#আলতা_রাঙা_পা পর্ব ৬
#রোকসানা_রাহমান
আমি গাড়ির জানালা দিয়ে আমার শাশুড়িকে দেখলাম। তিনি দু’হাতে কিছু একটা আগলে সাবধানে এদিকে আসছেন। একটু পেছনেই অমিত। যেন মায়ের পথচলা সহজ করতে সঙ্গী হয়েছে। বিয়ে বাড়ির সাজ আলোতে রাতের অন্ধকার খুব একটা কাটেনি। দুজনের মুখই আবছা, অস্পষ্ট। শাশুড়ির হাতে কী আছে সেটাও বোঝা যাচ্ছে না। চারকোণা মতো একটা আকার স্পষ্ট হতে আমার ভেতরটা কেঁপে উঠল। মনে পড়ল ড্রাইভারের রসিকতা। তাহলে কি সত্যি সত্যি আমাকে দিয়ে ডাল আলাদা করানো হবে? ধৈর্য্যের পরীক্ষা নেওয়া হবে? তবে কি আমিও সেই প্রাচীন যুগ থেকে চলে আসা শাশুড়ি ও বউমার নির্মম ও গতানুগতিক রীতিনীতির সামিল হলাম?
” বউমাকে নামাসনি এখনও? ”
শাশুড়িমার কণ্ঠে আমি ছিটকে উঠলাম। চেতনা পেয়ে ত্রস্ত হলাম। ঘোমটার আড়ালে চোখ-মুখ খিঁচে নিতে অমিতের গলা পেলাম,
” তুমি নেই, তাই আর গাড়ি থেকে নামাইনি। একা একা দাঁড়িয়ে থাকবে! ”
” এখন নামা। ”
মায়ের আদেশ পেয়ে অমিত দরজা খুলে দিল। আমার দিকে হাত বাড়াতে শাশুড়িমা হঠাৎ বললেন,
” থাক, তোকে নামাতে হবে না। আমার বউমাকে আমিই নামাব। ”
ছেলেকে সরিয়ে দিয়ে তিনি এগিয়ে আসলেন। বললেন,
” এসো, বউমা। ”
আমি কোনোরূপ আচরণ করার পূর্বেই তার কোমল হাতের স্পর্শ পেলাম আমার ডান হাতের কব্জি পাশে। নরম বাঁধন কিঞ্চিৎ শক্ত করে বললেন,
” কুঁচিগুলো ধরে নামো, নাহলে পায়ের সাথে আটকে যাবে। ”
তার কথামতো আমি শাড়ির কুঁচি ধরলাম বাম হাতে। সাবধানে নেমে আসতে তিনি বললেন,
” আসতে কোনো অসুবিধা হয়নি তো? ”
জবাবে মাথা হালকা বাম-ডানে নাড়লে তিনি আবার বললেন,
” তোমার শ্বশুরবাড়ি কিন্তু খুব দূরে নয়। মনে হয় জ্যামে পড়েছিলে তাই রাত হলো। আমি অপেক্ষা করতে করতে একটু শুয়ে পড়েছিলাম। কখন যে চোখ লেগে আসল বুঝতেই পারিনি। তাই তোমাকে নিতে আসতে একটু দেরি হলো। রাগ করোনি তো? ”
তার সহজ স্বীকারোক্তি আমাকে লজ্জায় ফেলল বোধ হয়। বদ্ধ ঠোঁটদুটো দ্রুত নড়ে উঠল,
” না, না, রাগ করিনি। ”
তিনি মৃদু হাসলেন। আমার হাত থেকে হাত সরিয়ে নিলেন। বুকে চেপে রাখা সে জিনিসটা আমার দিকে বাড়িয়ে বললেন,
” আমি যখন মাকে ছেড়ে আমার শ্বশুরবাড়িতে রওনা দেব তখন মা আমায় এ কোরআন শরীফ আর জায়নামাজটা দিয়েছিলেন। আজ আমি তোমাকে দিয়ে বধূবরণ করলাম। সোনার গয়না, দামি শাড়ি তো এ জীবনের সঙ্গী। কিন্তু এগুলো তোমার পরজীবনের সঙ্গী হবে। ”
এক মুহূর্তের জন্য আমি বাকহারা হয়ে পড়লাম। স্তব্ধ ও বিস্মিত চোখে চেয়ে রইলাম শাশুড়ি মায়ের মুখটায়। তিনি মিষ্টি হেসে বললেন,
” কী হলো, আমার দোয়া গ্রহণ করবে না? ”
আমি অসহায় কণ্ঠে বললাম,
