#আলতা_রাঙা_পা পর্ব ৯

0
451

#আলতা_রাঙা_পা পর্ব ৯
#রোকসানা_রাহমান

” আমি এখন সাজব। আপনি বের হোন। আপনি থাকলে আমার অসুবিধা হবে। ”

আপু বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। অমিতের দিকে চাইতে আমি অন্যদিকে মুখ করে আঁটসাঁট হয়ে দাঁড়ালাম। পুরো রুম থমথমে। কিছু সময় নীরব, নিশ্চুপ, নিঃশব্দে কাটল। তারপরেই আকস্মাৎ হাসির শব্দে কেঁপে উঠলাম আমি। সুরের ফোয়ারায় রুপান্তর হলো থমথমে পরিবেশ। আমি যন্ত্রের মতো ঘুরে দাঁড়ালাম ভাই-বোনের দিকে। আকাশ মাপের বিস্ময় নিয়ে তাদের শরীর দোলানো হাসি দেখলাম। হাসির শব্দ একটু কমে আসতে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন অমিতের আপু। কানের পাশে মুখ নামিয়ে আরও কিছুক্ষণ হাসলেন নিচু শব্দে। আমি বিপরীতে পাথরের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। আমাকে ছেড়ে এক পলক তাকালেন আমার মুখটায়। নিজের কান থেকে দুল খুলে আমার কানে পরিয়ে দিয়ে বললেন,
” সুখী হও। ”

আমি স্তব্ধ বদনে আপুকে চলে যেতে দেখছিলাম। তখনই পাশ থেকে অমিত বললেন,
” ভালো অভিনয় ছিল। ”

আমি চকিতে ঘাড় বাঁকালাম। তিনি গম্ভীর গলায় বললেন,
” অভিনয় ছিল বলেই আমি এখনও চুপ আছি। নাহলে বিনা দোষে কাউকে অপমান করা আমি মেনে নিতাম না। সে যেই হোক। নিজেকে আলাদা দাবি করছি মানে এই নয়, আমার রাগ নেই, বিবেক নেই, ভালো-মন্দ আলাদা করার জ্ঞান নেই। কোনো ভালো মনের মানুষ প্রথম পরিচয়ে কারও সাথে দুর্ব্যবহার করতে পারে না। তুমিও পার না। কারণ, আমার বউও ভালো মনের অধিকারি। তায়্যিবাহ, আমাকে মিথ্যা প্রমাণ করতে গিয়ে নিজেকে খারাপ প্রমাণ করো না। পরে নিজেই কষ্ট পাবে। ”

আমার মাথা আপনাআপনি নিচু হয়ে গেল। অমিত একটুখানি চুপ থেকে দূরে সরে দাঁড়ালেন। দূর থেকে বললেন,
” আপুকে দুল জোড়া আমি গিফট করেছিলাম। আমার উপার্জন থেকে আপুকে দেওয়া প্রথম উপহার! খুশি হয়ে সঙ্গে সঙ্গে কানে পরেছিল। তারপর আর কখনও খুলতে দেখিনি। বিয়ের দিনও না। ”

অমিত থেমে গেলে আমি মাথা উঁচু করলাম। দেখলাম এদিকে এগিয়ে আসছেন। আমার থেকে সামান্য দূরত্বে দাঁড়িয়ে কানের দিকে তাকালেন। বললেন,
” তুমি খুব সৌভাগ্যবতী! ”

আমি তার সামনে থেকে চলে এলাম। দরজা পেরুতেই টের পেলাম অশ্রুকণার উপস্থিতির। বুক ভারী হয়ে আসল অনুশোচনায়। ব্যাকুল চিত্তে খুঁজতে লাগলাম আপুকে। এ রুম থেকে সে রুমে ছুটে বেড়ালাম। যাকে সামনে পেলাম তার কাছেই আপুর খোঁজ চাইলাম। অবশেষে শাশুড়িমার রুমে পাওয়া গেল তাকে। খাটের উপর বসে আছেন পা তুলে। কোলের উপর মাঝারি আকারের লাগেজ। চেইন খুলে কীসব বের করছেন। আমি ধীরে ধীরে কাছে এগিয়ে গেলাম। কিছু বলতে হলো না আমাকে। তিনি লাগেজে চোখ রেখেই বললেন,
” বসো। ”

