#আলতা_রাঙা_পা পর্ব ১১

0
438

#আলতা_রাঙা_পা পর্ব ১১
#রোকসানা_রাহমান

নাস্তার টেবিলে অমিতের আপু ফিসফিস করে বললেন,
” খাওয়া শেষ করে আমার রুমে এসো তো। ”

আমি খানিকটা ঝিলকে উঠে তটস্থ হলাম। মাথা একপাশে নেড়ে নিভু স্বরে বললাম,
” আচ্ছা। ”

খাওয়া শেষ করে টেবিল ছাড়লাম না। হাতে হাতে শাশুড়িমাকে গুছাতে সাহায্য করলাম। তিনি মানা করলেও শুনলাম না। এতে যেন খুশিই হলেন। মৃদু হেসে আমাকে বুঝিয়ে দিলেন কোনটা কোন জায়গায় রাখতে হবে। গুছানো প্রায় হয়ে এলে আপুর রুমের দিকে অগ্রসর হলাম। তিনি ফোনে কথা বলছিলেন। কথা বলার এক ফাঁকে দরজার দিকে তাকালেন। আমাকে দেখেই ইশারায় ভেতরে যেতে বললেন। আমি বিছানার এক কোণা দখল করে বসলাম। তিনি আরও কিছুক্ষণ ফোনে কথা বলায় ব্যস্ত থাকলেন। সে সুযোগে আমি তার রুমটা পর্যবেক্ষণ করছি। অকস্মাৎ বললেন,
” তুমি যে এত ভীতু দেখে বুঝা যায় না। ”

আমি ছিটকে উঠে তার দিকে দৃষ্টি ফেরালাম। সামান্য ঘাবড়ে জিজ্ঞেস করলাম,
” কে বলল? ”

তিনি বসলেন আমার পাশে। ফোনটা বিছানায় রেখে বললেন,
” কেউ বলেনি। আমি নিজে দেখেছি। ঘুমের মধ্যে কেমন কাঁপছিলে! ”

আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম,
” ঘুমের মধ্যে কাঁপছিলাম? ”
” হ্যাঁ। অমিতের হাতটা এমনভাবে খামচে ধরেছিলে যে নখের দাগ পড়ে গেছে। দেখনি? ”

আমি বেশ ঘাবড়ে গেলাম। মুখে কিছু না বলে মাথা দু’পাশে নাড়লাম। তিনি মুখ এগিয়ে আনলেন আমার দিকে। আমার একহাত চেপে ধরে বললেন,
” এই যে, এভাবে ধরেছিলে। চোখ-মুখ খিঁচে পুরো শরীরটা জমিয়ে নিচ্ছিলে যেন কোনো গভীর খাদ থেকে উঠার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছিলে। ”

আমি সবিস্ময়ে চেয়ে থাকলে তিনি কৌতূহলী হয়ে পড়লেন। জিজ্ঞেস করলেন,
” রোজই নাকি এমন করো? ”
” কে বলল? ”
” কে আবার? অমিত। ইচ্ছে করে বলেনি অবশ্য। কাল রাতে আমার চাপে পড়ে বলেছে। কতটা অসহায় দেখাচ্ছিল ও কে জানো? যেন তোমার এই অবস্থার জন্য ও-ই দায়ী। ”

আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। তিনি একটু চুপ করতে প্রশ্ন করলাম,
” রাতে আমার রুমে গিয়েছিলেন? ”

তিনি সরলমনেই উত্তর দিলেন,
” হ্যাঁ, না গিয়ে উপায় ছিল? ”
” কেন? খারাপ কিছু হয়েছিল নাকি? ”
” খারাপ না আবার ভালোও না। ”
” বুঝিনি। ”

আপু একটু সময় নিয়ে বললেন,
” তোমাদের তো কাল আসার কথা ছিল না, তবুও হুট করে চলে এলে। তাও আবার মাঝরাতে। আমরা তখন গভীর ঘুমে। সেসময় তোমার বর আমার ফোনে কল দিয়ে বলল, ‘ আপু, দরজা খোল। আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। ‘ আমি ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দেখি অমিত একা দাঁড়িয়ে আছে। তোমার কথা জিজ্ঞেস করতে জানাল, তুমি নাকি ঘুমিয়ে পড়েছ। আমি ডাকতে বললাম, মানা করে দিল। ”