” আমার ওযু নেই! ”
তার ঠোঁটজোড়ার হাসি মুছে গেল। আশ্চর্য হয়ে বললেন,
” কবুল পড়ার আগে ওযু করোনি? ”
” না। ”
শাশুড়ি মায়ের চোখদুটি নিষ্প্রভ হলো। মৃদু স্বরে বললেন,
” আমাদের বেলায় তো মায়েরা ওযু করাতেন। ”
তারপরেই কোরআন শরীফ আর জায়নামাজ এগিয়ে দিলেন অমিতের দিকে। সে সাদরে গ্রহণ করলে তিনি বললেন,
” আমার বউমার দোয়া তোর কাছে আমানত থাকল। আজ থেকে তার পুন্যের খাতা ভারী করার দায়িত্ব তোর। ”
অমিত আমার দিকে তাকাল। আমি মুখ ফিরিয়ে নিলাম। শাশুড়িমা আমার দিকে ঘুরে বললেন,
” ভেতরে চলো। ”
বলতে বলতে আমার হাত ধরলেন আবার। ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বাড়ির বাইরের অংশ, ভেতরের অংশ পুরোটাই দেখিয়ে দেখিয়ে দিলেন। রান্নাঘরের সামনে এসে দাঁড়াতে আমার হৃদয় ভূমিকম্পের মতো কেঁপে উঠল। আরও একবার মনে পড়ল বড় আপুর কথা। তার বানানো সকালের নাস্তার কথা। অজান্তেই মনে প্রশ্ন জমল, ‘ আমাকেও কি এখন রান্না করতে হবে? ‘
” তোমার নিশ্চয় খুব ক্ষিধে পেয়েছে? কী খাবে বলো। তৈরি থাকলে তো ভালো নাহলে তৈরি করে দেব। ”
আমি আরেক দস্তুর অবাক হলাম। বিস্ময় ঠেলে বললাম,
” আমার ক্ষিধে লাগেনি। ”
তিনি শুনলেন না। আমাকে রান্নাঘর থেকে সরিয়ে এনে বসার রুমে বসালেন। তারপরেই ছুটে গেলেন কোথাও একটা। আমি অমিতের দিকে জিজ্ঞেসা দৃষ্টিতে তাকালে তিনি বললেন,
” আমার মা ভালোবাসতে খুব ভালোবাসেন। ”
আমি বিপরীতে কোনো অভিব্যক্তি প্রকাশ করার সুযোগ পেলাম না। তিনি ভাত আর ডিম ভাজা নিয়ে হাজির হলেন। নিজ হাতে ভাত মাখতে মাখতে বললেন,
” বিয়ে বাড়ির খাবার খেয়ে এখন তৃপ্তি পাবে না। তাই ভাত আনলাম। ডিম ভাজা খাও তো? ”
আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বুঝাতেই তিনি মুখের সামনে লোকমা তুলে ধরলেন। তাকে খুশি করতেই হোক অথবা নিজের ক্ষিধে মেটাতে আমি সবগুলো ভাত তৃপ্তি করে খেলাম। খাবার শেষে আমাকে অমিতের রুমে আনলেন। বিছানায় বসিয়ে দিয়ে চলে যাওয়ার পূর্বে আমার কপালে চুমু খেয়ে বললেন,
” আমি তোকে মেয়ের মতো না বউমার মতোই ভালোবাসব। কারণ, আমার একটা মেয়ে আছে। আমি চাই না সে ভালোবাসায় ভাগাভাগি হোক। আমি চাই, মেয়ে তার ভালোবাসাটা পূর্ণভাবে পাক, বউমাও তার ভালোবাসাটা পূর্ণভাবে পাক। ”
অমিতের মা শুধু আমার ভাবনাকে না ড্রাইভারের ভাবনাকেও ভুল প্রমাণ করে দিয়ে চলে গেলেন।
_____________
অমিতকে খুব একটা পাত্তা না দিলেও আমি কেন জানি তার অপেক্ষায় বসে আছি। অথচ সে আসছে না। আমি আরও কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে ঘড়ির দিকে তাকালাম। প্রায় তিনটা বাজে!