আমি বসলাম। কান থেকে দুল জোড়া খুলে বিছানায় রাখতে তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
” পছন্দ হয়নি? ”

আমি উত্তর দেওয়ার সুযোগ পেলাম না তার আগেই বললেন,
” নাকি পুরোনো বলে ফিরিয়ে দিলে? ”

আমি করুণ চাহনি ফেললে তিনি ঠোঁট টেনে হাসলেন। বললেন,
” অন্যদের মতো দামী উপহার কেনার সামর্থ্য আমারও আছে। ইরফান এ ব্যাপারে কোনো কার্পন্য দেখাবে না। কিন্তু ভালোবেসে নিজের সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটি কাউকে উপহার দেওয়ার সামর্থ্য সবার থাকে না, একমাত্র আমারই আছে। আর তুমি সে উপহার ফিরিয়ে দিতে আসছ? ”

আমি ভীত চোখে তাকালে তিনি কান বাড়ালেন আমার দিকে। বললেন,
” ঠিক আছে, ফিরিয়ে যখন দিবেই তাহলে আমার কানে পরিয়ে দেও। এ জিনিস তো আমি আর স্পর্শই করব না। ”

আমি কানের দুল তুলে নিলাম। তার কানে পরিয়ে দেওয়ার বদলে নিজের কানে পরে নিলাম দ্রুত। তিনি ঠোঁট টিপে হেসে বললেন,
” তুমি আসলেই বুদ্ধিমতী। ”

আমি জোরপূর্বক হাসলাম। আপু দুটো পাঞ্জাবি বের করে বললেন,
” বাবা আর ভাইয়ের জন্য এনেছি। অমিতকে কোনটা দিই বলো তো। ”

আমি পাঞ্জাবি দুটির দিকে তাকিয়ে থাকলাম একমনে। বেশ কিছুক্ষণ খুঁটিয়ে দেখে বললাম,
” দুটো তো একই রঙের, একই ডিজাইনের। ”

আমাকে বিভ্রান্ত করতে পেরে ভারি খুশি হলেন আপু। শব্দ করে হেসে বললেন,
” একই রকম কিনলে তো একই রকম হবে। ”
” তাহলে পছন্দ করতে বললেন কেন? ”
” যখন কিনেছিলাম তখন তো জানতাম না পছন্দ করে দেওয়ার মতো এমন একজন সঙ্গী পাব! তাই একই রকম কিনে ফেলেছি যাতে দোটানায় না পড়ি। এদিকে তোমাকে পেয়ে লোভটাও সামলাতে পারলাম না। তাই নিজেকে খুশি করতে জিজ্ঞেস করলাম। ”

আমি মুগ্ধ হলাম। ঘোর লাগা দৃষ্টিতে আবিষ্কার করলাম একজন হাসিখুশি, প্রাণবন্ত নারীকে। অমিত হয়তো ঠিকই বলেছে। আমি আসলেই সোভাগ্যশালী। নাহলে বহুবছর পর এমন চঞ্চল চিত্তের নারীর দেখা পাই?