কাল রাতে কী হয়েছিল আমার মনে নেই। আপুর কাছ থেকে শোনার সৌভাগ্য হতে আমি উত্তেজিত হয়ে পড়ি। মাঝেই জিজ্ঞেস করে বসলাম,
” তারপর কী হলো? ”
” তারপর আর কী, অমিত কোলে করে তোমাকে রুমে নিয়ে গেল। ”
” আপনার সামনে? ”

আপু ভ্রূ কুঁচকে ফেললেন। আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বললেন,
” তোমাদের দরজা বাইরে থেকে লাগানো ছিল। ও যদি খুলতে না পারে? তাই পেছন পেছন আমিও গেলাম। ভেতরে ঢুকে বালিশ ঠিক করে দেওয়ার পর তোমাকে শুয়িয়ে দেয়। তারপর আমি চলে আসছিলাম তখনই ব্যাপারটা চোখে পড়ে। ”
” কোন ব্যাপার? ”
” তুমি যে ঘুমের মধ্যে ভয় পাও সেটা। ”

আমার উত্তেজনা কমে আসল। আপু অল্পক্ষণ চুপ থেকে বললেন,
” আমার ভাইকে কেমন লাগে? ”

আপুর এমন প্রশ্নে আমি চমকে তাকালাম। দৃষ্টি স্থির হতে তিনি বললেন,
” পুরুষদের সম্পর্কে তোমার যে ধারণা তা এক মুহূর্তের জন্য ভুলে যাও, তোমার সেই কিশোরী বয়সটাকে কল্পনা করো। সেই নবজাত, কোমল মনটা কী বলে? অমিত ছেলেটা কেমন? প্রেমে পড়ার মতো কি? ”

আমি উত্তর দিতে গিয়েও চুপ হয়ে গেলাম। দৃষ্টি ছুটে বেরিয়ে গেল আপুর রুমের দরজার ওপারে। এখানে বসেও বসার রুম দেখা যাচ্ছে অনায়াসে। দূর থেকেই অমিতের মুখটার দর্শন পেলাম। তার মায়ের সাথে কথা বলছেন দুষ্টুমি ভঙ্গিতে। শাশুড়িমাও হালকা হাসছেন আর কান টেনে দিচ্ছেন বার বার। মা-ছেলের এমন মধুর মুহূর্তটুকু আমার মনকে পুলকিত করল। অজান্তেই প্রার্থনা করে বসলাম, এমন মুহূর্ত বার বার চোখে পড়ুক আর হৃদয় জুড়িয়ে দিক।

” মন উত্তর দিচ্ছে না? ”

আপুর কণ্ঠস্বরে আমার প্রার্থনায় টান পড়ল। দ্রুত চোখ সরিয়ে বললাম,
” হ্যাঁ ”

আপুর ভাবভঙ্গি খুব একটা পাল্টাল না। মনে হয় জানতেন আমি এমন উত্তরই দেব। বললেন,
” তাহলে পড়ছ না কেন? ”

আমি চোখ বড় বড় করে তাকালাম। তিনি শঙ্কিত গলায় বললেন,
” যদি অন্য কেউ পড়ে যায়? ”

তার ভবিষ্যৎ আশঙ্কাটুকু আমার মধ্যে স্থানান্তর হলো। চোখদুটো ঘুরে গেল অমিতের দিকে।

আপু আবার বললেন,
” তুমি বিশাল দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছ, বুঝলে? ”

