে, ওকে বোকা বানানো কাব্যর মতো ছেলের কাছে মামুলি ব্যাপার। কিন্তু আরশিকে বোকা বানানো এতো সহজ না। আরশি স্পষ্টই বুঝতে পেরেছে কাব্য সব বানিয়ে বলেছে। তিরা ইদানীং খুব বেশি এগ্রেসিভ হয়ে যাচ্ছিলো কাব্যর প্রতি। হয়তো সে কারণেই কাব্য আজ তাকে এসব আবোলতাবোল বুঝিয়ে দিলো। যাতে তিরা সরে যায়। তার মানে কাব্য তিরার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলো না। কিন্তু তাহলে এতদিন কাব্য কেন এসব করেছে? আরশির জন্য? কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব? তিরাকে রেখে কেউ তাকে কেন পছন্দ হবে? তিরা তার চেয়ে সুন্দরী, স্মার্ট, প্রাণবন্ত। তিরার সঙ্গ যেকোনো মানুষকে আনন্দ দেয়। অপরদিকে সে নিজেকে গুটিয়ে রাখা শামুকের মতো, অনুভূতি প্রকাশ করতে জানেনা, মানুষের সাথে মিশতে জানেনা। দেখতে খারাপ না হলেও তিরার মতো সুন্দরী তো নয়ই বরং কাউকে আকৃষ্ট করার মতো কিছু তার মধ্যে নেই। সেই চেষ্টাও সে কখনো করেনি। আজ পর্যন্ত জোর করেও কেউ তাকে সাজাতে পারেনি। গাঢ় কোনো রঙের জামাও তাকে কেউ পরাতে পারেনি কখনো। সে কখনো পার্লারে যায় না। সে চুল কাটে না, ব্রু প্লাগ করে না। এসবে তার লজ্জা লাগে৷ কলেজ, কোচিং সবখানে বন্ধুরা তাকে আম্মা, দাদী এসব নামে ডাকে। ঠিক বন্ধু নয়, আরশির নিজের কোনো বন্ধু নেই। তিরার বন্ধুরাই আরশির বন্ধু। আরশি যাদের সাথে প্রয়োজন ছাড়া কখনো কথা বলে না। তারাও বলে না। আরশির সঙ্গ তেমন কেউই পছন্দ করে না। কারণ সে বোরিং।
আরশিও নিজেকে উপন্যাসের নায়িকার জায়গায় ভাবতে পারেনি কখনো। বড়জোর নায়িকার বান্ধবী, বোন বা ননদের যে চরিত্র থাকে তার সাথে সে নিজেকে মেলাতে পারে। সাহিল, রশ্নি আর তিরা বাদে এই দুনিয়াতে আর কারো সাথেই কোনো সম্পৃক্ততা নেই আরশির। ১৮ বছর পেরিয়ে গেছে, আজ পর্যন্ত কোনো ছেলে তাকে পছন্দ করেনি। ভালোবাসার কথা বলেনি। রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে বখাটেরাও তার দিকে তাকায় না। অথচ তিরা যেখানেই যায় ভুরি ভুরি প্রোপোজাল পায়। সব ছেলেরা যেমন মেয়েকে সঙ্গী হিসেবে চায় তিরা ঠিক তেমন। সবাই তিরাকে পছন্দ করে। সেই তিরাকে গুটি হিসেবে ব্যবহার করে কাব্য তার সংস্পর্শে আসতে চেয়েছিলো এটা সে কেন যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। কিন্তু যুক্তি তো এটাই বলছে। সবকিছু কেমন অদ্ভুত লাগছে তার।
চলবে…