#আলতা_রাঙা_পা পর্ব ১
#রোকসানা_রাহমান
” দুলাভাই আবার মে’রে’ছে? ”
আপুর গলার চারপাশে আবছা আঙুলের ছাপ থেকে দৃষ্টি সরালাম আমি। শাড়ি পরা আছে বিধায় উদরের ডানপাশের লালচে দা’গটাও চোখে পড়ল আমার! সেখানে দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো আবারও।
” পালিয়ে এসেছ, তাই না? ”
আপুর বিক্ষত শরীরটা নড়ে উঠল ভূমিকম্পের মতো। ব্যস্ত হয়ে পড়ল আ’ঘাতগুলো ঢাকতে। আঁচল টেনে মাথা মুড়িয়ে দ্রুত বলল,
” মা-বাবা কি ঘুমিয়ে পড়েছে? ”
আমার দৃষ্টি কেঁপে উঠলেও আপুর আবৃত শরীর থেকে সরল না। চোখের কোল এমনভাবে ভরে উঠল যেন প্রতিটি আঘাত আমাকে করা হয়েছে। রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে সেই আঘাতের অসহণীয় ব্যথা!
আপু আমার দিক থেকে উত্তর না পেয়ে বিরক্ত হলো না। রাগও করল না। পুনরায় প্রশ্ন করার উৎসাহও পেল না বোধ হয়। বসার রুমের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,
” তিনটা বাজে! বাবা তো এগারোটা বাজেই শুয়ে পড়েন। মাও ঘুমিয়ে পড়েছে অনেক্ষণ হবে। ”
ঘড়ির থেকে চোখ সরিয়ে আবারও বলল,
” তুই এখনও জেগে আছিস কেন? পরীক্ষা চলছে নাকি? ”
আমি চুপ থাকতে পারলাম না। আপুর ফোলা চোখের দিকে চেয়ে মৃদু স্বরে বললাম,
” আমিও ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কলিংবেলের শব্দে জেগেছি। ”
আপু বিস্মিত হলো। অনুশাসনের আদলে বলল,
” তুই খুলতে গেলি কেন? যদি আমার জায়গায় চোর-ডাকাত হতো? এখনও সাবধান হতে শিখলি না? এত বোকা হলে তো শ্বশুরবাড়িতে খেটে মরবি। ”
আমি বেফাঁসে বলে ফেললাম,
” বড় আপুর মতো? ”
আপু হকচকিয়ে গেল। অপ্রস্তুত হয়ে চোখ নামিয়ে ফেলল। সোফার উপর পিঠ লাগিয়ে বলল,
” মা-বাবাকে ডেকে ঘুম ভাঙানোর দরকার নেই। আমি সকালে কথা বলে নেব। তুই গিয়ে শুয়ে পড়। ”
” তুমি শুবে না? ”
আপু চোখ বন্ধ করে বলল,
” হ্যাঁ, বিছানায় শুতে ইচ্ছে করছে না। এখানেই ভালো লাগছে। ”
আমি স্পষ্ট দেখলাম আপুর শরীর কাঁপছে। কথা বলছে জিরিয়ে জিরিয়ে। মেঝে থেকে পা তুলছে খুব সাবধানে। আমি ঠোঁট চেপে কান্নার দমক আটকে বললাম,
” কিছু খাবে, আপু? ”
আপু কিছু বলতে চেয়েও পারল না। শক্তির কাছে গলার স্বর হারিয়ে গেছে। মাথা হালকা নেড়ে ‘ না ‘ বুঝাতে আমার চোখ ছেড়ে পানি বেরিয়ে এলো। পা-দুটো ছুটিয়ে আনলাম নিজের রুমে। একটা বালিশ আর কাঁথা নিয়ে ছুটে গেলাম বসার রুমে। আপুর মাথার নিচে বালিশ রেখে কাঁথাটা শরীরে মেলতে মেলতে বললাম,
” আপু আর যেও না। আমরা রাত জেগে গানের কলি খেলব। পাল্লা দিয়ে ভোরের ফুল কুড়াব। মা-বাবাকে বোকা বানিয়ে সিনেমা দেখব। ”
আপু গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কাঁথার ওম টেনে নিতে আমি সরে আসলাম।