আমি বুদ্ধিশূন্য চাহনি রাখলে তিনি বললেন,
” ভাগ্য দোষে খুব খারাপ একটা পরিবেশে বড় হয়েছ তুমি। যার অভিজ্ঞতা বড়ই নিষ্ঠুর! চারপাশের কতগুলো নারী জীবনের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছ। এমনভাবে মিশে গিয়েছ যে, তোমার মন ধরেই নিয়েছে, তাদের মতোই একটা জীবন তোমার প্রাপ্য। অথচ বাস্তবে ঘটল অন্য। তাদের থেকে আলাদা এক মানুষ পেলে, আলাদা জীবন, আলাদা সংসার। এইদিকে তোমার এই পাওয়াটুকু মানিয়ে নিতে পারছে না তোমার সেই বেড়ে উঠা বোকা মন। সে খুব করে চাইছে অমিত অন্যসব পুরুষদের মতো হোক। যাদের পৈশাচিক রূপ তুমি দেখে এসেছ। কিন্তু হচ্ছে না। আর এই না হওয়াটাকেই ব্যর্থতা হিসেব করছে তোমার ভুগে আসা বোকা মন। আমরা মানুষরা সবসময় ভালো আশা রাখি এমন না। মাঝে মাঝে খারাপও রাখি। এই যেমন ধরো, হঠাৎ শুনলে কেউ একজন হার্ট অ্যাটাক করল। তুমি চিন্তিত হলে। আর চিন্তায় পড়ে জিজ্ঞেস করলে, ‘ উনি এখন কেমন আছে? ‘ কেউ একজন জানাল ভালো আছে। একটুর জন্য বেঁচে গেছে। এই খবর যেমন তোমাকে চিন্তামুক্ত করবে তেমন গোপনে নিরাশও করবে। কারণ, গোপনে কোথাও না কোথাও আশা করেছিলে মানুষটা মারা যাবে। যায়নি। এই যে মারা না গিয়ে বেঁচে গেল এটাই তোমার সেই গোপন আশাকে ভেঙে আশাহত করল। যেটা তুমি খেয়ালও করলে না। কারণ, সেই গোপন আশা সবসময় গোপনই থাকে। প্রকাশন পায় না। আর খারাপ আশা প্রকাশ পেতে নেই। তাই আশাভঙ্গটুকুও প্রকাশ পায় না। ”

আপু একটু দম নিয়ে আবার বললেন,
” এই মুহূর্তে তোমার মনের গোপন আশাটা হলো একটা খারাপ জীবন পাওয়া। যেটা পাচ্ছ না বলে হতাশ হচ্ছ। ফলে চিতা-ভাবনা বিক্ষিপ্ত হচ্ছে। অমিতকে নিয়ে ভালো আশা করতে পারছ না। মন খুলে বরণ করতে পারছ না। আপন করতে পারছ না। একমনে চাইছে তাকে ভালোবাসো আরেকমন চাইছে ঘৃণা করো। আর এই দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে তোমার দাম্পত্য জীবন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ আঁধারে ডুবে যাচ্ছে। তায়্যিবাহ, জোর করে যে নরক জীবনটা আদায় করতে চাচ্ছ তার পরিণাম কতটা ভয়াবহ হবে চিন্তা করেছ কখনও? ”

আমার ভেতরটা শিউরে উঠল। এক অদ্ভুত ভয়ে সারা গায়ে কাঁটা দিল। আপু আমার কাঁধে আলতো হাত রাখলেন। আশ্বস্ত করে বললেন,
” এতগুলো মানুষ কখনই তোমাকে ভুল বুঝাবে না। আমাদের বিশ্বাস করো। ঠকবে না। একটা খারাপ জীবন পাওয়ার আগে নাহয় একটা ভালো জীবন পাওয়ার আশা করো। ”

আমার চোখ ছলছল করে উঠল। তিনি কোমল কণ্ঠে বললেন,
” আমার ভাইটাকে একটু ভালোবাসা দেওয়ার চেষ্টা করো। দেখবে, হাজারগুণ বেশি ফেরত পাবে। ”

আমি চোখ নামিয়ে নিশ্চুপে বসে থাকলাম। আপুও চুপ থাকলেন কতক্ষণ। আমাকে একটু সময় দিয়ে বললেন,
” ভাই তোমাকে খুঁজছে। রুমে যাও। ”

আমি রুমে এসে দেখি সত্যি অমিত আমাকে খুঁজছেন। বারান্দায় না পেয়ে পেছন ঘুরে আমাকে দেখতে পেয়ে বললেন,
” আমি অফিসে যাচ্ছি। তোমার কিছু লাগলে কল করো। ”