আমি বসা থেকে উঠে পড়লাম। ঠিক করলাম শুয়ে পড়ব। বিছানায় ছড়িয়ে থাকা গোলাপের পাপড়িগুলো হাত দিয়ে সরালাম। বালিশ টেনে ঠিকঠাক করতে গিয়ে মেজো আপুর কথা মনে পড়ে গেল। বিয়ের পরেরদিন সকালে মাকে কল দিয়ে সে কী কান্না! শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে আসার তীব্র ইচ্ছা। বার বার করে বলছিল, বাবাকে পাঠিয়ে দিতে। আপু চলে আসবে। সেসময় এই কান্না আর ফিরে আসার কারণ আমি জানতে না পারলেও পরে জেনেছিলাম। বিয়ের রাতে নাকি দুলাভাই বাইরে ছিল। সারারাত মদ পান করে ফিরেছিল আযানের আগে। এসেই নাকি পশুর মতো আক্রমণ করে বসে আপুর ঘুমন্ত শরীরটায়!
আমি শিউরে উঠলাম। বালিশটা খামচে ধরে বিড়বিড় করলাম, অমিতও কি মদ পান করতে গেছে?
” বন্ধুরা বলল, বাসররাতে নাকি বউকে কিছু একটা উপহার দিতে হয়। তাই তোমার জন্য এই উপহারটা আনলাম। ”
অমিত পেছন থেকে উপহারটা আমার সামনে এগিয়ে দিয়েছে বিধায় আমি পিছন ফিরলাম না। কাচের গোলাকৃতি বোয়ামটিতে আমার নিষ্পলক দৃষ্টি।
” তারা অবশ্য বলেছিল, সোনা বা ডায়মন্ডের কিছু পেলে নাকি বউরা বেশি খুশি হয়। আবেগপ্রবণ হয়। কিন্তু আমার বউ তো তাদের জানা সে বউদের দলের না। আলাদা কেউ। তাই উপহারও আলাদা হওয়া উচিত। তাই তোমার জন্য এক বোয়াম জোনাকি আনলাম। ”
আমি বালিশ ছেড়ে দিলাম। সব দ্বিধা হারিয়ে কাচের বোয়ামটা দুহাতে চেপে ধরলাম। চকচকে দৃষ্টি রেখে বললাম,
” সত্যি, আমার জন্য এনেছেন? ”
অমিত বিছানায় বসে বলল,
” যাক, পছন্দ হয়েছে তাহলে। আমি তো ভেবেছিলাম, বড় হতে হতে ছোট বেলার শখ, আহ্লাদ, পছন্দ হারিয়ে গেছে। ”
” মানে? ”
” তিন্নি যখন তোমার ছবি দেখাল তখনই তোমাকে খুব মনে ধরেছিল। তাই সুযোগ পেলেই তোমার সম্পর্কে এটা-সেটা জিজ্ঞেস করতাম। ওর কাছ থেকেই শুনেছিলাম, জোনাকিপোকা ধরা নাকি নেশার মতো অভ্যাস ছিল। সন্ধ্যা নামলেই কাচের শিশি নিয়ে বেরিয়ে পড়তে। কিন্তু একদিন বাবা ধরে ফেলে। খুব বকাঝকা করে। সম্ভবত গায়েও হাত তুলে আর সন্ধ্যার পর বাড়ি থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দেয়। তুমি সে নিষেধ অমান্য করে বেশ কয়েক বার বেরুনোর চেষ্টা করে ধরা খেয়েছ আর মার খেয়েছ। একসময় বাধ্য হয়ে সেই নেশার মতো শখটাকে ভুলে গিয়েছ। ”
অমিত একটু থেমে বলল,
” আমার মনে হলো, তোমাকে খুশি করার জন্য একটা সুযোগ যখন পেলামই তাহলে ছোটবেলার খুশিটাকেই নিয়ে আসি। ”
আমিও অমিতের পাশে বসলাম। কাচের বোয়ামকে এমনভাবে আগলে ধরলাম যেন হাত ফসকে গেলেই হারিয়ে যাবে। ঠোঁটের কোণে, চোখের তারায় খুশি ঝলমলিয়ে উঠতে অমিত বলল,
” তোমার স্বরূপের সাথে তোমার পছন্দটা মানাচ্ছে না, তায়্যিবাহ। ”