____________
সকালে ঘুম ভাঙল চেঁচামেচিতে। আড়মোড়া ভাঙতে গিয়ে একটা পুরুষ কণ্ঠ পেলাম। চট করে বিছানা ছেড়ে বাইরে ছুটলাম। যা ভেবেছিলাম তাই। দুলাভাই এসেছে। বাবার সাথে কথা বলছে উঁচু’স্বরে। কথার ফাঁকে ফাঁকে আপুর দিকে তাকাচ্ছে আ’গু’ন চোখে। আপু ভ’য়ে জড়োসড়ো হয়ে মায়ের একহাত চেপে ধরে আছে। নিচু স্বরে অনুনয়-বিনয় করছে, ‘ আমি যাব না, মা। উনাকে চলে যেতে বলো। ‘ মায়ের মধ্যে অনুরোধ রাখার কোনো অভিব্যক্তি নেই। মেয়েকে রেখে মেয়ের জামাইয়ের আদর-যত্ন করার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠল। বাবাও মেয়ের জামাইকে শান্ত করতে আপুকে ধ’ম’কে দিচ্ছে। বাবার ধ’ম’কের উপর খুব একটা ভরসা পাচ্ছে না দুলাভাই, তাই সুযোগ পেলেই গরম চোখে ঝ’ল’সে দিতে চাচ্ছে আপুর নাছোড়বান্দা মনোভাবকে।
আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। হতাশমনে নিজের রুমে ফিরে গেলাম। এরপরের ঘটনা কী হবে সে তো আমার মুখস্থ! বাবা-মায়ের জোরাজুরিতে নয়তো স্বামীর রাগের ভয়ে ঠিকই ফিরে যাবে। তিন বছর ধরে এভাবেই চলে আসছে। দুলাভাই মে’রে ক্লান্ত হোন না। আপু রাতের আঁধারে পালিয়ে আসতে অসফল হয় না। বাবা-মায়েরও জামাই আদর ফুরোয় না।
আমি হাত-মুখ ধুতে যাওয়ার আগে বড় আপুকে কল দিলাম। জানি এ সময়টায় আপু কল ধরতে পারবে না তবুও বার বার দিলাম। আমার জেদের কাছে পরাজিত হয়ে বড় আপু বার্তা পাঠাল, ‘ তায়্যুসোনা, আমি তো নাস্তা সাজাচ্ছি। তোর দুলাভাই অফিস গেলে কলব্যাক করছি। পাগলামি করে না। অনেক আদর। ‘
বড় আপুর আদরে আমি একটুও খুশি হতে পারলাম না। ফোন ঢি’ল মারলাম দূরে। বিছানার চাদর খামচে ধরে ঝিম ধরে থাকলাম কতক্ষণ। অনেকটা সময় এভাবেই থেকে ফোন তুলে নিলাম আবার। বার্তার বিপরীতে লিখলাম, ‘ আমি কখনও বিয়ে করব না। কখনও না। ‘
________________
‘ কখনও বিয়ে করব না ‘ এই মনোবলে মন, মস্তিষ্ক ও শরীরকে যখন গড়ে তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম তখনই বাঁধা হয়ে দাঁড়াল এক সন্ধ্যা। মা একটা ছবি ও সি.ভি. টেবিলের উপর রেখে বলল,
” তোর বাবা বলেছে, কাল বাসা থেকে বের না হতে। ”
আমি অবাক হলাম। সন্দেহি গলায় জিজ্ঞেস করলাম,
” কেন? ”
মা সরাসরি উত্তর দিল না। টেবিলে রাখা ছবি ও কাগজটার দিকে চোখ রেখে বলল,
” এগুলো দেখলেই বুঝতে পারবি। ”
আমি ভ্রু কুঁচকে মায়ের চলে যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকলাম অল্পক্ষণ। তারপরেই হামলে পড়লাম রেখে যাওয়া কাগজ ও ছবিটার উপর। ছবিতে একটা ছেলের মুখ স্পষ্ট হতেই আমার সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল। কয়েক বছরের লালিত সংকল্প ভেঙে যাওয়ার ভয়ে আ’র্ত’চিৎ’কার বেরিয়ে এলো গলা ছেড়ে। ঝড়ের গতিতে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। রান্নাঘরে মাকে পেয়েই বললাম,
” বাবাকে বলো, আমি বিয়ে করব না। কোনো ছেলে যেন আমাকে দেখতে না আসে। ”
মা একটুও ঘাবড়াল না। উদ্বিগ্ন হলো না। স্বাভাবিক গলায় বলল,
” ঝামেলা করিস না। ”
আমি মাকে মানানোর জন্য অস্থির হলে সে বলল,
” চিংড়ি দিয়ে করলা ভাজি খাবি বলছিলি না? রেঁধেছি। পড়া শেষ করে তাড়াতাড়ি আয়। ”
মায়ের কথায় আমি প্রলুব্ধ হলাম না। নিজের মতামতে অটুট থাকতে আবারও বললাম,