আমি কিছু বললাম না। নীরবে বিছানায় আসলাম। মস্তিষ্ক জুড়ে আপুর বলা কথাগুলো ঝড় বয়ছে। অমিত একটু অপেক্ষা করে রুম থেকে বের হতে চাইলেন। আমি পেছন ডাকলাম,
” শুনুন। ”

অমিত থামলেন। আমার দিকে ঘুরে জিজ্ঞেস করলেন,
” কিছু বলবে? ”

আমি এবারও চুপ থাকলাম। বিছানায় বসে থাকলাম না। তার দিকে হেঁটে গেলাম ধীরপায়ে। চোখে চোখ রাখতে মনে পড়ল অমিতের শেষ বার্তাটি। আসলেই কি জড়িয়ে ধরলে ভালোবাসা হয়ে যাবে?

আমি আবার দ্বিধায় জড়িয়ে পড়লে তিনি বললেন,
” তোমার দ্বারা সম্ভব হবে না। অনুমতি দেও, আমিই জড়িয়ে ধরি। শিখে যাবে আবার সাহসও পাবে। ”

আমি লজ্জা পেলাম। একটু সরে এসে অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়ালাম। তিনি নিজ জায়গায় স্থির থেকে বললেন,
” মন পড়ে নেওয়ার কথা দেওয়াটা ভুল ছিল। সে কথা রাখতে গিয়ে তোমাকে লজ্জায় ফেলে দিলাম। দূরত্ব বাড়িয়ে ফেললাম। ভালোবাসাটা হতে গিয়েও হতে পারল না! ”

অমিতের কণ্ঠে আফসোস! আমি না চাইতেও হেসে ফেললাম। তিনি দৌড়ে আসলেন। পাশ থেকে মাথা এগিয়ে আনলেন আমার সামনে। আকাশ মাপের বিস্ময় নিয়ে সুধালেন,
” তুমি হাসছ? ”

আমি হাসি লুকাতে চাইলাম। পারলাম না। সে হাসি ছড়িয়ে পড়ল গালে, চোখে, চোয়ালে। তিনি ঘোরলাগা কণ্ঠে বললেন,
” হাসলে তোমায় আমার বউয়ের মতো লাগে। ”

আমার হাসি উবে গেল। কপট রাগ নিয়ে বললাম,
” বউয়ের মতো মানে? আপনার বউ কয়টা? ”

অমিত থতমত খেলেন। ভয়ে ভয়ে বললেন,
” আমি তো বউয়ের সংখ্যা বুঝাইনি। ”
” তাহলে? ”
” হাসলে আমার বউয়ের মতো লাগে, না হাসলে তায়্যিবাহর মতো। ”

আমি বুঝতে পেরেও চোখ-মুখ শক্ত করে রাখলাম। তিনি ধপাস করে বিছানায় বসে পড়লেন। আনন্দিত গলায় বললেন,
” আমার বউ হেসেছে মানে আমার সংসারে আনন্দ ফিরে এসেছে। এ খুশি উদযাপন করা উচিত। কী করা যায় বলো তো? ”

তিনি সপ্রশ্নে আমার দিকে তাকালেন। আমি কোনো বুদ্ধি দিলাম না। তার দিক থেকে কিছু আশা করে তাকিয়ে থাকলাম। তিনি একটু ভেবে নিয়ে বললেন,
” তোমার ভার্সিটি থেকে ঘুরে আসি চলো। বিয়ের পর প্রথম যাওয়াটা স্বামীর সাথেই হোক। ”
” আপনার অফিস? ”
” তুমি তৈরি হও, আমি দেখি বসকে ম্যানেজ করা যায় কিভাবে। ”

চলবে

[] রমজান উপলক্ষে আমার লিখিত দ্বিতীয় বই ‘বউ সোহাগি’ পাওয়া যাবে মাত্র ২০০ টাকায় []

বিস্তারিত: https://www.facebook.com/102175672032505/posts/300117108905026/?app=fbl

বর্ণলিপিতে নক করলে ওনারা অর্ডার প্রসেস বলে দেবেন।

পেজ লিংক,

https://www.facebook.com/bornolipi.prokashoni/

ছবি পছন্দঃ Tahura Islam

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here