অমিতের গলায় অন্যরকম স্বরে আমি চমকে তাকালাম। তিনি আমার দিকে মুখ করে বসে বললেন,
” তুমি স্বাধীনতাকে ভালোবাস। বাঁধন ছেঁড়া হতে চাও তাহলে এই জোনাকিপোকাদের বন্দিদশা তোমার পছন্দ হয় কী করে? তোমার তো উচিত এদের মুক্ত করে দেওয়া। ”
অমিতের এমন কথায় আমার খুশি হারিয়ে গেল। চোখের কোলে অশ্রু জমল। কাচের বোয়ামটাকে আরও গভীরভাবে চেপে ধরলে তিনি হেসে ফেললেন। সহাস্যে বললেন,
” আমরা পুরুষরাও এমনই। নিজেরা যতই স্বাধীনপ্রিয় হইনা কেন নিজের প্রিয় জিনিসটাকে বন্দি করতে ভালোবাসি। ভালোবাসার খাঁচায় বন্দি করে বুকে আগলে রাখতে পছন্দ করি। ভয় পাই, যদি হারিয়ে যায়? তোমার কাচের বোয়ামের মতো হয়তো ভালোবাসা ভেঙে যায় না কিন্তু দুর্বল হয়ে পড়ে। ”
অমিত নিজেকে আরও একবার প্রমাণ করল সে আলাদা। আমার ভাবনার বাইরের কেউ।
” হয় এদের মুক্ত করে নিজের স্বরূপ ধরে রাখ নাহয় নিজেও বন্দি হওয়ার প্রস্তুতি নেও। ”
আমার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে কথাগুলো বলেই তিনি একটা বালিশ তুলে নিলেন। বারান্দার দিকে হেঁটে চললে আমি প্রশ্ন করালাম,
” কোথায় যাচ্ছেন? ”
” তোমাকে ভয় থেকে মুক্তি দিতে। ”
” কিসের ভয়? ”
” ঘুমের মধ্যে যদি তোমাকে স্পর্শ করে ফেলি? ”
তার এমন কথায় আমি বিব্রত হলাম। দৃষ্টি নিচু করলে তিনি বললেন,
” যতদিন না তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছ ততদিন তোমার পাশে তো দূর, এক রুমেও শুব না। ”
কথাটা বলেই অমিত দরজা ঠেলে বারান্দায় চলে গেলেন। আমি বিছানায় বসলাম। কাচের বোয়ামের দিকে তাকিয়ে উদাস হলাম। সেই উদাসভাব কাটল একটা মেসেজ প্রবেশের শব্দে। আমি ঘাড় বাঁকিয়ে দেখলাম বিছানার পাশের ছোট টেবিলটায় আমার ফোন। আমি তো আনিনি, তাহলে কে আনল? অমিত?
ফোন হাতে নিতেই দেখলাম অমিতের নাম্বার থেকে মেসেজ,
” তোমাকে দূর থেকে দেখলেও কি তুমি রাগ করবে? উত্তর যদি হ্যাঁ হয় তাহলে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়। আমার সবকিছুকে দমিয়ে রাখলেও চোখদুটোকে পারছি না। বার বার মুগ্ধ হচ্ছে। ”
আমি বিছানা ছেড়ে উঠলাম। আলো নেভানোর বদলে বারান্দার দিকে জানালার পর্দা টেনে দিলাম।
_____________
ভারী সাজ পাল্টে হালকা হয়ে বিছানায় শরীর মেলে দিতেই আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। পায়ে সুড়সুড়ি অনুভব হতে ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলে পায়ের দিকে তাকাতে যারপরনাই বিস্মিত হলাম। চিৎকার করে বললাম,
” কী করছেন? ”
অমিত উত্তর দেওয়ার বদলে বলল,
” আরে! পা টেনে নিলে কেন? বিছানায় লাগবে তো। ”
” কী লাগবে? ”
” আলতা। ”
চলবে