” আমি বিয়ে করব না। কখনও না। ”
মা একটু চুপ থেকে বলল,
” তোর বাবার শরীরটা বেশি ভালো না। থার্মোমিটারটা কি তোর রুমে? দিয়ে যাস তো। একটু তাপমাত্রাটা মেপে দেখব। ”
আমি চোখ-মুখ শক্ত করে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। থার্মোমিটারের খোঁজ নিলাম না। আমি ধরে নিলাম এসব বলে তারা আমাকে দুর্বল করতে চাচ্ছে। আমার মনোবল ভেঙে দিয়ে এ বাড়ি থেকে তাড়াতে চাচ্ছে। আমার ভীষণ রা’গ হলো। অভিমান হলো। চোখে পানি এলো। খুব আপন দুটো মানুষকে হঠাৎ করেই পর বোধ হলো। ঝাপসা চোখে ছোট আপু ও বড় আপুর মুখ ভেসে উঠতেই আমি মনে মনে উচ্চারণ করলাম, ‘ আমি কখনও বিয়ে করব না৷ কখনও না। ‘
রাতে চিংড়ি-করলা ভাজি দিয়ে ভাত খাওয়া হলো না আমার। রুমের সিটকানি শক্ত করে টেনে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। চিন্তা, আশঙ্কা, দুর্ভাবনায় ঘুম ঠিকমতো হলো না। অস্থির চিত্তে এপাশ-ওপাশ করতে করতে রাত পার হয়ে গেল।
নাস্তার টেবিলে আমাকে না পেয়ে মা ডাকতে আসে। আমি উত্তর দিই না। মা জোর তালে দরজায় ঠকঠক শব্দ করলে আমি কান চেপে ধরি। বালিশ দিয়ে মুখ ঢেকে চুপচাপ শুয়ে থাকলাম। মায়ের সাথে বাবার গলা আসতেই আমার কলিজা একটুখানি হয়ে গেল। পুরোপুরি দুর্বল হয়ে যাওয়ার পূর্বেই বুদ্ধি এঁটে ফেললাম। সেই বুদ্ধি সফলকাম করতে কল দিলাম ছোটবেলার বান্ধুবী তিন্নিকে। চুপচাপ আমার মুখে সবটা শুনলেও পালানোর কথা আসতেই সে আঁ’ত’কে উঠল। অবিশ্বাস্য গলায় বলল,
” পালাবি! তুই সত্যি পালাবি? আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না। ”
আমি তাকে বিশ্বাস করাতে বললাম,
” সত্যি নাকি মিথ্যা সে তো একটু পরই টের পাবি। তুই শুধু বাবা-মাকে ম্যানেজ করে আমার রুমে আয়। জলদি। ”
তিন্নি ‘ আসছি ‘ বলে কল কেটে দিল। ওর বাসা আর আমার বাসার দূরত্ব খুব একটা বেশি না। বিশ-ত্রিশ মিনিট লাগবে। এই সময়ে আমি আমার প্রয়োজনীয় জিনিস গুছিয়ে নিতে শুরু করলাম। এদিকে মা-বাবা ডাকাডাকি পর্যায়ক্রমে চলছেই। বেশ কিছুক্ষণ পর তিন্নির গলা পেয়ে আমি সাহস পেলাম। সচেতন হয়ে বুঝার চেষ্টা করলাম মা-বাবা আশেপাশে আছে নাকি। মনে হলো নেই, তাই দরজা খুলে দিলাম। তিন্নির হাত ধরে টেনে ভেতরে আনব তখনই বলল,
” এই যে, আমার বান্ধবী তায়্যিবা। ছবিতে তো দেখেছই, এবার সরাসরি দেখ। ”
আমি বিস্ময় চোখে দেখলাম তিন্নির পেছনে সেই ছবির মানুষটি দাঁড়ানো। আমার পাথর হওয়া শরীরটাকে একদিকে সরিয়ে তিন্নি ভেতরে ঢুকে পড়ল। সেই ছবির মানুষটাকেও ভেতরে ঢুকাল। বিছানায় বসিয়ে দিয়ে আমার কাছে এসে বলল,
” তোরা কথা বল। আমি চা-নাস্তার ব্যবস্থা করছি। ”
তিন্নি চলে যেতেই যেন আমার প্রাণ ফিরে এলো। ধীরে ধীরে অনুভূতিরা জাগ্রত হলো। মানব চর্মের আড়ালে থাকা যন্ত্রাংশগুলো কাজ করতে শুরু করল। আমি ছবির মানুষটির দিকে না তাকিয়েই রুম থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলে তিনি বললেন,
” আপনার পা-দুটো তো খুব সুন্দর। আলতা পরলে বেশ মানাবে। ”
চলবে