” অমিতকে রাগানো এত সহজ না। অকারণে চেঁচানো একদম পছন্দ করে না। তর্কবিতর্কে জড়ানো উচ্ছৃঙ্খল মানুষজন থেকে সবসময় দূরে থাকে। তুমি যদি একান্তই তার রাগ দেখতে চাও তাহলে দাগ লাগাতে পার। ”
” দাগ? ”
” হুম। ও কোনোকিছুতে দাগ পছন্দ করে না। এই যেমন ধরো জামাকাপড়ে খাবার কিংবা অন্য কিছুর দাগ। ”

আপুর কথা ঠিকমতো বুঝলাম না। তবুও চুপ থাকলাম। ভাবখানা এমন যে সব বুঝে গেছি।

আপু লাগেজ থেকে লাল রঙের একটি সুন্দর শাড়ি আর আলতা বের করে আমার হাতে দিয়ে বললেন,
” যেদিন ভাইয়ের হাসি দেখতে ইচ্ছে হবে সেদিন এই শাড়িটা পরে ভাইকে বলো, আলতা পরিয়ে দিতে। কেমন? ”

আমি মাথা একপাশে কাত করে উঠে দাঁড়ালাম। আপুর কাছ থেকে চলে আসতে গিয়েও থেমে গেলাম। এক মুহূর্ত চুপ থেকে বললাম,
” আপনাকে একটু জড়িয়ে ধরি? ”

আপু একটুও অবাক হলেন না। কোল থেকে লাগেজ সরিয়ে ফেললেন চট করে। হাত দুপাশে ছড়িয়ে বললেন,
” এজন্য অনুমতি লাগে? ”

আমি দৌড়ে আপুকে জড়িয়ে ধরলাম। কেঁদে ফেললাম অকারণেই। কান্না বিজড়িত গলায় বললাম,
” আমাকে ক্ষমা করে দেও, আপু। আমি ইচ্ছে করে কষ্ট দিতে চাইনি। ”

আপু আমার পিঠে আদুরে হাত বুলালেন। মুখে কিছু বললেন না। তেমন সময় কেউ একজন গলা খাঁকারি দিল। আপুকে ছেড়ে সোজা হতে দেখলাম অমিত, অমিতের বাবা-মা দাঁড়িয়ে আছে। সকলের চোখে-মুখে হালকা হাসি। আমি লজ্জা পেলেও চোখ পাকিয়ে তাকালাম অমিতের দিকে। এই চাহনির অর্থ ধরে ফেলে বললেন,
” এটা মা-বাবার রুম। আমি তাদের কাছে এসেছি। ”

তার সরাসরি জবাবদিহিতায় আমার লজ্জা বেড়ে হলো দ্বিগুন। উঠে চলে যাব নাকি বসে থাকব বুঝতে পারছিলাম না। তখনই শ্বশুরআব্বা বললেন,
” তোমার বাড়ি থেকে কল এসেছিল। বেয়াইসাব বললেন তুমি নাকি কল ধরছ না? উনারা খুব চিন্তায় আছে। যাও, কল করে কথা বলে আসো। ”

আমি সুযোগ পেয়েই পালিয়ে এলাম। রুমে ফিরে বাবা-মাকে কল দিতে ইচ্ছে হলো না। কেন জানি তাদের জন্য মন টানছে না। তাই কল দিলাম বড় আপুকে। সে না ধরলে ছোট আপুকে দিলাম। আপু ধরল। তার কণ্ঠস্বর শুনতেই আমি মাত্র পাওয়া ভালোবাসাগুলো ভুলে গেলাম। তাকে হড়বড়িয়ে বলতে থাকলাম,
” একটা মানুষ এত ভালো হয় কী করে? অসম্ভব ব্যাপার! আমার মনে হয় অমিত ছেলেটা পুরোটাই মিথ্যায় ঢাকা। তার পরিবারও। নাহলে প্রত্যেকেই কেন আমাকে ভালোবাসবে? এমনটা কখনও হয় আপু? এই ছেলে গোপনে কোনো পরিকল্পনা করছে। পুরোদমে চেষ্টা করছে আমার মনে বিশ্বাস স্থাপন করতে। একবার বিশ্বাসে পরিণত হলেই আসল রূপ বেরিয়ে আসবে। কিন্তু আমি তো সে সুযোগ দেব না। তার আগেই তার মুখোশ খুলে ফেলব। শুধু একটা ভালো সুযোগ লাগবে। ”

আপু আমার সবটা শুনে ‘ আচ্ছা ‘ বলে ফোন কেটে দিল। তার এই জবাবে আমি সন্তুষ্ট হতে পারলাম না তাই বড় আপুকে অমিতের ব্যাপারে আমার যে ধারণা হয়েছে সবটা লিখে বার্তা পাঠালাম।

_____________
বিকেলবেলায় আমার বাবা-মা এসেছেন আমাকে নিতে। আমি সাফ জানিয়ে দিলাম ঐ বাড়িতে আমি যাব না। তারা আমার কথা মানলেন না। জোরাজুরি শুরু করলে সকলকে ফেলে রুমে চলে আসলাম। নিজের সিদ্ধান্তে অটল থেকে বিছানায় পা উঁচিয়ে বসতে অমিতের উদয় হলো। বললেন,
” আপু বলল, তুমি নাকি আমার প্রেমে পড়েছ? ”

আমি রাগ চোখে তাকালাম। তিনি পাত্তা না দিয়ে কথাটা শেষ করলেন,
” সেজন্য নাকি মা-বাবার সাথে যেতে চাচ্ছ না? ”

আমি পা ফেললাম মেঝেতে। মেরুদণ্ড সোজা করে কঠিন গলায় বললাম,
” প্রেমে ফেলা এত সহজ নাকি? ”
” তাহলে না যাওয়ার কারণ কী? ”

আমি মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। দুর্বল গলায় বললাম,
” এমনি। ”

সে জোর দিয়ে বলল,
” আপু ঠিকই বলেছে। তুমি আমার প্রেমেই পড়েছ। মুখে বলতে লজ্জা পাচ্ছ তো তাই ব্যবহারে বুঝাচ্ছ। ”

আমি আগুন চোখে তাকালে তিনি দরজার দিকে পা বাড়ালেন। বের হতে হতে বললেন,
” তুমি চিন্তা করো না। বাবা-মাকে আমি ম্যানেজ করে নিচ্ছি। ধরে নেও তোমার প্রেমে পড়ার উপলক্ষে ছোট্ট উপহার। ”

আমি যে অমিতের প্রেমে পড়িনি এই সত্যটা প্রমাণ করতে বাধ্য হলাম বাবা-মায়ের সাথে যেতে। বাড়িতে পৌঁছাতে বড় আপুর কল পেলাম। আমি বার্তায় পাঠানো কথাগুলো আরেকদফা মুখে আওড়ালাম। তাকে ভুল প্রমাণ করতে যে বাবা-মায়ের সাথে আসতে রাজি হয়েছি এটাও বাদ রাখলাম না। সবটা শোনার পর আপু বলল,
” অমিত যে সবার থেকে আলাদা তা আরও একবার প্রমাণ করল। ”
” কিভাবে? ”
” কথার প্যাচে ফেলে তোকে নিজ বাড়িতে আসতে বাধ্য করে। ”

আমি পুরো ব্যাপারটা বুঝে নেওয়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়তে বড় আপু বলল,
” অমিত তোকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে যে তুই টেরও পাচ্ছিস না। তায়্যু, ছেলেটাকে আর জ্বালাস না। ও আসলেই খুব ভালো। তোর চারপাশটা ভুলে ওর প্রতি একটু মনোযোগী হ। দেখবি, বার বার মুগ্ধ হবি আর নিজের সৌভাগ্যের জন্য কৃতজ্ঞতায় ভাসবি। ”

চলবে

[ একটু ভালো-মন্দ মন্তব্য করুন, অলস আপু-ভাইয়ারা। নাহলে বুঝব কিভাবে আপনাদের কেমন লাগছে। 😒]

টাইপোগ্রাফিঃ ফারহানা তাবাসসুম আপু। ❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here